#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪০
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
গীতের প্রতিধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠেছে। মেহেভীনকে গোসল করিয়ে দেওয়ার জন্য বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বজনরা গীত গাইছে আর মেহেভীনের মস্তকে পানি ঢালছে। সমস্ত কায়াতে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে মেহেভীনরে। হলুদের কার্যক্রম শেষ হতেই মেহেভীনকে কক্ষে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। মেহেভীন কক্ষে এসে গোসল করে মেরুন রঙের শাড়ি পরিধান করে নিল। কক্ষের কবাট খুলে বাহিরে যাবে, এমন সময় মুঠোফোনটা বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনে মুনতাসিমের নামটা জ্বলজ্বল করছে। ফোনটা কর্ণে ধরতেই মিষ্টি কণ্ঠস্বর ভেসে এল,
–কালকে কিন্তু শাড়ি পড়তে হবে।
–যদি না পড়ি তাহলে কি করবেন?
–আমি গিয়ে পড়িয়ে দিয়ে আসব। আমার বউকে আমার মনের মতো করে সাজিয়ে নিয়ে আসব।
–আর যদি না সাজি?
–বললাম তো আমি গিয়ে সাজিয়ে দিব।
–সাহস আছে?
–আমার সাহস দেখতে চান?
–হুম চাই।
–আমি জানি আপনি আমার মনের মতো করেই সাজবেন৷ কাল কেও বলেছিলেন কাঁচা ফুল দিয়ে সাজবেন না। তাহলে আজ সেজে ছিলেন কেন?
–আমার মন চেয়েছিল তাই।
–মিথ্যা কথা বলছেন?
–আমি আপনাকে ভয় পাই? যে মিথ্যা কথা বলব!
–আমি তো দেখতে পাচ্ছি। আপনি আমাকে ভয় পান।
–কালকে আমি লেহেঙ্গা পড়ব।
–না শাড়ি পড়বেন। মেহেভীন আর কিছু বলার সুযোগ পেল না৷ তখনই কেউ কবাটে কড়া নাড়ে খেতে যাবার জন্য। মেহেভীন মুনতাসিমের থেকে বিদায় নিয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল।
আরিয়ান আর মিরাজুল তৈরি হয়ে নিয়েছে। আরিয়ান আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ হয়ে গিয়েছে। নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো ব্যাগে তুলে নিল। দু’জনেই কালো পোশাক পরিধান করেছে। খুব কাছে থেকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে, কেউ বুঝতে পারবে না তারা দু’জন আরিয়ান আর মিরাজুল। আরিয়ান চরণে জুতা পড়তে পড়তে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–আমাদের লোকরা কোথায়?
–ছয়টা গাড়ি নিয়ে তারা আগে বেড়িয়ে পড়েছে। আমরা তো তাদের থেকে অনেকটা দুরত্বে আছি। আমাদের সেখানে পৌঁছে যেতে গোটা একটা দিন লাগবে।
–আমরা সেখানে গিয়ে কার কাছে থাকব? আরিয়ানের কথায় মিরাজুলের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। সে রাগান্বিত হয়ে কক্ষ ত্যাগ করল। আরিয়ান বিরক্তি মাখা মুখশ্রী করে তার যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মিরাজুলের এমন গা-ছাড়া ভাব আরিয়ানকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। মেহেভীনের আগেই না আবার মিরাজুলকে সে খু’ন করে বসে। মিরাজুল হাতের ব’ন্দু’ক’টা নিজের মধ্যে আড়াল করে নিয়ে, তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–এই জন্যই তোমাকে মেহেভীন বিয়ে করেনি। মস্তক ভর্তি শুধু ক্রোধ আর গোবর আছে। আরিয়ান রাগান্বিত হয়ে মিরাজুলের শার্টের কলার পাকড়ে ধরল। তাকে হালকা ঝাঁকিয়ে বলল,
–নিজেকে তুমি কি মনে করো? তুমি ভুলে যেও না এই যে এতদূর পর্যন্ত আসতে পেরেছো। সেটা কার জন্য? অবশ্যই আমার জন্য। আমি চাইলে তোমার যাত্রা এখানেই থামিয়ে দিতে পারি। আরিয়ানের কথায় মিরাজুলের মুখশ্রীতে বিরক্তি ফুটে উঠল। ক্রোধে সমস্ত কায়া কেঁপে কেঁপে উঠছে। মিরাজুল ঝাড়ি দিয়ে আরিয়ানের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
–এই শক্তির প্রয়োগ আমার কাছে না করে, যদি মেহেভীনের সাথে করতে! তাহলে আজ তুমি মেহেভীনের অর্ধাঙ্গ হয়ে যেতে। মস্তক তো একদমই ফাঁকা তাই তোমার ফলাফল গুলোও ফাঁকা। এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করবে নাকি আমার সাথে যাবে? মিরাজুলের কথায় হুস আসলো আরিয়ানের এই কয়দিনে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে দু’জনের। তবে মিরাজুল আরিয়ানের চেয়ে অধিক বুদ্ধিমান হওয়ায় আরিয়ান তার সাথে পেরে ওঠে না। দু’জন আর বিলম্ব করল না নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিল।
অন্ধকার কক্ষে নিস্তেজ অবস্থায় বাঁধা ছিল যুবকটি। তখনই কক্ষের মধ্যে এক রমণী প্রবেশ করে। রমনী দেখে গার্ড গুলো বিস্ময় নয়নে দৃষ্টিপাত করে আছে। প্রাণ প্রিয় ভাইয়ের এমন করুন অবস্থা দেখে, রমনীর বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠল। সে অস্থির হয়ে ভাইয়ের কাছে এসে অবস্থান করল। নিজের কোমল হাতের ছোঁয়ায় ভাইয়ের গাল স্পর্শ করল। কারো আদুরে স্পর্শ কায়াতে পড়তেই অসহায়ত্ব আঁখিযুগল দৃষ্টি মেতে তাকালো। সামনে অবস্থান করা মানুষ টিকে দেখে অধরের কোণে হাসি ফুটে উঠল। মলিনতার ছোঁয়ায় মাখা হাসিটা বেশ দারুন দেখালো রমনীর কাছে। সে হুংকার ছেড়ে বলল,
–তোমাদের সাহস কি করে হয়? আমার ভাইকে আহত করে এই অবস্থায় ফেলে রাখার! দ্রুত আমার ভাইয়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হোক৷ রমনীর কথায় গার্ডদের মধ্যে একজন বলল,
–আপনার সাহস কি করে হয় এখানে আসার! স্যার জানতে পারলে, তার সাথে আপনার মস্তকটাও কাটা যাবে। রমনী বস্ত্রের ভেতর থেকে ব’ন্দু’ক বের করে গার্ড হাত বরাবর মা’র’ল। গার্ডটা হৃদয়বিদারক চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তখনই কেউ রমনীর মুখশ্রী পেছনে থেকে চেপে ধরলো। রমণীকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছ। তা দেখে বিধস্ত যুবকটি বজ্র কণ্ঠে বলল,
–আমার বোনকে ছেড়ে দে জা’নো’য়া’র। আমি মুক্ত হলে তোকে আর তোর মুনতাসিমকে কে’টে টুকরো টুকরো করে কুকুরের খাদ্য বানাব। আমার বোনের কায়াতে একটা ফুলের টোকা পড়লে। আমি তোকে শেয়াল শকুনের মতো ছিঁ’ড়ে ছিঁ’ড়ে খাব। যুবকের কথায় পরিবর্তন আসলো না সামনে থাকা মানুষটার। সে আগের ন্যায় রমণীকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। বিধস্ত যুবকটি নিরুপায় হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখলো। তার জন্য তার বোনের করুন অবস্থাটা। ভেতরটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। মন বজ্রকণ্ঠে হুংকার ছেড়ে বলছে। প্রতিটি কাজের হিসাব দিতে হবে মুনতাসিম ফুয়াদ।
আনন্দ উল্লাস করে কে’টে দিল রজনী কে’টে গেল আস্ত একটা দিন। বিবাহের অনুষ্ঠান সন্ধ্যায় শুরু হবে। সূর্য মামা বিদায় জানিয়ে আঁধারকে আমন্ত্রণ করল ধরনীর বুকে আসার জন্য। সূর্য মামা বিলুপ্ত হবার সাথে সাথে, আঁধার ধরনীর বুকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। রাইমা বেগম বরযাত্রীর জন্য খাবার সাজাচ্ছিলেন। তখনই কর্ণকুহরে এসে পৌঁছল।
–কি রে রাইমা বিয়ের সময় তো হয়ে এল। কিন্তু ফরিদ তো এখনো এসে পৌঁছাল না। তুই ফরিদের নাম্বারটা আমাকে দে। আমি ফরিদকে ফোন দিয়ে দেখি সে কোথায় আসতে কতক্ষণ দেরি হবে?
–সে আসবে না আম্মা। আমার মায়ের অবস্থা ভালো না হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। সেখানে কেউ নেই যার ফলে মেহেভীনের বাবাকে আবার ঘুরে যেতে হয়েছে। মেহেভীনের বিয়ে হয়ে গেলে আমিও চলে যাব। মেহেভীনকে এ কথা বলবেন না। সে চিন্তা করবে। বৃদ্ধার বয়স্ক দৃষ্টি রাইমা বেগমের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে। সে এক কান দুই কান করতে করতে পাঁচ কান পর্যন্ত পৌঁছে দিল তথ্যটা। সবাই কানাঘুষা করছে তবে সামনে বলার সাহস কেউ পাচ্ছে না। এরমধ্যেই হৈচৈ শোনা গেল বর চলে এসেছে। সবাই বরকে বরন করার জন্য চলে গেল। এলাকার বাচ্চারা বরের গেট ধরেছে। তারা অনেক কষ্ট করে বরের গেট সাজিয়েছে। ফুল সংগ্রহ করে নিয়ে এসে বরের জন্য মালা বানিয়েছে৷ এত কষ্ট কিছুতেই বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না। তার মধ্যে একটা ফর্সা বাচ্চা ছেলেকে দেখে শেহনাজ বলল,
–আমরা তোদের টাকা দিতে পারি। কিন্তু আমার একটা শর্তে আছে। তোদের সাথে কালো শার্ট পড়া ছেলে টাকে আমার ভিষণ পছন্দ হয়েছে। তোরা যদি এই কালো শার্ট পড়া ছেলেটার সাথে আমার বিয়ে দিস। তাহলে আমি তোদের এক হাজার টাকার বদলে পুরো পাঁচ হাজার টাকা দিব৷ শিশু মস্তিষ্ক শেহনাজের এমন কথায় লজ্জায় মস্তক নুইয়ে নিল। অন্যান্য বাচ্চারা তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে শুরু করল। আনন্দ উচ্ছাসে বর বরন হয়ে গেল। এবার খাওয়া দাওয়ার পালা সবাইকে খেতে বসানো হয়েছে। তখনই মুনতাসিমের দিকে ব’ন্দু’ক তাক করা হয়। যখন শু’ট করতে যাবে তখনই পেছনে থেকে মিরাজুলের মুখশ্রী চেপে ধরা হয়৷ মিরাজুল যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে। ছাড়া পাবার জন্য শত রকমের কৌশল ব্যবহার করে-ও মানুষটার হাত থেকে ছাড়া পেতে সে ব্যর্থ হয়৷ দু’জন ধস্তাধস্তি করতে করতে মিরাজুল নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তখনই মানুষটা মিরাজুলকে অজ্ঞান করে ফেলে। মিরাজুলের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল,
–আমার ভালোবাসার মানুষের ভালো থাকা কেঁড়ে নেওয়ার অধিকার আমি তোদের দেইনি। যেখানে আমি নিজেই নিজের মনকে বুঝিয়েছি মানিয়েছি। সেখানে তোদের সাহস হয় কি করে! তাদের সুখের দিকে নজর দেওয়ার? তোদের এতটা দূরে পাঠাব যতটা দূরে গেলে ফিরে আসতে পারবি না। কথা গুলো বলেই উন্মাদের মতো উচ্চ হাসিতে মেতে উঠল।
মেহেভীনকে লাল টকটকে রঙের শাড়ি পড়ানো হয়েছে। সমস্ত কায়া জুড়ে সোনার অলঙ্কার পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই মুগ্ধ হয়ে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেয়েটার ভেতরে এতটা সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। তা মেয়েটার বিয়ে না হলে জানতেই পারতো না। সবাই মনে মনে আফসোস করতে শুরু করল। কেউ কেউ ঈর্ষা করছে। মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রী মলিনতায় ছেয়ে গিয়েছে। এত ভীড় এত কোলাহল আঁখিযুগল মাকে খুঁজতে ব্যস্ত। এর মধ্যেই কাজী সাহেব চলে আসলো বিয়ে পড়ানোর জন্য। মুহূর্তের মধ্যে পুরো কক্ষ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কিছু মেয়ে মেহেভীনের মস্তকে বড় করে ঘোমটা টেনে দিল। কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করে দিল। অদ্ভুত ভাবে মেহেভীনের ভেতরে ভয় কাজ করছে। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। কণ্ঠনালি দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে না। নিজেকে যতই স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। মানসিক ভাবে সে ততই অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। অনবরত অশ্রু বিবর্জন দিয়েই যাচ্ছে। তবুও মুখশ্রী দিয়ে কবুল শব্দটা উচ্চারিত হচ্ছে না। দীর্ঘ সময় নিয়ে কবুল বলতে সক্ষম হলো মেহভীন। সবাই মোনাজাত ধরল। বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ হতেই সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করা হলো। মেহেভীনকে বিদায়ের জন্য বাহিরে নিয়ে আসা হলো। মুনতাসিমের দৃষ্টি মেহেভীনের দিকে যেতে ডান হাতটা আপনা-আপনি বুকের পা পাশে চলে গেল।
–আমি শেষ এই মেয়ে আমাকে একদম শেষ করে দিয়েছে। নিজের অস্তিত্ব বলতে যতটুকু ছিল আজ সবটুকু নিজের মধ্যে গ্রাস করে নিয়েছে। বেহায়া আঁখিযুগল চোখের পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছে। আজ আঁখিযুগল তাকিয়ে থাকতেও দ্বিধাবোধ করছে না। আজ থেকে এই মানুষটা একান্তই তার নিজের, এই মানুষটার প্রতি একান্তই তার অধিকার থাকবে। তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে শুধু সে বিচরণ করবে। তাইয়ান নিজের আবেগকে দমিয়ে রাখতে পারল না। উৎসুক কণ্ঠে বলল,
–এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবেন না স্যার। এখানো পুষ্প শয্যার রাত বাকি। একবার বিয়ে না করে-ও সন্তানের বাপ হতে হতে বেঁচে গিয়েছেন। এখন বিয়ে করে বাপ না হতেই পটল তুলবেন? কথা গুলো বলেই তাইয়ান মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। সাথে সাথে তার জান উড়ে যাবার জোগাড়। সে শুকনো ঢোক গিলে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। ভয়ে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। সে মলিন গলায় বলল,
–স্যরি স্যার সবাই কত আনন্দ করছে। আপনাদের নিয়ে কত মজার মজার কথা বলছে। আমিও বলে ফেলছি ছোট ভাই মনে করে মাফ করে দেন। মুনতাসিম কিছু বলল না। সে সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তাইয়ানের মুখশ্রীতে হাসি ফুটে উঠল। সে জানে সে ঠিক কতটা প্রিয় মুনতাসিমের। মুনতাসিম মুখে যাই বলুক না কেন, সে কোনোদিন তাইয়ানের কিছুই করবে না। মুনতাসিমের রক্তিম দৃষ্টিকে ভয় পাওয়া যেন তার প্রতিদিনের অভ্যাস। সে ভয়কে দূরে সরিয়ে দিয়ে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠল।
–আজকালকার যুগে বিয়ের দিন মেয়েরা কাঁদতেই ভুলে গিয়েছে। নিজের বিয়েতে নিজেই নাইচা গাইয়া উল্টায়া দেয়। আমাদের মেহেভীন সোনার টুকরো একটা মেয়ে। ছোট বেলা থেকে কোনো বাজে রিপোর্ট নাই। এমন মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। দোয়া করি মা স্বামীর সংসারে তুমি সুখী হও। হাতের মেহেদীর রঙও দেখি ভিষণ গাঢ় হয়েছে। শুনেছি যার হাতের মেহেদীর রঙ যত বেশি গাঢ় হয়। সে স্বামীর সোহাগ তত বেশি পায়। মহিলাটির কথা গুলো কর্ণকুহরে আসতেই সবাই উচ্চ শব্দে হেসে উঠল। মেহেভীন শক্ত করে মায়ের হাত ধরে আছে। মুনতাসিমকে মেহেভীনের পাশে নিয়ে এসে দাঁড় করানো হলো। মাশরাফি শেহনাজকে বলল,
–বিয়ে করার সাথে সাথে ভাইয়ার ক্ষমতা কি আরো বেড়ে গেল নাকি আপু? কবুল বলার সময় এত দ্রুত বলল যেন ভাবি পালিয়ে যাচ্ছে। এখন ভাবির পাশে এসে দাঁড়াতে বলতে না বলতেই ঝড়ের গতিতে এসে দাঁড়াল।
–ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দই আলাদা। যেদিন বড় হবি সেদিন বুঝতে পারবি। কথা গুলো বলেই শেহনাজ মুনতাসিমের পাশে এসে দাঁড়াল।
মুনতাসিম দুধ কলা খাইয়ে দেওয়া হলো৷ সেটার আংশিক অবশিষ্ট ছিল। বাকিটা মেহেভীনকে খাইয়ে দিল রাইমা বেগম। মেহেভীনের হাত মুনতাসিমের হাতে তুলে দিয়ে বলল,
–নিজের জান তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি। আমি বেঁচে থাকা অবস্থায় যদি কখনো মনে হয়। সে তোমার সাথে সংসার করার যোগ্য না। নিজ দায়িত্বে আমার কাছে দিয়ে যাবে। আমার বুকের জিনিস আমি আবার বুকে আগলে নিব৷ আমি তোমাকে ভরসা করেছি। তাই এই ভরসার হাতে আমার কলিজার টুকরাকে তুলে দিলাম। কখনো কষ্ট পেতে দিও না। তার অশ্রু গুলো মাটিতে পড়ার আগেই তুলে আমার মেয়েসহ সেটা দিয়ে যেও। আমি আমার মেয়ের ভালো থাকার আশায় তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। যেদিন আমার মেয়ের ভালো থাকাটা হারিয়ে যাবে। সেদিন আমার মেয়েকে দুঃখ দেওয়া মানুষটাও আর ধরনীর বুকে থাকবে না। এই মেয়ের জন্য আমি সমস্ত ধরনীর মানুষের সাথে যুদ্ধ করেছি। তাকে দুঃখ দিলে আঘাতটা আমার কলিজাতে লাগবে। আমি তোমাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছি। আমার ভরসার মূল্য দিও। আমার বিশ্বাস বিফলে যেতে দিও না বাবা। মুনতাসিম মেহেভীনের হাত শক্ত করে ধরে জবাব দিল,
–আজ থেকে তার সব দুঃখ আর বিপদ আমার। যেদিন আপনার ভরসার মূল্য ভেঙে যাবে। সেদিনই হবে আমার জীবনের শেষ দিন। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করব। আমাকে ভরসা করেই দেখুন না আন্টি। সময়ের সাথে প্রমাণ আপনি নিজেই পেয়ে যাবেন। মুনতাসিম কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী। মুনতাসিমের কথা শুনে রাইমা বেগমের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। মেহেভীন মাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। নিঃশব্দে কান্না করে যাচ্ছে। সবাই শক্তি প্রয়োগ করেও মেহেভীনকে ছাড়াতে পারছে না। মাকে না ছাড়ার পণ করেছে সে। রাইমা বেগম সবাইকে দূরে যেতে বলল। সে মেহেভীনের মস্তক তুলে বলল,
–বাচ্চাদের মতো আচরন করছিস কেন মেহেভীন?
–তুমি আমার সাথে চলো।
–লোক হাসাতে চাস। আমি এতটাও দুর্বল নই। নিজেকে রক্ষা করার মতো ক্ষমতা আমার আছে। আমাকে কঠিন হতে বাধ্য করিস না। চুপচাপ গিয়ে গাড়িতে বসবি। মেহেভীনের অবস্থা দেখে মুনতাসিমের ভিষণ খারাপ লাগছে। সে রাইমা বেগমকে বলল,
–আন্টি আপনি আমাদের সাথে চলুন।
–এটা দৃষ্টিকটু দেখায় বাবা। তোমরা সামনের দিকে এগোনোর প্রস্তুতি নাও। আমি মেহেভীনকে নিয়ে আসছি। তখনই সবাই হৈহৈ করে উঠল নতুন বউ কেন হেঁটে যাবে? আশেপাশে তেমন কেউ নেই যে তাকে বলবে। মেহেভীনকে সে গাড়ি পর্যন্ত কোলে তুলে নিয়ে যাক। তখনই নজরে আসে আয়মান সবাই আয়মানকে ধরল। আয়মান রাজিও হয়ে গেল তবে মেহেভীনের মাঝে একরাশ অস্বস্তি ঘিরে ধরল। যাকে বিয়ে করবে না বলে পালিয়েছে! তার কোলে সে কিভাবে উঠবে?মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই কারো গম্ভীর কণ্ঠ স্বর ভেসে এল।
–আমার কি হাত নেই? নাকি আমি প্রতিবন্ধী যে, আমি থাকার পরেও আমার বউকে অন্য কেউ কোলে নিবে! আমার বউকে কোলে তুলে নিয়ে যেতে হলে, আমিই নিয়ে যাব। তবুও কোনো পরপুরুষকে আমার বউয়ের কাছে আসতে দিব না। যারা অন্যকের বউকে কোলে নিতে বলে আর যারা অন্যের বউকে কোলে তুলে নিতে আসে। তাদের মতো মেরুদণ্ডহীন মানুষ ধরনীর বুকে দুটো নেই। কথা গুলো বলেই মেহেভীনকে কোলে তুলে নিল মুনতাসিম। আকষ্মিক ঘটনায় মেহেভীন বিস্ময় নয়নে মুনতাসিমকে দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের কান্ড দেখে সবাই মিটমিট করে হাসছে। মুনতাসিমের সাথে তাল মিলিয়ে সবাই গাড়ির কাছে চলে গেল। মেহেভীনকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে সে-ও মেহেভীনের পাশে বসে ফিসফিস করে বলল,”আজকে যতখুশি পারুন কান্না করে নিন। আজকের পর থেকে আর কোনোদিন কান্না করতে দিব না। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন মায়ের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত ভাবে আঁখিযুগল দিয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। মনের অজান্তেই ভেতরটা খালি খালি লাগছে।
চলবে…..
(আমাকে কেউ এক গ্লাস জামাই গুলিয়ে খাইয়ে দিন। ষ*ড়*য*ন্ত্র, মা*রা*মা*রি, বিচ্ছেদ এসব ভালো লিখতে পারি। কিন্তু রোমান্টিক পর্ব লিখতে গেলে শব্দ খুঁজে পাইনা। ধরেবেঁধে নিয়ে আসতে হয় শব্দ। রোমান্টিক কি লিখব খুঁজে পাইনা সাথে একটু লজ্জাও লাগে। তার থেকে ভালো ঠা’স ঠা’স করে নায়ক নায়িকাকে মে’রে ফেলা রোমান্টিকতা পর্ব লিখার ঝামেলা থাকেনা। ঝামেলা ছাড়াই বিয়ে দিলাম। দেরি করে দেওয়ার জন্য বিশাল একটা পর্ব দিয়েছি। সবাই রেসপন্স করবেন ধন্যবাদ। শব্দসংখ্যা:২২৪৪)