#তুমি_আমার_স্নিগ্ধ_ফুল
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর
#পর্বঃ১৩
ফজরের আজানের শব্দে প্রীতির ঘুম ভাঙলো। কান্না করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলো টের পায় নি। ঘুম ভাঙতে কান্নাগুলো আবার উপচে পড়তে লাগলো। নিজেকে একটু সামলে উঠে যেয়ে ওজু করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলো। নামাজে শেষ করে কান্না করে করে আল্লাহর কাছে চাইলো যাতে ওর ভাই আর প্রিয় বন্ধু যেনো সুস্থ থাকে আবার ওদের মাঝে ফিরে আসে।
প্রীতি নামাজ শেষ করে ছাঁদে গেলো। সব কিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। বাসার ভিতরে দম বন্ধ হয়ে আসছে তাই ছাঁদে গেলো। চারেদিকে এখনো ভোরের আলো ভালো করে ফোটে নি। শীতের সকাল তাই চারেদিকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন। রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে নীরবে অশ্রু ফলতে লাগলো।
এদিকে শাফিন ওদের বাসার ছাঁদে দোলনায় মাথা নিচু করে চুল খামছে ধরে বসে আছে। সারারাত এখানেই ছিলো। সব কিছু কেমন বিষাদে ছেয়ে গেছে। এতো চেষ্টার পর ও প্রাণ প্রিয় বন্ধুর খোঁজ মিললো না সাথে পিচ্চি বোনটার ও। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে কি করলে ওদের খোঁজ পাবে।
শাফিন যখন এগুলো ভাবতে ব্যস্ত তখন কারো ফোপাঁনির শব্দ কানে ভেসে আসলো। শব্দ অনুসরণ করে সামনে তাকাতে দেখলো প্রীতি কান্না করছে।
শাফিন দ্রুত উঠে প্রীতিদের ছাঁদে চলে গেলো। পাশাপাশি বাড়ি হওয়াতে এক ছাঁদ থেকে আরেক ছাঁদে যাওয়া যায়। শাফিন প্রীতির কাছে এসে প্রীতির এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে শাফিনের বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। মেয়েটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না দুটো দিন ধরে পাগলের মতো কান্না করেই যাচ্ছে।
শাফিন কোনো কথা না বলে প্রীতির সামনে যেয়ে আলতো করে চোখের পানি মুছে দিলো।
প্রীতি শাফিনের দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকি ভাঙা গলায় বললো ভাইয়াদের কোনো খোঁজ পাও নি?
এ কথায়র কোনো উওর দিতে পারলো না শাফিন চুপচাপ প্রীতির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
শাফিনকে কোনো কথা না বলতে দেখে প্রীতি বুঝে গেলো উত্তর। উত্তর বুঝতে ডুকরে কান্না করে উঠলো।
শাফিন আলতো করে প্রীতিকে বুকের মাঝে আগলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ ওভাবে চুপ থেকে শাফিন ধীর গলায় বললো কান্না করো না। দেখো পারফিদের কিছু হবে না আল্লাহ সহায় আছেন। ওদের যেকোনো মূল্যে খুঁজে বের করবো। আর কান্না করো না, তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে হবে বলো? নিজের কি হাল করেছো? পারফি আর ইয়ানা ফিরে এসে তোমার এই অবস্থা দেখলে ওরা কষ্ট পাবে না বলো? নিজেকে একটু সামলাও আর কান্না করবে না এ বলে প্রীতির চোখের পানি মুছে দিয়ে আবার বুকের মাঝে আগলে নিলো।
প্রীতি ওভাবে থেকে ফের ভাঙা গলায় বললো ভাইয়াদের এনে দেওনা আমার কাছে। ইয়ানা, ভাইয়াকে ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ওদের কিছু হলে আমি বাঁচবো না। এনে দেওনা ওদের আমার কাছে।
শাফিন প্রীতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো কিছু হবে না ওদের। প্রমিজ ওদের সুস্থ অবস্থায় তোমার কাছে এনে দিবো। আর কান্না করো না সব ঠিক হয়ে যাবে।
শাফিনের কথায় প্রীতি কিছুটা শান্ত হলো। ওভাবে নীরবে কিছুক্ষণ শাফিনের বাহুডোরে ছিলো।
ভোরের আলো চারেদিকে ভালো করে ফুটতে শাফিন প্রীতিকে নিজের থেকে ছাড়ি প্রীতি গালে হাত রেখে বললো এখন ভদ্র মেয়ের মতো নিচে যেয়ে কিছু খেয়ে ঘুৃম দিবে। দুদিন থেকে কিছু খাও নি এখন খেয়ে ঘুৃম দিবে। আমি তোমার কাছে ওদের দুজনকে এনে দিবো প্রমিজ। এবার চুপচাপ নিচে যাবে আর যা বলেছি তা সুন্দর ভাবে সব করবে কেমন?
প্রীতি উপর নিচে মাথা দুলিয়ে বুঝালো করবে। তা দেখে শাফিন বললো গুড এবার যাও এ বলে প্রীতিকে ছেড়ে দিলো।
প্রীতি শাফিনের দিকে একবার তাকিয়ে ধীর পায়ে নিচে নেমে গেলো।
শাফিন প্রীতির যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণ পর নিজেও নিচে নেমে গেলো এখন বের হতে হবে।
——————————————-
বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে একটা বেঞ্চের উপরে বসে আছে পারফি আর ইয়ানা। বাস আসতে আরো অনেকটা সময় বাকি তাই দুজন বসে রইলো।
কিছুক্ষণ পর দেখতে পেলো পাশে ছোট একটা দোকান খুলছে। পারফি সেখানে যেয়ে দু বোতল পানি আর শুঁকনো কিছু খাবার কিনে এনে ইয়ানার পাশে বসে সেগুলো ইয়ানার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো এর থেকে বেশি কিছু এখানে পাওয়া যাবে না। আপাতত কষ্ট করে এইটুকু দিয়ে ম্যানেজ করে নেও।
ইয়ানা মুচকি হেসে বললো এতেই হবে তারপর বোতল খুলে চোখমুখে পানি দিয়ে খেতে লাগলো। খাওয়ার মাঝে খেয়াল করলো পারফি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ইয়ানা চোখ তুলে তাকাতে দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো। ইয়ানা বরাবরের মতো এবার ও পারলো না ওই নীলমনির দিকে তাকিয়ে থাকতে। তারাতাড়ি চোখ সরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো আপনিও চোখমুখ পানি দিয়ে একটু খেয়ে নিন ভালো লাগবে।
ইয়ানার কথায় পারফি ভাবলো আসলে চোখমুখে একটু পানি দেওয়া প্রয়োজন। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে তাই পানি নিয়ে চোখে পানি দিতে হাতে জ্বলন অনুভব করলো। তাই হাতের দিকে তাকাতে খেয়াল হলো হাত কাঁটার দিকে। রক্ত জমাট বেঁধে আছে তা দেখে ভালো করে হাত ধুয়ে নিলো। আশপাশে চোখ বুলালো কোনো ফার্মেসি আছে কিনা কিন্তু কোনো ফার্মেসি চোখে পড়লো না।
পারফি চোখমুখে পানি দিয়ে সেই টঙ এর দোকানে ফের যেয়ে দু কাপ চা নিয়ে আসলো। প্রচন্ড মাথা ধরেছে চা খেলে একটু ভালো লাগতে পারে তাই যেয়ে চা নিয়ে আসলো।
চা নিয়ে এসে বেঞ্চ বসে এক কাপ চা ইয়ানার দিকে বাড়িয়ে দিলো।
এখন সত্যি চা টা খুব প্রয়োজন ছিলো তাই চা টা হাত বাড়িয়ে নিয়ে ছোট করে পারফিকে বললো ধন্যবাদ।
ধন্যবাদের বিনিময়ে পারফি মুচকি হাসি দিলো। ইয়ানার চোখ আটকালো সেই মুচকি হাসিতে। নিজের অজান্তেই পারফির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
পারফি চাতে চুমুক দিয়ে ইয়ানার উদ্দেশ্যে বললো চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে ।
পারফির কথায় ইয়ানার ঘোর কাটলো। এতো সময় এভাবে তাকিয়ে ছিলো ভাবতেই লজ্জায় পড়ে গেলো। নিজেকে মনে মনে বকতে লাগলো ওভাবে তাকিয়ে থাকার জন্য।
কিছুসময় পর সেখানে এসে বাস থামলো। পারফি ইয়ানাকে নিয়ে বাসে উঠে বসলো। এখান থেকে ঢাকা পৌঁছাতে আরে ৩,৪ ঘন্টা লাগবে। তাই সিটের সাথে শরীরে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে রইলো পারফি।
ইয়ানাও দূর্বল শরীর সিটে এলিয়ে দিতে চোখে রাজ্যের ঘুম এসে ভর করলো। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো।
———————————
দীর্ঘ জার্নির পর অবশেষে ঢাকা পৌঁছাতে সক্ষম হলো পারফিরা। বাস থেকে নেমে পাশে একটা দোকানে যেয়ে দোকানদারের কাছ থেকে ফোন নিয়ে শাফিনকে ফোন লাগালো।
শাফিন অচেনা নাম্বার দেখে তারাতাড়ি ফোন রিসিভ করলো। ফোন রিসিভ করে ওপাশে থাকা মানুষটার ভয়েস শুনে জীবন ফিরে পেলো যেনো। বিচলিত হয়ে বলতে লাগলো পারফি ঠিক আছিস? কোথায় আছিস? দুদিন কোথায় ছিলি? ইয়ানা ঠিক আছে? কোথায় আছিস শুধু বল আমি এখনি গার্ডদের নিয়ে সেখানে পৌঁছে যাচ্ছি। সবাই কতটা টে….
আর কিছু বলার আগে পারফি বলে উঠলো রিলাক্স আমরা ঠিক আছি। ফোনে সব কিছু বলা সম্ভব না। আমি ঠিকানা দিচ্ছি এখানে এখনি চলে আয় তারপর সব বলছি। আর গার্ড আনা লাগবে না আমরা এখন বিপদমুক্ত আছি।
পারফি ঠিকানা দিতে শাফিন ছুটে চলে গেলো সেই ঠিকানায়। সেখানে পৌঁছে পারফি আর ইয়ানাকে দেখে জীবন ফিরে পেলো। ছুটে যেয়ে পারফিকে জড়িয়ে ধরে বললো সবাই কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তুই জানিস? কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি?এতো এতো খুজেও কোনো খোঁজ মিলে নি।
পারফি শাফিনের পিঠে চাপর মেরে বললো বলছি সব আগে বাসায় চল।
পারফির কথায় সম্মতি দিয়ে শাফিন পারফিকে ছেড়ে দাঁড়ালো। তারপর ইয়ানার দিকে চোখ পড়তে ইয়ানার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো ঠিক আছো তুমি?
ইয়ানা দূর্বল হেসে ছোট করে বললো ঠিক আছি ভাইয়া।
শাফিনের খুব খারাপ লাগলো কারণ দেখে বোঝা যাচ্ছে দুটো দিন শরীরের উপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। হাতে পায়ে কপালে ছোট ছোট ক্ষত গুলো বলে দিচ্ছে কি কি গিয়েছে ওদের উপর দিয়ে। শাফিন ওদের নিয়ে পাশে একটা ফার্মেসিতে চলে গেলো।
পারফি আর ইয়ানার ক্ষত স্থান গুলো পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করিয়ে তারপর দুজনকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। কিছুক্ষণ এর ভিতরেই বাসায় পৌঁছে গেলো।
ড্রয়িংরুমের সবাই উপস্থিত ছিলো কারণ শাফিন ফোন করে বলে দিয়েছিলো ওদের খুঁজে পেয়েছে কিছুক্ষণের মাঝে বাসায় আসছে। বাসায় প্রবেশ করতে পিয়াসা বেগম পারফিকে ঝাপটে ধরে কান্না করে দিলো। সারা মুখে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো।
পারফি মাকে বুকে আগলে নিয়ে শান্ত করতে লাগলো। বুঝাতে লাগলো কিছু হয়নি ও ঠিক আছে। তখন দেখলো কিছুটা দূরে প্রীতি অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে তা দেখে পারফি প্রীতিকে কাছে ডেকে বোনকেও বুকে আগলে নিলো। এতক্ষণে সবাই যেনো জীবন ফিরে পেলো।
কিছুক্ষণ পর প্রীতি পারফির থেকে সরে যেয়ে ইয়ানাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। ইয়ানার ক্ষত গুলোতে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে ব্যথিত গলায় বললো খুব কষ্ট পেয়েছিস? সব আমার জন্য হয়েছে। আমি যদি ওদিন তোকে আমাদের বাসায় না আনতাম তাহলে এমন কিছু হতো না৷ আমার জন্য আজ কতোটা কষ্ট পেতে হলো তোকে বলতে বলতে কান্না করে দিলো।
ইয়ানা প্রীতিকে শান্ত করতে বললো আমি ঠিক আছি কান্না করিস না। এই দেখ একদম সুস্থ আছি একটুও কষ্ট হচ্ছে না। আর একটু কান্না করলে কিন্তু আমিও কান্না করে দিবো বলে দিলাম।
ইয়ানার কথায় প্রীতি কান্নার মাঝেও হেঁসে ফেললো। তারপর একে একে সবাই ওদের খোঁজ খবর নিলো।
এক পর্যায়ে পারফি প্রীতির উদ্দেশ্যে বললো প্রীতি ওকে নিয়ে তোর রুমে যেয়ে ফ্রেশ করিয়ে রেস্ট নিতে দে। অনেক ধকল গিয়েছে ওর উপর এখন রেস্ট নেওয়া প্রয়োজন।
প্রীতি সম্মতি দিয়ে ইয়ানাকে নিয়ে উপরে উঠে গেলো। শাহানা বেগম কিছু খাবার নিয়ে ওদের পিছু পিছু উপরে গেলো । কোনো এক অজানা কারনে ইয়ানার প্রতি গভীর টান অনুভব করলো। ইয়ানার এমন করুন অবস্থা দেখে তার মন ও কেঁদে উঠলো।
ইয়ানা ফ্রেশ হয়ে আসতে নিজ হাতে খাইয়ে দিলো। ইয়ানার চোখ চিকচিক করে উঠলো এতে। এই অচেনা মানুষগুলো ওর জন্য কতোটা ব্যাকুল হয়ে আছে। এখানে হয়তো ওর নিজের মা থাকলে ফিরেও তাকাতো না ভাবতে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো একফোটা পানি।
ইয়ানাকে কান্না করতে দেখে শাহানা বেগম অস্থির হয়ে বললো কান্না করছো কেনো আম্মু? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলো আমাকে? ক্ষত গুলোতে খুব বেশি জ্বালাপোড়া করছে?
ইয়ানা কিছু না বলে শানাহা বেগমকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো আমি ঠিক আছি আন্টি।
শাহানা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো ইয়ানার। তারপর সবটুকু খাবার খাইয়ে দিয়ে একটু রেস্ট নিতে বললো। ইয়ানাও বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ শুয়ে পড়লো। শাহানা বেগম কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিচে নেমে গেলো।
প্রীতি ইসহাক আহমেদকে ফোন করে জানিয়ে দিলো ইয়ানার কথা। ইয়ানা ঘুমিয়ে পড়েছে তাই ও নিচে নেমে গেলো।
সবাই উপস্থিত হতে কি কি ঘটেছে সবটা খুলে বলতে লাগলো সবাইকে পারফি। সবটা শুনে সবাই ব্যথিত হলো কতোটাই কষ্ট পেতে হয়েছে দুটো দিন দুজনকে।
এখন পারফির রেস্ট নেওয়া প্রয়োজন তাই আর কেউ কথা বাড়ালো না। কারা এমন করেছে তাদের পরে ধরা যাবে তাই কেউ কথা না বাড়িয়ে পারফিকে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিতে বললো।
পারফি উপরে উঠে নিজের রুমে যেতে নিয়েও কিছু একটা মনে করে প্রীতির রুমে গেলো।
#চলবে?
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
হ্যাপি রিডিং….🥰