#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৭(২য় ভাগ)||
৫৩।
তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় ঘুরাঘুরি শেষে হোটেলে ফিরলো পুষ্প, লাবীব, রাদ আর আহি। গাড়ি থেকে নামতেই হঠাৎ পুষ্পের হাতটা গাড়ির কোণার সাথে লেগে কেটে গেলো। লাবীব পুষ্পের হাত থেকে রক্ত ঝরতে দেখেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পুষ্প লাবীবের এমন উৎকন্ঠা দেখে বলল,
“ওই মেয়েটা কি আমি?”
লাবীব ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কোন মেয়েটা?”
“যার প্রেমে পড়েছো!”
লাবীব কিছুক্ষণ পুষ্পের দিকে তাকিয়ে রইলো। পুষ্পও যেন ঘোরের মাঝেই চলে যাচ্ছে। তখনই লাবীব হেসে বলল,
“তোমার প্রেমে পড়তে আমার বয়েই গেছে।”
পুষ্প লাবীবের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “ফাজিল ছেলে একটা।”
পুষ্প হনহনিয়ে হোটেলে ঢুকে পড়লো। লাবীব সেখানেই দাঁড়িয়ে মাথা চুলকে হাসতে লাগলো। রাদ লাবীবের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আসলেই তো! মেয়েটা কে?”
লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তোর বউ!”
রাদ চোখ ছোট করে বলল,
“আমার বউ তোর বোনের মতো। সম্মান দিয়ে কথা বল।”
(***)
রাতে হোটেলের ছাদে উঠেই থমকে দাঁড়ালো আহি। আফিফ সুইমিংপুলের পাশে বেতের ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে, আর পদ্ম তার বুকে মাথা রেখে কোলে বসে আছে। আফিফ খুব শক্ত করেই পদ্মকে জড়িয়ে ধরেছে। আর পদ্মের ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে। আহি এক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মন-মস্তিষ্ক জানে পদ্ম আর আফিফ স্বামী-স্ত্রী। তবুও সে কষ্ট পাচ্ছে। ঠিক তেমনি যেভাবে একজন স্ত্রী তার স্বামীর প্রতারণায় কষ্ট পায়, আর একজন প্রেমিকা তার প্রেমিকের ছলনায় কষ্ট পায়। কিন্তু আফিফ তো আহির কেউ হয় না। তাহলে এই কষ্টটার কি কোনো ভিত্তি আছে? এই কষ্টের কি কোনো সংজ্ঞা আছে? কেউ শুনলে আহির উপরই উপহাস করবে। কিন্তু আহিই জানে এই কষ্টটা কতোটা ভয়ংকর। বুকটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে আহির। গলা কাঁপছে তার। হাতটাও ভীষণ কাঁপছে। আহি ধীর পায়ে পিছাতে লাগলো। সিঁড়ির কাছে আসতেই কেউ একজন তাকে শক্ত করে ধরে ফেললো। আহি পেছন ফিরে দেখলো রাদ দাঁড়িয়ে আছে। রাদ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“উলটো দিকে ফিরে হাঁটছিস কেন?”
রাদ খেয়াল করলো আহির হাত কাঁপছে। আহি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। রাদ আহির দুই গালে আলতো হাত রেখে বলল,
“আমি তোর পাশে আছি, আহি। কি হয়েছে বল?”
আহি অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো, “আফিফ!”
রাদ আহিকে ছেড়ে ছাদের কাছে যেতেই একই দৃশ্য দেখতে পেলো। রাদ পেছন ফিরে আহির কাছে আসার আগেই আহি দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো। রাদ আহির পেছন পেছন দৌঁড়ে এসেও তাকে ধরতে পারলো না। আহি তার আগেই নিজের রুমে ঢুকে পড়লো। রাদ দরজায় ঠোঁকা দিয়ে বলল,
“উল্টাপাল্টা কিছু করবি না, আহি।”
আহি বুকে হাত চেপে কাঁদতে লাগলো। তার সবকিছু কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। পদ্ম আফিফের চার বছরের সংসার। তাদের এতোটুকু ঘনিষ্ঠতা স্বাভাবিক। কিন্তু নিজের চোখে কেন দেখবে আহি? সে ফুঁপিয়ে বলতে লাগলো,
“আল্লাহ, তুমি আমাকে ওদের প্রেম কেন দেখালে? তুমি জানো না, মানুষটাকে আমি কারো সাথেই ভাবতে পারি না! আমি জানি তারা একসাথেই আছে। পদ্ম রোজ হয়তো আফিফের বুকে মাথা রেখে ঘুমায়, রোজ হয়তো তারা কাছাকাছি আসে, রোজ হয়তো আফিফ তার অধর ছোঁয়ায় পদ্মের গালে। কিন্তু এসব আমার কাছে শুধুই হয়তো। কোনোটাই বাস্তব ছিল না। তাহলে আমি কেন দেখবো এসব? আমাকে কেন দেখাচ্ছো? আমার তো সহ্য হচ্ছে না। আমি কল্পনা করতে পারবো না এসব। যতোক্ষণ কেউ কিছু নিজের চোখে না দেখবে, ততোক্ষণ বিশ্বাস না করেও থাকা যায়। কিন্তু এখন এই দৃশ্য আমার চোখের সামনে বার-বার ভাসবে, কারণ আমি দেখে ফেলেছি। আমি কীভাবে এই দৃশ্য আমার মন থেকে মুছে ফেলবো? আমার ভালোবাসার মানুষ আমার সামনে অন্যের হৃদয়ে হারিয়ে গেছে। আর আমার হৃদয়টা খালি করে দিয়েছে।”
আহি দেয়াল ধরে মেঝেতে বসে পড়লো। রাদ দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলো আহি কান্না করছে। রাদ ভেবেছিল আহি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখে গেছে। কিন্তু এখনো যে তার আফিফ আসক্তি কাটেনি। রাদ তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ফোন বের করে ডাক্তার নায়ীবের নম্বরে কল করলো। কয়েকবার রিং হতেই নায়ীব কলটা রিসিভ করলো। রাদ ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“ডক্টর নায়ীব, আহির আবার প্যানিক এ্যাটাক এসেছে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না।”
নায়ীব জিজ্ঞেস করলো, “কিছু কি হয়েছিল?”
রাদ নায়ীবকে জানালো আহি কি দেখে এমন করছে। নায়ীব সব শুনে বলল,
“রিল্যাক্স রাদ। এটাই তো আমি চেয়েছিলাম। আহির মস্তিষ্কে দু’জন অলকানন্দ। প্রথমজন যাকে আহি খুব ভালোবাসে। দ্বিতীয়জন যে আহিকে ভালোবাসে। প্রথম জনই হল বাস্তব। দ্বিতীয়জন আহির কল্পনা। বাস্তব আর কল্পনা মিশে যাওয়ায় আহি যখন অলকানন্দকে বাস্তবে দেখে সে স্বাভাবিক থাকে না৷ তোমাকে দুইটা উদাহরণ দেই। ধরো, তুমি একটা মেয়েকে ভালোবাসো। ধরো মেয়েটা আহি। আহির সাথে তোমার কাটানো মুহূর্তগুলো বা তুমি আহির জন্য যা করেছো সবকিছুই তোমার মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে। অন্য আরেকজন ছেলে, ধরো তার নাম এক্স। সে আহিকে সেভাবেই ভালোবাসে। কিন্তু তোমাদের দু’জনের ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য আছে। তুমি ভালোবাসায় ডুবে গেছো। ওটাকেই তুমি তোমার লক্ষ্য ধরে নিয়েছো। আর এক্স নামের ছেলেটা বাস্তবতা মেনে নিতে জানে। এমন পরিস্থিতি দু’জনের ভালোবাসাকে শুরুতে ভালোবাসা বলা যায়। কিন্তু শেষে এসে তোমার বাস্তবতা মেনে না নেওয়াটা হয়ে দাঁড়াবে রোগ। যেমনটা আহির হয়েছে। সে আফিফকে হারিয়ে ফেলার ধাক্কাটা নিতে পারে নি। কারণ ওর জীবনের যেই ট্রাজেডি সম্পর্কে জেনেছি, এমন হওয়াটা একদম স্বাভাবিক। আহির বাবা-মার সম্পর্কে ভালোবাসা ছিল না, কিন্তু তারপরও আহি নিজেই একটা ছেলেকে ভালোবেসেছে। আর ওর মস্তিষ্ক চেয়েছে ছেলেটা যাতে তাকে সেভাবেই ভালোবাসে, যেই ভালোবাসা সে তার বাবা-মার মধ্যে দেখে নি। তাই সেই বয়সে প্রেমটাই আহির লক্ষ্য হয়ে গেছে, যার রেশ এখনো কাটে নি। আর শেষমেশ সে যখন ছেলেটাকে হারিয়ে ফেললো, তখন তার মস্তিষ্কে গেঁথে যাওয়া সেই অনুভূতিটা তার বেঁচে থাকার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো। আর এজন্যই সে তার চারপাশে ছেলেটিকে কল্পনা করা শুরু করলো। ছেলেটির পছন্দে নিজেকে ডুবিয়ে রাখলো, যাতে কাল্পনিক মানুষটি তার উপর সন্তুষ্ট হয়। আর সে যাতে আহিকে ছেড়ে না যায়। আহি জানে ছেলেটা বিবাহিত, তাই একটা সীমার মধ্যে সে ছেলেটাকে কল্পনা করতো, একা একা গল্প করতো, ছেলেটার জন্য নিজেকে সাজাতো। একটা পড়া বার-বার পড়তে পড়তে যেমন মুখস্থ হয়ে যায়, এই এক্সপেরিমেন্টটাও আহির মস্তিষ্কে এই সত্যটা গেঁথে দেওয়ার জন্যই করতে বলেছি। আর আহিকে বোঝানোর জন্য যে তার কাল্পনিক পুরুষটির কোনো অস্তিত্বই বর্তমানে নেই। যাকে সে ভালোবাসতো, সে তো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। আজ এই ঘটনার পর আহির কাল্পনিক পুরুষটি সেই রূপেই আহির কল্পনায় আসবে, যেভাবে আজ তাকে দেখেছিল। আর সেটা আহি সহ্য করতে পারবে না। আমরা সেই জিনিসই কল্পনা করি, যেটা আমাদের মনকে সন্তুষ্ট করে। অসন্তুষ্ট করার মতো কিছুই আমাদের কল্পনায় জায়গা পায় না। আজ যদি আহি তার কাল্পনিক পুরুষের মুখোমুখি হতে পারে, পরের বার আহির আর হ্যালুসিনেশন হবে না। আর এরপরই আমি ওষুধ লিখে দিতে পারবো।”
রাদ নিজের রুমে গিয়ে শক্ত হয়ে বসে আছে। আহি রুম বন্ধ করে কি করছে সে জানে না। ভীষণ অস্থির লাগছে তার। এখন আর ঘুম হবে না রাদের।
(***)
আহি মেঝেতে শুয়ে আছে। মেঝেতে হাত হাতড়াতে হাতড়াতে আহি বলতে লাগলো,
“তুমি অন্তত আমার কল্পনায় আমাকে ভালোবেসো, আফিফ। আমি জানি, তুমি কাউকে স্পর্শ করো নি।”
আহি মেঝে থেকে উঠে ব্যাগ ঘেঁটে সাদা শাড়িটা বের করে পরা শুরু করলো। এলোমেলো ভাবে শাড়িটা গায়ে জড়ালো আহি। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
“আফিফ, প্লিজ লাভ মি, প্লিজ।”
আহি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে আফিফ দাঁড়ানো। আর আফিফের হাতের মুঠোয় পদ্মের হাত। আহি হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমাকে অন্তত কল্পনায় ভালোবেসো।”
আফিফের উত্তর এলো,
“আমি তো শুধু আমার পদ্মফুলকেই ভালোবাসি।”
আহি বুকে হাত রেখে বলল,
“আমি তোমাকে ভুলতে পারছি না, আফিফ।”
আহির কানের কাছে বার-বার একটা বাক্য এসেই ধাক্কা খাচ্ছে,
“আমি পদ্মফুলকে ভালোবাসি।”
আহির নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। তার ইচ্ছে করছে সত্যটা মিটিয়ে ফেলতে। সে রাদকে ডাকার জন্য রুমের দরজা খুলে বের হতেই পদ্মের সাথে ধাক্কা খেলো। পদ্ম আর আফিফ ছাদ থেকে নেমে নিজেদের রুমে ঢুকছিল। আফিফ আর পদ্ম আহিকে এমন অবস্থায় দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। পদ্ম ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আহি, কি হয়েছে তোর? তোর এই অবস্থা কেন?”
পদ্মের কন্ঠ শুনে রাদ তড়িৎ গতিতে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলো। আর আহিকে দেখেই সে দৌঁড়ে এলো। আহি আফিফের দিকে ভালোভাবে তাকাতেই পারছে না। আফিফ তাকে এমন অবস্থায় দেখে ফেললো কেন, এটাই ভাবছে সে। আরো অস্থির লাগছে তার। নিজেকে সামলাতে না পেরে শরীরের ভার ছেড়ে দেওয়ার আগেই রাদ এসে জড়িয়ে ধরলো আহিকে। রাদকে দেখে আহির কি হলো সে নিজেও জানে না। সেও রাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। পদ্ম কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আহি, তোর কি হয়েছে?”
আহি রাদকে বলল,
“আমাকে আজ তোর সাথে রাখবি, রাদ? আমি মরে যাচ্ছি।”
আফিফ বলল, “কি হয়েছে ওর?”
রাদ রাগী দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকালো। রাদের চাহনি দেখে আফিফ আর একটা বাক্যও উচ্চারণ করার সাহস পেলো না। পদ্মও যেন বেশ অবাক হলো। রাদ আহিকে পাঁজা কোলা করে নিয়ে নিজের রুমে চলে এলো। আহি রাদের কোলে মাথা রেখে বলল,
“ও আমাকে কেন ভালোবাসে না?”
রাদ আহির মুখটা উপরে উঠিয়ে বলল,
“আমি ভালোবাসি তোকে।”
“আমার সাথে এমন কেন হলো রাদ?”
“ভুলে যা না এসব!”
“ও আমার মনটা ভেঙে দিয়েছে। আমি কার কাছে অভিযোগ করবো? এমন একজনের কাছে যে নিজেই জানে না সে আমার মন ভেঙে দিয়েছে! আমি পাগল হয়ে গেছি, রাদ। ও আমাকে কাঁদতে দেখে ফেলেছে। এই শাড়িটা পরে রুম থেকে বের হয়েছি। ও সব দেখে ফেলেছে। আফিফ জেনে গেছে আমি ওর জন্য কান্না করছি।”
“আহি, ও বুঝবে না এসব। বুঝলে তোকে আজ কাঁদতে হতো না। ও তোকে কখনো বুঝে নি। আফিফ আর পদ্ম এখন এমন এক সম্পর্কে আছে, যেখানে তুই ভিত্তিহীন। যদি বিয়ে না হতো, আমি আফিফকে ধরে বেঁধে তোর সাথে বিয়ে দিয়ে দিতাম। এখন কি করবি বল? আমি কি করবো তোর জন্য বল?”
রাদের চোখে অশ্রু টলমল করছে। আহি চোখের পানি মুছে রাদের দিকে তাকালো। রাদ নিজের চোখ মুছে আহির মাথায় হাত বোলাতে লাগলো। আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“তুই কাঁদছিস কেন?”
“তুই আমার সামনে কষ্ট পাবি, আর আমি হাসবো?”
“তুই আমাকে খুব বুঝিস, রাদ।”
“তুইও আমাকে বুঝে দেখ। দেখবি, সব ঠিক হয়ে যাবে। ভালোবাসা একবার হয় না। বার-বার হয়। তুই শুধু ভালোবাসাকে তোর জীবনে আসতে দে। মনটাকে এক পুরুষে আবদ্ধ করিস না। যদি পুরুষটা তোর হতো তাহলে বিশ্বাস কর, এই মিথ্যে ভালোবাসার শহরে মানুষটা চরম ভাগ্যবান হতো। সে এখন নিজের হাতে ভাগ্যকে ফিরিয়ে দিয়েছে। তাহলে ক্ষতিটা তার হয়েছে। তোর এই ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার তার নেই। যার অধিকার, তাকে দে।”
“কার অধিকার?”
রাদ আহির চোখ ভালোভাবে মুছে দিয়ে বলল,
“যেদিন বুঝবি, সেদিন দিস। আশেপাশে তাকিয়ে দেখ। ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই। শুধু কষ্ট করে খুঁজে নিতে হয়। এখন আমি তোকে ভালোবাসার মানুষ খুঁজে দিতে পারবো না। তবে আমি তোকে ততোদিন ভালোবাসা দেবো, যতোদিন সেই মানুষটাকে তুই খুঁজে না পাবি। যেদিন পাবি আমাদের সম্পর্কে সংযোজন বিয়োজন তো ঘটবেই।”
“কেমন সংযোজন বিয়োজন?”
“এই যে বন্ধুত্বে ভাটা আসবে। তুই নতুন প্রেমিককে সময় দিলে, আমি আর কোথায়!”
আহি হালকা হেসে রাদের হাতে একটা ঘুষি দিয়ে বলল,
“যাহ পাগল, আমার বন্ধুকে আমি কখনো ভুলবো না।”
রাদ মনে মনে বলল,
“ভুলবি আর কীভাবে? একবার আমার প্রেমে পড়িস। আমার নামটা তুই কখনোই ভুলবি না। দ্বিতীয় কোনো ছেলের নামও আর তোর মনে পড়বে না। তোর মন জুড়ে শুধু আমিই থাকবো। তোকে কাঁদতেও হবে না। কারণ আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।”
(***)
রাতে আফিফ ঘুমাতে পারলো না। পদ্মও অনেকক্ষণ জেগে ছিল। আহির এমন অবস্থা অনেক প্রশ্ন জাগিয়ে তুলেছে তাদের মনে। আফিফ নিজেও আহিকে সেই অবস্থায় দেখে অনেকটা অপ্রস্তুত ছিল। আহির চোখ ভর্তি জল। কাজল লেপ্টে গিয়েছিল। শাড়িটাও এলোমেলো। আফিফ তো খারাপ কিছু ভেবে রুমে একবার উঁকি দিয়েছিল। কিন্তু ভেতরে কেউ ছিল না। তাহলে আহির এই অবস্থার জন্য কে দায়ী?
আফিফ এবার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। সমুদ্রের ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ছে। বারান্দা থেকেই এই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। শীতল হাওয়া শরীর স্পর্শ করে দিয়ে যাচ্ছে তার। আফিফ সেই স্পর্শে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। অতীতের সেই দিনটির কথা মনে পড়ে গেলো, যেদিন এক অপরিচিতা তার জীবনে এসেছিল একটা ছবি নিয়ে। কখনো কেউ তার ছবি আঁকে নি। সেদিন এঁকেছিল এক অদেখা অস্তিত্ব। চিরকুট দিয়েছিল সাথে। আফিফ সেই চিরকুটটি পড়েই সেদিন খুঁজেছিল সেই অস্তিত্বটিকে। কিন্তু পায় নি। পেলেও বা কি হতো? ছুঁয়ে দেখা তো কখনোই সম্ভব না। জীবনের সব সম্ভাবনা যে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছিল সে। জীবনটা তার হলেও ইচ্ছে পূরণের অনুমতি তার নেই। না, আর কিছু ভাবতে চায় না আফিফ। সেই ভয়ংকর দিনগুলো সে অতীতের পাতায় ফেলে এসেছে। এদের বর্তমানে জায়গা দিতে চায় না সে। তার বর্তমান জুড়ে পদ্মফুলই থাকুক।
৫৪।
পরদিন পুরো সকাল আহি ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। পদ্ম আফিফকে বলেছিল রাদের কাছ থেকে জেনে নিতে কি হয়েছিল রাতে। কিন্তু রাদ আফিফের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে চলছে। রাদের হাবভাব দেখে আফিফ আর তার সাথে কথা বলার সাহস পায় নি। শেষমেশ পদ্ম নিজেই রাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আহি সম্পর্কে। রাদ সংক্ষেপে জানালো, বাসায় সমস্যা হয়েছে তাই মন খারাপ ছিল। তার এই যুক্তি ফেলে দেওয়া যায় না। কারণ সবাই জানে আহির পারিবারিক জটিলতার কথা। সৎ মায়ের সংসারে কেই বা আর ভালো থাকে। পদ্ম আহিকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য যেতে চায়লে রাদ দৃঢ়ভাবেই জানিয়ে দিলো, রাতের বিষয় নিয়ে যাতে আর কোনো কথা না তুলে। পদ্মও তাই আর কোনো প্রশ্ন করে নি৷
বিকেলে আহি ঘুম থেকে উঠেই খাওয়া-দাওয়া সেরে একা একা বীচে ঘুরে এলো। এদিকে পুষ্প আর লাবীব ঝর্ণায় যাওয়ার জন্য অস্থির। আজ হিমছড়ি যেতে হবেই তাদের। তারা দু’জনই প্রস্তুত। অন্যদিকে রাদ আহির জন্য না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল। আফিফ আর পদ্মও তাই তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কিন্তু আহি হঠাৎ বীচ থেকে ঘুরে এসেই বলল,
“চল ঘুরতে যাই। আর রাতে পার্টি দিবো।”
সবাই আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। আহি বলল,
“ডান্স পার্টি হবো। যাদের নাচতে মন চাইবে নাচবে। আর যাদের খেতে মন চাইবে খাবে।”
পুষ্প বলল, “আমি তো খাবো।”
“আমি ম্যানেজারকে ফোন করে জানাচ্ছি, রাতের খাবারে যাতে সব ধরণের আইটেম থাকে।”
লাবীব এক গাল হেসে বলল,
“আহি লটারি জিতেছিস না-কি! এতো খুশি কেন?”
আহি হেসে বলল, “ভালো ঘুম হয়েছে তাই।”
কথাটি বলেই আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো। আফিফ থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি হলো এটা? তাকে দেখেই এমন করলো কেন? আফিফ এবার আঁড়চোখে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম পুষ্পের সাথে কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে। আফিফ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ভাগ্যিস পদ্ম দেখে নি।
(***)
আহি তৈরী হয়ে আসতেই সবাই মিলে হিমছড়ি গেলো। সেখানে অনেকক্ষণ ঘুরাঘুরি শেষে পুষ্প পদ্মকে টেনে নিয়ে গেলো রাস্তার উল্টো দিকে। হিমছড়ির রাস্তায় সমুদ্রতীরে মানুষ তেমন একটা থাকে না। অন্যান্য জায়গায় বেশ মানুষজন। তাই ভিডিও বা ছবিতে মানুষের ছবি চলে আসে। বীচ খালি দেখে পুষ্প পদ্মকে নিয়ে সেখানে চলে গেলো। তাদের সাথে লাবীবও গেলো। আফিফ রাস্তার পাশে পাথরের উপর বসে ছিল। অন্যদিকে রাদ আর আহি ঝর্ণার পাশে বসে আছে। দু’জনই ব্যস্ত গল্প করতে। এই বিষয়, সেই বিষয়ের কথা বলতে বলতেই হঠাৎ রাদের ফোনে কল এলো। রাদের মা কল দিয়েছে। ঝর্ণার আশেপাশে কোলাহল বেশি হওয়ায় রাদ আহিকে বসিয়ে একপাশে চলে গেলো। রাদ চলে যেতেই আহি কয়েক সিঁড়ি উঠে ঝর্ণার কাছে যেতে লাগলো। কিন্তু পাথরগুলো পিচ্ছিল হয়ে আছে। একটা পাথরের উপর পা রাখতে গিয়েই হঠাৎ আহি পা পিছলে নীচে পড়ে গেলো।
(***)
আফিফ দোকানে পানির বোতল কিনতে এসে খেয়াল করলো ঝর্ণার পাশে ভীড় জমে আছে। আফিফ সেদিকে গিয়েই দেখলো আহি নিচে পড়ে আছে। আফিফ ব্যস্ত হয়ে আহির কাছে যেতেই দেখলো আহি ব্যথায় কাতরাচ্ছে। আফিফ জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে তোমার? হাত তো ছিঁড়ে গেছে! আহি, কি হয়েছে?”
পাশের একটা মেয়ে বলল,
“উপরে উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেছে।”
আফিফ শাসনের সুরে বলল,
“বাচ্চা স্বভাব যাবে কখন তোমার?”
আহি আফিফের কথা শুনে তার দিকে তাকালো। এরপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, “রাদ কোথায়!”
আফিফ আহিকে টেনে তুলতে যাবে কিন্তু আহি পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারছিলো না। তাই সে আহিকে বসিয়ে রাদকে খুঁজতে গেলো। কিন্তু আশেপাশে কোথাও রাদকে না দেখে আবার আহির কাছে ফিরলো। আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আমার পায়ে ভীষণ ব্যথা করছে। হাঁটুতে নিশ্চিত কিছু হয়েছে।”
জিন্স পরা ছিল বিধায় হাঁটুতে কি হয়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে হাঁটুর দিকে জিন্সের অংশটা কেমন মলিন হয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছে হাঁটুর মাংস খানিকাংশ হলেও ছিঁড়ে গেছে। আফিফ আরেকবার এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে রাদকে খুঁজে পায় কি-না দেখে নিলো। এরপর আর কোথাও তাকে না দেখে নিজেই আহিকে কোলে তুলে নিলো।
রাস্তার মোড়ে এসে আফিফ একটা গাড়ি ঠিক করে আহিকে সেখানে বসালো। পদ্ম, পুষ্প আর লাবীবকে রাস্তা থেকেই দেখছে আফিফ। কিন্তু তারা বেশ দূরেই আছে। জোরে ডাকলেও শুনবে না। হাতের ইশারা করার পরও তাদের পালটা উত্তর এলো না। তার মানে তারা আফিফকে দেখেই নি। আফিফ পদ্মকে ফোন করতে গিয়ে দেখলো, পদ্মের ফোন তার কাছেই। বাকি কারো নম্বর আফিফের কাছে ছিলো না। সে এবার গাড়ির কাছে এসে আহিকে বলল,
“কাউকে ফোন করো।”
আহি ফোন বের করে রাদকে কল করলো। দেখলো রাদের নম্বর ব্যস্ত। আহি বিড়বিড় করে বলল,
“জন্মের সব কথা আজই তোকে বলতে হচ্ছে!”
আফিফ ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকালো। আহি চোখ ছোট করে বলল,
“আপনাকে বলছি না।”
আহি এবার পুষ্পকে কল করলো। কিন্তু পুষ্প সাথে সাথেই কল কেটে দিলো। আহি রাগী স্বরে বলল,
“ছবি তোলার জন্য আমার কল কেটে দিচ্ছে! দাঁড়া, আজ তোকে দিয়ে হোটেলের সবগুলো বাসন পরিষ্কার করাবো আমি।”
আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বলল, আশেপাশের কোনো হাসপাতালে নিতে যেতে। এরপর আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি অন্তত মেসেজ করে বলো, নয়তো সবাই চিন্তা করবে।”
আহি সাথে সাথেই রাদকে মেসেজ করে দিলো। তারপর সিটে হেলান দিয়ে বসলো। আফিফ আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ব্যথা করছে এখনো?”
আহি শীতল কণ্ঠে বলল,
“কিছু ব্যথা সহজে পিছু ছাড়ে না।”
আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে আমি এটাই করতাম।”
আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এসব সিনেমার কমন ডায়লগগুলো আমার একদম পছন্দ না।”
আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “হ্যাঁ?”
“জ্বি হ্যাঁ। রাস্তায় এখন অন্য কোনো মেয়ের পা ভেঙে গেলে, আপনি বউ ফেলে কখনোই আসতেন না। আপনি আমাকে সাহায্য করেছেন, কারণ আমি আপনার বউয়ের ফ্রেন্ড।”
আহি এবার ব্যাঙ্গ করে বলল,
“যে কেউ থাকলে আমি এমনই করতাম।”
আফিফ চোখ ছোট করে আহির দিকে তাকালো। আহি বলল,
“আপনার ভুল ধরিয়ে দিয়েছি। আমি আপনার পরিচিত তাই আমাকে সাহায্য করেছেন। আমার জায়গায় পুষ্প থাকলেও আপনি এমন করতেন। কিন্তু যে কেউ না।”
আফিফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আহি বিড়বিড় করে বলল,
“এমন ভাবে বোঝাচ্ছে, যেন আমি অন্য কিছু মনে করছি।”
আফিফ বলল, “ঠিক এজন্যই বোঝাচ্ছি।”
আহি রাগী স্বরে বলল,
“আপনি আমার কথা শুনছিলেন?”
“জোরে জোরে কথা বললে কি কানে আসবে না? আমি তো আর বধির না।”
“ওহ হ্যাঁ, আপনি তো অন্ধ। কিন্তু বধির না।”
দু’জনই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। আফিফ ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো,
“আর কতোক্ষণ লাগবে?”
ড্রাইভার জানালো প্রায় দশ মিনিট লাগবে। এবার আফিফ নিজেও গাড়িতে হেলান দিয়ে বসলো। এদিকে রাদের কল এলো আহির ফোনে। আহি রাদকে বলল, আফিফ তাকে পাশের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই পাশটা যে কোন পাশ সে নিজেও জানে না। এখনো সেই পাশের হাসপাতালে পৌঁছাতে পারে নি তারা। আহির কথা শুনে ড্রাইভার লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে একনজর আহিকে দেখে নিলো। আফিফ সেটা খেয়াল করে বলল,
“গাড়িতে বসে এতো কথা বলা ঠিক না!”
আহি চোখ ছোট করে বলল,
“আমার মুখ আমি বলবো।”
আফিফ এবার গুগল ম্যাপ অন করলো। না জানি কোথায় নিয়ে যায় এই ড্রাইভার। এরইমধ্যে পদ্মের কল এলো একটা অপরিচিত নম্বর থেকে। পদ্ম ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“আপনি আহিকে একা ছাড়বেন না, প্লিজ। ওর পাশেই থাকবেন কিন্তু।”
আফিফ পদ্মকে আশ্বস্ত করে কল রাখলো। আফিফ আর আহি এবার দু’জনই একে অপরের দিকে তাকালো। আহি বলল,
“এতোক্ষণ এদের খবর নেই, এখন মরে যাচ্ছে!”
আফিফ মৃদু হেসে বলল,
“পরের বার যে-কোনো অবস্থায় কল রিসিভ করবে। এই ভুল আর করবে না।”
“আমাদের উচিত ছিল ফোন বন্ধ করে তাদের শাস্তি দেওয়া। স্পেশালি পুষ্পের কল তো আমি এই বছর আর রিসিভই করবো না।”
আহি এবার পদ্মের ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পদ্ম ভুলেও আর আপনাকে ফোন দিয়ে কোথাও যাবে না। ফোনটা কেন রেখেছে ও? বরের হাতে রাখার জন্য? আদর্শ বিবি একটা!”
“হুম।”
আফিফের হুম শুনে আহি ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকালো। আহির চাহনি দেখে আফিফ নিজেও ভ্রূ কুঁচকালো। মেয়েটা যে কখন কোন চাহনিতে তাকে খুন করে ফেলে বলা যায় না। আফিফ একটু সরে বসলো। আহি আফিফের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে নিজেও গাড়ির একপাশে চলে গেলো। আফিফ তা দেখে কিছুটা স্বাভাবিক হলো। আহি এবার বলল,
“আমার আপনাকে ভয় পাওয়া উচিত। কিন্তু ঘটনা তো উলটো হচ্ছে। আপনিই আমাকে ভয় পাচ্ছেন।”
চলবে-