এক_সমুদ্র_প্রেম! লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি (০৯)

0
488

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(০৯)

আজ শুক্রবার। সাদিফ ব্যাতীত বাকিদের অবসরের দিন। ছেলেটা ছুটি পায় কেবল রবিবার৷ যেখানে পুরো বাড়িটায় এই দিন সবাই হৈহৈ করে মাতায়,সেখানে সাদিফ খা*টুনি খাঁটে অফিসে। জবা বেগমের মন খা*রাপ হয় মাঝেমধ্যে। সন্ধ্যায় সবার চায়ের আড্ডায় এইদিন সবাই যোগ দেয় যেখানে,তিনি ভীষণ ভাবে মিস করেন ছেলেকে। আজকেও এর ব্যাতিক্রম কিছু ঘটবেনা ভাবা প্রত্যেকটি সদস্য ভুল প্রমানিত হলো,খাবার টেবিলে ধূসর সহ পরিবারের সক্কলকে একসাথে দেখে। গতকাল রাত থেকে তাদের সিকদার বাড়ি যেন ফিরে গিয়েছে স্বাভাবিক রুপে। সবাই একসাথে খাচ্ছে,কথা বলছে,গল্প করছে এই দৃশ্যে বিমোহিত গৃহিণীরা।
দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে আজ সকালের নাস্তা তৈরী করলেন তারা৷ বহুদিন পর সকালে নাস্তার টেবিলে ধূসর,আমজাদ সিকদার সহ বাকী ভাইয়েরাও বসবেন। এ আনন্দ বলার মতো না কী?

চুলোয় পরোটা সেঁকে একটা পাহাড় সমান বানালেন সুমনা বেগম। হটপটে ধরছেনা আর। দুহাতে দুটো বয়ে এনে রাখলেন টেবিলের মাঝখানে। পিউ চোখ ডলে, হাই তুলতে তুলতে এসে বসেছে। রাদিফ হুটোপুটি করে ছুটে এসে বসে গেল তার পাশের কেদারায়। ওমনি পুষ্প নাকমুখ কুঁচকে বলল,
” এই তুই দাঁত ব্রাশ করেছিস রাদিফ?”
রাদিফ কাচুমাচু করল। পুষ্প খ্যা*ক খ্যা*ক করে উঠল সাথে সাথে,
” ইয়া*ক! তুই এত্ত অপরিষ্কার হচ্ছিস কেন দিন দিন? যা,এক্ষুনি গিয়ে মুখ ধুঁয়ে আয়।”

সকাল সকাল চোখ রা*ঙানি খেয়ে মুখ কালো করল রাদিফ। পিউ মায়া দেখিয়ে বলল,
” থাক আপু বকিস না। ছোট তো, বোঝেনি।”
” বোঝেনি? কোন মেয়ের চুল লম্বা, সুন্দর সেসব তো ঠিকই বোঝে। রাদিফ তুই উঠবি? তোকে চোখের সামনে দেখে আমি খেতে পারব না। ছি!”

পুষ্পর স্বভাবই এটা৷ ব*মি শব্দটা শুনলেও না কী ব*মি পায় তার ৷ সামান্যতম অপরিচ্ছন্ন বিষয় তার কাছে রে*হাই পাবেনা। পিউ মুখ ফু*লিয়ে শ্বাস ফেলে রাদিফ কে বলল
” চল মুখ ধুইয়ে দিই তোকে।”

রাদিফের ঠোঁটে হাসি ফোঁটে৷ বয়স দশ হলেও কুলি করতে গেলেও জামা ভিজিয়ে ফেলে সে৷ মা কত ব*কেন এ নিয়ে। তবু সে পারেনা। অথচ রাদিফ বাচ্চাকাল থেকে শুনে আসছে এই বয়সে তার ধূসর ভাই বড় মাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলেন। কথাটা যতবার জবা বেগম তাকে শোনান, সে অপমানিত বোধ করেনা। উলটে মন দিয়ে ভাবে
” বড় ভাইয়ার মত জিনিয়াস কী করে হওয়া যায়?”

পিউ রাদিফের হাত মুঠোয় ধরে ফের ওপরে নিয়ে চলল। পথে দেখা হলো সাদিফের সঙ্গে। দেখামাত্র দাঁড়িয়ে গেল পিউ। প্রত্যেকদিন সাদিফ একেবারে অফিসের জন্যে পরিপাটি হয়ে নামে। সেখানে আজ মাথার চুল গুলোও এলোমেলো দেখে অবাক হয়ে বলল,
” একী! আপনি অফিস যাবেন না আজ ?”
পালটা অবাক সাদিফ ও হলো। গতকাল দরজা পি*টিয়েও যে মেয়ে খুললনা সে আজ নিজে থেকে কথা বলবে এ তো ভাবেনি। আস্তে করে বলল,
” না,শরীরটা ভালো লাগছেনা। ”

পিউ চিন্তিত কন্ঠে বলল ” সেকি! কী হয়েছে? সেজো মা কে বলে আসি দাঁড়ান।”
পিউ নামতে নিলে সাদিফ থামিয়ে দেয়।
” না দাঁড়া যেতে হবেনা। ”

পিউ থামল। সাদিফ রয়েসয়ে বলল,
” কালকের ব্যাপারে রাগ করেছিলি? আমি আসলে….”
পিউ মাঝপথে মাছি তাড়ানোর মত হাত নেড়ে বলল,
” আরে ধুর! ওসব কোনও ব্যাপারই নয়। কালকের ব্যাপার কাল চলে গেছে,আমি মনেই রাখিনি।”

সাদিফ চোখ বড় করে বলল,
” সত্যিই? সত্যিই তুই সব ভুলে গেছিস?”
” ভুলে না গেলে কি আপনার সাথে কথা বলতাম? হ্যাঁ একটা কথা ঠিক,আপনার কাছে প্রথম বার বকা খেয়ে আমার ভীষণ খারা*প লেগেছিল,কেঁ*দেওছি। কিন্তু পরে আবার সব ভুলে গেছি আমি।”

মনে মনে বলল
” না ভুলে উপায় আছে? আমার ডেইরিমিল্ক যা সারপ্রাইজ দিয়েছে কাল,সেই খুশিতে দিন দুনিয়া ভুলে গেলেও কম হবে।”

সাদিফ খুশি হয়ে গেল। ঠোঁট চওড়া করে হেসে বলল,
” যাক। ভালো হয়েছে তুই কিছু ধরে বসে নেই । আচ্ছা বাদ দে ওসব। এই চশমার ফ্রেমটা আনিয়েছি কাল,কেমন হয়েছে?”

পিউ বলল ” সুন্দর লাগছে।”

দুজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলাপ জুড়ে বসায় রাদিফ অধৈর্য হয়ে পরল। কিন্তু সাদিফের সামনে চোট*পাট করা যাবেনা। পিঠে মা*র পরার সম্ভাবনা আছে তাতে। তাই আস্তেধীরে পিউয়ের হাত টেনে বলল,
” চলো না পিউপু।”
পিউ মাথা দুলিয়ে বলল ” চল।”
সাদিফের পাশ কা*টিয়ে চলে গেল দুজন। সাদিফ সেদিক চেয়ে মুচকি হাসল। ফুরফুরে মেজাজে লা*ফ দিয়ে দিয়ে নামল সিড়ি থেকে। জবা বেগম গ্লাসে গ্লাসে ফলের রস ঢালছিলেন। ছেলের হাসি হাসি মুখ দেখে ভ্রুঁ উঁচিয়ে বললেন,
” কী খবর আব্বা? খুশি লাগছে কেন এত? ”

সাদিফ চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
” সাত সকালে মন ভালো করার মত ঘটনা ঘটলে, খুশি কেন হব না আম্মা?”

পুষ্প আগ্রহী হয়ে বলল ” কী ঘটেছে ভাইয়া? আমাকেও বলোনা শুনি।”
সাদিফ চোখ ইশারা করে বলল ” এদিকে আয়।”
পুষ্প তৎক্ষনাৎ কানটাকে এগিয়ে ধরল। উত্তেজিত সে। অথচ সাদিফ
ফিসফিস করে বলল ” টপ সিক্রেট।”

পুষ্পর চেহারা চুপসে যায়। ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায়। পরপর চেঁ*তে বলে ” তুমি একটা যা তা। ”

ওর চেহারা দেখেই হুহা করে হেসে ওঠে সাদিফ। হাসতে হাসতে একটা চা*টিও বসায় পুষ্পর মাথায়। পুষ্প ডলতে ডলতে ঠোঁট উলটায়। নাস্তার টেবিল জমে ওঠে দুজনের খুনশুঁটিতে। জবা বেগমের অধর কোনে হাসি ভেড়ে। মুগ্ধ নয়নে দেখেন পুষ্প আর সাদিফের কান্ড। হঠাৎই মনের কোনায় একটা অদ্ভূত ভাবনা নাড়া দিল। সেই মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি৷ পরিবারের বন্ধন আরো দৃঢ় করার চমৎকার উপায়টাও ভেবে ফেললেন।

আমজাদ সিকদার টেবিলে উপস্থিত থাকলে জায়গাটা ভীষণ চুপচাপ থাকে। বাচ্চারা দুষ্টুমি করেনা,একে অন্যকে ক্ষ্যা*পায় না। হাহা-হিহি ও হয়না। শুধু আসে চামচ নাড়ার শব্দ। সাথে রিক্ত খাবার চুকচুক করে চিবোয়,শব্দ করে গেলে। পুষ্পর এতেও সমস্যা। সে বহুবার কান চে*পে ধরে বাচ্চাটাকে সতর্ক করেছে ” এভাবে শব্দ করে খায়না সোনা,আস্তে খাও।”
রিক্ত পাত্তা দিলে তো! সে তার মর্জির মালিক। আর প্রতিবার ওর বসতেও হবে পুষ্পরই পাশে। তাতে টেবিল নাগালে পাক,বা না পাক। আজও পুষ্প বিরক্তি সমেত এক কানে আঙুল গুঁ*জে খাচ্ছে। হঠাৎই এর মধ্যে আমজাদ সিকদার জিজ্ঞেস করলেন,
” তোমার ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট বেরিয়েছে না?”

পুষ্প চমকে তাকাল। আমতা-আমতা করে বলল,
” হ্যাঁ মানে, না আসলে…বেরিয়েছে।”

মিনা বেগম ভ্রুঁ কপালে তুলে বললেন ” বেরিয়েছে? কবে বের হলো? সেদিন যখন জিজ্ঞেস করলাম বললি তো বের হয়নি।”
পুষ্পর বুক ধুকপুক করে কাঁ*পছে। রেজাল্ট বেরিয়েছে গত সপ্তাহে। এত অনবদ্য রেজাল্ট এসছে যে কাউকে দেখানোর মুখ অব্ধি নেই। হুটহাট জ্বিভের ডগায় মানানসই উত্তর পেলোনা সে। ভেবেচিন্তে বলল,
” তখন দেয়নি, তাই বলিনি।”
আমজাদ সিকদার বললেন,
” তোমার ভার্সিটি থেকে আমাকে ফোন করেছিল। বলেছে একবার দেখা করতে।”

পুষ্পর মাথা ভনভন করে ঘুরে উঠল। চোখের সামনে ঝাপ্সা ঝাপ্সা দেখল ক্ষনশ্বর। ভাজিতে ডুবানো আঙুল কাঁ*পছে।
আমজাদ সিকদার শুধালেন,
” হঠাৎ ডাকল যে,কোনও সমস্যা?”

পুষ্প কী বলবে,কী করবে মাথায় কিচ্ছু ঢুকলোনা। ভ*য়ে ভ*য়ে একবার মায়ের দিকে তাকাল। মিনা বেগম ভ্রুঁ কুচকে বললেন ” কী হয়েছে,কথা বলছিস না কেন?”

পিউ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে। বোনের প্রতিটি অভিব্যক্তি নিরীক্ষন করে যা বুঝল,ডাল ম্যায় কুছ কালা হে। আগ বাড়িয়ে নরম স্বরে বলল
” আমার মনে হয় পড়াশুনা নিয়ে কিছু বলবে। আব্বু তুমি কী করে আপুর ভার্সিটি যাবে,তুমি তো ভীষণ ব্যস্ত৷ তাই তোমার জায়গায় মেজো চাচ্চু গেলে ভালো হতো না?”

পুষ্পর চেহারা ঝলমলে হলো। বোনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। আফতাব সিকদার গেলে সে নিশ্চিন্ত। তার মেজো চাচা মাটির মানুষ। শুধু একটু অনুরোধ করলেই গলে যাবেন। রেজাল্টের কথা কাউকে জানাবেন ও না। পুষ্পও স্বায় দিয়ে বলল,
” হ্যাঁ আব্বু,চাচুকে নিয়ে যাই?”

” তোমার চাচ্চু যেতে পারবেন না। বিকেলে তাকে কুমিল্লা যেতে হবে। ফিরতে ফিরতে কাল রাত হবে মা।”

আফতাব সিকদার মনে পড়ল এমন ভঙি করে বললেন,
” ও তাইতো। আমি তো ভুলেই গেছিলাম ভাইজান। ভাগ্যিশ মনে করালে। হ্যাঁ গো,আমার ব্যাগপত্র একটু গুছিয়ে রেখ।”

স্বামীর কথায় রুবায়দা বেগম ছোট করে বললেন ” আচ্ছা।”

পুষ্পর উৎফুল্ল মুখশ্রী মিইয়ে যায়। ভী*ত কন্ঠে শুধায়,
” তাহলে তুমি যাবে আব্বু?”
” আমারও সময় হবে না। তাই আমি চাইছিলাম ধূসর যাক তোমার সাথে। কী ধূসর, পারবে না?”

কথাটায় স্থানেই জ*মে গেল পুষ্প। ধূসর যাওয়া মানে তার ইহকাল সেখানেই স্থগিত। এতক্ষন নিরব শ্রোতার ভূমিকায় থাকা ধূসর তাকাল। আমজাদ ফের শুধালেন ” যেতে পারবে না পুষ্পর সাথে?”

ধূসর তার সদ্য ঘুম ভাঙা ভরাট কন্ঠে জবাব দিল,
” কাল তো অফিস যাব ভেবেছিলাম…”

” হ্যাঁ যেও,সমস্যা নেই। প্রথম দিন কিছুক্ষন থেকেই চলে এসো। এরপর পুষ্পকে সাথে নিয়ে যেও,কেমন? ”

পুষ্প -পিউ এক চোটে মাথা ঝাঁকাল। বিড়বিড় করে প্রার্থনা করল ” না না না।”
কিন্তু ধূসর তাদের হতাশ করে দিয়ে বলল,
” ঠিক আছে।”

পুষ্প আহ*ত চোখে পিউয়ের দিক তাকায়। সেও করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে। পুষ্প নিজের গলায় হাত দিয়ে ছু*রির মত পো*চ মেরে বোঝাল ” শেষ আমি!”

” হ্যাঁ রে সাদিফ, তুই এত আস্তে খাচ্ছিস কেন বাবা? দশটা বাজে। অফিসে দেরি হবে না?”

সাদিফ খেতে খেতেই জবাব দিল,
” এখন থেকে শুক্রবার ছুটি ফাইনাল করব মা। রবিবার বাড়িতে একা থাকি,চাচ্চুরা থাকেন না। ভালো লাগেনা আমার।”

জবা বেগম হৈহৈ করে বললেন,
” তাই? তাহলে তো খুব ভালো হবে।
সাদিফ হাসল। হাসল বাকীরাও। কাল থেকে সব ভালো ঘটনা ঘটছে বাড়িতে।
ধূসর আড়চোখে একবার তাকাল শুধু। চোখাচোখি হলো সাদিফের সহিত। সেকেন্ডে সে চোখ, ফিরিয়েও আনল ধূসর। কেউই কিছু বলেনি, উত্তর করেনি। তবুও মুহুর্তে পরিবেশ ভেতর ভেতর পালটে গেল ।
______

পুষ্প গালে হাত দিয়ে বসে। পাশেই অস*হায় মুখে পিউ। সেও ভারী চি*ন্তায়। পুষ্পর সিজিপিএ তিন এর কম এসেছে। এই কিছুক্ষন হলো শুনেছে কথাটা। দুশ্চিন্তা এখানেই। বাবার পরে তাদের কাছে দ্বিতীয় বা*ঘ ধূসর। রেজাল্টকার্ডের এই দশা দেখলে পুষ্পর যে কী অবস্থা হবে কে জানে! পিউয়ের মনের কথাটাই যেন শুনে ফেলল পুষ্প। হা হু*তাশ করে বলল,
” দেখিস পিউ, কাল রেজাল্ট দেখার পর পরই ধূসর ভাই আমায় টা*স করে চটকা*না লাগাবেন,আর আমি ঠাস করে মাটিতে অ*জ্ঞান হয়ে পরে যাব।”

পিউ মাথা দোলাল সামনে পেছনে। কথাটার সঙ্গে সেও একমত। ধূসর পড়াশুনার ব্যাপারে প্রচন্ড স্ট্রি*ক্ট! এরকমটা হয়েছিল সাদিফ ভাইয়ের বেলায়। সাদিফ স্কুলে থাকা কালীন ক্লাশ টেস্টে ফেইল করেছিল। তার আগের রাত পুরোটা জেগে ক্রিকেট ম্যাচ দেখেছে সে। আর সেই ঘুমটা পুষিয়েছে পরীক্ষা দেয়ার সময়। একই স্কুলে পড়ত বলে ধূসরের কানেই কথাটা আগে গেছিল। আর সঙ্গে সঙ্গে দাবাং চ*ড় পরল সাদিফের গালে। সাদিফ তখন সবে ষষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্র। ধূসরের পোক্ত থাপ্প*ড়ে সেই রাতেই এলো ধুম জ্বর । জবা বেগম রাত জেগে ছেলের মাথায় জলপট্টি দিলেও ধূসরকে একটা কথাও শোনালেন না। উলটে রুবায়দা বেগম যখন ছেলেকে ধম*কাতে গেলেন তিনিই সাফাই গেয়ে বললেন,” বড় ভাই ছোট ভাইকে শা*সন করেছে আপা, এতে দো*ষের কী আছে?”

পিউ তখন ছোট থাকলেও পুষ্পর সে কথা স্পষ্ট মনে আছে৷ তাই জন্যেই ভ*য়ে গুঁটিশুঁটি হয়ে আসছে প্রানটা। হঠাৎ বালিশের তলা থেকে ফোন ভাইব্রেট হওয়ার শব্দ এলো। পিউ বসেছিল কাছেই। ফোন ধরার জন্যে হাত বাড়াতে গেলেই পুষ্প হন্তদন্ত ভঙিতে চে*পে ধরল। পিউ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাতেই বলল,
” ধরিস না। কে না কে! ”
” হ্যাঁ, তো দেখি না কে! মামা বা খালামনি রা কেউ হলে?”
” না না ওনারা এ সময় ফোন করবেনা। আর করলেও বা,আমার কী এখন কথা বলার মত অবস্থা আছে বল? আমার চি*ন্তায় চোখের নিচে কালি পরে গেছে এই দ্যাখ।”

পিউ মুখ কুঁচকে বলল ” মিথ্যুক। একদিনে চোখে কালি পরে কারো?”
পুষ্প দুঃ*খী দুঃ*খী মুখ করে বলল,
” পরে পরে। আমার মত অবস্থায় পরলে তখন বুঝতি।”

পিউয়ের মায়া হলো। মন খা*রাপ করে বলল
” বুঝতে পারছি। কিন্তু কী করব আমি? চেষ্টা তো করেছিলা…….
বলতে বলতেই থেমে গেল পিউ। পরপর উদ্বেগ নিয়ে বলল,
” এই একটা কাজ করলে কেমন হয়? আমি গিয়ে যদি ধূসর ভাইকে অনুরোধ করি? ধর খুব বিনয় করে বলি যে
” ধূসর ভাই আপনার হাতে ধরি, পায়ে পরি আপুর সাথে যাবেন না। তাহলে? ”

প্রস্তাবটা প্রচন্ড বোঁকা বোঁকা হলেও উপায় না দেখে স্বায় দিলো পুষ্প। বলল,
” হ্যাঁ হ্যাঁ খুব ভালো হয়৷ যা এক্ষুনি গিয়ে বল।”
পিউ ক্ষনকাল থমকে বলল ” এক্ষুনি?”

” হ্যাঁ। শুভ কাজে দেরি কিসের? আমি নিশ্চিত,তোর অনুরোধ ধূসর ভাই ফেলতেই পারবেন না। যা না প্লিজ!”

মধ্যের কথাটা পিউয়ের বেশ পছন্দ হলো। ধূসর তার অনুরোধ ফেলতে পারবেনা এই লাইনটা ভীষণ মনে ধরেছে। পুষ্প কথার ছলে বললেও পিউয়ের প্রেমিকা হৃদয় নিজের মতন ভেবে শ*ক্তিশালি হলো। তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে গেল সে। বুকে সাহস যুগিয়ে,লম্বা করে দম নিয়ে বলল ” যাচ্ছি। ”

পুষ্প উৎসাহ দিয়ে বলল ” যা যা আমি আছি এখানে। ভ*য় নেই।”
পিউ মুখ বাঁকালো। যাচ্ছে ওর হয়ে অনুনয় করতে আর সে বলছে ভ*য় নেই। যে নিজেই ড*রে আধম*রা সে আবার আরেকজনকে সাহস দেয়! তবে বলল না কিছু। ধুপধাপ কদমে ঘর ছেড়ে বের হলো। পুষ্প ঘাড় নিচু করে করে দেখল পিউয়ের চলে যাওয়া। ওর অবয়বটা আড়াল হওয়া অবধি অপেক্ষা করল। যেই মাত্র বুঝল পিউ চলে গেছে ঝটপট বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করল। তখনও এক নাগাড়ে কল বাজছে। পুষ্প তড়িঘড়ি করে রিসিভ করে বলল,
” বাবু জানো কী হয়েছে!”

______

ধূসরের ঘরের দরজায় এসে ব্রেক ক*ষল পিউ। গতবার ধূসর সতর্ক করেছিল এ ঘরে না আসতে। আর সে নির্ল*জ্জের মত আবার এলো। সেদিনই তো প্রতিজ্ঞা করেছিল এ ঘর মুখো হবে না আর। সেই ক্ষনে খুব দোটানা ঘিরে ধরল তাকে। ঢুকবে,না কী ঢুকবেনা ভেবে ভেবে কা*টিয়ে দিল কিছুক্ষন। তারপর যুক্তি সাজাল,
” আমিত নিজের জন্যে আসিনি। এসেছি আপুর জন্যে। অন্যের ভালোর জন্যে প্রতিজ্ঞা ভা*ঙলে পা*প হবে না।”
তখনি পিউয়ের খেয়াল পরে ধূসরের ঘরের দরজা হা করে খোলা। পিউ কপাল কুঁচকাল। উনি কি ভেতরে নেই?

দুহাতে পর্দা আগলে দাঁড়িয়ে খরগোশের মতন উঁকি দিল ভেতরে। পুরো কক্ষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চোখ বোলাল পিউ। একটা সময় কক্ষের টানটান বিছানার চাদরের দিক চেয়ে আওড়াল,
” কবে যে ওখানে আমিও ঘুমাব! ”

আচমকা পেছন থেকে কেউ ভারি স্বরে বলল,
” হয় ভেতরে ঢোক,নাহয় দরজা ছাড়।”
পিউ কেঁ*পে ওঠে । ভ*ড়কে যায়। বিদ্যুৎ বেগে পেছন ফিরে ধূসর কে দেখে লজ্জ্বা পায়। মনে প্রশ্ন জাগে,
” ধূসর ভাই কী আমার কথা শুনে ফেললেন?’

ধূসর স্বাভাবিক। পিউ নিশ্চয়তা পেল,ধূসর শোনেনি কিছু। আস্তে-ধীরে দরজা ছেড়ে একপাশে সরে দাঁড়াল। চো*র ধরা পরার মতন চেহারা তার৷ ধূসর পাশ কা*টিয়ে রুমে ঢুকল। হাতে ধোঁয়া ওঠা কফি মগ। পিউ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। বলতে আসা কথাটা কী দিয়ে শুরু করবে,সাজাতে পারল না। তখনি ধূসর ডাকল,
” পিউ!”
পিউ সদাজাগ্রত হয়ে তাকায়। ধূসর সহজে এভাবে ডাকেনা । এই ডাকে আফি*মের ন্যায় নেশালো কিছু মেশানো। শুনলেই তার হার্টবিট থম*কে আসে। পিউ ঢোক গি*লে ক্ষীন স্বরে উত্তর পাঠায়,
” হু?”

ধূসর বলল ” ভেতরে আয়।”

পিউ ঢুকল না। তখনও দাঁড়িয়ে। ধূসর ঠোঁট কা*মড়ে অল্প হেসে বলল,
” ভয় নেই! তোর কান ধরার কথাটা বলব না কাউকে। ”
পিউ পাপড়ি ঝাপ্টে বলল ” সত্যি?”
” সত্যি। বলার হলে আগেই বলতাম। বিশ্বাস করলে কর, না করলে যা।”

সোজাসাপটা, কাঠ কাঠ কথাটা পিউয়ের গায়ে লাগল না। সে উদগ্রীব পায়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল
” না না করিতো বিশ্বাস।”

ধূসর কফিমগে চুমুক দিয়ে বলল ” কিছু বলবি?”
পিউয়ের উদ্বোলিত মনোভাব কমে আসে। বলতে তো অনেক কিছুই চায়। এই ব্যাটা কি শুনবে?
ঘাড় চুল্কে বলল,
” না মানে হ্যাঁ। ”

ধূসর ভ্রুঁ নাঁচায় ” কোনটা ধরব,হ্যাঁ? না কি না?”

পিউ সহায়হীন চোখে তাকাল। হাত কঁ*চলে বলতে গেল,
” ধূসর ভাই,বলছিলাম যে…”
ধূসর পথিমধ্যেই রাশভারি কন্ঠে শুধরে দিয়ে বলল,
” হোয়্যাট ধূসর ভাই পিউ? তোকে না বলেছি, ভাইয়া বলে ডাকতে?”

পিউ শব্দ, বাক্য গি*লে ফেলল সব। মাত্রাতিরিক্ত বির*ক্ত হলো কথাটায়। চোখ নামিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
” জীবনে আপনাকে ভাইয়া ডাকব না আমি। ওই টুকু ভাই বলি, তাই-ই দ্বায় পরে। ”

” কী যেন বলছিলি….?”

পিউ তাকাল। ধূসর ততক্ষনে কম্পিউটারের মনিটর চালু করে বসেছে। ধূসরের এই নিরুদ্বেগ ভাবমূর্তি দেখে আরো গুলিয়ে গেল সে। সিদ্ধান্ত নিল মুখ না খোলার। পুষ্পর হয়ে ওকালতি করতে এসে দেখা গেল শেষে ওর মাথাটাই নেই। এসব তার দ্বারা হবে না। ‘কিছুনা’ বলে ঘুরে হাঁটা ধরল বেরোনোর উদ্দেশ্যে। হঠাৎই বিছানার পাশের দেয়ালের দিকে চোখ পরল। সে মুহুর্তে কদম স্থিত হয় তার। সম্পূর্ন নতুন একটা পেইন্টিং ঝুলছে সেখানে। দুটো ডাগর ডাগর কাজল পরা চোখ,যেন জীবন্ত চাউনীতে চেয়ে। নাক, ঠোঁট কিচ্ছু নেই, এমনকি কপালও না । পিউ কৌতুহলি হয়ে বলল,
” এটা কবে কিনলেন ধূসর ভাই?”

পেছন থেকে জবাব এলো ” কিনিনি, বানিয়েছি।”
পিউ আর কিছু বলল না। একধ্যানে পেইন্টিংয়ের দিক চেয়ে থাকল। দেখতে দেখতে চোখ পিটপিট করল। এই অক্ষিযূগল ভীষণ চেনা, পরিচিত লাগছে। ধরবে ধরবে করেও ধরতে পারছেনা। পিউ মনপ্রান দিয়ে চেষ্টা করল চেনার। অকষাৎ পিঠের ওপর উষ্ণ কিছুর স্পর্শে থরথর করে শরীর কাঁ*পুনি দিলো। কারো উ*ত্তপ্ত শ্বাস -প্রশ্বাস আ*ছড়ে পরছে তার কাঁধে,ঘাড়ে, পিঠের উপরিভাগে। পিউ বরফের ন্যায় শ*ক্ত হলো । প্রথমবারের মত ধূসর এত্ত কাছে এসে দাঁড়ানোয়, হৃদস্পন্দন তিনগুন জোড়াল হয়। বুকটা ধড়াস ধড়াস করে লাফি*য়ে বেড়ায়। দেখতে দেখতে ধূসরের হাত তার চুল ছোঁয়। পরপর নেমে আসে গলার কাছটায়। বহু কাঙ্ক্ষিত স্পর্শে পিউ আবেশে চোখ বুজে ফেলল। সে ব্যস্ত ধূসরকে অনুভব করতে।

আচমকা কানে টান পরল। ধূসর দৃ*ঢ় হস্তে কানটা খিঁচে ধরে বলল,
” তদন্ত অনেক করেছিস,যা গিয়ে পড়তে বোস।”
চিরচেনা, পুরোনো ধ*মক। মুহুর্তমধ্যে পিউয়ের সব অনুভূতি থিতি*য়ে গেল। হতভম্ব হয়ে, হা করে তাকাল ধূসরের দিকে। ধূসর চোখ গ*রম করে বলল ” যা।”

পিউয়ের দুঃ*খে, ক*ষ্টে মেঝেতে চিৎ হয়ে পরতে মন চাইল তখন। কোথায় ভাবল সিনেমার মত রোমান্টিক ঘটনা ঘটবে একটা। নায়করা যেমন নায়িকাদের পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে, এক্ষুনি ধূসরও তাই করবে। সেত প্রস্তুতি নিচ্ছিলই।
পিউয়ের নাক ফু*লে ওঠে, ঠোঁট ভা*ঙা ভাঙা হয়। চোখ জ্বা*লাপো*ড়া করে। একটা আনরোমান্টিক ছেলেকে ভালোবেসে সে শেষ! তার এক সুমদ্র প্রেম এই শীতকালেই শুকিয়ে মরুভূমি হলো বলে।!

পিউ ক*ষ্টটা বুকে চে*পে, ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। পুষ্প ফোনে কথা বলছিল। পিউয়ের পায়ের শব্দ পেতেই ফোন কা*টল তাড়াহুড়ো করে। পিউ ঢুকতেই বলল
” কাজ হলো?”

পিউয়ের রা*গ সব গিয়ে পরল নির্দোষ বেচারীর ওপর। অল্প কথাটায় জ্ব*লে উঠে বলল,
” নিজের কাজ নিজে করতে পারিস না? আমাকে বলিস কেন? অসহ্য!”

পিউ ঢুকে যায় ওয়াশরুমে। পুষ্পর মাথার ওপর দিয়ে গেল সব। সে বলদ বনে চেয়ে রইল সেদিকে।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here