এলোকেশী_সে #মাহমুদা_লিজা পর্বসংখ্যাঃ১৭

0
369

#এলোকেশী_সে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বসংখ্যাঃ১৭

সাদা কাগজে কালো কালিতে লিখতে ব্যস্ত সবাই। দুই বেঞ্চ সামনে বসা অনুও সমানতালে লিখে যাচ্ছে। সবটা মনোযোগ দিয়ে পড়েছিলো তোড়াও কিন্তু কিছুই মনে করতে পারছেনা। পঁচিশ মার্কসের উত্তর লিখতে পেরেছে সবে। বাদ বাকি কোন সমাধান স্মৃতিতে আসছে না। চোখ বন্ধ করে বারবার স্মরণ করতে চাইল কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হলো। একের পর এক ঝড় তার স্মৃতির কোটরে হানা দিয়ে তছনছ করে দিয়েছে মনোযোগের ডালপালা। তার হাস ফাঁস দেখে পরীক্ষক বার দুয়েক এসে জানতে চেয়েছেন কোন সমস্যা কিনা। হতাশ হয়ে তোড়া জবাব দিল সে সব ভুলে গেছে। দ্বিতীয় ঘন্টা অতিক্রান্ত হওয়ার ঘন্টা বাজল। স্বায়ুর সহজাত কর্মে যেন পাহাড়সম বাঁধা। খাতাটা পরীক্ষকের হাতে জমা করে হেরে যাওয়া সৈনিকের ন্যায় হল ছাড়ল। কলেজের মূল ফটকের বাইরে এসে বসে রইল অনুর জন্য। জ্যেঠীমার কড়া আদেশ, ননদ আর ভাবীর একইসাথে বাড়ি ফিরতে হবে। পরীক্ষায় না পারার আফসোস তাকে ভেঙে দিয়েছে প্রায়। হর্ণের শব্দে ঘোর ভাঙল, চোখ তুলে তাকাতেই দেখল বাইক স্ট্যান্ডে ভর দিয়ে দাঁড় করিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে অয়ন।

একেবারে তোড়ার পাশে এসে দাঁড়িয়ে অয়ন শুধালো -“পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”
চোখের কোণে ততক্ষণে চিকচিকে জল জমা হয়েছে তোড়ার। রাত জেগে পড়েছে, পড়া শেষ না করে হাল ছাড়েনি অথচ আজ সব ব্যর্থ হলো। মাথা নুইয়ে জবাব দিল -“ভালো হয়নি, ফেইল আসবে।”
তোড়ার কথায় ভ্রু কুঁচকাল অয়ন। উদ্বেগের স্বরে জিজ্ঞেস করল -“পড়ে আসিস নি?”
উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে তোড়া জবাব দিল -“পড়েছিলাম, সব পারিও কিন্তু কেন যেন আজ স্মৃতিভ্রম হচ্ছে। আমি সত্যি আর নিতে পারছি না।”
তোড়ার অবস্থা আঁচ করতে পেরে অয়ন খানিক ভাবল কিছু। তার মাথায় হাত রেখে বলল -“টেনশন নিসনা, তুই স্হির হ, ভুলে যা এসব। কিছুদিন বাদেই পরীক্ষা, ওতে মন দে। যা হয়েছে বাদ দিয়ে সামনের পরীক্ষার জন্য প্রিপারেশন নে।”

নিশ্চুপ তোড়া। মাঝেসাঝে কিছু অঘটন সত্যি মন ভেঙে দেয়। মৃদু স্বরে অয়নকে জিজ্ঞেস করল -“ভাবীকে কি আপনি নিতে এসেছেন?”
ফটাফট জবাব এল -“উহু, ভেবেছিলাম অনুকে আর তোকে নিয়ে একটু ঘুরেফিরে তোরা বাড়ি ফিরবি আর আমি বাবার অফিসে।”
মলিন হেসে তোড়া জবাব দিল -“আপনাদের মাঝে আমি গিয়ে কি করব! আমি বরং বাড়ি ফিরে যাই।”
অয়ন দ্বিমত করতে চাইল কিন্তু তোড়ার অটল সিদ্ধান্তে হার মানল অবশেষে। অয়নকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিল মেয়েটা।

মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে দু’হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি চালিয়ে ক্ষুদেবার্তাটা লিখল অয়ন। ‘অহন’ লেখা নামটায় সেন্ড করে অপেক্ষা করতে লাগল স্ত্রীর জন্য। এতদিন যা ছিল লুকোচুরি, নিয়তির সুদৃষ্টিতে আজ তা অধিকার। তৃপ্তির হাসিটা অবশেষে ঠোঁটে ঝুললো অয়নের।

ক্লাস চলাকালীন মুঠোফোনটা ধরেও দেখেনা অহন। ক্লাসের ঘন্টা বাজলে তখন একবার চেক করে নেয় কোন জরুরী কল এসেছে কিনা! ভাইয়ের ফোন থেকে আগত বার্তাটা পড়ে ভ্রু কুঁচকালো সে। সিরিয়াস ব্যাপারে অয়নের খুনসুটি মাঝেমধ্যে তাকে রাগিয়ে তোলে। আজও ভাইকে সে পাঠিয়েছিল –
“তোর বউয়ের পরীক্ষা খারাপ হয়েছে, ফেল আসবে বলল। তুই বসে বসে সুন্দরীদের পড়া, ভবিষ্যতে লোকে বলবে ফেল্টু বউয়ের বর।”

অয়নকে ডায়াল করতে গিয়েও কি মনে করে তোড়ার নাম্বারটায় ডায়াল করল। রিং হতে হতে বন্ধ হয়ে গেল শব্দ। পকেটে পুরে রাখল ফোনটা। ফের পকেটে হাত দিয়ে ফোনটা বের করল। মায়ের নাম্বারটায় ডায়াল করে বসল আচমকা। তার উচাটন মনটা বেশ পোড়াচ্ছে তাকে। তিন চারটে রিং হতেই ওপাশ থেকে মায়ের স্বরটা শুনে অহন বলল -“আম্মা!”
অনিমা অবাক হলো, মিষ্টি হেসে বলল -“হু, শুনছি। বল।”

কি বলবে তা ভেবে পেলো না অহন। উশখুশ করে মাথা চুলকে বলল -“বাবাকে বলো আজ অফিসে যেতে পারব না। ভালো লাগছে না।”
ওপাশে মায়ের নীরবতায় আবারও অহন বলল -“আম্মা!”
ছেলের কথা শুনে হেসে অনিমা বলল -“তাড়াতাড়ি আসিস, কথা আছে তোর সাথে।”
মায়ের আদরমাখা আবদারে হাসল অহন। বাবার সাথে সম্পর্কটা খুব সুন্দর হলেও মায়ের সাথে মাঝেমধ্যে সবচেয়ে ভারী আলোচনার সুষ্ঠু সমাধান হয়।

*****************

তড়িঘড়ি করে ছেলের ঘরে ঢুকল অনিমা। মা’কে দেখে শোয়া ছেড়ে উঠে বসল অহন। মায়ের আদলে বিরাজমান অস্হিরতা তাকে ভাবাচ্ছে। দরজাটা ঠেলে দিয়ে ছেলের পাশে বসতে বসতে অনিমা বলল -“বড় আশা করে এসেছি বাবা, ফিরিয়ে দিস না।”
মায়ের কথা শুনে গলা শুকিয়ে এলো অহনের। বড় বড় চোখ করে চেয়ে রইল মায়ের পানে। মায়ের বলা বাক্য দুটো আগত ঝড়ের পূর্বাভাস নয়ত! রীতিমতো ঘামতে শুরু করল সে। আজ যদি মা কোন কঠিন আবদার করে বসে! সে তো সেই আবদার রাখতে পারবে না। এলোকেশী বিনা অন্য কারো সঙ্গ যে তার জন্য মৃত্যুসম। তবুও স্বাভাবিক স্বরে বলল -“কি বলবেন আম্মা?”

দরজার পানে সতর্ক দৃষ্টি রেখে অনিমা বলল -“অমত করিস না বাবা, আমার খুব ইচ্ছে ছিল অয়নের জন্য ওকে রেখে দেব। কিন্তু তোর ভাইতো সে সুযোগ দিলো না। তোর বাবাও রাজি হয়না। হয়ত বয়সের ফারাক অল্প বিস্তর এদিক ওদিক, বউ হিসাবে উত্তম হবে।”

বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল অহনের।শেষ পর্যন্ত ছোট ভাইয়ের জন্য ঠিক করা মেয়েকে নাকি তাকে বিয়ে করতে হবে! আর তোড়া বিনা অন্য কাউকে বিয়ে করার ভাবনাটাও সে অবচেতন মনেও ভাবতে পারে না। মাথা ভনভন করছে যেন। কানের পাশ থেকে উত্তপ্ত ধুম্রের ব্যাপক আনাগোনা চলছে। কপালের ঘাম ইতোমধ্যে গালে নেমে এসেছে। বুকে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছে। তখনই কর্ণকুহরে এলো সেই কাংখিত নামটা -“বাবা, তোড়ার বয়স কম হলেও মেয়েটা ম্যাচিউরড। সম্পর্কের মানে বোঝে, সম্মান দিতে জানে। তুই অসুখী হবি না বাবা। আমার পুরো মনটা পড়ে আছে ঐ ছোট্ট পরীটার কাছে। কোলে তুলে মানুষ করেছি, ওকে চিনতে একটুও ভুল হয়নি বাবা। ঐ ছোট্ট টুকটুকে মেয়েটা ছাড়া অন্য কাউকে বউ হিসেবে মানতে মন সায় দিবে না রে। ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকুক। আমায় ফিরিয়ে দিস না প্লিজ।”

এই মুহূর্তে অহনের ইচ্ছে করছে ইয়া জোরে একটা চিৎকার দিতে। অমাবস্যার আধারে ছেয়ে যাওয়া আদলটা তখন চকচক করছে আহ্লাদে। মায়ের পানে চেয়ে মৃদু হেসে বলল -“তারপর!”
অনিমা খানিক আশার আলোর ঝলকানি পেল। গদগদ হয়ে বলল -“তারপর তাড়াতাড়ি শুভ কাজটা সেরে ফেললে তোর আর অয়নের রিসিপশনের অনুষ্ঠান একসাথে করব। ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা সেরে ফেললে মনে হয় ভালো হবে। যত তাড়াতাড়ি হবে ততই মঙ্গল। মেজ ভাই তো সেদিনও বলল ওর বিয়ে দিয়ে দিবে তাড়াতাড়ি।”

কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো আঙ্গুলের সাহায্যে পেছনে ঠেলে দিয়ে প্রসন্ন কন্ঠে অহন বলল -“ভালো হবে।”
ছেলের কাছে নিজের আবদারের শতভাগ মর্যাদা পেয়ে পাখির মত উড়ছে অনিমা। কোনমতে দৌড়ে এসে রুবাবাকে জড়িয়ে ধরল। কলিকে জড়িয়ে ধরল একবার। কিশোরীদের ন্যায় খুশিতে বাক-বাকুম করছে। রুবাবা আর কলি দুজনেই অবাক হলো। কলিতো বলেই বসল -“বড় ভাবী! সবটা খুলে বলুন, আমিও একটু লাফাই।”
হু হা করে হেসে উঠল অনিমা। রুবাবার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিয়ে আনমনে গেয়ে উঠল -“সম্পর্ক বদলে গেল একটি পলকে।”
কথার আগামাথা না বুঝে কপালে তিন চারেক কুঞ্চন এনে কলি আর রুবাবা হা করে তাকিয়ে আছে।

অহন উপরে দাঁড়িয়ে মায়ের ছুটোছুটি দেখে আনমনে হাসল। ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে খুশির খবরটা এলোকেশীকে দিয়ে আসতে কিন্তু না, তাকে একটু জ্বালানোর সাধ জেগেছে প্রেমিক পুরুষের অন্তরে। পেছনে ঘুরে দরজাটার দিকে চেয়ে দুষ্টু হাসিটা হেসে এগিয়ে গেল। মুখে বিরাজমান হাসিটা আড়াল করে বিষাদের ছায়া টেনে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ করল। বিষণ্ণ মেয়েটা দরজা খুলতেই দরজায় দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে চোখজোড়া ছোট করে মাথা হেলে দাঁড়ালো। মানুষটার ভাব-গতিক বিশেষ সুবিধের লাগল না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে শুধাল -“কিছু বলবেন মাস্টার মশাই?”

ধীর কদমে ঘরে এসে অহন বলল -“তোমার অনুভূতির আবদার রক্ষা করতে পারলাম না এলোকেশী। মায়ের দাবির কাছে ভালবাসা হার মেনেছে।”
দৃষ্টির উদ্বিগ্নতার আদলে স্হান নিয়েছে স্বভাব-সিদ্ধ চাহনি। হেরে যাওয়ার গ্লানি এসেছে ফের। ঠোঁটের কোণে মলিন হাসিটা বুঝিয়ে দিচ্ছে বুকের ভেতরটা নিঃশব্দে টুকরো টুকরো হয়ে রক্তক্ষরণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। উদাস চোখে জানালার বাইরের লোহিত আভায় ছেঁয়ে যাওয়া আকাশটায় তাকিয়ে সঙ্গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল -“আর কিছু বলবেন?”
চোখের অবাধ্য জলকে কঠিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সটান দাঁড়িয়ে তোড়া। কন্ঠে কাঠিন্যের মুদ্রণ। অহন গম্ভীর স্বরে বলল -“আমায় ক্ষমা করবে না তুমি!”
মৃদু হাসল তোড়া। ঠোঁট গোল করে ভেতরের কষ্ট বের করে দেয়ার ব্যর্থ প্রয়াস। ব্যর্থতার গ্লানিভরা চাহনি নিয়ে ঐ দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে বলল -“আমার কোন অভিযোগ নেই।”
অহন রাশভারি গাম্ভীর্যের আদলে বলল -“লক্ষ্য অর্জনের জন্য লড়াই করতে হয়। এত সহজে হাল ছেড়ে দিলে?”

বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আসছে তোড়ার। নিঃশ্বাস আঁটকে যাবে যেন। ইচ্ছে করছে সামনের মানুষটাকে চিৎকার করে বলতে -আপনি আমার ছাড়া আর কারো নয়। কিন্তু চিৎকার করলে যদি সব পাওয়া যেত তাহলে আকাংখা শব্দটা থাকত না। জোর শব্দটা হতো সবার প্রিয়। নিজের উড়ন্ত অনুভূতিকে সমাহিত করে তোড়া শব্দ করে হাসল। মিষ্টি হেসে বলল -“জোর করা আর লড়াই করা আলাদা শব্দ। সবক্ষেত্রে লড়াই শব্দটা ঠিক যায়না, আবার সবক্ষেত্রে জোর শব্দটাও যায়না। পরিস্থিতিই আহ্বান করে নিজস্ব উপায়ে।”
উক্ত কথাগুলোর পিঠে কিছু বলতে যাচ্ছিল অহন, তার আগেই গম্ভীর স্বরে তোড়া বলল -“নিজের ঘরে যান।”
অহন এবার হেসে দিল। কাঁধ উচিয়ে, ভ্রু নাচিয়ে শুধালো -“যদি না যাই?”
জিভের আগায় সাজানো কথাটা ঝটপট বলে দিল তোড়া -“আমিই চলে যাব।”
তোড়ার কথা শুনে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল অহন। সেদিকে চকিতে তাকাল মেয়েটা। অহনের দুষ্টুমির ছলে করা প্রশ্নে ক্রুদ্ধ হলেও নিজেকে সংযত রাখল। অহন ফের বলল -“কিসের গন্ধ পাচ্ছি যেন!”
মৌন হয়ে গেল তোড়া। দ্রুত পদে ত্যাগ করল নিজের ঘর আর ঐ মানুষটার সান্নিধ্যের আড়াল হল।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here