#এলোকেশী_সে
#মাহমুদা_লিজা
পর্বঃ১০
ত্রিকোণমিতির সমস্যাগুলো সমাধানের এক পর্যায়ে অহন ব্ল্যাকবোর্ড থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। পাশ থেকে ফিসফিস কথার শব্দ তার কান এড়ায়নি। সেদিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে আওয়াজ দিল -“ক্লাস ভালো না লাগলে বেরিয়ে যাও। আউট!”
ব্যস পুরো কক্ষের ছাত্রীরা তখন শোক দিবসের নীরবতা পালন করার মত নিশ্চুপ। হাত থেকে চকটা ডেস্কে রেখে সে পুনরায় বলল -“আজ আর কোন সমস্যার সমাধান করব না। আজ তোমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানাব। তোমাদের মূল্যায়ন পরীক্ষা কিন্তু সন্নিকটে। বলতে পারো নিশ্বাস নাকের আগায়। তোমরা পড়ায় মনোযোগ দাও। মূল্যায়ন পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে অন্যদের কথা জানিনা তবে আমার সাবজেক্টে কোন অঘটন ঘটলে পরীক্ষায় বসতে দেবো না। আমাকে প্রেমপত্র না পাঠিয়ে সময়টা পড়াকে দাও। পরবর্তীতে কেউ এই ধৃষ্টতা দেখালে আমি প্রিন্সিপালকে ইনফর্ম করব। আজ নিয়ে অষ্টম বার আমাকে বিরক্ত করা হয়েছে।”
অহনের গুরুগম্ভীর প্রতিটা বাক্য শুনে ভয়ে আড়ষ্ট হলো মেয়েরা। মাথা নুইয়ে লজ্জা আড়াল করতে চাইছে তারা। প্রেমপত্র দেয়া মেয়েটির দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কক্ষ ত্যাগ করল অহন। বারংবার একই কাজ রীতিমতো তাকে অপ্রস্তুত করে তুলছে ধীরে ধীরে।
করিডোর পেরিয়ে সিঁড়িতে পা রাখতেই নিজের মুঠোফোনের কম্পন অনুভব করল অহন। পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই উত্তপ্ত মেজাজ ক্রমেই শীতল হয়ে গেল তার। তার এই শুভদিনে প্রিয় বন্ধু তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। প্রতিবছর সবাই মুঠোফোনে শুভেচ্ছা জানিয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠায় যন্ত্রটাতে। আজ সহকর্মী আর প্রিয় বন্ধুই শুভেচ্ছা জানিয়েছে শুধু, বাড়ির কেউই কোনো হেলদোল দেখালো না।
ফোনটা পকেটে রেখে পরবর্তী ক্লাস নেয়ার জন্য পা বাড়াল সামনের দিকে। মুঠোফোনে আবারও কম্পন হতেই পকেট থেকে তা বের করেই অপরিচিত নাম্বার থেকে ইনকামিং কল দেখতে পেল। কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শুনল -“আরিয়ান মজুমদার বলছেন?”
এপাশ থেকে সম্মতি জানাতেই অহন ফের শুনল -“আপনার জন্য মালিবাগ ব্রাঞ্চে একটা পার্সেল এসেছে। পার্সেলদাতা জানিয়েছেন অতীব গুরুত্বপূর্ণ পার্সেল, আজই আপনাকে নিতে হবে।”
দ্বিধান্বিত হলো অহন, তাকে পার্সেল পাঠানোর মত কে আছে? নিজের মনে মনেও কাউকে সন্দেহ করতে পারল না।
শিডিউল মোতাবেক ক্লাস শেষ করে কুরিয়ার সার্ভিসে গেলো সে।
র্যাপিং পেপারে মোড়ানো পার্সেলটা হাতে নিয়ে প্রেরকের নামের জায়গায় অপরিচিতা দেখে খানিক ভড়কালো। কেমন উৎসুক নজরে পার্সেল ডেলিভারি দেয়া লোকটার দিকে চাইল। গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করল -“কে পাঠিয়েছে এটা?”
ডেলিভারিম্যান ঈষৎ হেসে জানাল -“বলা বারণ।”
কথাটুকু বলেই নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল লোকটা। অহন বেকুবের মত তখনো দাঁড়িয়ে আছে। নজরটা ফের পার্সেলে ফেরাতেই তড়িঘড়ি করে র্যাপিং পেপারটা টেনে ছিড়ল।
আয়তাকার বক্সটাও এক প্রকার টেনে ছেড়ার মত খুলল।
চশমা আর কলম দেখে থমকালো সে। আপনজন ছাড়া কেউতো গ্লাসের পাওয়ার জানার কথা নয়। নজর গেল ভাজ করা হলুদ রঙা কাগজটার দিকে। আয়তাকার বক্সটায় চশমা আর কলমটা রেখে কাগজটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে ভাজ খোলা শুরু করল। মনটা কেমন খচখচ করছে, কি লেখা আছে ঐ কাগজটায়। ভাজ খুলতেই দৃষ্টিগোচর হলো কালো কালিতে লেখা গোটা গোটা অক্ষরগুলো। অহন পড়তে শুরু করল –
“প্রিয় মাস্টারমশাই,
শুরুতেই জানুন শুভ জন্মদিন। সবার সামনে সাহস হয়না আপনাকে প্রিয় বলার, আপনার সামনেতো সাহস হওয়ার প্রশ্নও উঠে না।
মাস্টারমশাই, দেখুনতো কি অদ্ভুত নিয়ম! সবার প্রিয় মানুষটাকে সবাই স্বহস্তে উপহার দিতে পারে, অথচ আমার সে সৌভাগ্যটা হলো না। হয়ত বিশাল কিছু দিতে পারিনি কিন্তু যেটুকু দিয়েছি সম্পূর্ণ নিজ সামর্থ্যে দিয়েছি। দেখে নিয়েন একদিন এভাবেই উড়ো চিঠি দিয়ে আপনাকে বিশাল কিছু উপহার পাঠাব।
রাত জেগে আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা হয় কিন্তু স্বপ্ন পূরণ করার সেই সাধ্য যে আমার নেই। নিজের অনুভূতিটুকু স্বযত্নে বুকের গভীরে তুলে রেখেছি, পাছে হৃদয় ভাঙার চুরমার শব্দে মনটা না কেঁদে ওঠে।
এই যে আমি আপনাকে নিজের মনের কথা বলছি, হয়ত সম্মুখে আপনার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলাতে পারিনা কিন্তু কল্পনায় আপনি আমার ধ্যান।
জানেন মাস্টারমশাই, অনুভব উৎকৃষ্ট কিন্তু অনুভূতি ভয়ংকর। অনুভব স্বস্তি দেয় আর অনুভূতি পুড়িয়ে খাক করে দেয়। আমি দগ্ধ হচ্ছি অনুভূতির অনলে। একপেশে যন্ত্রণা না হয় আমার হৃদয়কে ভস্ম করুক। সেই প্রলয়কারী অনল থেকে আপনার নিস্তার মিলুক।
আপনার জন্য সাজানো অনুভূতিগুলো যত্ন করে রেখে দিয়েছি। হয়ত রেখে দিন, নয়ত উড়িয়ে দিন।
ভালো থাকুন মাস্টারমশাই, খুব ভালো থাকুন।
~নাম না জানা অনুভূতি।”
চিঠিটা বার কয়েক পড়ল অহন। চিঠির ভাষাটার সাথে সে পরিচিত নয়। ঐ টুকরো কাগজটা আবার নিজের সামনে মেলে ধরল, যদি সেই মানুষটার সন্ধান মিলে কোন ক্লু পেয়ে। হাতের লেখাটা একদমই অপরিচিত লাগল। বাঁকা বাঁকা অক্ষরে লেখা, কখনো খানিক পেঁচানো লেখা।
কুরিয়ার অফিস থেকে নেমে নিজের বাইকের পাশে এসে দাঁড়াল ছেলেটা। আবার মনোযোগ দিল চিঠির ভাষায়। অমন এলোমেলো অনুভূতি কে জানিয়েছে! চোখজোড়া বন্ধ করে কিছু একটা ভাবতে লাগল। চিঠির প্রতিটি শব্দ মনে আওড়ালো। দৃষ্টি স্হান নিলো চিঠির শেষে নিজের চোখের সেই পরিচিত নকশায়। ক্ষুদ্র অংশজুড়ে ঐ চশমাপরা একজোড়া মায়াবী চোখ। নিজের নয়নজোড়া চিনতে বেগ পেতে হয়নি অহনের। চিঠিটা বুকে জড়িয়ে, চশমা আর কলমটাও বুকে জড়িয়ে চোখের কোণে জমা জলটা তর্জনী দিয়ে মুছে নিল। হাত ছড়িয়ে ‘ইয়েস’ বলে লাফটা দিতেই পেছন থেকে কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে আছড়ে পড়ল মাটিতে। হাত থেকে খসে পড়ল কলমটা। ঝড়ের বেগে কলমটা তুলে চিঠিসমেত পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল। কলারটা ঠিক করে শার্টে লেগে থাকা ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে সামনের মানুষটাকে বলল -“সরি।”
কথাটা বলে লোকটার মুখের দিকে তাকাতেই ফিক করে হেসে দিল অহন। মুখ ফসকে বলেই ফেলল -“আরে টাকলু সাহেব যে, শেষে আমার সাথেই ধাক্কা খেতে হলো?”
সবে ‘সরি’ বলার জন্য মুখ খুলছিল জাকারিয়া তার আগেই অপরিচিত মানুষের পরিচিত স্বরটা শুনেই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল -“তুই ঐ দিনের বদমাশটা না?”
অহনের হাসিই থামেনা। কোনরকম ঠোঁট কামড়ে হাসি থামিয়ে সদর্পে বলল -“চাপার দাঁত ঠিক আছে? দু একটা পড়েনি?”
কথাটা শেষ করার আগেই অহনের কলার চেপে ধরে ধাক্কা মারল জাকারিয়া। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ল ধুম করে। ক্ষণিকের মধ্যেই দুটো লাথি বসিয়ে দিল জাকারিয়া৷ তৃতীয় লাথি দেয়ার আগেই অহন বা’পা দিয়ে সজোরে লাথি দিল জাকারিয়ার ঊরুতে। এক পলকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে ব্যালেন্স করল অহন। বাইকের লুকিং গ্লাসে আটকে রাখা হেলমেটটা এনে এলোপাতাড়ি মার বসাল জাকারিয়ার চোয়াল, মুখ আর মাথায়। বৃষ্টির মত উদুম কেলানিতে দিশেহারা জাকারিয়া। তবুও থামেনি অহন। নিজের হাত পা সমান তালে চলছে। আশেপাশের মানুষজন এসে অহনকে থামাল। বায়ে ডানে নিজের ঘাড় কাত করে শরীর ঝাড়ল সে। দু’হাত সামনের দিকে ঝাড়তেই শার্টের কাফড আবার পজিশন নিল। এলোমেলো চুলগুলোতে হাত না দিয়েই মাথাটা পেছনে ঝাঁকাতেই কপাল থেকে সরে গেল লেপ্টে থাকা চুলগুলো। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা রক্তগুলো মুছে নিলো আঙ্গুল দিয়ে। তর্জনী তুলে সে বলল -“ঘুষির বদলে আমি লাথি দিতে জানি। আপনার শত জনমের সৌভাগ্য, টাক ফাটিয়ে ঘিলু খুলে আনিনি।”
ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েও আগে বুকপকেটে রাখা চিঠির অস্তিত্ব নিশ্চিত হয়ে সবার উদ্দেশ্যে অহন বলল -“অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ধাক্কা খাওয়ার পর আমি সরি বলেছি তাকে। কিন্তু আলাভোলা ফালতু লোকটা রীতিমতো মানসিক অপরিপক্কতায় ভুগছে।”
সবাই যার যার মত সটকে পড়েছে এবার। বিনেপয়সার সিনেমা দেখা হলে কে আর সময় নষ্ট করে! অহন নিজের ভাঙাচোরা হেলমেটটা নিয়ে বাইকে উঠে বসল। পকেট থেকে মাস্কটা বের করে দু কানের পেছনে মাস্কের লুপ গুঁজে লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে নিজের চুল ঠিক করে নিল। চোখ সরিয়ে দৃষ্টি রাখল জাকারিয়ার পানে। লোকটা এত মানুষের সামনে অপমানিত হয়ে রীতিমতো বাকরুদ্ধ। অচেনা লোকটা সবার সামনে তাকে মানসিক রোগী বলেছে। সম্বিত ফিরল তার সামনে দিয়ে শোঁ করে চলে যাওয়া বাইকের হর্ণে। বাইক আরোহী আবারও পেছনে তাকিয়ে তার উদ্দেশ্যে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। ঐ হাসিটা দেখে ভীষণ জেদ চেপেছে জাকারিয়ার। তোড়া নামের ঐ মেয়েটাকে সে বিয়ে করবে, সে যেভাবেই হোক।
________
বুকপকেটে রাখা চিঠিটার ভাষা বুকে তোলপাড় তুলছে। সেই সাথে বাড়ছে বাইকের গতি। চিঠির মালিককে একনজর না দেখলে যেকোন সময় অ্যাটাক হয়ে যেতে পারে, দম আঁটকে যেতে পারে। সাই সাই করে উড়ছে যেন। হুলস্থুল বাঁধিয়ে দিতে মন চাইছে। এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির ফটকটার সামনে চলে এলো অহন। তাকে দেখেই দারোয়ান গেট খুলে জিজ্ঞেস করল -“এত তাড়াতাড়ি আসছেন কেন বাজান? শরীর টরীর খারাপ হইছে?”
অহন মৃদু স্বরে বলল -“না চাচা, আমি ঠিক আছি।”
কোনোমতে বাইকটা স্ট্যান্ডে ভর দিয়ে দাঁড় করাল। পেছনে আর ঘুরল না, সোজা ছুট লাগালো বাড়ির দরজার দিকে। কলিংবেলের সুইচটা অনবরত টিপে ধরে আছে।
অনিমা দৌড়ে এসে দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল অহন। জুতো না খুলেই দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল উপরে৷ হতাশ হলো। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিত্বটি অনুপস্থিত। চোখের দেখাটুকুও হলো না।
নিজের ঘরে গিয়ে জুতা সমেত বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ল অহন। দরজাটা হাট করে খোলা। ছেলের পিছু পিছু অনিমাও আসলেন। ঘরে ঢুকেই তিনি অস্হির স্বরে জিজ্ঞেস করলেন -“কিরে বাবা? অশান্তি কোথায় হচ্ছে?”
মায়ের অতটুকু কথা শুনেই লাফিয়ে উঠে মাকে জড়িয়ে ধরে অহন বলল -“খুশিতে মরে যাব মা, খুশিতে মরে যাব। আজ আমার জীবনের অপ্রত্যাশিত কাঙ্ক্ষিত খুশিটা এসেছে আম্মা। এত তাড়াতাড়ি এই দিন আসবে আমি ভাবিনি আম্মা।”
অনিমা আগামাথা না বুঝে একের পর এক প্রশ্ন করেই চলেছে। তবে ছেলের নীরবতা দেখে এবার হাল ছেড়ে বললেন -“আজ তোর জন্মদিনের আয়োজন করেছে অয়ন। ভেবেছি তুই পরে আসবি, ততক্ষণে ঘরদোর সাজানো হয়ে যাবে। ওমা, এখন দেখি বর আসার আগে কাজী এসে হাজির। এসেছিস যখন ভালো করেছিস। গোসল টোসল করে নে।”
অনিমা ঘর ছাড়লেন, সেদিকে ভ্রুক্ষেপহীন অহন। চিঠিটা আবার বের করে ছোট করে একটা চুমু খেল প্রাণহীন কাগজটাতে। এলোকেশীর ছোঁয়া আছে যে তাতে।
আজ বিকেলের পরপরই সবাই বাড়ি চলে এসেছে। পরিবারের বড় ছেলের জন্মদিন বলে কথা। সবাই কাজকর্ম শেষ করে সেজেগুজে অপেক্ষা করছে কখন ছেলেটা কেক কাটবে। বাহারী সব খাবারের বিশাল আয়োজন ডাইনিং টেবিল জুড়ে। সবার গিফট সাজানো রয়েছে বসার ঘরটায়। বেলুন দিয়ে অয়ন, তুষার, তন্ময় ঘরটা সাজিয়েছে। পরশ আর প্রহর দুজনে মিলে তাকিয়ে দেখছে বড়দের কাজকর্ম। নিজের ছেলেদের ভদ্রতায় আজ বেশ মুগ্ধ কলি। দূরন্তপনায় পটু ছেলেদুটো আজ শান্ত হয়ে বড়দের কাজ দেখছে।
বাড়ির বউরাতো রান্নাঘরেই সারাদিন কাটিয়েছে। কত রকমের রান্না হয়েছে! সবাই ব্যস্ত দিন পার করলেও লাপাত্তা তোড়া। পরিবারের কোন উৎসবে একরকমের গা ঢাকা দিয়ে থাকে মেয়েটা। সবার হাজার অনুরোধ উপেক্ষা করে সে কোন সকালে বেরিয়েছে, ফিরেছে বিকেলে। এসেই ঘরে দোর দিয়েছে আর বেরোয়নি। রুবাবা বার কয়েক দরজায় কড়া নেড়ে এসেছে কিন্তু মেয়ের পক্ষ থেকে ইতিবাচক কোনো ইঙ্গিত পেলো না। আফসোসের শ্বাস টানা ছাড়া আর কোন উপায় নেই রুবাবার হাতে। এত বছর ধরেই মেয়ের এই নির্লিপ্ততা সয়ে এসেছেন তিনি।
সবাই অপেক্ষা করছে কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটার জন্য। কখন অহন আসবে আর কখন শুরু হবে আনন্দ। অয়নতো হাতে ডিম নিয়ে বসে আছে ভাইয়ের মাথায় ভাঙবে বলে। সবাই চমকে উঠলো কারো দরজায় সজোর করাঘাত শুনে। কান পেতে শুনতেই উপর থেকে ভেসে এলো -“তোড়া, তোড়া, দরজা খুল। তুই বের হলে তবেই কেকটা কাটব। নয়ত সব ওভাবেই পঁচবে।”
অহনের কাজে সবার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলেও রুবাবার মনে ভয় বাসা বেঁধেছে। এভাবে চলতে থাকলে মেয়েটা নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাতে খুব বেশি সময় নিবে না। সবাইকে ঠেলে তিনি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন। অহনকে বাঁধা দিয়ে বললেন -“ওকে ওর মত থাকতে দে অহন। তুই চল নিচে।”
কথাটুকু বলেই ছেলেটাকে টেনে নিচে নামিয়ে এনে কেকের সামনে দাঁড় করিয়ে রুবাবা বলল -“তাড়াতাড়ি কর, সবাই অপেক্ষা করছে।”
অয়ন চোখেমুখে বিরক্তি প্রকাশ করে বলল -“আহা কাকীমা, এভাবে থাকতে থাকতে ও আরো বেশি কষ্ট পাবে। ও আসুক না, তখন না হয়…”
অয়নের কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই রুবাবা তাকে থামিয়ে হাসির ছলে বলল -“সবারই নিজের মত থাকার অধিকার আছে অয়ন। ও ওর মত ওভাবেই থাকতে চায়। বরঞ্চ ওকে কিছু চাপিয়ে দিলে ও কষ্ট পায়, আঘাত পায়।”
অহনের হাতে কেক কাটার ছুরিটা এগিয়ে দিয়ে রুবাবা তাড়া দিল। নিজের হাতে লুকোনো ডিমটা অহনের মাথায় ফাটিয়ে বলল -“শুভ জন্মদিন আব্বাজান, কাকীমার পক্ষ থেকে সুপার গিফট।”
সবাই হাততালি দিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল। উচ্চহাসির রোল তোড়ার শ্রবণসীমা অতিক্রম করতে পারেনি। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে উদাস হয়ে শুনছে সে উচ্ছল প্রাণবন্ত হাসির শব্দ।
পাতলা ফিনফিনে টিস্যু পেপারটা দিয়ে সবে মাথাটা মুছে কেকে ছুরি বসালো অহন, তখনই তার মাথায় দ্বিতীয় ডিম ভেঙে ‘ওওওওও’ শব্দে হুল্লোড় করে উঠলো অয়ন। আজ এভাবে নাকানিচুবানি খাবে জানলে ঘরমুখো হতো না অহন। আদলে হতাশার ছাপ টেনে বলল -“এসব অত্যাচারের মানে হয়?”
মাথাটা ফের মুছে এক টুকরো কেক বাবার মুখের সামনে আনল অহন। একে একে মা, কাকীমা, ভাই সবাইকে খাওয়ালো। বারবার বেহায়া দৃষ্টি চেয়ে থাকে সিঁড়ির উপরে। যদি একবার তার এলোকেশী নেমে আসে। বুকের ভেতর জমে থাকা দীর্ঘশ্বাসটা ছেড়ে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখাটা টেনে সবাইকে বলল -“ধন্যবাদ।”
রঙবেরঙের র্যাপিং পেপারে মোড়ানো গিফট বক্সগুলো একে একে তুলে দেয়া হলো অহনের হাতে। অয়ন গলাটা উঁচু করে বলল -“আমার ভাইজান, গিফটের কিছু অংশ এই ফকিরকে দান করুন।”
নিজের দিকে আঙ্গুল তাক করে কথাটা বলতেই সবাই আরেক প্রস্হ হেসে উঠল। অহন মৃদু হেসে সব অয়নের হাতে দিয়ে বলল -“উপরে নিয়ে আয়, আমি গোসল করে নেই। তোদের ডিম থেরাপি আমার চুলের বারোটা বাজিয়ে দিল।”
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ডানদিকের ঘরটার দিকে আরেক নজর তাকালো অহন। আবারও হতাশ হলো। যদি তার দিব্যদৃষ্টি থাকত তাহলে দেখত ওপাশের মানুষটা দরজার গায়ে মাথা ঠেকিয়ে নীরবে অশ্রু ঝরাচ্ছে।
চলবে……..
(অনুভূতিটুকু জানিয়ে দিবেন। কতটুকু মন ছুঁয়েছে তা বলে দিন নিঃসংকোচে নাকি আদৌ মন ছুঁতে পারেনি তাও বলে দিন নির্দ্বিধায়।)