#এলোকেশী_সে
#মাহমুদা_লিজা
পর্বঃ৫
কান থেকে ফোনটা নামিয়ে গর্জে উঠলো নিজাম মজুমদার। চিৎকার করে ডাকতে শুরু করল তোড়াকে। নিজের নামটা বাবা নামক মানুষের মুখে সশব্দে বার কয়েক উচ্চারিত হওয়ায় খানিক ভড়কালো মেয়েটা। তবুও মুখোভঙ্গি স্হির রেখে ঘর ছেড়ে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুতই নিচে নেমে এলো। বসার ঘরে সোফার সামনে ক্রুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নিজাম মজুমদার। দিনটা শুক্রবার হওয়ায় সবাই বাড়িতেই ছিল। তাঁর জোরালো আওয়াজ শুনে সবাই দৌড়ে এলো সেখানে। সবার চোখেমুখে একরাশ কৌতূহল আর খানিক ভয়ও কাজ করছে সবার মনে।
মেয়ের দিকে আক্রোশ নিয়ে তাকালেন তিনি, রুষ্ট স্বরে জিজ্ঞেস করলেন – “জাকারিয়াকে মারার জন্য কাকে পাঠিয়েছো? এতটা অধঃপতন কবে ঘটেছে তোমার?”
ক্রোধে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ঘরভর্তি মানুষের সামনে নিজের সন্তানকে অপমান করার মত কাজটা ফের ঘটিয়ে ফেললেন নিজাম সাহেব। সবাই উৎসুক চাহনি নিক্ষেপ করছে তোড়ার দিকে। অয়ন চোখজোড়া ছোট করে কিছু একটা ভাবছে। তার ভাবনায় দুয়ে দুয়ে চার মিলতেই স্পষ্ট প্রতিবাদ করল সে -“ভেবেচিন্তে কথা বলুন কাকা। যার সাথে আপনি তোড়ার বিয়ে ঠিক করেছেন তাকে ও দেখেনি আর না সে ঐ ছেলের সম্পর্কে কিছু জানে।”
তোড়া নির্লিপ্ত কণ্ঠে জানালো -” আমি যেহেতু আপনার সন্তান সেহেতু আমার নিকট কোন কিছুই অসম্ভব নয়। সব করতে পারি নিজের জন্য। আর রইলো বাকি কাউকে মারার কথা। আপনাকে বলে দেই আমি কাউকে মারার জন্য লোকটোক পাঠাইনি, আমি কাউকে পেছন থেকে আঘাত করার মন মানসিকতা রাখিনা। আমি সামনাসামনি মরণ ছোবল দেয়ার হিম্মত রাখি।”
কথাটুকু বলে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল তোড়া। এক ঘর মানুষের সামনে তাকে আজ আবার অপমান করা হয়েছে। আজও সব অভিমান, অনুযোগ বর্তাল মায়ের উপর। এখানে না থাকলে এতটা অপমান, অপদস্ত হওয়া লাগতো না। চোখের কোলটা মুছে এলোমেলো পদে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে মেয়েটা। কোমর পেরিয়ে নেমে আসা চুলগুলো এদিক সেদিক হেলে দুলে উঠছে। তোড়ার মনে হচ্ছে এটুকু সিঁড়ি কেন শেষ হচ্ছে না। নিজের ঘরে গিয়ে কখন সবার আড়াল করবে অপমানিত আদলটুকু! চোরের মত পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা যেন!
মেয়ের গমন পথে দৃষ্টি রেখে নিজাম সাহেব চেচিয়ে বললেন -“আমিতো বের করেই ছাড়বো কার আস্পর্ধা এতটা বেড়েছে। আমার দেখানো সম্বন্ধ কে বাঁকড়া দিয়েছে তাকে আমি খুঁজে বের করব।”
তোড়া থামল না, ফিরেও দেখলো না পেছনে। ঘরে আসতেই চোখ গেল বেগুনি জমিনটায়। মনটা নিমিষেই শীতল হয়ে গেল। তুলিটা আবারও আঙুলের ফাঁকে ধরল। কোমল স্পর্শে কাঠগোলাপের পাতা আঁকছে, ছোট খাটো পাখির অবয়বও ফুটিয়ে তুলেছে। তোড়ার ইচ্ছে হলো তাদের মত ডানা মেলে নীলাম্বরে উড়তে, ডানা ঝাপটে সবুজ রঙা পাতার ফাঁকে গাছের ডালটায় বসতে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের মনকে প্রশ্ন করল কে আজ তার জন্য রহমত হয়ে এসেছে, কোন মানুষটা তার মন পড়েছে। কেন সে তার বিয়েটা ভাঙল?
এলো চুলগুলো হাতে প্যাচাতেই মনে পড়ল অহনকে তো আজ বাড়িতে দেখা গেলো না। মুখটা চকচক করে উঠল তার। গতরাতেও একমাত্র অহনই প্রতিবাদ করেছিল তার বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে। তোড়ার অচেতন মন জানান দিচ্ছে ঐ পুরুষটাই তার জন্য লড়েছে। কিছু একটা ভেবে মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে ঝটপট ডায়ালপ্যাড থেকে অহনের কন্টাক্ট নাম্বারটা সামনে আনলো। কল অপশনে ট্যাপ করেই ফোনটা কানের কাছে তুলল। বুকের ভেতর অস্হির ঝড়টা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। তিনটে রিং হওয়ার পর পরই ওপাশ থেকে ভরাট কন্ঠে শোনা গেল – “বল, কল দিলি কেন?”
বুকের ভেতরটা ছলাৎ করে উঠল তোড়ার। কি বলবে সে? কেন কল দিয়েছে সেটা না ভেবে বেকুবের মত কাজ করেছে সে!
ওপাশ থেকে আবার শোনা গেল – “হ্যালো, বোবায় পেয়েছে তোকে?”
সম্বিত ফিরল তোড়ার। আমতা আমতা করে বলল – “ভাইয়া, আসার সময় আমার জন্য সবুজ আর রয়েল ব্লু এক্রেলিক কালারটা নিয়ে আসতে পারবেন?”
অহন ছোট্ট করে জবাব দিল হু। ফোনটা কানে চেপে বুকে সাহস সঞ্চার করে তোড়া ফের প্রশ্ন করল – “শুক্রবার তো আপনি বের হন না কিন্তু আজ কোথায় গেছেন?”
ডানগালে তখন বরফ ঘষছিল অহন। তোড়ার শেষোক্ত প্রশ্নটা শুনে বরফটা হাত ফসকে ভূমি স্পর্শ করল। অহন ঢোক গিলে নিজের মনের নিয়ন্ত্রণ টেনে বলল – “চিৎকার করে করে ভাইয়া ডাকলে যে এমন প্রশ্ন করতে হবে সেটাও শিখে গেছিস?”
তোড়া মুচকি হাসল। কথার মানেটা সে বুঝেছে কিন্তু মনের আবেগটা সংযত করল। খানিক চুপ থেকে বলল – “আচ্ছা ভুল হয়ে গেছে, আর কখনো জিজ্ঞেস করব না। রাখছি।”
অহন কিছু বলার আগেই কলটা ডিসকানেকটেড করা হলো। একবিন্দু অভিমান এসে মেয়েটার বুকে জমলো, অপরপাশে সামনে থাকা টুলটায় সজোর লাথি দিয়ে উঠে দাঁড়াল অহন।
মিরান হকচকিয়ে জিজ্ঞেস করল – ” মাথার তার ছিঁড়ছে নাকি শা/লা?”
অহন ডান হাত দিয়ে কপালটা মোছার ভান করে বলল – “ভুল বুঝল, ও আমাকে ভুল বুঝে কলটা কেটে দিল। কেমন রোবটের মত থাকে। আর কিভাবে বোঝালে ও আমার মন বুঝবে?”
মিরান ঠোঁটজোড়া গোল করে চোখ ছোট করে বলল – “তার রাগ কি তুই আমার অবলা টুলের উপর ঝাড়বি? টুলটা কি তোর শ্বশুরের টাকায় কিনেছি নাকি?”
মিরানকে সজোরে এক ধাক্কা দিয়ে হনহন করে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়াল অহন।
________
কলিংবেলের শব্দ শুনে কলি এসে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলতেই নজরে এলো অহনের থমথমে আদলখানা। তার ডানগালে চোটের দাগ স্পষ্ট। কলি ছোট্ট করে জিজ্ঞেস করল – “আজও মারামারি করে এসেছিস?”
আনমনেই অহনের হাতটা গালে চলে গেলো। চোটের জায়গাটায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল – “আমায় কি তোমার গুন্ডা মনে হয়, ছোট কাকীমা? খেলতে গিয়ে বল এসে লেগেছে আর গালের দাঁত কোনদিক টপকে কোনদিক গেছে খুঁজে পাইনি।”
অহনের কথা শুনে কলি সশব্দে হেসে উঠল। অহন ততক্ষণে বসার ঘর পেরিয়ে দু ‘তিন ধাপ সিঁড়ি উঠে গেছে। ডানের ঘরটার সামনে এসে দাঁড়াল। শার্টের কলারটা ঠিক করে দরজায় শব্দ করতেই ভেতর থেকে আওয়াজ এলো – “দরজা খোলা।”
দরজা ঠেলে ভেতরে আসতেই অহনের দৃষ্টি আঁটকে গেল সপ্তাদশী মেয়েটার চিত্রায়ণে। শাড়ির জমিনে ফুল ফোটানো মেয়েটার চুলের প্যাচে থাকা তুলিটাতেও দৃষ্টি ঘুরে এলো একবার। বারবার এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গোঁজার দৃশ্যটুকু দেখে অহনের ইচ্ছে হলো এলোকেশীর অবিন্যস্ত কেশরাশি নিজ হাতে বেঁধে দিতে।
তোড়া ব্যস্ত শাড়িতে রং করায়। মাথাটাকে বারবার এদিক সেদিক হেলে পরখ করছে। শাড়িটার রং মাখানো সম্পূর্ণ শেষ হয়েছে। নিজের জন্য শাড়িটা ডিজাইন করলেও তোড়ার মনে হলো এই কাজের জন্য শ্রম আর সময় বাড়ালে নিজেকে স্বাবলম্বী করতে পারবে। মনের কোণে আশার ক্ষীণ আলো জ্বলে উঠল যেন। ওষ্ঠপুটে প্রাণহীন হাসিটা দৃশ্যমান হলো। কল্পনার সাগরে নিমজ্জিত হওয়ার পূর্বেই ডুবুরির বেশে এলো অহন। খানিক জোরে চেচিয়ে বলল – “তোর রং নিয়ে এসেছি, এগুলো কিনা দেখ।”
এতক্ষণ জানালার দিকে মুখ করে থাকা সপ্তাদশী কন্যার ঘুরে দাঁড়ানোর দৃশ্যটা দরজার কপাটের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটার বুকে ধ্রিম ধ্রিম কম্পন তুলে দিল যেন। চোখে কাজল দেয়া মেয়েটাকে দেখেই উদ্বেলিত হৃদয়খানা কেঁপে উঠল। কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল – ” চোখে কাজল দিয়েছিস কেন? পাত্রপক্ষের সামনে বসার জন্য পুরোদস্তুর তৈরী হয়েছিস নাকি?”
ঐ ব্যাকুল মুখখানা দেখে ঈষৎ হাসল তোড়া। তার দৃষ্টি আটকাল অহনের ডান গালে। তবুও প্রশ্ন না করে জবাব দিল – “অনুদের বাড়ি যাব ভেবে কাজল দিয়েছি। কারো সামনে সঙ সাজার অভিপ্রায় নেই।”
বুকে চাপা পড়া নিশ্বাসটা যেন অক্সিজেন পেলো এবার। খানিকটা এগিয়ে এসে অহন জিজ্ঞেস করল -” তোকে দেখতে কখন আসবে?”
তোড়া আফসোসের মেকি ছলে বলল – “কে আসবে দেখতে? যে আসার কথা তাকে কেউ মেরেছে মাঝ রাস্তায়। ”
অহন ফিক করে হেসে দিয়ে বলল -” তোর কষ্ট হচ্ছে? ”
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তোড়ার। চোখের ভাষার পরিবর্তন হলো ক্ষণিকের ব্যবধানে। গলায় ঝাঁঝালো তেজ এনে বলল -“আমি পুরুষদের ঘৃণা করি, স্রেফ ঘৃণা করি। কষ্ট হচ্ছে না বরং শান্তি পাচ্ছি। ”
এলোকেশীর যশস্বী রূপটা বেশ টানছে অহনকে। খুব ইচ্ছে করছে বুকে টেনে পরম আবেশে তার ভুল ভাঙাতে। তাকে বোঝাতে ইচ্ছে করছে সব পুরুষ এক নয়। কিন্তু অধিকার জন্মায়নি।
চলবে…….
[দুঃখিত এতটা দেরীতে দেয়ার জন্য। সবার ছোট্ট অনুভূতি জানাতে ভুলবেন না।]