#এলোকেশী_সে
#মাহমুদা_লিজা
পর্বসংখ্যাঃ১১
রাত প্রায় এগারটার আশেপাশের সময়টায় দোর খুলল তোড়া। আজ আর খাবে না সে। ঘরে আলোটাও নিভিয়ে রেখেছিল নয়ত নিজের ফোলা নয়নজোড়া আয়নার এপাশ থেকে দেখলে নিজেও চমকাতো। বদ্ধ ঘরটায় নিঃশ্বাস টানতেও কেমন হাসফাস হচ্ছে। পা টিপে টিপে নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেল। পুরো বাড়ি ততক্ষণে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। সব ঘরেই আলো বন্ধ করা। সবার এতক্ষণে খাওয়াও শেষ। আজ অহনের প্রতি তীব্র অভিমান জমেছে। ঐ মানুষটা কি ডেকে খাওয়াতে পারতো না! নিজে দিব্যি খেয়ে শুয়ে আছে। বললেই কি সে সব খেত নাকি? মানুষটা জানেনা আজ সারাদিন না খেয়ে থেকে শরীরটা বেশ কাহিল হয়ে আছে।
ছাদের কার্নিশে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইল। আঁধারী আকাশটায় ঝলমলে তারাদের আনাগোনা দেখে মনটা আনচান করে উঠল, কবে তার অমাবশ্যার জীবনটায় এমন ঝলমলে তারা আসবে!
আনন্দ উৎসবে উপস্থিত হতে ভীষণ রকমের যন্ত্রণা হয়। সবার ঠোঁটজুড়ে থাকে আসল হাসি কিন্তু বাবার অবহেলায় তার ঠোঁটের কোণের হাসিটাও কৃত্রিম হয়ে গেছে। মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে স্বাভাবিক থাকতে সে পারেনা কিংবা কখনো তার মা-ও চেষ্টা করে না এই কলুষিত দশা থেকে তাকে মুক্তি দিতে। সে একা থাকা শিখে গেছে। তাইতো মন চায় মাকে নিয়ে দূরে কোথাও ছোট্ট একটা নীড়ে বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে। যেখানে প্রত্যহ প্রভাতে কোন কুশ্রীতা দেখতে হতো না।
নাক টেনে চোখের জল মুছে পেছনে ঘুরতেই অন্ধকারে কারো স্পষ্ট অবয়ব দেখে স্বস্থানেই দাঁড়াল তোড়া। অবয়বটার আগমনের উদ্দেশ্য বুঝতে সজাগ দৃষ্টি সামনে রেখে আদলে কাঠিন্য বজায় রেখে সটান দাঁড়িয়ে থাকল মেয়েটা। আগত মানুষটার গলা পরিষ্কার করার শব্দটা কানে এসে ঠেকল। পরিচিত স্বরটা শুনেই বুকের ভেতর ছলাৎ করে উঠল। বক্ষস্থলে থাকা পিন্ডটা যেন এদিক ওদিক লাফাচ্ছে। নিজেকে কেমন ভরশুন্য লাগছে। মনে হচ্ছে এখনই লুটিয়ে পড়বে ছাদের শক্ত খসখসে মেঝেটায়। সারাটা দিন যে মানুষটা থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে স্বয়ং সেই মানুষটা তার সামনে দাঁড়িয়ে। কথাগুলো জিহ্বার আগায় এসে জড়িয়ে যাচ্ছে, কি বলবে সে! সকল নীরবতা ভেঙে ঐ মানুষটাই প্রথম বলল -” আমার উপহার কোথায় তোড়া? সবাই কত কত উপহার দিয়েছে আর তুই ঘরে বসে দরজা আঁটকে রাখলি। শুভেচ্ছাটুকুও জানালি না।”
বুক থেকে যেন ভারী বোঝা নেমে গেল। চাপা পড়া নিশ্বাসটা ছেড়ে বুকে হাত দিয়ে ভাবল -” যাক মানুষটা টের পায়নি তাহলে।”
আমতা আমতা করে তোড়া বলল -“একজনের শুভেচ্ছা না পেলে আপনার দিনটা গোল্লায় যাবে না নিশ্চয়ই।”
ছাদের খসখসা মেঝেতে বসে পড়ল অহন। নিজের তৃপ্ত আদলখানা উপরে তুলে তোড়াকে আদেশের স্বরে বলল -“বস এখানে।”
তোড়া ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। মৃদু স্বরটা বদলে কর্কশ স্বরে রূপ নিল। বেশ ঝাঁঝালো স্বরে অহন বলল -“কথা কানে যায় না?”
ওপাশের মানুষটার তাতেও কোন হেলদোল হলো না। মেজাজ ততক্ষণে অনেকটাই চড়ে বসেছে অহনের। মূর্তির ন্যায় থমকানো তোড়ার ডান হাতটা টেনে নিজের মুখোমুখি বসাল। নিজের হাতের খাবারের বক্সটা এগিয়ে দিল। মুঠোফোনে থাকা ফ্ল্যাশ লাইটটা অন করে তোড়াকে খেতে ইশারা করল। পানির বোতলটাও খাবারের পাশে রেখে স্বল্প ভাষায় বলল -“খেতে শুরু কর আর মন দিয়ে আমার কথা শুন। তার আগে তোকে একটা নিউজ দেখাই।”
তোড়া মুখ ভার করে বলল -“খিদে নেই।”
উত্তরীয় হিম শীতল হাওয়া কেমন শরীরে কাঁপন তুলে দিচ্ছে। তোড়ার দুই শব্দের কথাটা শুনে অহন মৃদু হেসে বলল -“তবুও খেতে হবে। অনেকটা পথ হেঁটে গিয়ে নিয়ে এসেছি।”
তোড়া সন্দিগ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল -“কি দেখাবেন বললেন যেন!”
অহন ইশারা করল খেতে। ফোনটা হাতে নিয়ে মৌন হয়েই রইল ছেলেটা। বারবার তোড়ার দিকে তাকাচ্ছে। একটা সময় অপ্রসন্নতা ভর করল অহনকে, তাগাদা দিয়ে বলল -“খেতে শুরু কর, তারপর বলব। নয়ত এভাবেই বসে থেকে রাত পার করে দে।”
অহনের গোঁয়ারের মত আচরণে ‘চ’ শব্দ করে খাবারের বক্সটা ছিঁড়তেই মিষ্টি সুবাসটায় খিদেটা আরেকটু বেড়ে গেল তোড়ার। বক্সে থাকা বার্গারটা হাতে তুলে অহনের দিকে তাকাল। সন্দিগ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল -“আপনি কি করে জানেন আমি ছাদে আসব!”
অমন হেয়ালী প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুঁচকাল অহন। গাল বেঁকিয়ে বলল -“বাংলা সিনেমা নাকি? তুই আমার পাশের ঘরে আছিস, তোকে আমি ডেকে ওখানেই খাবারটা দিতাম। ঘর থেকে বের হতেই দেখি তুই ছাদে আসলি, তাই আমিও ভাবলাম ভালোই হবে, এত রাতে ভূতও দেখা হবে আর তোকে খবরটাও শোনানো হবে।”
মানুষটার খামখেয়ালি কথায় ফিক করে হেসে উঠল তোড়া। এই মানুষটার সংসর্গে বেশ উচ্ছল থাকে মেয়েটা। হাসিটা ঠোঁটের কোণে রেখে জিজ্ঞেস করল -“আপনি খেয়েছেন?”
বাক্যটা কর্ণকুহরে তরঙ্গায়িত হলো যেন বার কয়েক। আকাশের পান থেকে দৃষ্টি সামনের মানুষটার দৃষ্টিতে মেলাল। প্রসন্ন হাসির রেখা ধরে রেখে বলল -” অনুভূতিদের অদ্ভুত অধিকারবোধ জন্মায় তাইনা! তারপরও মানুষ অনুভূতিদের চাপা রাখতে চায়।”
চকিতে তাকাল তোড়া, চক্ষুদ্বয় যেন স্হানচ্যুত হবে। তখনই স্বাভাবিক স্বরে অহন বলল -“আমিও খাইনি।”
মানুষটা হুটহাট অপ্রস্তুত করে দেয় কেন! কাঁপা কাঁপা হাতে বার্গারের অর্ধাংশ এগিয়ে ধরল অহনের দিকে।
অহন হাত বাড়িয়ে নিল বার্গারের অংশটা। ইচ্ছে করেই নিল, আনন্দটুকু নয়ত ভাগ হতো নাকি!
খেতে খেতে অহন মুঠোফোনে একটা ভিডিও দেখালো তোড়াকে। তোড়াও মনোযোগ দিয়ে শুনছে ভিডিওর কথাগুলো -“পরকীয়া প্রেমের জের ধরে নিজের সাত বছর বয়সী সন্তানকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে পালিয়ে গেল প্রেমিকের হাত ধরে।”
বাকি কথাগুলো শোনার আগেই ভিডিওটা বন্ধ করে অহন বলল -“পুরো নারী জাতটাই খারাপ।”
অহনের বলা উক্তিটি শুনে বেকুবের মত চেয়ে রইল তোড়া। চোখেমুখে লেপ্টে আছে একরাশ বিস্ময়। সম্বিত ফিরতেই সে উত্তেজিত হয়ে বলল -“সবাইকে একই মানদণ্ডে বিচার করা উচিত নয়। একজনের অপরাধের ভার কেন সমস্ত জাতটাকে নিতে হবে?”
তোড়া বুঝতেও পারলো না তারই কথায় তাকে ফাঁসাল অহন। পানির বোতলটা টেনে নিয়ে দু’ঢোক পানি খেল সে। তারপর ধীরে সুস্থে বলল -“তাহলে একজন পুরুষের পাপের ভাগীদার হয়ে কেন অন্যরাও সইবে? একজনের পাপের অনলে অন্যদের বিশ্বাস কেন জ্বলবে? আমি মানছি মেজ কাকা ভুল করেছে, তাই বলে সব পুরুষই ভুল তা তো ঠিক নয় তোড়ারাণী। পুরুষরা নারীদের রাণীর বেশে রাখে আর কাপুরুষোচিত মনোভাবের মানুষগুলো নারীদের সম্মানহানি করে।”
তোড়া চোখজোড়া বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিল। উত্তরীয় হাওয়ায় আড়ষ্ট হয়ে ওড়নাটা আরো ভালো করে জড়িয়ে নিল। নিজের ভুল ধারণার দেয়ালটা এক লহমায় ভেঙে চুরচুর হয়ে যাওয়ায় বুকটাও হালকা লাগছে বেশ। সামনে থাকা মানুষটাকে এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভরসাযোগ্য মনে হলো। অনায়াসে নিজের জীবনটা লোকটার জিম্মায় ছাড়া যেতেই পারে। বেশ ভরাট কন্ঠে সে বলল -“ভাইয়া!…..”
বাকি কথাটুকু শেষ করার আগেই শীতল চাহনির মানুষটা গম্ভীর স্বরে জানিয়ে দিল -“ভাইয়া নয়, মাস্টার মশাই ঠিক আছে। আমি ঠিক তোর ভাইয়া হতে চাইনা, মাস্টারমশাই হয়েই থেকে যেতে চাই।”
কথাটুকু কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্রই এক লাফে দাঁড়িয়ে গেল তোড়া। এভাবে ধরা পড়ে সে নিজেই বিহ্বল হয়ে গেছে। সে পালাতে চাইছে। কোন অলৌকিক ক্ষমতার বলে সে মুহূর্তেই অদৃশ্য হতে চাইছে। কিন্তু সে কোথায় পাবে অলৌকিকতা!
এক প্রকার ছুট লাগালো অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার আস্ফালনে। তার আগেই বাঁধা পড়ল সেই বলবান পুরুষটার হাতের শক্ত বাঁধনে। নিজের চমকানো দৃষ্টি গেল ঐ মানুষটার পানে। যার শক্তপোক্ত ডান হাতটায় আটকা পড়েছে তার কোমল, তুলতুলে বা’হাতটা। সে ছাড়ানোর চেষ্টা করল না বরং নিজের গতি থামিয়ে স্হির দাঁড়িয়ে রইল। ওপাশ থেকে শুনল -“ইচ্ছেদের একবার আশকারা দিয়েই দে তোড়ারাণী। তাদের মুক্ত করে দে। এভাবে পালিয়ে বেড়াস না। আমার মনের দুয়ারে তোর পদচারণ হয়েই গেছে, অনুভূতি লুকিয়ে আড়ালে থাকিস না। আমি হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছি, শুধু একবার ঐ হাতে তোর হাতটা রাখ। কথা দিচ্ছি অমর্যাদা করব না তোর অনুভূতির।”
হাতটা ছাড়িয়ে দ্রুত পায়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল মেয়েটা। ছাদ পেরিয়ে সিঁড়িতে এসে থামল একপ্রস্ত। চোখের কোণের আনন্দ অশ্রুকণা মুছে নিল হাতের পিঠ দিয়ে। তার ছোটার বেগে আলগোছে করা খোঁপাটার বাঁধন আলগা হয়ে অশান্ত কেশরাশি ছড়িয়ে পড়ল পিঠে। কোমর পেরিয়ে হাঁটুর কাছে এসে থামল কেশরাশি। পরম সুখের এই মুহূর্তে হতবিহ্বল হয়ে নিজের ঘরে ছুটে আসতেই চমকে গেল মেয়েটা। মায়ের রুদ্রমূর্তি তাকে ভস্ম করে দিবে যেন। এগিয়ে এসেই থমকানো মেয়েটার গালে সপাটে চড় বসিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন -“এইদিন দেখার জন্য বেঁচে আছি? এই আমার বিশ্বাসের মর্যাদা দিলি?”
অবনত দৃষ্টি তখন মেঝেতে আবদ্ধ। কিশোরী মেয়েটার ব্যাথাতুর অশ্রুজল গাল গড়িয়ে মেঝে স্পর্শ করেছে ততক্ষণে। মায়ের হাতে দ্বিতীয় চড় হজম করে যখন মাকে কিছু বলতে চাইছে তখনই ফের হাত উঠালেন রুবাবা। সে হাতখানা মেয়ের গাল স্পর্শ করার আগেই কেউ আটকাল তাকে। এক টানে সরিয়ে নিল কান্নারত মেয়েটাকে। অহনকে দেখতেই এবার দ্বিগুণ ক্রোধে তেতে উঠল রুবাবা। বেশ রুক্ষ স্বরে বলল -“সীমা অতিক্রম করা ভালো নয় অহন।”
অহন দমলো না বরং তোড়াকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলল -“কথাটা সবার জন্য কাকীমা। এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তুলতে আপনার কষ্ট হয়না? ওর অপরাধটা কি? আমার অপরাধে ও কেন শাস্তি পাবে?”
রুবাবা এবার দমে গেল। অনুনয়ের স্বরে করজোড়ে অহনকে বলল -“বাবা, আমার মেয়েটা এমনি মনভাঙা, তুই দুইদিন বাদে যখন বিয়ে করবি তখন আমার মেয়েটার হাল কি হবে ভাবছিস? তখন তিলে তিলে শেষ হওয়ার আগেই ওকে বুঝতে হবে এসব মরীচিকা। বাবা, ও নাহয় ছোট। বুঝেনা ভালোমন্দ। কিন্তু তোর তো বয়স হয়েছে, ওকে এই আগুনে জ্বালাস না বাবা। দয়া কর, একটু দয়া কর।”
অহন দীর্ঘশ্বাসটা ছাড়ল না, বুকের মাঝেই চাপা দিল। অগ্নি দৃষ্টিতে চাইল রুবাবার দিকে। গলা যথাসম্ভব খাদে নামিয়ে বলল -“আপনার ধারণা ভুল কাকীমা,এখন রাত না হলে ওকে এখনই বিয়ে করে আপনাকে ভুল প্রমাণ করতাম। আপনি আর একবারও ওর গায়ে হাত দিবেন না। আপনার ধারণা খুব শীঘ্রই ভাঙব কিন্তু আপনি ওকে এখন আর কিছু করবেন না।”
কথাটুকু বলেই প্রস্হান করল অহন। তোড়া অসহায় চাহনি নিয়ে দেখছে মা’কে। রুবাবা কিছু একটা ভেবে মেয়েকে সাফ জানাল -“আজ থেকে তুই আর উপরে থাকবি না। নিচে আমার সাথে থাকবি।”
নির্বাক চাহনি তোড়ার। এ বুঝি নিয়তি!
চলবে………