#এলোকেশী_সে
#মাহমুদা_লিজা
পর্বঃ১৮
সন্ধ্যার পরের এই সময়টায় বাড়ির রমণীরা আড্ডায় মাতে। টুকটাক তোড়াও হা হয়ে গিলে সেসব আড্ডার মুখরোচক সব আহ্লাদ। আজ তাকে না দেখে অনিমা গেল ডাকতে। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা ছোট্ট পরীটাকে পরম মমতায় ছুঁয়ে দিয়ে বলল -“তোড়া, তোড়ারে! কিরে এবেলা ঘুমাচ্ছিস কেন?”
জ্যেঠীমায়ের কোমল স্বরটা শুনেও মাথা তুললো না তোড়া। ঘুমের ভান নিয়েই শুয়ে আছে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অনিমা ফের শুধালো -“শরীর খারাপ নাকি মা? অবেলায় শুয়ে আছিস কেন?”
নিজেকে আর সংযত রাখতে পারল না তোড়া। হুড়মুড় করে উঠে বসেই ঝাপটে ধরল জ্যেঠীমাকে। মানুষটার বুকে মুখ গুঁজে সময় নিয়ে কাঁদল। অনিমাও জড়িয়ে রেখেছে পরীকে। মাঝেমাঝে নাক টানার শব্দ আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ ছাড়া কোন শব্দ এলোনা ঐ ঘর থেকে। নিজের ইস্পাত কঠিন খোলসের আড়ালে দগদগে হৃদয়ের একেকটা ক্ষত স্মৃত হতেই কান্নার তোড় বাড়ে তার। সব কষ্টকে ছাপিয়ে যাওয়া অহনের প্রত্যাখ্যান তাকে পুরোদমে ভেঙেচুরে গুটিয়ে দিয়েছে। সবে ডানা মেলতে চেয়েছিল সে কিন্তু তার আগেই নিষ্ঠুর শিকারীর শায়কের আঘাতে সম্পূর্ণ শরীরটাই মুষড়ে থুবড়ে পড়েছে মাটিতে।
অনেকটা সময় পর শান্ত হলো তোড়া। জ্যেঠীমায়ের বুক থেকে মুখ তুলে নাক চোখ মুছে নিল। মলিন হেসে বলল -“পরীক্ষা খুব বাজে হয়েছে জ্যেঠীমা। কিচ্ছুটি মনে আসছিলো না অথচ সব পারতাম।”
তোড়ার বাচ্চামোতে ভুলল না অনিমা। কঠিন চাহনিতে দেখছে তোড়াকে। কালে ভদ্রে তোড়াকে কাঁদতে দেখেন তিনি। মায়ের অসুস্থতার দিনগুলোতেও কখনো হেঁচকি তুলে কাঁদেনা মেয়েটা। আজকের কান্নাটা সাধারণ কোন কান্না নয়। কান্নার হেতু খুব গভীরে, যার উদঘাটন করা তার পক্ষে মোটেও সম্ভবপর হবে না। তবুও স্বাভাবিক স্বরে বলল -“নিচে চল।”
ডানে বায়ে মাথা দুলিয়ে সে জানাল তার পড়া আছে। আজ নিখাদ অভিনিবেশ রাখতে হবে নয়ত পড়াটা মোটেও আত্মস্থ হবেনা। নীরবে সটকে পড়ল অনিমা। আবারও না চাইলেও যোগ দিতে হলো সাঁঝের আড্ডায়। কয়েক পাক রুবাবাকে লক্ষ্য করে অমনোযোগী মানুষটা। বিচক্ষণ অনিমা আজ জা’য়ের আদলেও পেল হা-হুতাশের ছাপ।
আড্ডার জমজমাটি উপেক্ষা করে অনিমার মন পড়ে রইল উপরের ঘরটায়। এদিক সেদিক তাকিয়ে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণিত পদক্ষেপে এগিয়ে গেল শাশুড়ির ঘরের দিকে। নিজের মনস্কামনা সাধন করতে হলে এই মানুষটার দারস্থ হতেই হবে তাকে। মায়ের কথার পৃষ্ঠে ফের আজ্ঞা রাখেনা তাঁর সন্তানেরা। রুবাবাকে মানাতে পারলেও নিজাম মজুমদারের ব্যাপারে দোটানায় আছেন তিনি নিজেও। মানুষটার অনিয়ন্ত্রিত গতিবিধিতে যারপরনাই অসন্তোষ আছে অহনের। আর অহনের তীব্র আক্রোশে বিদ্বিষ্ট নিজাম মজুমদার। একে যেন অন্যের প্রতিপক্ষ। সব ভাবনায় বুঁদ হয়ে শাশুড়ির দরজায় পা রাখল অনিমা। ঠোঁট রাঙিয়ে পান খাওয়া প্রৌঢ়া রমণী বসে বসে তসবিহ জপছেন সৃষ্টিকর্তার নামে। বড় ছেলের বউকে দেখে ঠোঁটজোড়া প্রশস্ত হলো খানেক। হাতের ইশারায় পাশে বসতে বললেন ছেলের বউকে।
ইঙ্গিত পেয়ে শাশুড়ির সামনে টুল টেনে বসল অনিমা। শাড়ির আঁচলে ঝুলতে থাকা সুতোটা আঙ্গুলে পেচিয়ে সে বলল -“একটা আবদার করতে এসেছি আম্মা।”
ছেলের বউয়ের ইতস্ততবিক্ষিপ্ত চাল-চলনে গভীর কিছু আঁচ করে শাশুড়ি অভয় দিলেন তাকে -“কি কইবা, কইয়া ফালাও।”
আশেপাশে সাবধানী কায়দায় নজর বুলিয়ে ক্ষীণ আওয়াজে বলল -“আপনার বড় নাতীর বিয়ের কথা বলতে এসেছি আম্মা।”
অনিমার অস্হিরতায় ভাঁটা দিতে মেহেরজান শুধালো -“বউ দেখছো নি?”
এবার গলা শুকিয়ে এলো অনিমার। শুকনো ঠোঁটেজোড়া ভেজাতে জিভের আগাটা বের করল একটুখানি। আমতা আমতা ভাবটা সহসা ভর করেছে। মনে সাহস সঞ্চার করে চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস টেনে তিনি বললেন -“আম্মা, আমি তোড়ার কথা ভেবেছিলাম, ওকে নতুন করে আর কি দেখব?”
রাঙা টুকটুকে ঠোঁটজোড়া এবার প্রসন্ন হাসিরা দখলসত্ত্ব নিল। অন্তরের অন্তস্তল থেকে বেরিয়ে এলো -“আলহামদুলিল্লাহ, তয় তোমার আউস পুরা করার দায়িত্ব কি তুমি আমারে দিতাছো? যদি এমন কিছু ভাইবা থাকো তাইলে আমি চেষ্টা করুম আর সব আল্লাহর হাতে।”
শাশুড়ির পূর্ণ সমর্থন পেয়ে সহাস্য বদনে অনিমা বলল -“তাহলে আম্মা বেশি দেরী না করলেই ভালো হতো। বড়টার আগে ছোটটা বিয়ে করে বসে আছে, বড়টার বিয়েটা তাড়াতাড়ি হলেই ভালো হবে।”
বউয়ের শেষোক্ত যুক্তিতে অসমর্থন করলেন মেহেরজান। চোখে চশমাটা ঠেলে দিয়ে বললেন -“আমার নাতনীর পরীক্ষা চলতাছে, পরীক্ষাটা শেষ হউক। তহন সময় কইরা তারিখ ঠিক করন যাইব। পোলা মাইয়া দুইডাই এই বাড়ির। আনন নেওনের কোনো তাল বেতাল হইব না।”
শাশুড়ির মতকে সম্মান দিয়ে অনিমা বলল -“রুবা যদি অমত করে আম্মা!”
পানের পাত্রটা খুলে রুবার সাজানো পানটা মুখে পুরে দিয়ে মেহেরজান বলল -“আমার উপ্রে ছাইড়া দেও। যাও পোলার বিয়ার গোছগাছ করো। পোলার বউর লাইগাও গোছগাছ করো। আমার নাতনীর জানি কোন কিছুর অভাব না পড়ে।”
কিশোরী বয়সে এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিল অনিমা। মাতৃস্নেহে তাকে আগলে নিয়েছিলেন মেহেরজান। কোন ভুলচুক হলে যখন অনিমা ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত, তখন পরম আহ্লাদে কাছে টেনে আদরমাখানো শাসন করে বলতেন -“এত ডর করো ক্যান, আমি কি তোমারে খাইয়া ফালামু?” আজও সেই আস্হার অন্যথা হলোনা। আজ বউ থেকে শাশুড়ি হওয়ার এই ক্ষণটায়ও নিজের পুত্রবধূর পরম বিশ্বাসের আধার প্রৌঢ়া রমণীকে আপ্লুত করেছে আবেগে। ছলছল আঁখিজোড়া নিয়ে অনিমার পানে পেলব হাতজোড়া বাড়িয়ে দিলেন। শাশুড়ির আহ্বানে ঐ ভরসার কোলটায় নিজের মাথা রেখে অনিমা বলল -“আম্মা, আমার মা না থাকার আফসোস কিন্তু আপনাকে পেয়ে মিটে গেছে।”
মেহেরজান হেসে বললেন -“আমারও মাইয়ার অভাব মিটছে তোমাগো তিনটারে পাইয়া।”
*********************
গমগমে আওয়াজ তুলে পড়ছিল তোড়া। বার কয়েক অনু ঘুরে গিয়েছিল আশেপাশে। প্রিয় বান্ধবীর উপস্থিতিও আজ তাকে প্রসন্ন করতে পারল না। অবশেষে অনুর ডাকেই গভীর মনোযোগের ছেদ হলো। মলিন হেসে শুধালো -“কিছু বলবেন?”
বান্ধবীর অমন নির্লিপ্ততা হজম হলোনা অনুর। মুখ ভার করে বলল -“আপনি করে বলিস কেন, তুই বদলে যাচ্ছিস পরী। তোর পরীর মত চেহারা আজ পেত্নীর মত রাখছিস কেন? শা/লা তোকে আর পরী ডাকব না আমি।”
অনুর হাতটা টেনে নিজের হাতে রেখে তোড়া জবাব দিল -“আমাদের সম্পর্কের নাম বদলেছে। এখন আপনি আমার বড় ভাইয়ের স্ত্রী। সম্পর্ককে সম্মান করতে হবে। সম্পর্কের নাম বদলালেও আমাদের বোঝাপড়া বদলাবে না। অহেতুক ‘আপনি’ – ‘তুমি’ নামক শব্দে না আঁটকে আমার ভাইয়ের সেবা করুন। বেচারা কঠিন কসরত করেছে আপনাকে পাওয়ার জন্য।”
বিষণ্ন মুখচ্ছবিতেও ফুটে উঠেছে ক্ষীণ হাসি। সইয়ের সাথে একটুখানি খুনসুটিতে মেতে উঠল তোড়া। ড্রেসিং টেবিল থেকে চিরুনিটা এনে অনুর চুল আছড়ে দিতে দিতে বলল -“ভাইয়া কখন আসবে কিছু জানেন?”
উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে অনু জবাব দিল -“একটু পরই আসবে।”
এরপর অনুর অবিরত বকবক হজম করল তোড়া। তার চুলে হাত খোঁপা করে দিয়ে বলল -“মাফ করেন ভাবী সাহেবা, কানের পোকা নড়ে গেল। দয়া করে বরের ঘরে গিয়ে তার কান ঝালাপালা করার প্রস্তুতি নিন। ধন্যবাদ, পরে দেখা হবে।”
তোড়ার বলা কথায় চোখ পিটপিট করে অনু বলল -“অপমান করছিস?”
ঠোঁটজোড়ায় অনেকখানি ফাঁকা করে চোখ বড়বড় করে তোড়া শুধালো -“আপনার মান আছে?”
ব্যস অমনি লেগে গেল ধুন্ধুমার ঝগড়া। অনুর নজর গেল টেবিলে রাখা পানির বোতলের দিকে। তোড়াকে কথায় ব্যস্ত রেখে পানির বোতলটা এনে সব পানি ঢেলে দিল তার মাথায়। মৃদু চিৎকার দিল তোড়া। বোতলটা তোড়ার মুখে ছুঁড়ে দিয়ে অনু ছুটে পালাল অয়নের ঘর অভিমুখে, তোড়াও ছুটলো পিছু। অনু ঠিকঠাক পালাতে পারলেও তোড়ার ছোট্ট দেহটার সংঘর্ষ হলো শক্ত কিছু একটার সহিত। আশেপাশের কোন অবলম্বন হাতড়ে না পেয়ে সে ছিটকে পড়ল মেঝেতে। ‘আহ’ শব্দে উচ্চারিত হলো মৃদু আর্তনাদ। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখতেই চক্ষু স্হানচ্যুত হওয়ার উপক্রম হলো। তার মাস্টার মশাই সটান দাঁড়িয়ে তার পেছনে। হাতের কনুইটা ঘষতে ঘষতে উঠে দাঁড়াল তোড়া। ব্যাথাতুর চাহনি ক্ষণিকের জন্য মিলিত হলো। দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনে পা বাড়াতেই তোড়া টের পেল কোমরেও ব্যাথা লেগেছে। ওটুকু ব্যাথা আমলে না নিয়ে খুঁড়িয়ে চলতে লাগল সে। সেকেন্ডের ব্যবধানে বাঁধা পেল। কলমি লতার ন্যায় কোমল হাতখানায় কারো দৃঢ় টান অনুভব করল। পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারল মানুষটার পরিচয়। হাত ছাড়িয়ে নেয়ার অব্যাহত প্রয়াস চালালেও বিশেষ কোন লাভ হলো না। পোক্ত হাতটার শক্ত বাঁধনটা ঢিলেও হলোনা বিন্দু পরিমাণ। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে তোড়া মানুষটার নিমিত্তে বলল -“ছাড়ুন।”
মুহূর্তেই বাঁধন আলগা হলো। তোড়াও এগিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গিয়ে বিছানায় বসল। দৃষ্টিগোচর হলো ব্যাথানাশক মলমটা। দৃষ্টি উঁচুতে রাখতেই মানুষটাকে দেখে কপাল কুঁচকালো। আদলে বিরাজমান বিদ্বিষ্ট ভাব। শীতল চাহনিতে থাকা মানুষটার নজর থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই আজ্ঞাপিত হলো -“তাকান আমার দিকে।”
নুইয়ে রাখা মাথাটার অবস্থান বদল হলো না। বিরহের দৃষ্টি তখন মেঝেতে নিবদ্ধ। অহন এবার শুধালো -“অভিযোগ না অভিমান!”
ঈষৎ হাসল তোড়া, মৃদু স্বরে জবাব দিল -“কিছুই না।”
শীতল স্বরটাকে গম্ভীর করে অহন বলল -“আপনার আচরণ আমায় কষ্ট দিচ্ছে। পরবর্তীতে আবার অনুতাপ ঘিরবে না তো আপনাকে?
অহনের আধো উক্ত বাক্যে প্রীত হলো না তোড়া। পূর্বের ন্যায় কাঠিন্য বজায় রেখে বলল -“কষ্ট পাওয়ার কোন কারণ নেই তো! কি বিশেষ হেতু, আমার আচরণে আপনি কষ্ট পাওয়ার?”
গলা খাদে নামিয়ে কোমল স্বরে অহন শুধালো -“কবে নাগাদ এই সান্নিধ্যের ছোঁয়ায় আগমন ঘটবে আপনার? আমার তৃষিত হৃদয় আপনার সামীপ্যের অপেক্ষায়? আপনার মৌন অবজ্ঞা আমাকে চুরমার করে দিচ্ছে।”
ভ্রু কুঁচকে চোখজোড়া ছোট করে তোড়া শুধালো -“হেয়ালী করছেন কেন?”
এলোকেশীর জবাব দেয়ার জন্য মুখ খোলার আগেই তিড়িং বিড়িং করে এগিয়ে আসা অনু থমকে দাঁড়াল। অপ্রস্তুত কায়দায় দাঁড়িয়ে রইল ভ্যাবলকান্তের মত। অহনের শীতল মেজাজ দপ করে জ্বলে উঠল, অনুর অসময়ী আগমনে মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
চলবে…….