#এলোকেশী_সে
#মাহমুদা_লিজা
পর্বসংখ্যাঃ২০
বুকের ভেতর অস্হিরতার আবেশ অনুভব করছে অহন। সিঁড়ি বেয়ে যত এক ধাপ করে এগোচ্ছে, হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিক গতি ততই বাড়ছে। তবুও চেহারার শীতলতা লোপ পেলো না। নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রাখার কৃত্রিম ভানটা একেবারে অকৃত্রিম লাগছে। সিঁড়ির সবগুলো ধাপ শেষ করতেই তার দৃষ্টি আটকালো ডানের ঘরটায়। বাহির থেকে বন্ধ ঘরটা তার অনুভূতি রাঙিয়ে দিলো যেন। এইতো গত দিনও এই ঘরটায় আসার জন্য কত বাহানা সাজাতে হতো। আর আজ! এই ঘরের মানুষটা তার নিজের ঘরে সদর্পে বসে আছে। কোন লুকোচুরি নেই, কোন বাহানা নেই। বৈধ অধিকারের জোর আছে তার। ঠোঁটের কোণের হাসিটা দ্বিগুণ প্রশস্ত হলো। দু’পা পেছনে গিয়ে নিজের ঘরের দিকে ঘুরতেই ভ্রু কুঁচকে এলো তার। অনু, পরশ, প্রহর, তুষার আর তন্ময় টান টান উত্তেজনা নিয়ে দাঁড়ানো, যেন ফুটবল বিশ্বকাপ চলছে। গম্ভীর স্বরে অহন শুধালো -“আবার কি?”
অনু ফিসফিস করে বলল -“দুলাভাই, বউকে দেখতে হলে খরচা করতে হবে। আপনি আমাদের দু’হাজার দিলেই হবে। দাদুর টাকায় তো আরো দু’জনের ভাগ আছে কিন্তু আপনি এখন যে টাকা দিবেন ওতে শুধু আমাদের ভাগ। তোড়াও পরে ভাগ চেয়ে বসবে।”
অনুর প্রস্তাবে সমর্থন জানালো তার দলভারী করা ছেলের দলটাও। উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে বলল -“জ্বি দুলাভাই, ভাবী ঠিক বলছে।”
সমাবেশে শ্রোতাদের শান্ত করার জন্য নেতা যেমন হাত নাড়িয়ে এপাশ ওপাশ করে, অনুও সেভাবে ছেলের দলটাকে শান্ত করার ভঙ্গিতে হাত নাড়ল।
উপরের হৈ-চৈ শুনে মিরান আর অয়ন দৌড়ে উঠল সিঁড়ি বেয়ে। অহনের দরজার সামনে ভিড় দেখে সজোর ধমকে বলল -“যাও ঘুমাতে যাও সবাই, ডাকাতি করতে নেমেছে আবার।”
অনু মুখভার করে বলল -“বেয়াই মশাই আপনি কেন শালী-দুলাভাইয়ের লেনদেনে অপরিষ্কার বা’হাত দিচ্ছেন? ঘুমাতে যান আপনি। টাকা না নিয়ে সরব না।”
অয়ন বেশ বুঝতে পারল অনু তাকে জব্দ করতে চাইছে। এক ঢিলে দু’ভাইকে কাবু করার ফন্দি এঁটেছে। সে-ও দমে যাবার নয়। ফিরতি চালে কুপোকাত করল স্ত্রীকে -“ওহ আচ্ছা, আপনার আজ্ঞা মানছি তবে।”
অনুর ঠোঁটে জয়ের হাসি। অয়ন সেই হাসিকে ম্লান করতে বোমা ফাটালো -“চলুন মিরানভাই, আজ আপনার সাথে থাকব। দু’জনে মিলে নিকোটিনের ধূম্র বাষ্পে মন ভাসাব। ঐ ঘরটায় ভূতের দল কিচিরমিচির করে রাত জেগে। আমার ভয়ে তারা কারো ঘাড় মটকানোর সাহস পায়না। থাক, আজ বাড়ির ছেলের বিয়ে উপলক্ষে তারাও পার্টি করুক। চলুন।”
কথাটা বলে সামনে পা বাড়াতেই মৃদু চিৎকার করে অনু বলল -“নাহ, আপনি যাবেন নাহ। আমিতো মজা করেছি।”
হু হা করে হেসে দিল উপস্থিত সবাই। অহনও হাসল নীরবে। পকেট থেকে টাকা বের করে অয়নের হাতে দিয়ে বলল -“তোদের ভাগ দিবে না বলেই চুপিচুপি এসেছিল সবাই। ডিমান্ডের চেয়ে বাড়িয়ে দিয়েছি। সমান ভাগ হবে।”
অনু খুশিতে দিশেহারা হয়ে হামলে পড়ল অহনের পায়ে। গদগদ বচনে বলল -“ধন্যবাদ ভাইয়া।”
লাফিয়ে দু’পা পেছাল অহন। অনু সামনে পা বাড়াতেই ছেলের দলটা অনুসরণ করলো তাকে। হৈ হৈ করে সবাই এগিয়ে গেল। পেছনে রেখে গেল প্রেমিক পুরুষটাকে।
আচমকা কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে ঘোর ভাঙল অহনের। ঘাড় ঘুরিয়ে অয়নকে দেখে হাসার চেষ্টা করল। অয়ন ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল -“দাঁড়িয়ে কি ভাবছিস? আরে পরিচিত বউ, লজ্জা পাইস না। নাকি ভাবতেছিস তোর আবেগ কাজ করতেছে, বিবেক কাজ করে না!”
অন্যসময় হলে এতক্ষণে ভাইয়ের কান মলত অহন। আজ ইচ্ছে করছে না বাচ্চামো করতে। তার আগে অবশ্য অয়ন বলল -“যা তোর বউ অপেক্ষা করছে। হ্যাভ এ সুইট ড্রিম।”
দ্রুত পদে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল অয়ন।
***********
আধ বেড়ানো দরজাটা ঠেলে নিজের কক্ষটায় আসল অহন। বুকে হাত দিয়ে অস্হিরতা দমানোর ব্যর্থ চেষ্টা তার। শুকনো গলাটা ভেজাতে বারবার ঢোক গিলছে সে। জিভ বের করে চৈত্রের খরার মত শুকনো ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে আরেক পা এগোতেই দেখল জানালার পাশে রাখা চেয়ারটায় পা তুলে বসে উপন্যাসের পাতায় ডুবেছে তার এলোকেশী। তার অজ্ঞাতে ঘোমটাটা লুটিয়ে পড়েছে মেঝেতে। খোঁপা করা কৃষ্ণ কেশরাশিতে পেঁচানো কৃত্রিম গাজরা। শাড়ির আঁচল সরে যাওয়ায় পিঠের উন্মুক্ত অংশটুকু দৃষ্টির আড়াল হলোনা। ফর্সা পিঠটায় কাঁধের ইঞ্চি তিনেক নিচে কালো তিলটা এই প্রথম নজরে এলো অহনের। ঘড়ি লাগানো হাতটা মাথায় নিয়ে চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে বলল -“আসসালামু আলাইকুম।”
বইয়ের পাতায় বুঁদ হওয়া রমণীর কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি শখের পুরুষটার সালাম। আনমনা ললনার চুলের বাঁধন আলগা করে দিল অহন। মুহূর্তেই তরতরিয়ে উন্মুক্ত পিঠখানা ঢেকে দিল ঝরঝরে অবাধ্য কেশরাশি। সম্বিত ফিরতেই হাতের বইটা রেখে ঘোমটা টানল তোড়া। চেয়ার ছেড়ে হুড়মুড় করে নামতে গিয়ে পড়তে পড়তে টাল সামলে নিল বলিষ্ঠ হাতজোড়া আঁকড়ে ধরে। কপালের ওপরের অশান্ত চুলগুলো ঘোমটার আড়ালে গেলো না। হাত বাড়িয়ে তার এলো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিল অহন। ঘোমটার আড়ালে ঢাকা পড়া মুখটা দেখার জন্য হৃদয় ব্যাকুল হয়েছে তার। নিজ হাতে ঘোমটা সরিয়ে শীতল স্বরে বলল -“আমার দিকে তাকাবেন না? আমি কি দেখতে এতটাই কুশ্রী?”
কাজল টানা আঁখি যুগল দৃষ্টি মিলাল প্রেমিক পুরুষের দৃষ্টিতে। চিকন গোলাপি ঠোঁটজোড়ায় কৃত্রিম রঙটা তার তিরতিরে কাঁপন ঠেকাতে পারেনি। দৃষ্টি সরিয়ে নিল অহন। ঘাড় চুলকে বলল -“আপনার পাওনা মেটানোর মত আজ আমার প্রিপারেশন মোটেও ছিলো না। ধর্ম মোতাবেক আপনার পাওনা মিটিয়ে তবেই নিজের করে নেব। তার আগে আপনার ঐ কপালে কি একটা চুমু খেতে পারি? আপনাকে নিজের দু’বাহুর বেষ্টনীতে একবার আগলে নিতে পারি? কদুষ্ণ স্পর্শে আপনি কি নিজেকে সমর্পণ করবেন? স্রেফ এটুকুই চাওয়া। বাদবাকি আপনিটাকে না হয় আপনিই আমার করে নিয়েন!”
অমন আদুরে আবদার উপেক্ষা করার শক্তি নেই এলোকেশীর। ঠোঁটজোড়া কিঞ্চিৎ গোল করে শ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলল -“সম্পূর্ণ আমিটাই তো আপনার, মাস্টার মশাই। আপনার কোন আবদারে অসন্তোষ নেই আমার। হয়ত আর দশটা বউয়ের মত আপনাকে লাজুকতা উপহার দিতে পারব না কিন্তু আপনাকে অসম্মান করব না কখনো।”
কঠিন এই রমণীর কোমল হৃদয়ের সন্ধান পেলো প্রেমিক পুরুষ। ডান হাতটা বাড়িয়ে প্রেয়সীর নির্মেদ কোমরে রেখে মৃদু টানে নিজেদের দূরত্ব কমাল। নিজের উষ্ণ ঠোঁটজোড়া ছুঁইয়ে দিল স্ত্রীর কপালে। কোমল হাতখানা ততক্ষণে তার বুকের কাছটার পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরেছে। বলিষ্ঠ বাহুদ্বয়ে আবদ্ধ হয়ে পুরুষ্টু বুকটার কবোষ্ণ ছোঁয়া পেল। পেলব হাতজোড়া থেমে থেমে সুতনু নিজের পুরুষটার পিঠে ছোঁয়ালো। আড়ষ্টভাব দূর হতেই হাতজোড়া কঠিন করে আঁকড়ে রাখল স্বামীর পিঠে। বুকের ভেতরটায় দ্রিমদ্রিম হাতুড়ি পেটার শব্দ ধীরে ধীরে কমে এলো যেন। এলোকেশীর পিঠে রাখা হাতটা দৃঢ় হলো আরেকটু৷ গভীর শ্বাসটুকু টেনে নিজের চোখের কোণে জমা জলটুকু আলগোছে তর্জনী দিয়ে মুছে নিল। তার কল্পনার জালে এলোকেশীর এই রূপ দুষ্প্রাপ্য। সে হয়ত ভেবেছিলো তার স্ত্রী-ও লজ্জায় রক্তিম হবে, ভয়ে আড়ষ্ট হবে, জড়তায় সিটিয়ে থাকবে। কল্পনায় বারবার প্রার্থনা করেছিল অমনটা না হোক। তার আপন মানুষটা যেন সকল জড়তা ভুলে তাকে আগলে নেয় মুহূর্তে। তার সকল প্রার্থনা এত সহজে মঞ্জুর হবে তা ভেবে হাতের বাঁধন আরো খানিকটা দৃঢ় করে বলল -“ভালোবাসি তোড়ারাণী। আমার মনের শহরের এপাশ থেকে ওপাশ, সর্বত্র তোমার স্হান। তোমাকে পাওয়ার জন্য যদি সম্পর্ক ছেদ করতে হতো তবে আমি তা-ও করতাম। তবুও তোমার আলিঙ্গনের এই মুহূর্তের লোভ ছাড়তাম না।”
বুকের কাছটায় ভেজা ভেজা অনুভব হলো অহনের। তার এলোকেশী নীরবে কাঁদছে। তার বুকে লেপটে থাকা মুখটা তর্জনী দিয়ে নিজের দিকে তুলল। গালের দুপাশে হাত রেখে ছোট্ট গালটা নিজের হাতের তালুতে নিয়ে বলল -“কাঁদছেন কেন? কোন অভিযোগ?”
দু’পাশে মাথা নাড়াল তোড়া। নাক টেনে বলল -“কখনো ছেড়ে যাবেন?”
কান্নার তোড়ে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠা ঠোঁটজোড়ায় নিবদ্ধ দৃষ্টি টেনে হিঁচড়েও সরাতে পারছে না অহন। গম্ভীর স্বরে বলল -“এখন একদম কাঁদবে না। উল্টোপাল্টা কিছু একটা করে বসব। তখন দায় কে নিবে, হু! তোমার মোহর না মিটিয়ে তোমাকে স্পর্শ করাটা গর্হিত পাপ। আমি আগে দায়মুক্ত হতে চাই। তারপর সারাদিন আমার সামনে বসে কেঁদো। বারবার, হাজারবার তোমার প্রেমে পড়ব না-হয়।”
চোখজোড়া মুছে তোড়া বলল -“আজ নাকি ভরা জোছনা, আমি কিন্তু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবসময় ঐ চাঁদটা দেখতাম। আজ একদম নিয়ম ভাঙব না বলে দিলাম।”
নিজের ঘরের ব্যালকনির পানে চাইল অহন। মৃদু হেসে বলল -“চাঁদ দেখাব, তবে একটা শর্ত আছে।”
ভ্রু কুঁচকালো তোড়া। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে রইল মানুষটার দিকে। উত্তরের আশায় নিশ্চুপ রইল বেশ কিছুক্ষণ। প্রেমিক পুরুষের হুটহাট নীরবতা তার বেশ লাগে। এই যে এখনো নীরব হয়ে ঠোঁটে হাসি রেখে তাকে দেখছে এটাও তার কাছে বহুল কাঙ্খিত লাগছে। সে-ও ঘোর ভাঙালো না। থাকুক না সময়টা থমকে। আকাশের ঐ চাঁদটার বদলে আজ না হয় প্রেমিক পুরুষের চাহনিতেই ঘায়েল হোক।
খানিক বাদে অহন বলল -“শর্ত হলো আমি কিন্তু আপনাকে জড়িয়েই থাকব। আর আপনি চাঁদ দেখবেন। রাজি থাকলে কবুল বলুন আর রাজি না থাকলেও কবুল বলুন। আপনি না চাইলেও আমি জড়িয়েই থাকব আপনাকে।”
হাত বাড়িয়ে অহনের চশমাটা খুলে নিল তোড়া। নিজের তুলতুলে হাত দু’খানায় আবদ্ধ করল স্বামীর বা’হাত। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল ব্যালকনির পানে। দরজাটা ঠেলে সেথায় পা রাখতেই মৃদুমন্দ সমীরণ এসে ছু্ঁয়ে দিল তাদের। শীতল বাতাসে কেঁপে উঠল দু’জনে। রেলিঙের পাশে এসে দাঁড়াল তোড়া, দৃষ্টি রাখল ঐ দূর আকাশে। এলো চুলগুলো বাতাসে উড়ছে ঝরঝরিয়ে। নিজের একদম অনতিদূরত্বে থাকা পুরুষটা তাদের মধ্যকার ব্যবধানটা আরেকটু ঘুচিয়েছে। নির্মেদ কোমরের দু’পাশ থেকে হাত এনে পেটে রাখল। কেঁপে উঠল তোড়া। ঐ হিম বাতাসের চেয়ে এই স্পর্শের শিহরণ অধিকতর শীতল। লম্বাটে মানুষটার থুঁতনি স্পর্শ করল এলোকেশীর কাঁধ। এই কদুষ্ণ আলিঙ্গনেও কেঁপে উঠছে তোড়া। মৃদু হেসে বলল -“মাস্টার মশাই।”
তার ঠোঁটজোড়ায় নিজের তর্জনী রেখে অহন বলল -“একদম বেফাঁস কথা বলবে না অয়নের মত। শত শত স্টুডেন্টের ক্লাস নিয়েছি। তুমি কি বলতে চাইছ আমি বুঝতে পেরেছি।”
তোড়া ফিক করে হেসে দিল। নিজের হাত দিয়ে অহনের তর্জনী নিজের ওষ্ঠপুট থেকে সরিয়ে বলল -“সত্যি বলছি মাস্টার মশাই। এখন মনে হচ্ছে আমার আবেগ করছে, বিবেক কাজ করে নাই। বিবেক কাজ করলে নিশ্চয়ই আপনার শীতল স্পর্শে পুড়তাম না।”
নিজের লোমশ হাতটা স্ত্রীর গলার কাছটায় শক্ত বেষ্টনীর মত রেখে তার গালে ছোট্ট একটা চুমু বসাল অহন। পেটের ওপর রাখা স্বামীর হাতটা মুঠ করে ধরল তোড়া। শীতল স্বরে শুনতে পেল -“বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকো না, ঠান্ডা লেগে যাবে।”
তোড়া উপরে নিচে মাথা দুলালো কিন্তু সরে এলোনা রেলিঙের পাশ থেকে। তার অনুভূতির রঙে জোছনাও যেন দ্বিগুন আলোকিত হচ্ছে। তার কানে এসে লাগছে ব্যক্তিগত মানুষটার উষ্ণ নিঃশ্বাস। কি ভীষণ রকমের ভালোলাগা কাজ করছে…..
চলবে……..