এলোকেশী_সে #মাহমুদা_লিজা পর্বসংখ্যাঃ১৯(বিবাহ স্পেশাল)

0
374

#এলোকেশী_সে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বসংখ্যাঃ১৯(বিবাহ স্পেশাল)

রাতের খাবারের পরপরই বসার ঘরে সবাইকে ডেকেছেন নিজাম মজুমদার। খুশির খবরটা সবার সাথে ভাগাভাগি করতে চান তিনি। ছোটখাটো আয়োজনেও যেন জৌলুস থাকপ ভরপুর। বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা।
একে একে সবাই এসে উপস্থিত হলেও তোড়া স্বভাবতই নিজের ঘরেই অবস্থান করল।
শাশুড়ির পাশে সোফার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অনু। রুবাবা নির্লিপ্ত। সে ঘর ছেড়ে আর এমুখো হয়নি।

রুদ্ধদ্বার বৈঠকের উত্তেজনা চলছে যেন। সবার উৎসুক দৃষ্টি নিজাম মজুমদারের পানে নিবদ্ধ। তেজস্ক্রিয় বোমার বিস্ফোরণের আদলে তিনি ঘোষণা দিলেন -“আগামী শুক্রবার তোড়ার আকদের আয়োজন করা হবে। আজই জাকারিয়া জানিয়েছে, সে শিগগিরই তোড়াকে বিয়ে করতে চায়৷ পড়াশোনা নিয়ে কোন হেলাফেলা করবে না, সবটা সামলে নিবে সে-ই।”
ছেলের কথায় চরম আপত্তি মেহেরজানের। জোরালো স্বরে জানালেন তুমুল নাখোশের বাণী -“আমার নাতনীর পরীক্ষা শেষ হওনের আগে কোন তামাশা চলব না। মাইয়া সম্বন্ধে এতদিন যেমন হেয়ালী আছিলি, তেমনি থাক। অধিকার দেহাইতে আসবি না।”
অনিমার বুকে ঠাসঠাস করে যেন দামামা পেটাচ্ছে। স্বামীর পানে চাইলেন অসহায় চাহনি নিয়ে। নির্বাক নাঈম মজুমদার যেন জানতেন এই সাধের পরিণতি, তাইতো তিনি মূক হয়েই রইলেন। অনিমার বুকের ভেতরটা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে যেন। তখনই নিজাম মজুমদারের ফের বিস্ফোরিত মন্তব্য -“আমি জাকারিয়াকে কথা দিয়ে এসেছি, আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ আমায় চিন্তিত করে। অমন অমায়িক ছেলেটা তোড়ার জীবনে এলে ও ভালো থাকবে।”
মেহেরজান সবে মুখ খুলছিল প্রত্যোত্তরে হুংকার করার, তার আগেই জবাব এলো অহনের দিক থেকে -“আঠার বছরের মত সময় ও আপনার চিন্তিত হওয়ার প্যারা থেকে যেভাবে বেঁচে আছে, ঠিক সেভাবেই বাকি জীবন পার করবে। অতিরিক্ত চিন্তা আপনার শরীরের জন্য ক্ষতিকর হবে কাকা।”
অহনের আচার আচরণ খুব একটা যুতসই লাগেনা এই মানুষটার নিকট, তার উপর এমন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় তার অনধিকার চর্চায় রীতিমতো ফোঁস করে উঠলেন তিনি -“আমার মেয়ে আর আমার মাঝে কথা বলার তুমি কে? আমাদের বাবা-মেয়ের ব্যাপারে তুমি কথা বলো না একদম।”

নিজাম মজুমদারের স্বার্থপরতায় থমকালো অহন, তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল -” আপনার আর আপনার মেয়ের ব্যাপার হলে আমাদের কেন ডেকেছেন? এটা যৌথ পরিবার মেজ কাকা, আপনার মতামতে সবাই সমর্থন জানাবে এটা ভাবা ভুল, তাছাড়া তোড়া আপনার মেয়ে হলেও আপনি ওর দায়-দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ অবহেলা করেছিলেন। তখন কোথায় ছিলো আপনার প্রাইভেসি? কোথায় ছিল আপনার মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা?”

অহনের মোক্ষম তিতকুটে জবাবে জব্দ নিজাম মজুমদার তেতে উঠে বললেন -“যৌথ পরিবারে থাকলে যদি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে আমার আর আমার সন্তানের সহিত দূরত্ব বাড়ানোর প্রবণতা এভাবেই চলতে থাকে তাহলে আমি আলাদা হতে দু’দন্ড ভাবব না।”
ছোট ভাইয়ের কথা শুনে গর্জে উঠলেন নাঈম মজুমদার -“অহন তো ভুল কিছু বলেনি? সত্যি কথা শুনলে আঁতে ঘা তো লাগবেই। আর তোড়ার বিয়ে যদি তোর পার্সনাল ম্যাটার হয় তাহলে এসবে আমাদের আর ডাকিস না।”
বাবার কথা শুনে দ্বিগুণ তেজে গর্জে উঠলো অহন। মুষ্টিবদ্ধ বা’হাতটা দিয়ে সজোরে সেন্টার টেবিলে ঘুষি মারল অহন। ঝনঝন শব্দে টেবিলের কাচ ভেঙে চুরচুর হয়ে ধূলোতে লুটালো। তার অগ্নিরূপের সাথে বাড়ির সকলে পরিচিত হলেও অনু অজ্ঞাত ছিল। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে শাশুড়িকে ঝাপটে ধরল।
এতক্ষণের উচ্চবাচ্য ভাঙচুরের শব্দে রূপান্তর ঘটার পর পরই তোড়া ঘর ছেড়ে হন্তদন্ত হয়ে নেমে এলো৷ রুবাবাও দৌড়ে এলো বসার ঘরে। শ্যামবরণ হাতটা লোহিত বর্ণে রঞ্জিত হলো। ঘন ঘন নিশ্বাসের দরুণ পুরুষ্টু বুকটা উঠানামা করছে অনবরত। ক্রোধে ফুঁসছে ছেলেটা। অয়ন নিঃশব্দে ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়ালেও সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরীর হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হলো। ঐ হাত বেয়ে গড়িয়ে পড়া লোহিত যেন তার মনটাকে ধারালো তরবারির তেজে ফালাফালা করে দিচ্ছে।
অনিমা আর্তনাদ করে উঠল। এগিয়ে এসে ছেলেকে আগলে নিতে চাইল কিন্তু কঠিন বাঁধা দিল ছেলেটা নিজেই। অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে নিজাম মজুমদারের পানে চেয়ে হুশিয়ারি বার্তা শুনালো -“সমাজের আবর্জনাগুলো স্রেফ গায়েব করে দিতে মন চায়। রক্তের কাছে হার মানে বিবেক। নয়ত কবেই খু/নী/র তকমা গায়ে লেগে যেত!”

কাউকে ফিরতি জবাব দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই লম্বা লম্বা পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল অহন। অয়নও পিছু নিল ভাইয়ের, যাওয়ার সময় অনুকে ইশারা করে গেল আসর ত্যাগ করার জন্য।

*************

বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল অহন। ভাইয়ের হাতে আগলে রাখা নিজের হাতটা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সয়ে নিল। নীরব বিরহ যন্ত্রণার কাতরানির তীব্রতা ঐ কাঁচের টুকরো দিয়ে কেটে যাওয়ার যন্ত্রণাকে ম্লান করে দিয়েছে।

কাঁচের ছোট্ট কণাটা তীর্যকভাবে আঙ্গুলের পিঠে গেঁথেছে। অয়ন আলতো করে আঙ্গুলে চাপ দিতেই ‘উহ’ শব্দ করে হাত টেনে সরিয়ে নিল অহন। অনু এসে অয়নের পেছনে দাঁড়িয়েছে। অয়ন ফের টেনে নিল ভাইয়ের হাতটা। ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো মানুষটা। তখনই ভেসে এলো সেই পরিচিত কোমল, কিন্নরী স্বরটা -“ভাইয়া আপনি সরেন, আমি দেখছি।”
এলোকেশীর অপ্রত্যাশিত আগমনে চমকালো অহন। মুখ তুলে চাইল কাঙ্খিত রমণীর পানে। ততক্ষণে অয়নকে সরিয়ে মাস্টারমশাইয়ের হাতের দখল নিলো তোড়া। কলমি লতার ন্যায় চিকন চিকন আঙ্গুলের সাহায্যে চেপে ধরল অহনের শক্তপোক্ত হাতটা। অপর হাতের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলির শক্ত যুগলে কঠিন টান দিয়ে বের করে আনল টুকরো কাচটা। লাল উষ্ণ তরলের স্রোতটা এবার বেশ জোরালোই হলো। নিজের ফিনফিনে সুতোর ওড়নাটার কোণাটা দিয়ে চেপে ধরল উষ্ণ তরলটার বেগ থামাতে। শারীরিক মানসিক সব ধরনের ঝরা বিস্মৃত হলো অহনের। অপলক চেয়ে দেখল তার যন্ত্রণায় এলোকেশীর উদ্বিগ্নতা।
অয়নের পরিপক্ব মানসিকতা আঁচ করল এই স্বল্পভাষী কিশোরীই পারবে অশান্ত পুরুষটাকে সামলে নিতে। স্ত্রীকে ইশারায় সরিয়ে দিয়ে নিজেও সুযোগ বুঝে সটকে পড়ল।

গভীর মনোযোগ দিয়ে ক্ষতস্হানে গজ পেচিয়ে দিচ্ছে তোড়া। নীরবতার জাল কেটে শুধালো -“নিজে যদি বাবা-মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে পারেন, তাহলে আমার বেলায় অন্য মত কেন খাটবে?”
এলোকেশীর খোঁচা দেয়া কথাটা গম্ভীর মুখটাকে স্বাভাবিক করে দিল। এক চিলতে হাসি দিয়ে অহন বলল -“নানার বাড়ি আর মামার বাড়ি এক হলে নতুন করে আলাদা আলাদা সম্বোধন করা লাগে নাকি?”
গজটায় গিট দিতে দিতে তোড়া বলল -“ব্যস, কাজ শেষ। এবার একটা পেইন কিলার খেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ুন।”
মেঝেতে জমাট বাঁধা রক্ত ফোঁটা মুছে নিজের ঘরের পানে পা বাড়াল তোড়া। তার গতি রোধ করল অহনের শীতল কন্ঠধ্বনি -“পুরো আমিটার দায়িত্ব নিবে কখন? তোমার একবাক্যে সকল বন্ধকতায় নিমেষেই ভাঁটা পড়বে। একবার জানিয়ে দাও। আমি দাদুকে বলে আজই ব্যবস্হা করব সব।”

মানুষটার হৃদয়াবেগ মিশ্রিত তীব্র আহ্বানের কাছে বন্দীনি হলো তোড়া। মাঝে মাঝে স্বল্প সময়ের ব্যবধানেও বড়সড় সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন পড়ে যায়। নয়ত বয়ে যেতে পারে ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব। ভাবি পরিস্থিতির ছোবল আঁচ করে মৃদু হাসল সে। সে উপলব্ধি করতে পারছে সামনের মানুষটার অন্তর্দহন। নুইয়ে রাখা মাথাটা তুলে সরাসরি প্রশ্ন করল -“ততটুকু স্পর্ধা রাখছেন? আপনার সাহস থাকলে আমার তরফ থেকে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।”
প্রেয়সীর আকুন্ঠা স্বীকারোক্তিতে কাঙ্খিত জবাব পেয়ে অহন শুধাল -“আপনার নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কাও করতাম না, আমিতো জাস্ট ফরমালিটি করেছি। মিরানকে বলে দিয়েছি, কাজী আসছে বলে। আপনি তৈরী হন, আপনার স্বার্থপর বাবার সকল চিন্তার অবসান ঘটাতে চাই। প্রতিদিন এত প্রেসার নিতে পারব না। আপনার বিয়ে বিষয়ক কর্মশালায় প্রতিদিন উপস্থিত থেকে নিজের বুকে ব্যাথা বাড়াতে চাইনা। তারচেয়ে বরং আজই সকল নাটকের যবনিকা ঘটুক। এই দিনটা নিয়ে যত স্বপ্ন ছিল সব জলাঞ্জলি দিয়ে চোরের মত বিয়ে করব ভাবতেই আমি হতাশ।”

অহনের ঘরটা ছেড়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল তোড়া। তার গমনের পরপরই দ্রুত পদে বেরিয়ে এলো অহন নিজেও। সোজা মেহেরজানের ঘরটায় এসে উচ্চশিরে বলল -“দাদু, নিত্যনতুন যন্ত্রণায় আর পুড়তে চাইনা। আপনি বাবা আর আম্মাকে ডেকে বলে দিন আপনার নাতনীকে আজই বিয়ে করতে চাই। আমি প্রতিদিন কারো প্রাইভেট ম্যাটারে ইন্টারফেয়ার করার তকমা নিতে চাইনা।”
মুখে পান গুঁজতে গুঁজতে মেহেরজান বললেন -“আইতে কও তাগোরে। কাজী ডাকনের ব্যবস্হা কর। আমার নাতনীরে বিয়া আমি দিমু।”
কলিকে উচ্চশব্দে ডাকল মেহেরজান। বসার ঘরে ফের আহ্বান করলেন সবার উপস্থিতি।

ভয়ে ভয়ে সবাই উপস্থিত হলো প্রৌঢ়া মেহেরজানের আজ্ঞাপিত আদেশ পেয়ে। দীপ্ত বলীয়ান কন্ঠে ভণিতাহীন আওয়াজ ছাড়লেন তিনি -“আইজ এই মুহূর্তে আমার অহনের লগে তোড়ার বিয়ার ব্যবস্হা করতাছি। কারো কোন আপত্তি থাকলে পরে কতা কমুনে। আপাতত বিয়ার বর-কন্যার কোন আপত্তি নাই।”

নিজাম মজুমদার চিৎকার করে বললেন -“আমি মানিনা এই বিয়ে। অমন অসভ্য ছেলের সাথে আমার সহজ সরল মেয়ের বিয়ে দেব না।”
ছেলের অমতের জবাবে পাল্টা যুক্তি মেহেরজানের -“অথচ তোর মাইয়া রাজি বিয়াতে। তোড়ার সকল দায়িত্ব আমি পালন করছিলাম, সেই অধিকারে আমি এই সিদ্ধান্ত নিছি। তোর কোন বাঁধা আমি মানুম না।”
অনিমা খুশিতে গদগদ হয়ে কলিকে জড়িয়ে ধরে বলল -“তাড়াতাড়ি যা, তোড়াকে সাজিয়ে আন।”
অনুতো বিষম খেলো রীতিমতো। সিঁড়ি বেয়ে ছুট লাগালো তোড়ার ঘরে। বসার ঘরে মা-ছেলের চরম বাকবিতন্ডায় অহন নীরব দর্শক। অয়ন খুশিতে দিশেহারা হয়ে বলল -“মেজ কাকা থামুন তো। আগে মিষ্টি খাওয়ান, পরে শ্বশুর হওয়ার আনন্দে গ্র্যান্ড ট্রিট দিয়েন।”
রুবাবার মৌনতায় সন্তুষ্ট মেহেরজান। অমন আঁধার রাত্রিতে মজুমদার বাড়িতে হুলস্হুল লেগেছে বিয়ের ধুমে।

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here