#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
গাছের আড়ালে মস্তক লুকিয়ে দক্ষ ভাবে মেহেভীনের দিকে ব’ন্দু’ক তাক করা হলো। ক্রোধ সমস্ত কায়া কেঁপে কেঁপে উঠছে আরিয়ানের। মিরাজুল মুখে অনেক বড় বড় কথা বলেছিল। কিন্তু কাজের বেলায় শূন্য! এই যে বিয়ে হয়ে গেল। এখন মেহেভীনের বিদায়ের পালা চলে আসলো। তবুও তার দেখা মিলছে না! ক্রোধের মাত্রা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্রকোপ হতে লাগলো। সমস্ত কায়া থরথর করে কাঁপছে। সে বিলম্ব করল না। দ্রুত গু’লি করার জন্য প্রস্তুত হতেই মিরাজুলের মতো কেউ তাকে পেছনে থেকে চেপে ধরলো। দু’জন মানুষের হাতাহাতির মাঝেই আরিয়ান জ্ঞান হারালো। সেই সাথে অন্ধকার আচ্ছন্নে ঢেকে গেল কারো চূর্ণবিচূর্ণ হৃদয়ে। ভেতরটা ভিষণ বাজে ভাবে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। মানুষটা অশ্রুসিক্ত নয়নে শেষ বারের মতো প্রেয়সীকে দেখে নিল। ভেতর জুড়ে আজ শুধুই হাহাকারের বসবাস। তারে এত করে চাইলো। তবুও মানুষটারে নিজের করে পেল না। বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করেছে। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ভেতরে থেকে দুমড়ে মুচড়ে যাবে। নিজের প্রেয়সীকে অন্য কারো হতে দেখার সহ্য ক্ষমতা সবার থাকে না। তবে বিধাতা তাকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে। তবে ক্ষমতাটা বেশিক্ষণ স্থায়িত্ব পেল না। মনের সাথে সাথে কায়ার সমস্ত শক্তি ক্ষয় হতে শুরু করল। সে মলিনতায় ছোঁয়ায় মাখা কণ্ঠে বলল, “ভালো থেকো আমার না হওয়া প্রিয় মানুষ। পরের বার জন্ম বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে আমি অবশ্যই মুনতাসিম হয়ে জন্মাম। খুব সংগোপনে তোমার ভালোবাসা লুফে নিব। আমার মতো নিকৃষ্ট মানুষের সাথে তোমার যায় না। মুনতাসিমের মতো অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষই তোমার যোগ্য, আমার মতো অমানুষ কখনোই তোমার ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা রাখে না৷ পরপরে দেখা হলে একজন ভালো মানুষ হয়ে, আল্লাহর কাছে তোমারে চাইব। তখন আমায় ফিরিয়ে দিও না। আমার না হওয়া প্রিয় মানুষ। তুমি ভালো থেকো সুখে থেকো। তোমার নতুন জীবনের জন্য শুভেচ্ছা রইল গুড বাই ডার্লিং। ” বাক্য গুলো শেষ করেই আঁধারের সাথে মিলিয়ে গেল মানুষটা।
রাজপ্রাসাদের মতো বিশাল গৃহের সামনে এসে দাঁড়াল গাড়িটা৷ মুনতাসিম আগে নেমে মেহেভীনের হাত ধরে মেহেভীনকে নামালো। সে মেহেভীনের হাত শক্ত করে ধরে প্রবেশ দারে এসে স্থির হলো। সাহেলা চৌধুরী দু’জনকে বরন করে নিল। দূরের স্বজনরা বউ দেখতে ভিড় জমিয়েছে। এত এত ভিড়ের মাঝে হঠাৎ মুনতাসিমের আঁখিযুগল অস্থির হয়ে যায়। বিদায়ের মুহুর্ত থেকে তাইয়ানের উপস্থিতি সে অনুভব করছে না। ছেলেটা তো তাকে ছাড়া এক মুহূর্ত কোথাও যায় না। তবে আজ তার কি হলো? যে মুনতাসিমের আশেপাশে ও তাকে দেখা যাচ্ছে না! মুনতাসিমের ললাটে চিন্তার ভাজ পড়লো। তাইয়ানের জন্য ভিষণ চিন্তা হচ্ছে তার। সবাই মেহেভীনকে ঘিরে ধরে বসে আছে। মুনতাসিম মেহেভীনকে বলল,
–আপনি এখানে সবার সাথে বসে গল্প করেন। আমি পাঁচ মিনিটে আসছি। মেহেভীন কোনো উত্তর দিল না। নতুন মানুষদের ভিড়ে ভিষণ অস্বস্তি লাগছে তার। মুখ ফুটে সে কথা বলতেও পারছে না সে। সবাই তাকে প্রশ্ন করছে সে হ্যাঁ না উত্তর দিচ্ছে। সবাই অনেক প্রশংসা করল মেহেভীনের। এত ভিড়ের মধ্যে সে তাইয়ানকে কোথায় পাবে? চিন্তায় মস্তক ঝনঝন করে উঠল। মুনতাসিম সমস্ত গৃহ হন্যে হয়ে খুঁজে চলছে। অবশেষে গৃহের পেছনে মুনতাসিমের ফলের বাগানে তাইয়ানের দেখা মিলল। তাইয়ানের কাঁধে স্পর্শ করতেই তাইয়ান চমকে উঠল! তড়িঘড়ি করে আঁখিযুগলের অশ্রুকণা গুলো মুছে নিল। মুনতাসিম গম্ভীর দৃষ্টিতে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তাইয়ানের সমস্ত মুখশ্রীতে মলিনতা ছেয়ে গিয়েছে। আঁখিযুগল ভয়ংকর ভাবে রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। তাইয়ান অপরাধীর ন্যায় বলল,
–স্যরি স্যার আমি আসলে ভেবেছিলাম। এত মানুষ আছে সমস্যা হবে না। তাই আপনার থেকে কিছুটা দূরত্বে চলে এসেছি। মুনতাসিমের মুখশ্রীতে কোনো পরিবর্তন এল না৷ সে আগের ন্যায় গম্ভীর মুখশ্রী করে বলল,
–সত্যি কথা বলো।
–কিসের সত্যি কথা স্যার?
–এক কথা দু’বার বলা পছন্দ করি না।
–কিছু হয়নি স্যার চলুন ভেতর যাই। সবাই আপনাকে খুঁজবে।
–কাঁদছিলে কেন?
–আপনার আজ কত বড় সুখের দিন স্যার। আপনাকে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হতে দেখেছি। কিন্তু আপনার আনন্দ কোনোদিন দেখিনি। আজ আপনার আনন্দ দেখে আমার এতটা আনন্দ হচ্ছে, যে আঁখিযুগলের কার্ণিশে অশ্রুকণা এসে জমা হচ্ছে।
–অভিনয়ে তুমি ভিষণ কাঁচা তাইয়ান। পাকাপোক্ত হয়ে তারপর আমার সাথে অভিনয়ের খেলা খেলতে আসবে। আমি তোমাকে জাস্ট দশ সেকেন্ড সময় দিলাম। সত্যি কথা ছাড়া একটা অযথা বাক্য যেন মুখ দিয়ে উচ্চারিত না হয়। আমার কথা গুলো মস্তকে রেখে বলা শুরু করো।
–স্যার আমার বাবা মারা গিয়েছে। কথা গুলো বলতে গিয়েও তাইয়ানের কণ্ঠনালি কাঁপছিল। ভেতরটা অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করছে। মানুষটাকে এতদিন অবহেলা করে এসেছে সে। যে মানুষ টাকে এতদিন ঘৃণা করতো আজ সেই মানুষটার জন্য ভেতরটা হাহাকার করছে। তাইয়ানের কথায় মুনতাসিম বিস্ময় নয়নে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে কিছুটা বিস্ময় কণ্ঠে বলল,
–তুমি না বলেছিলে তোমার কেউ নেই!
–মিথ্যা কথা বলেছিলাম স্যার। আমি আসলে আমার বাবাকে ঘৃণা করতাম। যদি-ও ঘৃণার মাত্রা এতটাও প্রকোপ ছিল না। আমার মা কালো ছিল বলে আমার বাবা আমার মাকে ছেড়ে সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করে নেন। তারপর আর আমাদের কোনো খোঁজ খবর তিনি রাখনেনি। মা আমাকে অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করিয়েছে। আমি নিজেও মায়ের সাথে কাজ করেছি। আমার মা রাতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতো। মায়ের কান্না আমার বুকে ভিষণ ব্যথা দিতো। আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম। আমার মাকে সুখে রাখার মতো ক্ষমতা আমার ছিল না৷ তবে মনে মনে শপথ করে ছিলাম। মাকে আমি রাজরানীর মতো করে সাজাব। তখন আমার মা ছিল কিন্তু ক্ষমতা ছিল না। এখন আমার ক্ষমতা আছে কিন্তু মা নেই। যে মানুষটার জন্য আমার মা তিলে তিলে শেষ হয়ে গেল। সেই মানুষকে কিভাবে ভালোবাসব বলেন স্যার। আমার মা অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। বাবা তার দ্বিতীয় বিয়ের কয়েক বছর পর ফিরে আসেন। মাকে বলেন মায়ের মতো করে কেউ তাকে ভালোবাসতে পারবে না। বাবার কান্নায় মায়ের নরম মন গলে গিয়েছিল। মা বাবাকে ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু আমি মানুষটাকে ক্ষমা করতে পারিনি৷ সেদিন মায়ের ওপরে ভিষণ অভিমান হয়েছিল। পকেটে এক হাজার চারশো টাকা নিয়ে গৃহে ত্যাগ করেছিলাম। শহরে আসি কাজ করি। তখন আমি নতুন কলেজে উঠেছি। দীর্ঘ তিন মাস বাসায় যোগাযোগ রাখিনি। বাবা আমাকে অনেক মানানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ঘৃণা নামক জিনিস আমার বাবার প্রতি এসে গিয়েছিল। তারপর একদিন যোগাযোগ করলাম। মা আমাকে প্রতি মাসে পড়াশোনার খবর পাঠানো শুরু করল। জীবনটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল। আমি খুব আনন্দ নিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। আমি বাসায় ফিরে আমার মায়ের জীবিত মুখটা দেখতে পারিনি স্যার। বাবা নামক মানুষ টার ওপরে যতটুকু ভালোবাসা এসেছিল। সেদিনের পর সেটুকুও মুছে গেল। আমার মনে হলো মায়ের মৃত্যুর জন্য সে দায়ী। সে তিলে তিলে আমার মাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু আমার ধারোনাটা ভুল ছিল তাই না বলেন স্যার? আমি কোনোভাবেই সন্তান হবার যোগ্যতা রাখি না। না পারলাম মায়ের স্বপ্ন পূর্ণ করতে। আর না পারলাম বাবার সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে। আপনিই বলুন স্যার আপনি আমার জায়গায় থাকলে কি করতেন? যে বয়সে এসে আমার বাবার ভালোবাসা পাবার কথা ছিল। সে বয়সে এসে বাবার ভালোবাসা কি তা কেমন হয়? সেটাই আমি জানতাম না। তিনি ঠিকিই তার ভুল বুঝতে পেরে আমাকে আগলে রাখার চেষ্টা করছে। তাহলে আমি কেন তার সাথে মানিয়ে নিতে পারলাম না?
–তোমাকে কিছু কথা বলি তাইয়ান। আমরা হচ্ছে মানুষ আর প্রতিটি মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়। চলার পথে আমরা না চাইতেও ভুল করে বসি। তোমার বাবাও একটা ভুল করে ফেলছে। ভুল বললে ভুল হবে জঘন্যতম অপরাধ করেছে। একজন অপরাধী যখন অপরাধ করার পর অনুতপ্ত হয়। তখন তাকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিৎ। ক্ষমা হচ্ছে মানুষের মহৎ গুন। যে ক্ষমা করতে জানে সে অনেক সুখে থাকে জানো। ক্ষমা করার মধ্যেও আলাদা একটা শান্তি আছে। যা রাগ আর ঘৃণার মধ্যে নেই। রাগ আর ঘৃণা মানুষের মস্তিষ্কে বিকৃত করে দেয়। একটা সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করে তোলে। ধীরে ধীরে ধংসের দিকে ঠেলে দেয়। তোমার দোষ আমি দিব না তাইয়ান। তোমার হৃদয়ের ব্যথাটা আংশিক হলে-ও অনুভব করতে পারছি। আমাদের জীবনটা অনেক ছোট তাইয়ান। তুমি চাইলে কয়টা দিন তোমার বাবা-মায়ের সাথে সুন্দর কিছু মুহূর্ত উপভোগ করতে পারতে। কিন্তু তুমি জীবন টাকে উপভোগ করতে ব্যর্থ হয়েছ। আমি যদি আগে জানতাম তোমার বাবা বেঁচে ছিল। তাহলে অবশ্যই আমার কাছে নিয়ে এসে রাখতাম। যে মানুষটা প্রতি মাসে তোমাকে দেখতে আসতো, তিনিই তোমার বাবা? আর এতদিন যে টাকা গুলো তুমি পাঠাতে সেগুলো তোমার বাবার কাছে?
–জি স্যার বাবা অনেক অসুস্থ ছিল। প্রতিদিন অনেক টাকার ঔষধ লাগতো। আমি সেগুলো বাবার চিকিৎসার জন্য পাঠাতাম। আমাদের এলাকার একজনকে বাবার দেখাশোনার জন্যও রেখেছিলাম।
–তোমার বাবা জানতো তুমি টাকা পাঠাতে?
–জানতো স্যার।
–তিনজন মানুষ তিনজনকে এতটা ভালোবাসলে অথচ প্রকাশ করতে ব্যর্থ হলে তাইয়ান! তোমাদের জেদের কাছে হেরে গেল ভালোবাসা। তা কি ঠিক করলে বাবাকে দেখতে যাবে না।
–যাব না স্যার।
–কেন?
–না সে বাবার মতো বাবা হতে পেরেছে। আর না আমি সন্তানের মতো সন্তান হতে পেরেছি। আমাদের জীবনের ছন্দ বহু আগেই হারিয়ে গিয়েছে। আপনাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।
–এই যে এখানে এসে বসেছিলে?
–কাছেই তো ছিলাম স্যার।
–যার তৈরি হয়ে নাও।
–আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না৷
–বেশ তবে আমিও যাব তোমার সাথে চলো।
–আজকে আপনার জীবনের একটা বিশেষ দিন স্যার! আমার মতো নিকৃষ্ট মানুষের জন্য এত সুন্দর মুহুর্ত নষ্ট করবেন না। কিছু সময় জীবনে বারবার আসে না।
–আমি আর মেহেভীন বেঁচে থাকলে এমন হাজারটা মুহুর্ত কাটাতে পারব। কিন্তু তোমার বাবা পরপারে গমন করেছে! আজকের পর তুমি চাইলেও আর তোমার বাবাকে দেখতে পারবে না৷ আমি থাকতে তোমাকে এই আক্ষেপ নিয়ে বাঁচতে দিব না। তুমি তৈরি হয়ে না আমি গাড়ি বের করতে বলছি।
–আমি কোথাও যাব না স্যার।
–তোমার থেকে অনুমতি চাইছি না তাইয়ান।
–এখন গেলে কখন ফিরব?
–তোমার বাবা কখন মা-রা গিয়েছে?
–আপনাদের বিদায়ের সময় ফোন দিয়ে জানিয়েছে বাবা আর নেই।
–তাহলে কাল সকালে আসব।
–আপনি আজ আমার সাথে গেলে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হবে। তাইয়ানের আরো কিছু বলার ছিল। কিন্তু কথাগুলো কণ্ঠনালিতে এসে আঁটকে গেল।
মুনতাসিমের রাগান্বিত দৃষ্টি উপেক্ষা করার ক্ষমতা তার নেই। মুনতাসিম মেহেভীন আর রিয়াদ চৌধুরীকে জানিয়ে তাইয়ানকে নিয়ে চলে গেল। মেহেভীনকে মুনতাসিমের কক্ষে রেখে গেল শেহনাজ। সবকিছু দেখিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে বলল। তাইয়ানের বাবার জন্য ভিষণ খারাপ লাগছে মেহভীনের। তাইয়ান বড় ভাইয়ের মতো সব সময় মেহেভীনকে সাপোর্ট করে গিয়েছে। অদ্ভুত ভাবে তাইয়ানের জন্য মনের গহীনে সফট কর্ণার কাজ করছে। মেহেভীন পুরো কক্ষে চোখ বুলিয়ে নিল। সমস্ত কক্ষ জুড়ে ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে। গোলাপ আর রজনীগন্ধার সুবাস মস্তিষ্ককে মাতাল করে তুলছে। মেহেভীন আস্তরনের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ ফুলের সুবাস নিল। ব্যাগ থেকে বস্ত্র বের করে ফ্রেশ হতে চলে গেল।
চলবে…..