#এলোকেশী_সে
#মাহমুদা_লিজা
পর্বসংখ্যাঃ১৬
অহন মা’কে বলল অতিথিদের আপ্যায়ন করানোর জন্য। তার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে কলি এসে অনিমাকে বলল -“এরা অতিথি! এসেই তো হৈ হুংকার লাগিয়েছে ষাঁড়ের মত। একই মায়ের পেটে এত রঙের পোলাপান কেমনে হয়, বড় ভাবী?”
অনিমা আর রুবাবা হেসে দিল। কানন ছেলেদের নিয়ে শপিংমলে থাকায় মুখরোচক দৃশ্যায়ন মিস করে গেল। কলি বুকে হাত দিয়ে জোর নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল -“বাবা গো, আরেকটু হলে নির্ঘাত দম ফুস হয়ে যেত।”
কলির বেফাঁস কথাবার্তা শুনে শব্দ করেই হেসে উঠল বাকি দুই জা। তাঁর এই সহজ সরল ভাষায় দুষ্টুমিতে মেতে ওঠার কারণেই সবার আদরের সে। ওদিকে বসার ঘর থেকে তখনো উচ্চ আওয়াজ ভেসে আসছে। খানিক তিতিবিরক্ত হয়েই আদিব বলল -“তুই চল, দিন সময় ঠিক করে আনুষ্ঠানিকভাবে তোকে এই বাড়িতে পাঠাব”
বড় ভাইয়ের আশ্বাসে মোটেও ভরসা হলো না অনুর। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল -“আমি যাব না ভাইয়া, আমি জানি তোরা আর আমায় আসতে দিবি না।”
বোনের কথা শুনে চেচিয়ে উঠল আদিব। সোফার নরম গদি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বোনকে শাসিয়ে বলল -“তোর পড়ালেখা গোল্লায় যাবে। কলেজ পার করিসনি অথচ নাচতে নাচতে বিয়ে করে নিলি। আর এক অপদার্থ নিজে শিক্ষক হয়ে বিয়ে করেছে কলেজ পার করতে না পারা আরেক অপদার্থকে।”
বড় ভাইয়ের কথা শুনে হেসে দিল আহির। অহনের চোয়াল শক্ত হয়ে এল, কিছু বলার জন্য সবে মুখ খুলতে যাবে তার আগেই অয়ন বলে বসল -“তাও ভালো অনু মাধ্যমিক পার করেছে কিন্তু আপনি যখন ভাবীকে বিয়ে করেছিলেন তখন তো তিনি সবে দশম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। আপনিও পালিয়ে বিয়ে করেছেন অথচ ঠিকই নিজের বোনের বেলায় ভিলেন হয়ে চলে আসলেন।”
অয়নের কথার পিঠে কথা বলার জন্য কোন যুক্তি খুঁজে না পেয়ে আদিব চুপসে গেল। অহনকে একটু আধটু জানলেও অয়নকে নিয়ে বিন্দু পরিমাণ ধারণা নেই আহিরের নিকট। তবে ও যে বড় ভাইকে কথার জালে এলোপাতাড়িভাবে সেঁটে দিল তা ভেবেই মনটা খিলখিলিয়ে হাসছে। সারাক্ষণ হুংকার গর্জন করা মানুষটাও কারো কথার মারপ্যাচে কুপোকাত হয়ে চুপসে যাওয়ার ব্যাপারটা কতটা দৃষ্টিনন্দন তা মনে করে তৃপ্ত হচ্ছে আহির। বোনের পালিয়ে যাওয়া নিয়ে তার কোন মাথাব্যাথাই ছিলো না। যাকে ভালবাসে তাকে দুনিয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করাটা তার কাছে মোটেও অহেতুক লাগে না। এই যে একটুখানি আলো ছায়ার খেলায় কিশোরী মেয়েটাকেও তার হৃদয়ে গেঁথে নিয়েছে। সে ভাগ্যে থাকুক বা না থাকুক তার আপ্রাণ চেষ্টা থাকবে তাকে নিজের করে পাওয়ার। তার বেখেয়ালি আচরণের যবনিকা ঘটে অহনের কন্ঠধ্বনির শীতল স্বরে -“বাবা আসুক, বাবার সাথে কথা বলাটাই ভালো হবে। উনি আসছেন, আমি খবর পাঠিয়েছি।”
আহিরকে দেখে চিনতে পারলেও তার আবেগী চাহনিতে নিজের এলোকেশীকে দেখে তাকে প্রতিপক্ষ মনে হচ্ছে অহনের। মেজাজের নিয়ন্ত্রণ লোপ পেয়েছে সিংহভাগ। ইচ্ছে করছে সামনে বসা শান্ত পুরুষটার চোখ উপড়ে নিতে৷ দৃষ্টি ঘুরল অনুর অশ্রুসজল বদনে। ফটাফট উলটোপালটা কথা বলার ওস্তাদ অয়নও ঘাবড়ে আছে। ভালবাসার শীতল দহনে বেকাবু দু’জন। ভাইয়ের মনের অবস্থা আঁচ করে অনুকে নিজের ঘরে যেতে বলল সে। অয়নকে ইশারা করল সরে যেতে। সে একা কথা বলতে চায় আদিবের সাথে।
অয়নের প্রস্হানের পরবর্তী সময়ে বিলম্ব না করে অহন বলল -“আপনার বোনকে নিজের বোনের চেয়ে অন্যথা ভাবি না। যদি তার অমঙ্গল হওয়ার অনু পরিমাণ সন্দেহ থাকত তাহলে আমি নিজ হাতে তাকে আপনার বাড়িতে পৌঁছে দিতাম। অয়ন খারাপ ছেলে নয়, অনুকে আমৃত্যু নিজের সবটা দিয়ে কঠিন মায়ায় জড়িয়ে রাখবে। তাহলে কেন এত আকুলতা সম্পর্ক ভাঙার নিমিত্তে!”
অহনের কথা শুনে চূড়ান্ত পর্যায়ের শিথিলতা এলো আদিবের ভাবনায়। সবার সাথে আলোচনা করে বোনের বিয়ের আয়োজন করলে হয়ত কুৎসা রটনাকারীদের মুখটায় তালা পড়বে। আজ এ স্হানে না এলে হয়ত তার মত বদলাত না কিন্তু পরিবারটাকে দেখে মনে হলো অপাত্রে হৃদয় বিনিময় করেনি বোনটা। অহনের কথার ফিরতি জবাব না দিয়ে ছোট ভাইকে নিয়ে প্রস্হান করলেন তিনি। কাউকে একটা শব্দ উচ্চারণের অবকাশ দিলেন না পর্যন্ত।
************
রাতের খাবার শেষ করে ঘরময় পায়চারি করছেন নাঈম মজুমদার। হন্তদন্ত পায়ে দৌড়ে এলো অনিমা। সেই নতুন বউয়ের মত এখনো কোন আবদার করার আগে স্বামীর চারপাশে লাটিমের মত ঘুরে। স্ত্রীর পাক চক্কর দেখে তিনি শুধালেন -“গলা কা/ট/তে এসেছ না পকেট? এমনি তোমার ছোট ছেলে আমার নাক কে/টে বসে আছে।”
স্বামীর এটুকু কথাতেই গলা শুকিয়ে চৈত্রের খরা দেখা দিল। জিভের আগা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল -“বড় ছেলেটার বিয়ে নিয়ে কিছু ভেবেছ?”
স্ত্রীর কথা শুনে নাঈম মজুমদার ঘাড় চুলকে বললেন -“ওটা আবার কাকে নিয়ে পালাবে সে চিন্তা করছি।”
স্বামীর অমন তাল বেতাল কথায় অসন্তুষ্ট হলো অনিমা। হাত কচলাতে কচলাতে গজগজ শুরু করেছে ক্রোধে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল -“দুটো ছেলেই তোমার মত হয়েছে। আবোলতাবোল বকবক করায় ডিগ্রীধারী সবাই। আবার জিজ্ঞেস করে ওরা এমন কেন?”
নাঈম মজুমদার ধরতে পারলেন হাওয়ার গতি ঘুরে নিম্নচাপে পরিণত হবে। তার আগেই মোড় ঘুরিয়ে সীমানা পার করতে হবে। তাইতো একগাল হেসে বললেন -“তো ছেলের বিয়ে নিয়ে কি যেন বলছিলে?”
রুষ্টভাবটা কমে গেল মুহূর্তে। আবার চনমনে হয়ে অনিমা বলল -“ছেলেটার জন্য তোড়াকে মনে ধরেছে। মেয়েটা আগলে রাখতে জানে আমি দেখেছি। ভদ্রতা, নম্রতার খামতি নেই। তাছাড়া বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই থাকুক। ওরতো ভালভাবে বাঁচার অভিলাষ আছে, আমরা নাহয় ওটুকু সুযোগ তৈরী করে দেই!”
স্ত্রীর কথা শুনে রীতিমতো ঘামতে শুরু করলেন নাঈম মজুমদার। এমনটা তিনি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। এমনিতে ভাইয়ের সাথে মন কষাকষির অন্ত নেই, এই প্রস্তাব রাখলেতো দা-কুমড়া সম্পর্ক হতে পারে। ভাই কখনো রাজি হবে না এই প্রস্তাবে। অহন বা অয়নের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বেপরোয়া আলাপ মোটেও পছন্দসই নয় ঐ নিজাম মজুমদারের। বিশেষ করে নিজাম মজুমদারের সাথে বাক বিতন্ডা এক প্রকার লেগেই থাকে অহনের, হয়ত তোড়াকে নিয়ে নয়ত রুবাবার অধিকার সম্বন্ধে। আর সেই অহনকে জীবনেও মানবে না নিজাম মজুমদার। সবাই যতই বলুক মেয়ের বেলায় উদাসীন পিতা নিজাম কিন্তু বাবার উপস্থিতিতে তো অন্য কেউ অভিভাবক সাজার জো নেই।
গম্ভীর স্বরে নাঈম মজুমদার বললেন -“সব জেনেশুনেও কি দরকার ঘরে হুলস্থুল বাঁধানোর! তারচেয়ে বরং ছেলের জন্য কলির ভাইয়ের মেয়েটাকেই আনতে পারো।”
আশাহত হয়ে মলিন হল অনিমার হাসি। যতটা আশা নিয়ে স্বামীর শরণাপন্ন হয়েছে ততটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিজের সাধটাকে সমাহিত করতে হচ্ছে। হাল ছাড়ল না অনিমা। স্বামীর হাতখানা আগলে বলল -“তুমি একবার মা’কে বলো। মেজ ভাই জীবনেও মায়ের আদেশ অগ্রাহ্য করবে না।”
খ্যাক করে উঠলেন নাঈম মজুমদার -“অবান্তর কথা বলো না। কাননকে বিয়ে করার সময় কি মায়ের আদেশ মেনেছিল?”
নিজেকে আর দমাতে পারল না অনিমা। চিৎকার করে বলল -“আমি কিছু জানিনা, জানতে চাইনা। আমার ছেলের বউ যদি ও না হয় তবে আমিও সংসার ছাড়ব। এ আমার শেষ কথা।”
আগে পরের কোন কথা শুনেনি রুবাবা, শুধু তার কানে এসেছে অনিমার বলা শেষোক্ত উক্তিখানা। মনটা কেঁদে উঠল তার। মেয়ের চোখে অহনের জন্য যে ভালবাসা দেখেছেন, আজ যদি মেয়ে জানতে পারে অহনের বিয়ে ঠিক হচ্ছে অন্যত্র! তবে মেয়েটার ভগ্ন হৃদয় এবার মরেই যাবে। এজন্যই তো মেয়ের মনের অনুভূতিকে সমাহিত করতে চেয়েছেন বারবার। তার গুমোট মেয়েটা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে ঐ ছেলেটার একটুখানি আশকারায়। আজ যদি মেয়েটা তার জ্যেঠীমার কঠিন প্রতিজ্ঞাটা শুনতে পায় তবে তো চূড়ান্ত পর্যায়ের আঘাত পাবে।
এসব ভাবতে ভাবতে কঠিন সিদ্ধান্তটা নিল রুবাবা। এত বছর মেয়ের কথা ভেবে শত লাঞ্চনা উপেক্ষা করে পড়েছিলেন মজুমদার বাড়িতে, আজ সিদ্ধান্ত বদলের সময় এসেছে। মেয়ের মন ভাঙার আগে গ্রামে ফিরতে হবে। ছোট্ট মনটার খানখান হওয়াটা দেখতে পারবেন না মা হয়ে।
চলবে…….
(অনেকটা অসুস্থ আমি। আজ ছোট্ট করে লিখলাম। এতটুকু ক্ষমা তো পেতেই পারি!)