#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৭(১ম ভাগ)||
৫২।
“আহি কি মারটাই না দিলি। আমার তো মনে হচ্ছিলো কোনো লাইভ অ্যাকশন সিন দেখছিলাম।”
পুষ্পের কথায় সায় দিয়ে লাবীব বলল,
“আহিকে দেখে মনে হচ্ছিল লো বাজেটের স্টান্ট হিরোইন।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে লাবীবের দিকে তাকালো। রাদ বলল,
“লো বাজেটের বলছিস? তোকে তো ফ্রীতেও নিবে না।”
পুষ্প লাবীবের দিকে আঙ্গুল তাক করে ব্যাঙ্গ করে হাসতে লাগলো। লাবীব মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“তুমি এমন দাঁত দেখিয়ে হাসছো কেন?”
পুষ্প হাসতে হাসতে বলল,
“ফ্রী বাজেটের চা-ওয়ালা মামা।”
লাবীব মুখ ফুলিয়ে দ্রুতপায়ে সামনে চলে গেলো। এবার পদ্ম আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আহি, তোর এমন রূপ এই প্রথম দেখেছি। এতো রাগ তো তোর আগে ছিল না।”
আফিফ আহির দিকে তাকালো। আহিও তার দিকে তাকাতেই দু’জনের চোখাচোখি হলো। আহি চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
“প্রকৃতিই আমাকে এই রূপ দিয়েছে। আমিও গ্রহণ করে নিয়েছি। এখন থেকে এই রূপই আমার পরিচয় হবে। আবেগী আহিকে মেরে ফেলতে চাই আমি।”
শেষ কথাটি মিনমিনিয়েই বললো সে। তাই কেউ শুনতে পেলো না।
(***)
পুষ্প রাস্তার পাশে আইসক্রিমের দোকান দেখে লাফিয়ে সেদিকে চলে গেলো। বাকিরাও সেদিকে গেলো। রাদ বলল,
“কে কোন ফ্লেভারের আইসক্রিম খাবি বল?”
পুষ্প বলল, “মালাই।”
লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বললো, “বাচ্চাদের আইসক্রিম।”
“মালাই বাচ্চাদের আইসক্রিম? আচ্ছা! তো বড়দের আইসক্রিম কোনটা?”
“ভ্যানিলা!”
পুষ্প অট্টহাসি দিয়ে বলে উঠল, “কাপের ভ্যানিলা?”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আইসক্রিমে বড় ছোটদের ভাগ আছে না-কি! পছন্দে কোনো বয়স হয় না। আর মানুষের বয়স বাড়লেও তাদের মনের বয়স বাড়ে না। আমার তো চকোলেট আইসক্রিমই ভালো লাগে।”
পদ্ম আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি কী খাবেন?”
আফিফ বলল, “আগে তুমি নাও।”
“আপনি যেটা নিবেন।”
আফিফ দু’টো স্ট্রবেরি নিলো। রাদ এবার আহির দিকে তাকালো। আফিফের প্রিয় স্ট্রবেরি, তাই এতো বছর ধরে আহি যতোবারই আইসক্রিম খেয়েছে, স্ট্রবেরিই খেয়েছে। আজ প্রথম আহি চকোলেট আইসক্রিম নিলো। রাদ মনে মনে বলল,
“তুই আসলেই পাগল আহি। এতো বছর ধরে তুই নিজের পছন্দগুলো এমন একজনের জন্য দাবিয়ে রেখেছিস যে তোর কখনোই হবে না। নিজেকে এতোটা না হারালেও পারতি। যাক, পরিশেষে ভালোই হয়েছে। আজ আমি প্রথম আসল আহিকে দেখছি। এতোদিন তো সে মুখোশ পরে ছিল। আফিফের ভালোবাসার মুখোশ।”
সবাই গোল হয়ে বসে আইসক্রিম খাচ্ছে। লাবীব ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে আছে। পুষ্প কিছুক্ষণ পর পর লাবীবের দিকে তাকিয়ে হাসছে। লাবীব তো রাগে কিছু বলতেই পারছে না। তার ইচ্ছে করছে কাপটা পুষ্পের মুখে ঢুকিয়ে দিতে। পুষ্প নিজের আইসক্রিমে এক কামড় বসাতেই লাবীব পুষ্পের আইসক্রিমটা অর্ধেক কামড় বসিয়ে দিয়ে খেয়ে নিলো। পুষ্প হাঁ করে লাবীবের দিকে তাকিয়ে রইলো। লাবীব বসা থেকে উঠে বাঁকা হেসে চলে গেলো। পুষ্প মুখ ফুলিয়ে রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাদ আরেকটা আইসক্রিম এনে দিতেই পুষ্প বলল,
“এমন একটা দুলাভাই লাগবে আমার! সো সুইট।”
রাদ চোখ বড় বড় করে পুষ্পের দিকে তাকালো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কি বললি তুই?”
পুষ্প তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেলো। আহি রাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাদ আহির কাছে এসে বসে বলল,
“এতো ভাবছিস কেন? বানিয়ে ফেল পুষ্পের সুইট দুলাভাই!”
“মজা করছিস?”
“যদি সিরিয়াস হই?”
“খান সাহেব এই মজাটা সিরিয়াসলি নিয়ে অনেক কিছুই করতে পারে।”
“তাহলে আমি খান সাহেবের বিদায় হওয়ার অপেক্ষায় থাকি?”
আহি প্রতিত্তোরে হাসলো। আর আফিফ শান্ত দৃষ্টিতে রাদ আর আহির দিকে তাকিয়ে রইলো।
(***)
রাতে হোটেলের ছাদে বসে আছে সবাই। পুষ্প কোথা থেকে একটা কাচের বোতল নিয়ে এলো। লাবীব আর পুষ্প বুদ্ধি বের করেছে ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলবে। তাদের ধারণা আহি আর রাদ নিজেদের মধ্যে অনেক কথা জমিয়ে রেখেছে। আজ তারা সব সত্য বের করবে এই খেলার মাধ্যমে।
লাবীব বোতলটা টেবিলের উপর রেখে বলল,
“আগে থেকেই সবাইকে শপথ নিতে হবে।”
রাদ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কেমন শপথ?”
“যাহা বলিব সত্য বলিব, মিথ্যে বলিলে নিকটস্থ সময় অন্ধকার।”
“আচ্ছা! তুই কোন কালের জ্যোতিষী রে?”
পুষ্প বলল, “সত্য তো বলতেই হবে।”
আহি বলল, “যদি কেউ ডেয়ার নেয়?”
“ডেয়ার শুধু একবার। দু’বার করে চান্স হবে।”
পুষ্প মনে মনে বলল,
“প্রথম প্রশ্নেই তোদের মনের কথা বের করে ছাড়ছি।”
(***)
খেলা শুরু হয়ে গেলো। লাবীব বোতল ঘোরাতেই প্রথমে থামলো পদ্মের সামনে। পদ্ম মুখে হাত দিয়ে আফিফের দিকে তাকালো। পুষ্প গালে হাত দিয়ে ভেবে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাবে, তার আগেই আহি জিজ্ঞেস করলো,
“তোর বর কি তোর ছবি এঁকেছিল কখনো?”
আফিফ আর রাদ দু’জনই অবাক দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালো। পদ্ম আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“উনাকে তো বিয়ের পর ছবিই আঁকতে দেখি নি।”
“তোদের তো প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ের আগে ছবি আঁকে নি?”
আফিফ ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকালো। পদ্ম বলল,
“উহুম। আমার ছবি আঁকে নি।”
আহি আনমনে হাসলো, আর ভাবলো,
“অন্তত তোমার তুলিতে আমিই প্রথম আর শেষ জায়গাটা নিতে পেরেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু চাই না আর।”
দ্বিতীয়বার বোতল ঘোরাতে পুষ্পের দিকে পড়লো। পুষ্প কাঁধ ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
“আমার এতো সিক্রেট-ফিক্রেট নেই। যতো কঠিন প্রশ্ন করবে এই পুষ্প সহজ ভাষায় ফটাফট উত্তর দিয়ে দেবে।”
লাবীব ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমার উপর ক্রাশ খেয়েছো?”
পুষ্প তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “নো ওয়ে।”
আহি পুষ্পের উত্তরে মুখ চেপে হাসলো। রাদ এবার বোতল ঘোরাতেই আফিফের দিকে থামলো। পদ্ম এবার আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি করি?”
পুষ্প বলল,
“তোর বর সম্পর্কে তুই তো সবই জানিস। আবার কি করবি? বরং আমরাই করি।”
“না আমার একটা প্রশ্ন আছে।”
আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কী প্রশ্ন?”
“ছবিটা কার?”
আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কার ছবি?”
“যার জন্য আপনি প্রথম কবিতা লিখেছিলেন।”
আফিফ থম মেরে বসে রইলো। আহি কৌতুহলী চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বার-বার তার হাত ঘষছে। তার এমন আচরণ রাদেরও সুবিধের মনে হচ্ছে না। তার নীরবতায় যেন অনেক কিছু বলে দিচ্ছে। পদ্ম এবার মুখ ফুলিয়ে বলল,
“সব সময় আপনি এই কথাটা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। আজ না হয় বলেই দিন, ছবিটা কার?”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কিসের ছবি?”
পদ্ম বলল, “আফিফ একটা ছবি….”
আফিফ পদ্মকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“একটা খেয়ালের ছবি।”
পুষ্প অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“খেয়াল বলতে!”
আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“ভাবনা। যারা ছবি আঁকে, তারা অনেক কিছুই ভাবে। সেটাও আমার ভাবনা ছিল।”
পদ্ম বলল,
“মিথ্যে কথা বলা যাবে না কিন্তু।”
আফিফ পদ্মের দুই হাত আলতোভাবে স্পর্শ করে বলল,
“আমার প্রথম ভালোবাসা কে জিজ্ঞেস করো, আমার উত্তর হবে, পদ্মফুল।”
আফিফের কথাটা আহির বুকে তীরের মতো বিঁধলো। কি সহজেই বলে দিলো, তার প্রথম ভালোবাসা পদ্মফুল। আহির ঠোঁট কাঁপছে। রাদ শক্ত করে আহির হাত ধরলো। আহি পরক্ষণেই নিজেকে শান্ত করে রাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তবে এই হাসির পেছনে রাদ দেখতে পেলো ভয়ংকর কষ্ট।
এবার বোতল ঘোরাতে আবার আফিফের কাছে এসে ঠেকলো। লাবীবের কচকচানি মনের প্রশ্নটা সে করেই ফেললো,
“কবিতাটি কি ছিল ভাইয়া?”
আফিফ এই প্রশ্নে যেন আরো চমকে উঠলো। আহির বন্ধুগুলো কি এক রাতেই তার অতীত রহস্য ভেদ করে ফেলতে চায়ছে না-কি। পুষ্প হাততালি দিয়ে বলল,
“ভাইয়া, আমরা অপেক্ষায় আছি। কবিতাটা শুনতে চাই।”
আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে বলল,
“পরের বার যেন তোমাকে এই রূপেই দেখি,
প্রতিবারই তুমি আমার সামনে সেই রূপেই দাঁড়াবে- আমি জানি,
সাদা শাড়ি, আলতা রাঙা হাত,
চুলের ফাঁকে আমার প্রিয় অলকানন্দা ফুল গুঁজে,
আর আমি পথ সাজিয়ে রাখবো কৃষচূড়ায়,
মনে হবে আলতার ছাপ পড়ছে সেই পথের বুকে,
পরের বার যেন তোমাকে এই রূপেই দেখি।”
আহি স্তব্ধ হয়ে আফিফের দিকে তাকিয়ে রইলো। যেন মুহূর্তেই তার পুরো পৃথিবী থমকে গেছে। আফিফ চোখ নামিয়ে রেখেছে। অন্তত এবার সে আহির দিকে চোখ তুলে তাকাতে চায় না। পদ্ম আজ যে সর্বনাশটা করে দিলো, তার ভোগান্তি যে আফিফকেই পোহাতে হবে। এদিকে রাদের মনে অজানা কৌতুহল জন্ম নিলো। যদি কবিতাটি পদ্মকে নিয়ে লেখা না হয়, তাহলে আফিফ কাকে নিয়ে এই কবিতা লিখেছে?
রাদ এবার বোতল ঘোরাতেই সবার মনোযোগ আবার সেদিকে গেলো। এবার বোতলটা লাবীবের দিকে এসে থামলো। পুষ্প জিজ্ঞেস করলো,
“কারো প্রেমে পড়েছো?”
লাবীব বলল, “হুম।”
“কে সে?”
“একটা প্রশ্ন, একটা উত্তর, শেষ।”
পুষ্প চোখ ছোট করে লাবীবের দিকে তাকালো। লাবীব রাদ আর আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই দুইটা এতো সহজে বেঁচে যাবে, এটা মানা যায় না।”
পরের বার বিসমিল্লাহ বলে বোতল ঘোরাতে আবার পদ্মের দিকে এসে থামলো। পুষ্প বলল,
“তুই আমাদের তোর আর ভাইয়ার প্রেমের গল্প শুনাবি একটু পর। তার আগে এই দু’টার কাছে দুইটা প্রশ্ন করবোই করবো।”
আহি বলল,
“নো নো নো, টাইম ওভার। এখন আর খেলা হবে না।”
লাবীব রাদের কাঁধ চেপে ধরে বলল,
“রাদ, তোকে উত্তর দিতেই হবে। তোদের ভাগ্যেই পড়ে নি! এটা মানা যায় না। নয়তো আমাদের উপর অবিচার হবে।”
রাদ লাবীবকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা, কি প্রশ্ন করবি কর।”
লাবীব আর পুষ্প একসাথেই প্রশ্ন করতে যাবে কিন্তু লাবীবই আগে প্রশ্নটা করে ফেললো,
“কাউকে ভালোবাসিস?”
পুষ্প লাবীবের হাতে চিমটি কেটে বলল,
“কাউকে ভালোবাসে এটা শুনে আমরা কি করবো? আহিকে ভালোবাসে কি-না জিজ্ঞেস করতে বলেছি। গাঁধা একটা।”
আহি মুখ চেপে হাসলো। রাদ আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালো তো একজনকে বাসিই। আর আহিকে কেমন ভালোবাসি, তা আর কেউ জানুক না জানুক আমি জানলেই হবে।”
পদ্ম মুচকি হেসে বলল,
“লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবাসা হচ্ছে!”
আহি রাদের হাত ধরে বলল,
“আমরা ভালো ফ্রেন্ড, তাই না রাদ!”
রাদ আহির দিকে তাকালো। আহির চোখে ভীতি। সত্যিই যদি রাদ তাকে ভালোবেসে ফেলে, তার জন্য সে এই মুহূর্তে প্রস্তুত নয়। রাদ জানে আগে আহির আফিফকে ভুলতে হবে। তারপর তাজওয়ারের কাছ থেকে মুক্তি পেতে হবে। আর এরপরই তো রাদ তার ভালোবাসার গল্পটা শুরু করবে। এতো ঝামেলার মধ্যে প্রেম হয় না। প্রেম হবে সুস্থ মনে, শান্ত পরিবেশে।
এবার পুষ্প আহির দিকে তাকালো। আহি বলল,
“আমার সম্পর্কে বলার মতো কিছুই নেই। আমার জীবনটাই আমার কাছে রহস্য। তবে দুই লাইন গান শোনাতে পারি, যদি সবাই শুনতে চাস।”
সবাই সায় দিলো। আহি মনে মনে বলল,
“সেই সুযোগে এতো বছর পর আমি আবার তোমাকে আমার মনের কথাটা জানাতে চাই, এআর।”
আহি চোখ বন্ধ করলো, কন্ঠে ধরলো গান।
“আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে,
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
.
ভালো আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো,
দিও তোমার মালাখানি
বাউলের এই মনটা রে।
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।”
আফিফ আহির দিকে তাকিয়ে রইলো। আহির গান শেষ হতেই সবার মনোযোগ পদ্ম আর আফিফের দিকে গেলো। তাদের প্রেমের গল্পটা আহিও শুনতে চায়। আহি তো নিজের উন্মাদনা দেখেছে। আফিফ হয়তো দেখে নি। এবার সে পদ্মের উন্মাদনা দেখতে চায়। জানতে চায় কি এমন প্রেম হয়েছিল তাদের, যার নেশায় ডুবে আফিফ সেই বেনামি চিরকুটের মেয়েটাকেই ভুলে গিয়েছিল!
(***)
আফিফ আর পদ্মের দেখা হয়েছিল সিঁড়িতে। পদ্ম নামছিল নীল ওড়না মাথায় দিয়ে। এভাবেই তাদের প্রথম দেখা। চোখাচোখিতেই সমাপ্ত। দ্বিতীয় দেখা পাড়ার হিন্দু পরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠানে। আফিফ ছাদে উঠেছিল। পদ্মও সেদিন ছাদে উঠেছিল বিয়ে দেখতে। আফিফকে দেখেই লজ্জায় নেমে পড়েছিল সে।
লাজুক মেয়েরা একটু বেশিই লক্ষী হয়। আফিফও তাই ভাবতো।
তৃতীয় বার তাদের দেখা হয়েছিল রাস্তায়। ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিলো সেদিন। আফিফ দেখলো পদ্ম রিকশা পাচ্ছে না। নিজের রিকশাটা ছেড়ে দিয়েছিলো পদ্মের জন্য। ব্যস, পদ্মের মনে সেদিনই আফিফ রাফাত তার স্বপ্নের পুরুষের জায়গাটা দখল করে নিয়েছিল।
এরপর পদ্ম প্রায়ই ছাদে চলে যেতো আফিফকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার জন্য। আফিফও তাকে হাতে-নাতে ধরে ফেলতো। ভীষণ লজ্জা পেতো পদ্ম। আফিফ তা দেখে হাসতো।
ছাদে অলকানন্দা গাছ লাগিয়েছিল আফিফ। অজান্তেই পদ্ম সেই গাছে পানি দিতো। আফিফের গাছের যত্ন নিতো নীরবে নীরবে। আফিফ আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতো পদ্মের কান্ড। আর আনমনে হাসতো। তাদের কথাবার্তা শুরু হয়েছিলো এক শীতের সকালে। কনকনে শীতে শক্ত হয়ে বসে ছিল আফিফ। পদ্ম তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখেই নিজের শালটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “মন খারাপ?”
আফিফ বলল,
“না। ভাবছি কীভাবে মানুষ হওয়া যায়!”
“তো আপনি কি মানুষ নন?”
“এই সমাজে মানুষ তারাই যাদের অনেক টাকা। আর তাদেরই ভালোবাসার অধিকার আছে।”
“যদি বেকার মানুষের জীবনে ভালোবাসা আসে?”
আফিফ প্রতিত্তোরে হেসে বলল,
“বেকারদের জীবনে খেয়াল আসে। স্বপ্ন আসে৷ ভালোবাসা আসে না।”
পদ্ম আফিফের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার খুব বলতে ইচ্ছে করছিল,
“আমি আপনার ভালোবাসা হতে চাই।”
কিন্তু পদ্ম বলতে পারলো না। এভাবেই কেটে গেলো এক বছর। এই এক বছরে বেশ কথাবার্তা জমলো আফিফ আর পদ্মের। আফিফের মনে হলো পদ্ম প্রেমিকা হিসেবে মন্দ নয়। আর সে এতোটুকু বুঝে গেছে পদ্ম তার কাছে ভালোবাসি শব্দটা শোনার অপেক্ষায় আছে। আফিফও এক বছর পর মাকে এই ব্যাপারে জানালো। আফিফা বেগম অজানা কারণে বার-বার পদ্মকে মেনে নিতে চাচ্ছিলেন না। আফিফ বেশ বুঝতে পেরেছিলো মায়ের অজানা কারণটা কি। কিন্তু সেই কারণটির কোনো ভিত্তিই নেই। শেষমেশ আফিফের ছোট বোন এসেই মাকে রাজি করিয়েছে। তারপর একদিন আফিফ ভোরে উঠেই পদ্মকে ছাদে আসতে বলল। পদ্ম ছাদে আসতেই আফিফ হাঁটু গেড়ে বসে অলকানন্দা ফুল এগিয়ে দিয়ে পদ্মকে বলল,
“তুমি কি আমার মনের পুকুরের পদ্মফুল হবে?”
পদ্ম এক সেকেন্ডও দেরী করলো না। ফুলটি নিয়েই বলল,
“হুম, অবশ্যই হবো।”
……………….
পদ্ম অতীতের ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে এলো। তারপর মুচকি হেসে আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এটাই ছিল, আমাদের প্রেমের গল্প। ছোট্ট কিন্তু ভীষণ মিষ্টি।”
আহি উঠে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে বলল,
“আর এরপর তুই এসে আমাদের বিয়ের দাওয়াত দিলি, আর আমি বর্ষার রাতে তোর বিয়ে খেয়ে বাসায় ফিরলাম।”
আফিফ আহির কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। আহি হেসে বলল,
“ভীষণ সুন্দর ছিল তোদের গল্পটা। আমার প্রেমের গল্পটাকেই হার মানিয়ে দিয়েছে।”
পদ্ম বলল, “তোরটা তো সাংঘাতিক ছিল।”
আহি মনে মনে বলল,
“অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো হয় না। যেমন আমার অতিরিক্ত ভালোবাসা হেরে গেছে তোর ছোট্ট আর মিষ্টি প্রেমের কাছে। আমার চিরকুটগুলো হারিয়ে গেছে তোর লাজুক হাসির কাছে। আমার প্রকাশিত অনুভূতিগুলো হেরে গেছে, তোর না বলা অনুভূতির কাছে। আমিই তো হেরে গেছি, আমার প্রেমিকের কাছে।”
চলবে-