#এলোকেশী_সে
#মাহমুদা_লিজা
যবনিকা -১
অনুর ভরটা অনেকটা নিজের ওপর রেখেছে অয়ন। কলিংবেলের আওয়াজে দরজা খুলে অনুকে ওভাবে দেখে আঁতকে উঠল কলি। তড়িঘড়ি করে সে-ও আগলে নিল অনুকে। সোফায় অনুকে বসিয়ে কলি দৌড়ে এসে অনিমাকে জানাল। হাতের কাজ ফেলে পুত্রবধূকে দেখতে ছুটে এলেন তিনিও। সকাল বেলা ভালোইতো ছিল। হঠাৎ কি হলো, তা ভাবতে ভাবতে উচাটন হলো মন।
শাশুড়িকে দেখে এবার লজ্জারা আরো ঘিরে ধরেছে অনুকে। অনিমা আর কলির একের পর এক প্রশ্নে নাজেহাল অবস্থা। পরশ আর প্রহরও এসে দাঁড়াল কলির পেছনে। অনুর মুখ লুকানোর ধাঁচে অনিমা কিছু আঁচ করে শুধালো, “তোড়া কোথায়? ও আসেনি?”
ধড়ে যেন প্রাণ ফিরল অনুর। অয়ন তার স্ত্রীর জন্য মায়ের উৎকন্ঠা দেখে ঈষৎ হাসল। খবরটা শোনার পর মায়ের ঠিক কতটা আনন্দ হবে, তা ভেবে তৃপ্ত সে। অপেক্ষা করছে তোড়া আসার। কিভাবে কি বলবে তা মোটেও ভাবতে রাজি নয়, শুধু ভাবছে তোড়া এলেই না হয় বুঝিয়ে বলবে। মায়ের প্রশ্নের জবাবে বলল, “ভাইয়ার সাথে আসছে ও। ভাইয়া গিয়েছিলো তো।”
অনিমা হেসে ছেলেকে তাগাদা দিলো অনুকে ঘরে নেয়ার জন্য। কিন্তু অয়ন কোন হেলদোল দেখালো না বরং মাথা চুলকে বলল -“আচ্ছা, আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। তোড়া আসলে ওর সাথে কথা বলেন আম্মা।”
ছেলের চোখেমুখে এই প্রথম লজ্জার আভাস অনিমার সন্দেহ আরো গাঢ় করল। তিনি কেমন পুলকিত অনুভব করছেন। তিনি যা ভাবছেন তা যদি সত্যি হয় খুশিতে দিশেহারা হবেন বোধ হয়, এরূপই অবস্থা কায়দা বোঝা যাচ্ছে।
অয়ন চলে যাওয়ায় অনু বেকায়দায় পড়েছে। মনে মনে ভাবছে, “লোকটা ঠিকই কেটে পড়েছে, মাঝখান থেকে তাকে বেকাবু করার পাঁয়তারা করছে।”
তার ভাবনায় ঘি ঢালল কলিংবেলের আওয়াজ। পরশ এসে দরজা খুলতেই অহন হাসল। পরশের কান টেনে বলল, “অয়নকে চেপে ধর, ট্রিট না দিলে ঘর থেকে বের হতে দিবিনা। আমিও আজ তোদের দলে।”
পরশ আগা মাথা না বুঝে ছুটল অয়নের ঘরে। বাহির থেকে দরজা আঁটকে বলল, “ট্রিট না দিলে বড় ভাইয়া দরজা খুলে দিতে নিষেধ করেছে। ট্রিট দিতেই হবে।”
ওদিকে আগেপিছে চিন্তা না করে প্রহরও ছুটলো পরশের তালে তাল মেলাতে। আদতে তারা জানেও না তারা কিসের ট্রিট চাইছে।
অয়ন ভেতর থেকেই পাল্টা জবাবে বলল, “ওর মত বড় ভাই না থেকে একশ শত্রু থাকাও ভালো। নিজে না পেরে ছিনতাইকারী লেলিয়ে দিয়েছে।”
অয়নের সজোর কন্ঠধ্বনি শুনে সবাই হাসলেও উন্মুখ হয়ে আছে কারণ জানার জন্য। তোড়া সদর দরজা পেরিয়ে প্রবেশ করতেই অনিমা প্রশ্ন ছুঁড়লো -“কি হয়েছে অনুর? ডাক্তার দেখাসনি?”
তোড়া অনুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল। সে কি বলবে, কিভাবে বলবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। অহন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্ত্রীর পানে। সে দেখতে চায় তার এলোকেশী কিভাবে খবরটা জানায় সবাইকে। এদিক সেদিক তাকিয়ে তোড়া বেশ উশখুশ করছে। অবশেষে মনস্থির করল যা হওয়ার হোক, সে সরাসরি বলেই দিবে।
এদিকে তোড়ার ইতস্ততায় অহনের বেশ হাসি পাচ্ছে। হাসি লুকানোর জন্য নিজের ঘরে যাওয়াটাই সবচেয়ে নিরাপদ মনে হচ্ছে তার। যেই ভাবা, সেই কাজ। উঠে হাঁটা ধরল নিজের ঘরটার দিকে। সিঁড়ির দু’ধাপ অতিক্রম করতেই কানে এলো তোড়ার স্বর, “ভাবীর সব গোছানো চাল চলন এলোমেলো করার সময় ঘনাচ্ছে হয়ত। রাত জেগে কারো কান্না থামানোর সময় এগিয়ে আসছে।”
তোড়ার কথার মানেটা ধরতে অনিমা খানিকটা ভাবল। কলিও চোখজোড়া ছোট করে যখন কথার মর্ম বুঝল, একগাল হাসল সে। কিভাবে গুছিয়ে বলে মেয়েটা!
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল অহন। তার শীতল দৃষ্টি স্ত্রীর পানে নিবদ্ধ। তার মনে হলো যখন সময়টা তার জীবনে আসবে তখন অনুভূতি ঠিক কেমন হবে! ওদিকে অনিমা আর কলির খুশির ছটায় অনুর লজ্জা লোপ পাচ্ছে ধীরে ধীরে। যতটা লজ্জা সে পাচ্ছিল, তোড়ার কথায় তা উবে গিয়ে ভাল লাগতে শুরু করেছে। কতটা কাঙ্খিত সংবাদ তার জীবনে!
অনিমা তো খুশিতে কেঁদেই দিয়েছে। অনুকে বুকে জড়িয়ে বলল -“সন্ধ্যায় তৈরী থেকো, ডাক্তার কাছে যেতে হবে তো, নাকি!”
তোড়া হাসল। রসিকতা করে বলল -“আজ ভাইয়া ট্রিট না দিলে বাড়িতে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেব।”
অনিমা ছুটলো শাশুড়ির ঘরের দিকে। সুখবরটা ঐ মানুষটাকে দিলে কতই না খুশি হবেন তিনি!
*******************
রান্নাঘরে ব্যস্ত সবাই বিকেলের নাস্তা তৈরীর আয়োজনে। তোড়াও হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিচ্ছে। অনু একপাশে দাঁড়িয়ে মুখ গোমড়া করে সবার কাজ দেখে যাচ্ছে। তাকে কেউ কোন কাজে হাত লাগাতে দিচ্ছে না। তোড়া চা নামিয়ে সবে কাপে ঢালছিলো। কানন আর নিজাম মজুমদারের চিৎকার ভেসে আসল সবার কানে। হাতের কাজ রেখে সবাই দৌড়ে গেলেও তোড়া নির্বিকার। সে জানে ঘটনার আদ্যোপান্ত। একটা সময় শোনা গেল -“চরিত্রহীনের মত কাজ করেছ, কয়েকটা দিন সহ্য হয়নি। তুমি আমায় বিয়ে করে আমার জীবনটা ধ্বংস করেছ। নির্লজ্জ লোক। তোমার কাজের খেসারত কেন আমি দেব? আত্মীয় স্বজন ধরে ধরে আমায় জিজ্ঞেস করছে তোমার কীর্তির কথা। কোথাও মুখ বের করতে পারছিনা। মরে যেতে ইচ্ছে করছে।”
কাননের অভিযোগের ফিরতি বার্তা এলো -“সব আমার দোষ অমনি? তুমি জানতে না আমি বিবাহিত ছিলাম? তখন তো নাচতে নাচতে রাজি হয়েছিলে। মরে যাও না, ধরে রেখেছে কে?”
তুষার, তন্ময় বাবা-মায়ের তর্কাতর্কিতে বেদিশা হয়ে গেছে। এমনটা কখনোই দেখেনি। অন্যের বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখলে নাক সিটকাত, আজ তারা নির্বাক। তাদের জীবনের গন্তব্য এখন ঘোর অনিশ্চিত।
সবাই মিলে দু’জনকে থামানোর চেষ্টা করলেও দু’জনই মুখ চালিয়ে যাচ্ছে সমানে। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না। একটা সময় নিজাম মজুমদার অজ্ঞান হয়ে গেলেন। ধুন্ধুমার ঝগড়ার দেখার পর এবার সবাই ব্যস্ত নিজাম সাহেবের জ্ঞান ফেরাতে। কেউ পানি দিচ্ছে, কেউ হাত পা মালিশ করছে। তোড়া নিজের মত রান্নাঘর সামলাচ্ছে। একটুখানি উঁকি দিয়েও সে পরিস্থিতি দেখার প্রয়োজনবোধ করেনি। মেহেরজানও নিজের ঘর ছেড়ে বেরোয়নি। অনিমা এসে বসল তোড়ার পাশে। তোড়া চা খেতে খেতে পেঁয়াজু ভাজছিল। শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হাসল। অনিমা একদৃষ্টিতে দেখছে শীতল আদলে শাণিত দৃষ্টি। মায়ের অবহেলার প্রতিশোধ এত কঠিনভাবে সে নিতে পারবে তা ঘূর্ণাক্ষরেও আঁচ করেনি কেউ। নীরবতা ভেঙে অনিমা বলল -“একদম ছাড় দিবি না। রুবার একেকটা মুহূর্ত আরো কষ্টে কেটেছে, আমি দেখেছি।”
তোড়া নির্বিকার। তার স্বাভাবিক আদলে কোন কাঠিন্য বা কোমলতা ছিলনা। তার ভেতরের অবস্থা আঁচ করা গেলো না মোটেও।
দেড় মাস যাবত চলা পরীক্ষা শেষ হয়েছে দু’দিন হলো। এতদিন কাজ কর্ম থেকে মোটামুটি দূরেই ছিল। পরীক্ষা শেষ হওয়ায় আগের মতই ঘরের কাজে মনোযোগ দিয়েছে তোড়া। গণিত পরীক্ষাটা ভালো হলেও পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে তার চিন্তা। সাথে যোগ হয়েছে রসায়ন। একদম ভালো ফলাফলের আশা নেই তার, তবে বাড়াবাড়ি রকমের খারাপ হলে তখন সবার সামনে লজ্জিত হতে হবে। তার বরটা শিক্ষক অথচ সে বাজে ছাত্রী। ইস কি লজ্জা! এসব ভেবেও খানিক নীরব হয়ে আছে। ফলাফল পাওয়ার পর নাহয় মনটা শান্ত হবে। তার উপর বাড়িতে প্রায়ই কিছু না কিছু ঘটে, এসব দেখতে তার ভালোই লাগে। তার বাবা সম্পর্কীয় মানুষটাকে সে প্রতিনিয়ত হুলস্থুলে রেখেছে, মানসিক টানাপোড়েনে ডুবিয়ে দিয়েছে। সে পড়ালেখায় ব্যর্থ হলেও মায়ের প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারার তৃষ্ণা মিটছে প্রত্যহ। মায়ের জীবন থেকে শান্তি কেড়ে নিয়ে মানুষটা যে পৈশাচিক কান্ড ঘটিয়েছে, তোড়া পাই টু পাই হিসেব বুঝিয়ে দিচ্ছে। সে নিজেকে দৃঢ় করল – জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষমা করবে না ঐ মামুষটাকে। তার মায়ের আর্তনাদের মূল্য সে বুঝে নিবেই।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শাশুড়ির কথার পিঠে জবাব দিল -“ছাড়ব না জ্যেঠীমা, একদম ছাড়ব না। আমার আম্মু যতটা কষ্ট নিয়ে চলে গেছে, ততটুকু না পারলেও, কিছুটা হলেও ফিরিয়ে দিব ঐ মানুষটাকে। নিজের হিসাব চাইনা জ্যেঠীমা, মায়ের অধিকারের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হিসেবও বুঝে নিব। একদম ছাড়ব না।”
ছেলের বউকে বুকে টেনে অনিমা বলল -“আম্মু বলতে পারিস না? জ্যেঠীমা তো আগে ছিলাম, এখন কি মা হতে পারব না?”
তোড়া হেসে দিল। মাথা চুলকে বলল -“বলব।”
শাশুড়ি-বউয়ের খুনসুটির পালায় ব্যাঘাত ঘটল কলিংবেলের শব্দে। তোড়া অনিমাকে ছেড়ে দরজা খুলতে গেল। দরজা খুলতেই তিনটে পরিচিত মুখ দেখে হাসল। ভেতরে আসতে বলেই শাশুড়িকে ডাকল ঈষৎ উঁচু আওয়াজে। অনিমা বসার ঘরে আসতেই চোখ ছোট করে বলল -“অহন তো বাসায় নাই, মা।”
তন্মধ্যে একজন বলে উঠল -“আমরা তোড়ার কাছে এসেছি। ওকে প্রয়োজন।”
তোড়া ভ্রুজোড়া উঁচু করতেই কপালে ভাঁজ হলো তিন চারটে। ভ্রু চুলকে বলল -“আমাকে কি বলবেন আপু? আমি কিভাবে কি করতে পারি?”
নাতাশা বসতে বসতে বলল -“অহনের কাছ থেকে শুনলাম তুমি নাকি শাড়িতে হ্যান্ড ওয়ার্ক বা হ্যান্ড পেইন্ট করতে পারো!”
তোড়া উপরে নিচে মাথা দুলালো। তোড়ার ইশারা দেখে অন্তি বলল -“এতগুণ কেমনে থাকে তোমাদের? আমিতো খাওয়া আর ঘুম ছাড়া কিছুই পারিনা।”
গরম গরম পেঁয়াজু এনে সামনে রাখল অনিমা। তাগাদা দিল খাওয়ার জন্য। সবাই ঝাপিয়ে পড়ল পেঁয়াজুর প্লেটে। কাড়াকাড়ি করে খেয়ে একজন আরেকজনকে দোষ চাপাচ্ছে। একজন আরেকজনকে বলছে তুই বেশি খেয়েছিস। তোড়া নিভৃতে তাদের উচ্ছলতা দেখল। তার গম্ভীর আদলে নজর পড়তেই মিথিলা ঠিক হয়ে বসল। কপালের চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে বলল -“তোমার সাথে ডিল করতে এসেছি। তুমি আমাদের জন্য টোটাল আঠারটা শাড়িতে সূর্যমুখীর দৃশ্য আঁকবে। গর্জিয়াস করে সাজাবে, যেন ইউনিক লাগে। কালারটা মনে হয় অনিয়ন কালারে করলে ভালো হয়। তুমি দুইমাস সময় পাচ্ছো। আঠারটা শাড়ি আমাদের দু’মাসের মধ্যে লাগবে।”
তোড়া উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে অল্প ভাষায় শুধালো -“উপলক্ষ্য কি? মানে কি উপলক্ষ্যে করব, এটা বললে আমার ডিজাইন করতে সুবিধা হবে।”
অন্তি পেঁয়াজু চিবোতে চিবোতে জবাব দিল -“রি-ইউনিয়ন। কতশত, হাজার মানুষ হবে! তারমধ্যে আমাদের সেম ড্রেস, সেম কালার, সেম ডিজাইন সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয় যেন।”
তোড়া ফের শুধাল -“অনিয়ন কালার জমিনে সূর্যমুখী থাকবে, সাথে থাকবে নীল রঙা আকাশ। আঁচলে ঝুলবে টারসেল। সিক্সটি সিক্সটি কাউন্টের তাঁত শাড়ির জমিনে হবে কাজটা। পাড়ে থাকবে সিকোয়েন্স ওয়ার্ক।”
তোড়ার বিশদ বর্ণনায় তুষ্ট হলো সবাই। নাতাশা মিষ্টি হেসে বলল -“অহনের কাছে শুনেছি, ইভেন ও আমাদের ভিডিও দেখিয়েছে তোমার কাজের। ভালো লেগেছে খুব। তাহলে ডিল ফাইনাল!”
তোড়া মৃদু হাসল। তার গম্ভীরতায় অভ্যস্ত সকলেই। তাই কথা না বাড়িয়ে অন্তি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে তোড়ার দিকে বাড়িয়ে দিল, মোলায়েম স্বরে বলল -“এডভান্স হাফ পেমেন্ট। বাকি টাকা শাড়ি নেয়ার সময় দিব মানে যতটুকু টাকা বাকি থাকবে।”
হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল তোড়া। তার মৃদু কম্পন অনিমার দৃষ্টি এড়ালো না। তোড়ার বুকের ভেতরের হাতুড়ি পেটার শব্দটা কারো কর্ণে প্রবেশ না করলেও তার হঠাৎ নিভে যাওয়া খেয়াল করল উপস্থিত সকলে। তোড়ার মন কাঁদছে, এই দিনটা তো তার মা চেয়েছিল দেখতে। মনের কান্নাটা সকলকে দেখাতে নারাজ সে। তাইতো মনের কান্নাটাকে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যাতে চোখের কোণে তার রেশ না আসে। আরো খানিকক্ষণ আড্ডা দিল তারা। একটা সময় আগন্তুকেরা চলেও গেল, তোড়া তখনও টাকাগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। এই টাকাগুলো যদি কিছুদিন আগেও আসত, তবে মা হয়ত সাহস পেত মেয়েকে নিয়ে আলাদা থাকার। একে একে পুরোনো দৃশ্য ভেসে এলো তার মানসপটে। সেইসব দৃশ্যাবলী ছিল মায়ের প্রতি হওয়া ঘোর অপমানের প্রতিচ্ছবি। অনিমা এগিয়ে এসে তোড়ার মাথায় স্নেহের হাত ছোঁয়াল। ঘোর কাটল মেয়েটার। জোরপূর্বক ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে বলল -“আজ আম্মুকে মনে পড়ছে খুব, এই দিনটার জন্য কত অপেক্ষা ছিল। ক্ষণটা এসেছে সময়মত, আম্মুও চলে গেছে নির্দিষ্ট নিয়মে। ঘটনা দু’টোই ঘটেছে, তবে সম্পন্ন হওয়ার সময়টা আগপাছ হয়েছে। একে অন্যকে সাক্ষাৎ দিতে চায়নি।”
অনিমার চোখে জলকণা দৃশ্যমান। তিনি আর তাদের মুছেননি। বোনের মত করে যাকে আগলে রাখতেন, সে তাঁদের ছেড়ে আজ বহুদূরে।
*************
রাতের খাবারের পালা শেষ করে ঘরে এলো অহন। ছোট ছোট চিরকুটগুলো দরজার পাশের দেয়ালটায় কেউ আঁটকে দিয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে একগাল হেসে বলল -“কুইন, আপনি কি জেলাস?”
তোড়া মুখ তুলে বলল -“একদম না। আপনার সুন্দরী ছাত্রীরা প্রেমপত্র দিয়েছে, আপনি যত্ন করে তুলে রেখেছেন আর আমি সদ্ব্যবহার করলাম।”
অহন ঠোঁট টিপে হেসে বলল -“বাহ, ঘরময় প্রেমপত্র। কি চমৎকার!”
তোড়া নির্লিপ্ত। তার সূক্ষ্ম অভিমানটা ধরতে পারল অহন। এলোকেশীকে আরেকটু জ্বালানোর জন্য গুনগুন সুরে গান ধরল। তোড়া আড়চোখে তাকাতেই কাঁধ উচিয়ে ইশারা করল। ভাবখানা এমন -“আমি কি করেছি?”
তোড়া মুখ ভার করে বারান্দায় চলে এল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখার অভ্যাস মেয়েটার। চারদিকের ভ্যাপসা গরমেও আকাশের দৃশ্যটা মনকে প্রশান্তি দেয়। একমনে আকাশ পানে দৃষ্টি রেখেছে সে। কারো শরীরের সাথে নিজের ছোট্ট শরীরটা স্পর্শ পেতেই বুঝল তার মাস্টার মশাই তার পেছনে আছে। আকাশ থেকে দৃষ্টি সরাতেই দেখল সুতনু পুরুষটার বলিষ্ঠ হাতজোড়া তার দু’পাশে বেষ্টনীর মত রাখা আছে। হাতগুলো ভর দিয়েছে চিকন রেলিঙে। তোড়া শীতল স্বরে বলল -“মাস্টার মশাই, আমার ওড়নাটা আলমারিতে তুলে রেখেও সেদিন মিথ্যে কেন বলেছিলেন?”
ওপাশের জবাব আশা করেছিল তোড়া। কোন জবাব না পেয়ে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে ফের বলল -“মাস্টার মশাই!”
সম্বিত ফিরল অহনের। তবুও সে নীরবতা আলিঙ্গন করল। সেই বেষ্টনীর বলয়তেই তোড়া ঘুরে দাঁড়াল মুখোমুখি। রেলিঙের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বলল -“আজ কি ঠিক করে রেখেছেন, আপনি নীরব থাকবেন?”
অহন হাসল। হাতজোড়া এবার উঠে এল স্ত্রীর কাঁধে। মুখটা খানিক নিচু করে বলল -“ভালবাসি।”
সমস্ত প্রশ্নের এ যেন একটাই সমাধান। তোড়া ঘাড় কাত করে হাসল। হাত বাড়িয়ে তার ব্যক্তিগত পুরুষটার চুল ঠিক করে দিল। তার হাতটা নিজের হাতের দখলে নিল অহন। অন্য হাতটা এবার স্ত্রীর নির্মেদ কোমরে নামিয়ে বলল -“পুরোদমে এলোমেলো করে রেখেছ আমাকে। আমাকে ঠিক করবে না?”
তোড়া এক চুটকিতেই ধরতে পারল মর্মার্থ। মিষ্টি হেসে বলল -“আমি বারবার দায়িত্ব নিতে চেয়েছি মাস্টার মশাই, আপনিই বরং নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন আমার জিম্মা থেকে।”
স্ত্রীর আকুন্ঠা সমর্থনে রীতিমতো চমকাল অহন। পুরুষদের প্রতি মেয়েটার বিদ্বিষ্টভাব দেখেইতো এতদিন নিজেকে সংযত রেখেছিল। তাছাড়া মাতৃবিয়োগের শোক কাটানোর সুযোগ দিয়েছিল স্ত্রীকে। ভাঙাচোরা হৃদয়টাকে গোছানোর সময় দিয়েছিল। নিজেকে সংযত রাখার সংযমে স্ত্রীর নিকট পূর্ণ ভরসা অর্জনে সে নিজেকে প্রেমিক পুরুষ দাবি করতেই পারে। তার অশান্ত মনে অস্হির তোলপাড়।
স্ত্রীর হাত ধরে তাকে ঘুরিয়ে নিল অহন। তার লোমশ বুকে ঠেকল এলোকেশীর পিঠ। তার পেটে হাত জড়িয়ে রেখে কাঁধের চুলগুলে সরিয়ে দিল একপাশে। আলতো চুমুটা কানের পেছনে বসাতেই কেঁপে উঠল তোড়া। তার একেকটা উষ্ণ নিশ্বাস ছুঁয়ে দিচ্ছে তার এলোকেশীর কাঁধ। হঠাৎ নিজেকে ভরহীন লাগছে যেন। ঘোর লাগানো কন্ঠের আকুতি এলো -“একবার ভালবাসি বলবে না!”
অমন মিষ্টি যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হবে জানলে আগেই পালাত মেয়েটা। ছোট্ট ধাক্কায় মানুষটাকে সরিয়ে দৌড়ে এসে স্হান নিল বিছানায়। বারান্দার দুয়ারে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর লুকোচুরি দেখে হাসল অহন। ধীর কদমে এগিয়ে এলো। চোখ ধাঁধানো আলোটা বন্ধ করে নিঃশব্দে বিছানায় এসে বসল অন্ধকার হাতড়ে। শীতল স্বরে বলল -“অভিযোগ করলে ঠিকই। তবে এখন কেন পালাচ্ছ? আমার তরফ থেকে কোন জোর নেই কুইন। আমি অনন্তকাল অপেক্ষা করতে রাজি।”
আঁধারের গায়ে হাত বাড়িয়ে অহনকে জড়িয়ে ধরল তোড়া। সে চায় না মানুষটাকে আর অপেক্ষা করাতে। অপেক্ষার অবসান একদিন না একদিন তো হতেই হবে। সেই ক্ষণটা আজ আসুক।
বুকে জড়ানো পরীটাকে নিজের করে পেতে আর কোন দ্বিধাই রইল না। নিকষ আঁধারটা সাক্ষী হলো পবিত্র ভালবাসায়।
চলবে…..