#এলোকেশী_সে
#মাহমুদা_লিজা
পর্বঃ৬
রাতের খাবারটা নিজের ঘরেই খেয়েছে অহন। সবার সামনে আসলেই ডান গালের চোট পাওয়া নিয়ে কাড়ি কাড়ি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো তাকে। কাজল নয়না ঐ এলোকেশীর কৃষ্ণ চোখজোড়া বারবার তার চোখে ভেসে আসছে। বুকের ভেতরটা শুন্য শুন্য লাগছে বেশ। কিছু একটার অভাববোধ তাকে শান্তি দিচ্ছে না। ক্লেশে আচ্ছাদিত হচ্ছে সেই দুপুর থেকে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল নাঈম মজুমদারকে সরাসরি বলতে হবে। এভাবে ভেতরে ভেতরে গুমরে কাঁদার কোন মানেই হয়না। পরক্ষণেই মানসপটে ভেসে এলো বেগুনি জমিনের কোলে কোলে কাঠগোলাপ অঙ্কনের দৃশ্যটুকু। অহনের মনে পড়ল তোড়া তো স্বাবলম্বী হতে চায়। এই গুণটুকু ষোলআনা কাজে লাগালে তার এগিয়ে চলার পথটা খুব একটা কঠিন হবে না।
নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে অয়নের রুমে এসে বিছানায় ধুপ করে শুয়ে পড়ল অহন। অয়ন এক নজর তার দিকে তাকিয়ে পুনরায় দৃষ্টি রাখল বইয়ের পাতায়। ভাইয়ের দিকে না তাকিয়েই শুধালো -“ঘুষিটার ভর কতটুকু ছিল? কত ডিগ্রী এঙ্গেলে ঘুষি লেগেছে আর ঘুষিটা দিতে জাকারিয়া সাহেব কত প্যাসকেল চাপ প্রয়োগ করেছে?”
অহন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে শুয়েই রইল। গালে হাতটা ঘষতে ঘষতে বলল -” কাল স্টুডেন্টদের ক্লাস টেস্ট আর আমি এখনো প্রশ্ন রেডি করিনি।”
অয়ন মুচকি হেসে গলা ছেড়ে গান ধরল – “বন্ধু তুমি ঝড়ের দিনের আমের মত না, দমকা হাওয়া আসে বন্ধু – তুমি আসো না।”
মাথার নিচে রাখা বালিশটা ছোট ভাইয়ের দিকে ছুঁড়ে মারল অহন। আজকাল অয়নটা তাকে দেখলেই এই গানটা গাইতে থাকে। নিজে দিব্যি প্রেম করে বেড়াচ্ছে অথচ বড় ভাই এক-আকটু প্রেম করার চেষ্টা করছে, তাতেই বিষফোঁড়ার হুল তুলেছে এই ছেলেটা।
অয়ন বালিশটা ঠেকিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করল – “ভাই এটা বল আগে, তুই কবে থেকে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস? আমি তো ভেবেছি তোর বিয়ে বিদ্বেষী মনোভাবের জন্য আমাকেও ব্যাচেলর হয়ে থাকতে না হয়।”
অহন জবাব দিলো না। সে তার এলোকেশীর সামনে নিজেকে সুদর্শন আর যোগ্য প্রমাণ করার জন্য গত আটমাস কতটা কসরত করছে। আগে শুধু জগিং করলেও এখন নিজেকে আকর্ষণীয় করায় মন দিয়েছে। এমন নয় যে ভাল লাগাটা অনেক আগের, আটমাসের অনুভূতিটুকুই তাকে অঙ্গার করে দিচ্ছে। নবীণ বরণে লাল শাড়িতে এলোকেশে ছুটে বেড়ানো সপ্তাদশীতে মজেছে সে। মায়ের পাশাপাশি রিকশায় চড়ে সেদিন কলেজে যাওয়ার আগে বাড়ির সদর দরজায় এক পলকের জন্য দৃষ্টি ঘুরেছিল সপ্তাদশীর পানে। তাতেই সর্বনাশ হলো। মাটির বুকে আলতো হয়ে ঝুলে পড়েছিল এলোকেশীর আঁচল। লাল জামদানীতে নতুন বউ লাগছিল যেন। সেই মুহূর্তটা বুকে মধুর বাণ হয়ে বিঁধে গেছে অহনের। কাজল দেয়া আয়তলোচন, লাল রঙা লিপস্টিকে রাঙানো তিরতিরে ওষ্ঠপুট, কোমর ছাড়িয়ে নেমে আসা কেশরাজির দোল খাওয়ার দৃশ্যটুকু কিছুতেই ভুলতে পারেনা অহন। রাতের ঘুমটুকু হারাম করার জন্য ঐ একটি মুহূর্তই এন্টিবায়োটিকের মত কাজ করেছে।
বুকের ভেতর আবার হু হু করে উঠল। কবে নিজের শুন্য বুকটাকে ভরিয়ে দিবে ঐ নিষ্ঠুর রমণী!
দীর্ঘশ্বাসটা আরো দীর্ঘ হলো। অতীত থেকে বেরিয়ে এসে গলা ঝেড়ে ছোট ভাইয়ের উদ্দেশ্যে ভ্রু নাচিয়ে অহন জিজ্ঞেস করল -” একটা দায়িত্ব পালন করতে হবে অয়ন, বলতে পারিস আদেশ করছি।”
অয়ন মাথা তুলে ভাইয়ের দিকে একবার দৃষ্টি রাখল কিন্তু পরক্ষণেই আবারো বইয়ে মুখ গুঁজে বলল – “চাইয়া থাকস ক্যা! কি কবি ক। তুই কইলেই তো আমি কমু হ।”
অহন হো হো করে হেসে উঠল, তার কন্ঠের তেজটা ততক্ষণে কমে গেছে। হাসির চোটে অহনের চোখের কোণে জল চিকচিক করছে।
হাসির তোড় কোনমতে কমিয়ে অহন বলল -“যতটা সাপোর্ট লাগে আমি দেব, তুই শুধু তোড়ার পেইন্টিংগুলো ভাইরাল করবি আর ম্যাক্সিমাম মানুষের কাছে পৌঁছে দিবি। আমিও স্হির চিত্র বা ভিডিওগুলো তোর ফোনে পাঠাব আর তুই ওকে পরিচিত করে তুলবি। আমি চাইনা তোড়া সবসময় এভাবে গুমরে থাকুক। ওর গুমট ভাবটা সত্যি নিতে পারছিনা। মেজ কাকার করা অন্যায়ের ঠিক কি শাস্তি হওয়া উচিত আমি জানিনা, তবে ওর একটা সুন্দর জীবন পাওয়ার অধিকার আছে।”
অয়ন মাথা নুইয়ে রেখেই হাসল। খনিক বাদে উঠে এসে ভাইয়ের পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল -” তুই গুণে গুণে আমার এক বছর পাঁচ মাসের বড়। তুই হয়ত জানিস মেজ কাকা কেন দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। আমায় বল না ভাইয়া। ”
ভাইয়ের কথাটা শুনে ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠল অহনের। ছোট ভাইকে কথাটা সে মোটেও বলতে পারবে না। সম্পর্কটা যথেষ্ট মুক্তমনার হলেও এই বিশ্রী কথাটা কিভাবে ভাইকে বলবে সে!
অহন উঠে দাঁড়াল সটান। অয়নের উৎসুক দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে বলল -” ছোট ভাইকে এ ধরনের কথা বলা বড় ভাইয়ের উচিত নয়। কখনো নিজ থেকে জানলে তখন না হয় নিজের কৌতূহল দমাস। কৌতূহল ধরে রাখ। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু।”
_______
তুষার আর তন্ময়কে নিয়ে কানন তার ছোট ভাইয়ের সাথে বিকেলে বেলায় বাবার বাড়ি গেছে। তাঁর ছোট কাকার মৃত্যুর সংবাদ শুনেই ভাইকে খবর দিয়েছেন তিনি। এ বাড়ির কেউই তাঁর বাবার বাড়ি মুখো হয়না। নিজাম সাহেবের কাজ থাকায় তিনিও স্ত্রী -পুত্রের সঙ্গ দিতে পারেন নি।
বাড়ির সবাই আধঘুমে বিভোর। তখনই মায়ের ঘরে এলেন নিজাম মজুমদার। মাকে এটাসেটা জিজ্ঞেস করে ঘরের এ মাথায় ও মাথায় চোখ বুলিয়ে দেখলেন রুবাবা নেই সেখানে। মায়ের সাথে আরো খানিকক্ষণ টুকটাক কথাবার্তা বলে নিজাম সাহেব মায়ের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। ড্রয়িংরুমে এসেই দেখতে পেলেন রুবাবা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। নিজাম মজুমদারকে পাশ কাটিয়ে রুবাবা সামনে এগোতেই কানে এলো সেই পরিচিত ডাকটা -“রুবা!”
পাজোড়া থমকে গেল রুবাবার। কত বছর পর সেই ডাকটা, একসময় যেই ডাকের জন্য সারাদিন অপেক্ষা করত, কত কাংখিত ছিল সেই ডাক। আর আজ! আজ একই পুরুষের মুখে সেই কাংখিত ডাকটা শুন ঘৃণায় গা রি রি করে উঠল। পেছনে ঘুরে ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বলল -“আমাকে এই নামে আর কখনো ডাকবেন না। তখন নিজের নামের প্রতিও ঘৃণা চলে আসবে।”
তোড়া পানির জগটা নিয়ে সবে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কোণে আসতেই বাবা আর মাকে দেখে সেখানেই থমকে গেল। তাহলে কি তার মায়ের এখনো ঐ লোকটার জন্য দুর্বলতা আছে মনে! ব্যাপারটা আঁচ করার জন্য সিঁড়ির কোণে আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল সে।
নিজাম সাহেব অবনমিত দৃষ্টিতে বলল -” নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবো না, শুধু বলব এত অবহেলা পেয়েও নিজেকে কষ্ট দেয়ার জন্য এখানে কেন পড়ে আছো? তুমি চাইলে আমি অন্যত্র তোমার থাকার ব্যবস্হা করব।”
রুবাবা কোন প্রত্যোত্তর করল না। শান্ত দৃষ্টি নিয়ে মাটিতে চোখ রাখল। খানিক বাদে নিজাম সাহেব অনুরোধের স্বরে বললেন -“মেয়েকে বিয়েতে রাজি করাও রুবা, ছেলেটা খুব ভালো, মেয়ে সুখে থাকবে।”
এবার আর নিজেকে সংযত করতে পারল না রুবাবা। গলার স্বরটা খানিক উঁচু করে বললেন -“আমার বাবাও তো ভালো ছেলে দেখে আমায় বিয়ে দিয়েছিল। তিনিও বলেছিলেন ভালো ছেলে, তোকে সুখে রাখবে। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতে কি হলো? বলুন। আপনার সন্তান জন্মেছে, আর আপনি? নিজের বাসনা মেটানোর জন্য পঁয়তাল্লিশ দিনের জন্য আমাকে ছাড় দেন নি। আরে দুনিয়ার অন্য পুরুষেরা যদি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সেখানে আপনি নিজের খায়েশ মেটানোর জন্য আমার ঐ অবস্হায় দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। তো বলুন এবার আমি খুব সুখে আছি, আপনি সুখে রেখেছেন তাইনা!”
অসহায় চাহনি নিয়ে নিজাম মজুমদার তাকিয়ে আছে রুবাবার দিকে আর সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা ততক্ষণে দুমড়ে মুচড়ে গেছে মনের দিক দিয়ে। থপ করে বসে পড়ল ফ্লোরেই। চোখের জল আর বাঁধ মানছে না। তার শ্বাসের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। হাত পায়ের অস্বাভাবিক কম্পনে নিজেকে প্যারালাইজড মনে হচ্ছে। এতদিন বাবার প্রতি ক্ষোভ ছিল, রাগ ছিল আর আজ তো ঘৃণা জমেছে। একটা মানুষ কতটা নিম্নরুচির হলে অমন ঘৃণ্য কাজ করতে পারে। নিজের মায়ের প্রতি জমা অভিমান আজ অভিযোগে রূপ নিয়েছে।
অমন কাপুরুষের ঘরে আজ পর্যন্ত কেন পরগাছা হয়ে রয়ে গেলেন তিনি? নিজের প্রতি নূন্যতম সম্মান যার নেই সে কাউকে ভালবাসতে পারে নাকি! হাতে থাকা পানির জগটা অমনি রয়ে গেল। তোড়ার ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে। কাদের ভিড়ে, কার সান্নিধ্যে সে বড় হচ্ছে! দৌড়ে ছাদে চলে গেল মেয়েটা।
বড় নিঃসঙ্গতা প্রয়োজন তার। ভগ্ন মনটা এতটাই বিধ্বস্ত হলো যে তার খেয়ালই ছিলো না ছাদের দরজা খোলা আর সেখানে কেউ থাকতে পারে। ছাদের দরজাটা আঁকড়ে ধরে সেখানেই হাঁটু মুচড়ে বসে হেঁচকি তুলে ফুপিয়ে ফুপিয়ে নিজের ভেতরে থাকা কষ্টদের উগড়ে দিচ্ছে। নিজের ঝলমলে স্নিগ্ধ চুলগুলো দু হাতে শক্ত করে ধরে বিলাপের মত করে আর্তনাদ করছে মেয়েটা। আচমকা কারো স্বরে দমে গেল সে – “কি হয়েছে, কাঁদছিস কেন?”
মুখ তুলে সামনের পরিচিত অবয়বটাকেও তখন ভীষণ ভয় হলো তোড়ার। চট করে দাঁড়িয়ে গেল। হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে মুখ ঘুরিয়ে ছাদ ত্যাগ করতেই অহনের শক্তপোক্ত হাতটা এসে তার কব্জি ধরে ফেলল। শীতল কন্ঠে ফের শুধোলো -” কাঁদছিলি কেন?”
তোড়া একটানে হাতটা সরিয়ে নিল। উদ্ভ্রান্তের মত নিজের মুখটা মুছে ছুট লাগালো নিজের ঘরের দিকে। ঘরে এসেই চুলগুলো টানতে লাগল। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। তার মনে হচ্ছে সে কোথাও ডুবে যাচ্ছে। নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে ক্রমে। নিজের সাধের চুলগুলো শক্ত হাতে টানতে শুরু করল। কান্নার তোড়ে এবার যেন দম আঁটকে আসছে। মুখের সামনে পানির গ্লাসটা দেখে একটানে সেটা নিজের হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটা গিলে নিল। পানি খাওয়া শেষ করে ডানে তাকাতেই দেখল অয়নকে। এবার ভয়ে খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে তোড়া বলল -” কেন এসেছেন আমার ঘরে? বের হন, এখুনি বের হন। আমি চিৎকার করব।”
অয়ন ভ্রু কুঁচকে চোখজোড়া ছোট করে গমগমে আওয়াজে জিজ্ঞেস করল -“তোর মাথা ঠিক আছে? কি ভুলভাল বকছিস?”
তখনই অহন এসে পাশে বসল। তোড়ার মাথায় হাতখানা রেখে বলল -“কি হয়েছে তোর? এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছিস কেন?”
তোড়া গায়ের ওড়নাখানা আরো আঁটসাঁটভাবে নিজের গায়ে জড়িয়ে বলল -“চলে যান, আপনারা চলে যান। আপনাদের দেখে ভয় লাগছে আমার। প্লিজ চলে যান। আমার দম বন্ধ করে দিচ্ছে আপনাদের উপস্থিতি। ”
অয়ন বিস্ময় নিয়ে অহনের দিকে তাকাল। তোড়া তখনো উদ্ভ্রান্তের মত শুধু নিজেকে ওড়না দিয়ে আবৃত করছে। অহন আরেকটু এগিয়ে এসে তোড়ার মুখোমুখি বসে কন্ঠে কাঠিন্য এনে জিজ্ঞেস করল -“ভয় পাচ্ছিস কেন তোড়া? বল। তোর সাথে কেউ অসভ্যতা করেছে? বল, কে সে।”
অয়ন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তোড়াকে দেখছে। একটু আগেও তোড়াকে স্বাভাবিক দেখেছে সে। কিছু সময়ের ব্যবধানে কি এমন হলো!
তোড়া আরো খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে বলল -“আমার সামনে থেকে চলে যান, আমার ভয় করছে।”
নিজেকে আর সংযত করতে পারলো না অহন। সশব্দে চড় বসিয়ে দিল তোড়ার গালে। আচমকা অমন দাবাং চড়ে ভয়ে কেঁপে উঠল মেয়েটা। অয়নও চমকে উঠলো। অহনকে ধমকে বলল -“পাগল হইছিস?”
নিজের সম্বিত ফিরতেই তোড়ার দু বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল -“বল না কি হয়েছে।”
তোড়া নিজের সর্বশক্তি দিয়ে দুহাতে কঠিন ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল অহনকে। গলার আওয়াজ খানিক উঁচু করে বলল – “আমার ঘরে কি চাই? কেন এসেছেন? ওহ ঐ লোকটার রক্ত তো আপনাদের শরীরেও বইছে, তাইনা? ভদ্রতার মুখোশ খসে পড়েছে তাইনা? আফটার অল আপনাদের আদরের মেজ কাকাতো।”
তোড়াকে থামাতে তার ঠোঁটের উপর নিজের তর্জনী রেখে অহন বলল -“তুই কিভাবে জানলি এসব? কে বলেছে?”
অয়ন বেকুবের মত প্রশ্ন করল -” কি জানার কথা বলছিস ভাইয়া?”
অহন তখনো তার এলোকেশীর ভুল ভাঙাতে ব্যস্ত। কন্ঠস্বর দ্বিগুন শীতল করে বলল – “জানিনা তোকে এসব কে বলেছে কিন্তু সব মানুষকে এক পাল্লায় মাপিস না। তোর বাবার দাঁড়িপাল্লায় আমাদের কেন রাখছিস?”
অয়ন এবার আর ধৈর্য্য রাখতে পারলো না। খানিক চেঁচিয়ে বলল -“ঐ তুই কি আমারে সব বলবি? নাকি মাথায় দিমু একটা। ”
ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তোড়াই বলল -“কি বলবে, কি শুনবেন? মুখ আছে নাকি? এতদিন সবাই বলে এসেছে বাবাকে সম্মান করতে। কিন্তু যে মানুষ নিজের চরিত্রের হেফাজত করতে পারেনি, অল্প কিছু সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারেনি তাকে কি সম্মান করব? যে মানুষ সৃষ্টিকর্তার নিয়ম লংঘন করতে চায় তাকে কিভাবে বিশ্বাস করব। সেই জাতটাকে কিভাবে বিশ্বাস করব, সম্মান করব?”
অয়ন কিছু বুঝল কিনা বোঝা গেলো না কিন্তু নিজের কৌতূহল যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করে সে অবনত মস্তকে বলল -“ভাইয়া, চল। ওকে একা থাকতে দে।”
অয়নের কথামতো অহনও ত্যাগ করল তোড়ার ঘর। যাওয়ার আগে তোড়ার হাত পা ছড়িয়ে এলোমেলো হয়ে বসে থাকার দৃশ্যটা তার বুকের ভেতরটা চুরমার করে দিচ্ছে। মেয়েটার অমন নাজুক অবস্থায় একটা বিশ্বস্ত কাঁধের দরকার ছিল, একজোড়া ভরসার হাতের দৃঢ় বন্ধন দরকার ছিল।
________
সকালের নাস্তার সময়টায় বাড়ির বউদের হিমশিম অবস্থা। কেউ স্কুলে যাবে তো কেউ অফিস বা নিজের কর্মক্ষেত্রে যাবে।
তোড়া রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তার জ্যেঠী মায়ের হাত থেকে নিজের নাস্তার প্লেটটা নিয়ে সবে পা বাড়াল বসার ঘরের দিকে। তখনই অনিমা ঘোষণা করলেন -“আজ বিকেলে সবাই তাড়াতাড়ি আসবে, এক জায়গায় নিমন্ত্রণ আছে।”
অয়ন খেতে খেতে প্রশ্ন করল -“কোথায় যাবে আম্মা?”
কলি সহাস্যে বলল -“অহনের জন্য এক জায়গায় মেয়ে দেখতে যাব, পছন্দ হয়েছে সবারই। অহনের সায় পেলেই আজ পাকা কথা হবে। গত এক সপ্তাহ ধরেইতো আমরা সবাই আজকের জন্য অপেক্ষা করছি। আমার মেঝ ভাইয়ের মেয়ে মৃদুলার কথা বলছি আরকি। ওর ভার্সিটি ছুটি পেয়েছে, আজ বাড়ি ফিরবে ও।”
রুটির টুকরোটা ছিড়ে সবে মুখে দিচ্ছিল অহন। সেভাবেই থেমে গেল সে। অয়নও চকিতে তাকালো ভাইয়ের দিকে। তোড়ার দ্রুতগতির চলন মুহূর্তেই শ্লথ হলো। ফিরে তাকালো একবার। থমকে থাকা অহনকে নীরব থাকতে দেখে বিরহের হাসিটা এলো ঠোঁটের কোণে। পেলব হাতজোড়া কেঁপে উঠল, বুকের ভেতরটা যেন ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব শুরু করল। কিন্তু অনুভূতিদের মেলে ধরা বারণ। মন কাঁদলেও চোখদের কাঁদতে দেয়া যাবে না।
চলবে…….