#বুকপকেটের_বিরহিণী
কলমে: মম সাহা
দ্বিতীয় পর্ব:
পথের ধারে ঝিমিয়ে এসেছে রোদ। একটি ক্লান্ত সন্ধ্যা তখন। শহরের পথ-ঘাট সেজে উঠেছে কৃত্রিম আলোয়।
করবী টিউশনি করিয়ে বের হয়েছে মাত্র। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। টিউশনির বাসায় স্টুডেন্টের আম্মুর কাছে সে আগামী মাসের বেতন অগ্রীম চাইতেই মহিলা কেমন উগ্র আচরণ দেখালেন। মুখ ঝামটি দিয়ে বললেন, ‘এত টেকা টেকা না কইরা একটু ভালো কইরা পড়াইবার মন দিলেও তো পারো। আমার পোলার হাতের লেখা দিনদিন বাজে হইতাচে হেইটা দেখবার পারো না? তাছাড়া আমরা কী হেই(সেই) মানুছ যে টিচারদের টেকা পয়ছা ছময় মতন দিবার পারি না।’
করবী আর কথা বাড়ালো না। এই স্টুডেন্টের মা একদম জন্মসূত্রে ঢাকার বাসিন্দা। তাই তার কথাবার্তায় আঞ্চলিক ভাব-সাব এবং আচার-আচরণে কিছুটা রুক্ষতা আছেই। তাই মহিলার সাথে আর কোনো কথা না বাড়িয়েই সে বাড়ি ত্যাগ করল। তার কাছে যদি সামান্য কিছু টাকা থাকতো তাহলে সে জীবনেও এ বাড়ির দিকে ফিরে তাকাতো না। শিক্ষকতা পেশা সম্মানের, সেই সম্মানই যদি না পায় তবে এ’ পেশা করানোর মানে হয় না। কিন্তু কী করার! পেটের জন্য কখনো পিঠের মাইর সহ্য করতে হয়। পেট চালানোর জন্য সম্মান কখনো সখনো বিসর্জন দিতে হয়। তবে মধ্যবিত্তের যে সম্মান বেশি দামী!
বাকিদের কাছে অগ্রীম বেতনের কথা বলেনি সে, ভেবেছিল এই পরিবারটি যেহেতু বেশ স্বচ্ছল তাই চাইলেই মেডামের বেতন তারা হয়তো মাসের আগেই দিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু করবী বুঝেনি, এদের অর্থ থাকলেও যে মানসিকতায় অনেক ঘাটতি আছে। বুকে একরাশ দীর্ঘশ্বাস এবং মাথায় এক ঝাঁক চিন্তা নিয়ে সে যখন ফুটপাতে হাঁটা আরম্ভ করল ঠিক তখন পেছন থেকে তার ডাক এলো,
“মেডাম, একটু দাঁড়ান।”
করবী দাঁড়ালো। পিছনে ফিরে দেখলো তার বারো বছরের ছাত্রটি দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। হয়তো ছুটে এসেছে বলে ক্লান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু মাত্রই তো ওদের বাসা থেকে বের হলো, তাহলে কোন কারণে আবার ছেলেটি এখানে এলো? করবীর ভাবনার মাঝেই সুন্দর গোলগাল ছোটো ছেলেটি এগিয়ে এলো। মেডামের পাশে দাঁড়িয়ে সে এক গাল হাসল। করবী বাচ্চাটির মায়ের আচরণ ভুলে ছেলেটির ফুলো ফুলো গাল গুলো টেনে দিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল,
“অর্পণ, তোমার এখানে কী? কোনো কাজে এসেছো?”
অর্পণ মাথা নাড়াল উপর-নীচ। তারপর ব্যস্ত ফুটপাতে একবার চোখ ঘুরিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল,
“মেডাম, তুমি কী কষ্ট পেয়েছো আম্মুর কথায়? কষ্ট পেয়ো না, তুমি তো জানো আম্মু কেমন!”
করবী ভারী অবাক হলো অর্পণের এমন কথায়। ছেলেটা বেশ চঞ্চল ও দুষ্টু। প্রথম যেদিন ও গেল পড়াতে, সেদিন করবীর হাতে কামড় লাগিয়ে দেয় অর্পণ। চুল টেনেও ধরেছিল। কিন্তু করবী ধমকা ধমকি করেনি মোটেও। তারপর এই বাঁদর ছেলে কীভাবে কীভাবে যেন করবীর ভক্ত হয়ে যায়। দীর্ঘ পাঁচ বছর সে এই মেডামকে ছাড়া আর কিছু কল্পনাও যেন করতে পারেনা। বাচ্চাটিও কি তবে তার মায়ের এমন পর্দা হীন আচরণে লজ্জা পেলো!
করবীর ভাবনার মাঝে অর্পণের কণ্ঠ ভেসে এলো,
“মেডাম, শুনো…….”
করবী ভ্রু উঁচু করে শুধায়, “কী?”
অর্পণ তখন সাবধানী হাতে পকেট থেকে টাকা বের করে। এক হাজার টাকার তিনটি কচকচে নোট। সেটা করবীর সামনেই অন্য পকেট থেকে খাম বের করে টাকা গুলো খামের ভেতর ঢুকিয়ে করবীর হাতে দেয়। তারপর গাল ভর্তি হাসি দিয়ে বলে,
“নেও তোমার সম্মানী। আব্বুর কাছ থেকে জন্মদিন উপলক্ষে এটা নিয়েছিলাম। বলেছিলাম বন্ধুদের খাওয়াবো। কিন্তু আমার বন্ধুদের খাওয়ার থেকেও তোমার এইটা বেশি প্রয়োজন, তাই তুমি রেখে দাও। তোমাকে যখন আম্মু দিবে সম্মানী, তখন নাহয় আমারটা আমাকে শোধ করে দিও? বুঝোই তো প্রেস্টিজ ইস্যু। বন্ধুরা নাহয় খেপাবে।”
করবী অবাক হয়। বিস্ময় পৌঁছে যায় আকাশ অব্দি। সে দ্রুত খামটা অর্পণের দিকে বাড়িয়ে দেয়,
“এমা, অর্পণ! তুমি তোমার টাকা কেন আমাকে দিয়েছো, বোকা ছেলে? মেডামের অতটাও প্রয়োজন নেই টাকা। তুমি রেখে দাও এগুলো। আর কখনো এমন করবে না কেমন? যাও বাসায়।”
করবী টাকাটা দিলেও অর্পণ নিল না। বরং মাথা নামিয়ে ফেলল। খুব ধীরে বলল,
“আম্মুর কাছে টাকা চাওয়ার সময় যে তোমার চোখ থেকে পানি পড়েছিল সেটা আম্মু না দেখলেও আমি দেখেছি। তুমি নেও এটা, মেডাম। পরে শোধ দিয়ে দিও, কেমন?”
কথাটা বলেই বাচ্চাটা ছুটে চলে গেলো। করবী বার কয়েক পিছু ডাকলেও বাচ্চাটির মাঝে থামা থামির কোনো ভাব দেখা গেলো না। ছেলেটার ছুটন্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে করবীর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। একটা বারো বছরের বাচ্চাও আজ তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে? সৃষ্টিকর্তা একটা পথ বন্ধ করলে আরো সাতটা পথ খুলে দেন- কথাট মিথ্যে নয়। অথচ তাও আমরা কত অভিযোগ করি!
করবীর সকালের লোকটার কথা মনে পড়লো। কতজনের কাছে সে ঋণী হয়ে যাচ্ছে! তাও আমরণ কৃতজ্ঞতা নিয়ে।
৩.
করবীর ছোটো বারান্দায় এখন রজনীর তমসা খেলা করছে। ঝিঁঝি ডাকছে অনবরত। ঘরে কারেন্ট নেই। ইদানীং রাত হলে কারেন্ট থাকে না। গরম বাড়ছে তো তাই। করবী মাত্রই খাওয়া দাওয়া করে বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। আসার সময় ছোটো ছোটো দু’টি রুই মাছ নিয়ে এসেছিল। বাবা সেগুলোই রান্না করেছে। করবীই কেটে-বেঁটে দিয়েছে, রান্নাও করতে চেয়েছে কিন্তু বাবা দেয়নি। বাবা হয়তো বুঝে মেয়ের ক্লান্তির ইতিহাস। রান্না সুস্বাদু হলেও করবী খেতে পারেনি তেমন। ক্ষুধা বেশি থাকায় অল্পতেই পেট ভোরে গেছে। তাছাড়া আজকাল অনেকদিন পর পর মাছ খেতে পাচ্ছে তো, তাই মাছের প্রতি কেমন অভক্তি এসে গেছে। অথচ এই করবীই আগে মাছের মাথা না হলে ভাত খেতো না।
সারাদিনের অজস্র ক্লান্তি যেন ঝরঝর করে লুটিয়ে পড়ল শরীরের প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। পুরুষ মানুষ বলে, নারীদের আর কি চিন্তা? বেকারত্ব কেবল থাকে পুরুষদের। দায়িত্ব তো থাকে কেবল পুরুষদের। কিন্তু পুরুষ যদি একবার পরিবারের সে মেয়েটিকে দেখতো, যার মাথার উপর বড়ো ভাই নেই, বাবার নেই রোজগার…… তার প্রতিদিনের যুদ্ধটা কত ভয়ঙ্কর হয়। প্রতিনিয়ত তার বাঁচতে হয় সমাজের সাথে যুদ্ধ করে, মানুষের লোলুপতার সাথে যুদ্ধ করে এবং নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ করে। পুরুষেরা এই ক্ষেত্রে একটা জিনিস থেকে বেঁচে গেছে। তাদের অন্তত প্রতিনিয়ত কারো লোভের সাথে যুদ্ধ করা লাগছে না। নিজের চরিত্রে দাগ লাগার ভয়ে তটস্থ থাকা লাগছে না।
বারান্দার গ্রিল ভেদ করে সামন্যই বাতাস আসছে তবে এতটুকুই শরীরকে প্রশান্তি দিচ্ছে। সেই প্রশান্তিতে করবীর চোখ লেগে যায়। ঝিমুতে ঝিমুতে এক সময় তলিয়ে যায় ঘুমের দেশে। ঘুমের মাঝেও মেয়েটা কী ভেবে যেন বার কয়েক শিউরে ওঠে। তৈয়ব হোসেন বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে সবটাই দেখে। বার কয়েক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগে। বাবা হয়ে সন্তানের দুঃখ চোখ মেলে দেখা ছাড়া তার উপায় নেই আর! কী দুর্ভাগা সে!
করবী ঘুমের মাঝে বার কয়েক কেঁপে কেঁপে উঠে। কি জানি, মধ্যবিত্তের এই সিন্ড্রেলা কোন রাক্ষসীর স্বপ্ন দেখে ভয় পাচ্ছে৷ অবশ্য গরীবের জন্য বড়ো রাক্ষসী তো তার অভাব অনটন। তৈয়ব হোসেন মেয়ের মাথায় হাত রাখতেই ঘুমন্ত মেয়েটির কপালের ভাঁজ শিথিল হয়ে আসে। ভরসার হাত টুকু পেতেই মেয়েটি নিশ্চিন্তে ঘুমায়। কারণ মেয়ে তো জানে, বাবা গরীব হোক কিংবা বড়োলোক…. তার কাছে তার মেয়ে সবসময় রাজকন্যা। আর বাবা কখনো সেই রাজকন্যার ক্ষতি হতে দিবে না।
৪.
টাকা হারানোর কথাটা গোপনেই রাখল করবী। বাবা অসুস্থ, এর মাঝে এই খবরটা পেলে বাবা চিন্তায় হয়তো আরও অসুস্থ হয়ে পরবে। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলবে। যদি আরও কয়েকটা দিন সময় চেয়ে নেওয়া যায় তাহলে তো খারাপ হবে না।
সময়টা সকাল আনুমানিক দশ-টা। যথারীতি নিয়মে তৈরী হলো করবী। নিয়ম অনুযায়ী বারান্দায়ও গেলো। বাণী নামক টিয়া পাখিটা আবারও ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে বলল,
“সই, সই, সই, মনের কথা কই?”
করবী সম্মতি জানালো। তবে মনের কথা বলতে পারার অনুমতি পেয়েও বাণী মনের কথা বললো না। অনুমতিকে আপোষ করে গেলো নিঃসংকোচে। করবী হাসল। যেদিন বাণী প্রথম কথা বলল স্পষ্ট, সেদিন তার সাথে দু’টি অবাক ঘটনা ঘটেছিল। রাস্তায় একটি ছোটো বাচ্চা হারিয়ে গিয়েছিল। সে বাচ্চাটিকে তার বাবা-মা এর কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। বাচ্চাটির মা বেশ আন্তরিকতার সাথে করবীকে বার বার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল। এবং পরবর্তীতে দুই বছরের সেই মেয়ে বাচ্চাটির নাম নতুন করে সেই ভদ্রমহিলা রেখেছিলেন- করবী। যেহেতু করবীর মাধ্যমে নতুন করে আবার নিজের কন্যাকে খুঁজে পেয়েছিল। এরপর অবশ্য ওদের সাথে করবীর আর দেখা হয়নি৷ ওরাও করবীর বাসা চিনতো না যে আসবে। করবীরও আর সময় হয়ে উঠেনি যাওয়ার। এবং দ্বিতীয়টি হলো, করবীর বাবা তৈয়ব হোসেনের মুখটা হালকা বাঁকিয়ে গিয়েছিল একবার মিনি স্ট্রোক করে। অনেক চেষ্টার পরও পুরোপুরি মুখটা সোজা হয়নি। অথচ সেদিন তৈয়ব হোসেনের মুখটা নিজে নিজে সোজা হয়ে গেলো। অবিশ্বাস্যকর ভাবে ভদ্রলোক আগের মতন পরিষ্কার কথাবার্তা বলতে শুরু করল।
সে যুক্তি অনুযায়ী করবীর মনেহয় বাণী যেদিন মনের কথা বলতে পারবে সেদিন হয়তো আরেকটি আশ্চর্যজনক কিছু ঘটবে। হয়তো আরও একটি বিস্মিত কিছু। করবী তাই দিন গুনে, মনে মনে ভাবে বাণী আরো কয়েকদিন সময় বেশি নিয়ে তারপর মনের কথা বলতে শিখুক। এখনও করবীর দুঃখগুলো বাঁধ ভাঙেনি। যেদিন বাঁধ ভাঙবে, পুরো পৃথিবী অসহায় লাগবে, সেদিন নাহয় এই আশ্চর্য জনক ঘটনা দ্বিতীয়বার ঘটবে। করবীর আবারও ধৈর্য ধরার অনুপ্রেরণা জাগবে।
আজকে কোনোমতে খাবার খেয়েই বেরিয়ে গেলো করবী। প্রথমে টিউশনি গুলো একে একে শেষ করল। চারটা টিউশনি করিয়ে বের হতে হতে বাজল আনুমানিক সাড়ে চারটা। যেহেতু প্রতিটা স্টুডেন্টের বাসা অনেকটা দূরে দূরে এবং হেঁটে আসা যাওয়া লাগে তাই বেশ খানিকটা সময়ই লেগে যায় টিউশন করাতে। টিউশনি শেষ করিয়েই সে রওনা দিল বাড়িওয়ালাদের বাসার উদ্দেশ্যে। সে যে এলাকায় থাকে সে এলাকায় বাড়িওয়ালারা থাকেন না। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। যাদের টাকা আছে তারা প্রাধান্য দেয় বিলাসবহুল জীবনকে আর যাদের টাকা নেই তার সবটুকু উজাড় করে দেয় একটু বেঁচে থাকাতেই। সেই শর্তানুযায়ী বাড়িওয়ালারা বিলাসবহুল জীবন চাইবে সেটাই স্বাভাবিক।
করবীকে বাড়িওয়ালার বাসা অব্দি যেতে হয়নি। এলাকায় ঢুকতেই দেখা পেলো বাড়িওয়ালার। বাড়িওয়ালাকে দেখতেই সে মাথায় কাপড় দিল। যথেষ্ট শালীনতা বজায় রেখেই সে মার্জিত ভঙ্গিতে সালাম দিল,
“চাচা, আসসালামু আলাইকুম। আমি কোর্ট লেনের গলিতে থাকি আপনাদের চড়ুই ভিলাতে। দু’তালায়।”
বাড়িওয়ালা আন্তরিক হাসি দিলেন, “হ্যাঁ চিনেছি, চিনেছি। কবরী?”
করবীর মলিন হাসি আরও মলিন হলো। বলল, ” কবরী না চাচা, করবী আমার নাম।”
”ঐ তো, একই হলো। তা বলো কী বলবে? ভাড়াটা এনেছো?”
ভাড়ার কথা উঠতেই করবীর মুখটা ছোটো হয়ে এলো। দোনোমনা করে বলল,
“আসলে চাচা, আমাকে কী আর কয়েকটা দিন সময় দিবেন? আমি ভাড়ার টাকাটা অন্য একটা জরুরী কাজে ব্যয় করে ফেলেছি। আপনি কয়েকটা দিন সময় দিলে আমার সুবিধা হতো। এক সপ্তাহ সময় দিন, আমি জোগাড় করে দিয়ে যাব?”
সে কথাটা বেশ অস্বস্তি নিয়ে বলেই ভীরু চোখে বাড়িওয়ালার দিকে তাকালো। সে ভেবেছিল বাড়িওয়ালা তার এমন কথায় রেগে যাবেন। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। বরং ভদ্রলোকটির বিস্তৃত হাসি আর প্রশস্ততা লাভ করল। তিনি করবীর বাহুতে ডান হাত রেখে কেমন কামনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“বাড়ি ভাড়া না দিলেও তো হয়। আমার ঐ একটা ভাড়া না পেলেও কিছু আসে যায় না। তোমার এমন রূপ, এমন দেহ, এমন যৌবন থাকতে তুমি আমাকে ভাড়া দিতে চাও! বরং চলো, ভাড়ায় ভাড়ায় কাটাকাটি করে ফেলি? আমি বাসা ভাড়া দিলাম আর তুমি দেহ ভাড়া। কেমন হবে?”
কথাটা থামতেই লোকটার লোভনীয় চাহনিতে ঘিনঘিন করে উঠল করবীর শরীর। কি জানি কি হলো, সদা সকল পরিস্থিতিতে ঠান্ডা থাকা মেয়েটা ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করল। সশব্দে বাবার বয়সী লোকটার গালে চ ড় বসিয়ে দিলো। নিস্তব্ধ এলাকায় এই চ ড়ের শব্দে যেন শহরের নিঃসঙ্গ কাকও ভীত হলো। অথচ করবীর দৃষ্টি তীর্যক। রাগে শরীর তার কাঁপছে। সে এক দলা থুথু মেরে বলল,
“তোর জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। পাপী লোক।”
থেমে নেই ভদ্রলোকটিও। বরং আক্রোশে ফেটে পড়ে বলল,
“এই মাসেই আমার বাড়ি খালি করবি মা*। আর তোর রূপ কীভাবে এই রুহুল বেপারীর বিছানায় আসে কেবল সেটাই দেখিস।”
করবী আর কথা বাড়ায় না। ছুটে চলে যায় সেই স্থান থেকে। ঘৃণা-অপমানে তার মাথা ঘুরে আসে। এই নিষ্ঠুর শহরে নারীর বেঁচে থাকা যে বড়ো কষ্টের। বড়ো যন্ত্রণার। এই বুঝি প্রাণ নিলো শকূণে আর ইজ্জত নিলে পুরুষে!
হাঁটতে হাঁটতে ফুরায় না এই পথ। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হয় গন্তব্যে পৌঁছানোর রাস্তা। করবী ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে যায়। ফুটপাতের কিনারায় থাকা ছোটো প্লে গ্রাউন্ডটাতে গিয়ে বসে। ব্যাগের ভেতর থাকা ফোনটা অনবরত বাজছে। নিশ্চয় বাবা কল করেছে! কিন্তু করবীর ফোনটা রিসিভ করার শক্তি হয়। ব্যাগের চেইন খুলে ছোটো বাটন ফোনটা হাতে নেয়। বাবা লেখাটা ঝাপসা হতে থাকে চোখের পাতায়। তার বড়ো ইচ্ছে করে বাবাকে নালিশ দিতে। হাহাকার করে বলতে- এ পৃথিবী করবীদের ভালো থাকতে দিচ্ছে না, বাবা। এ পৃথিবীর যে বাণীর মতন মন নেই।
কিন্তু সব কথা যে আর বলা হয় না শেষ অব্দি। যেমন বলা হলো না এই কথাটিও। ঠিক সেই মুহূর্তে করবীর মুখের সামনে একটি পানির বোতল এগিয়ে দেয় কেউ। পুরুষালী ভরাট কণ্ঠে বলে,
“যুদ্ধে নেমে কাঁদতে নেই, রক্তকরবী। অপরপক্ষ তাহলে দুর্বল ভাববে যে!”
করবী অবাক হয়। অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখে গতদিনের সেই শ্যামবর্ণের পুরুষটি দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে তার মিহি হাসি।
#চলবে