এলোকেশী_সে #মাহমুদা_লিজা পর্বঃ২১

0
423

#এলোকেশী_সে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বঃ২১

নাস্তার টেবিলে অহনের তাড়াহুড়ো দেখে অয়নের দুষ্টুমি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ঠোঁটের উপর হাত দিয়ে হাসি থামিয়ে নিচু স্বরে বলল -“প্রতিদিন আটটার আগে নাস্তার টেবিলে থাকিস, অথচ আজ আটটা পাঁচ মিনিটে টেবিলে বসলি। তাড়াহুড়ো তো লাগবেই। নতুন বিয়ে করেছিস, ছুটি নিলেই পারতিস।”
অয়নের কথা শেষ হওয়ার আগেই কাশির চোটে গরম চায়ে চুমুক দেয়ার সময় ঠোঁটে ছ্যাকা লাগলো অহনের। চায়ের কাপটা হাত থেকে টেবিলে নামিয়ে রেখে ধড়াম করে এক থাবা বসাল ছোট ভাইয়ের পিঠে। টানটান পিঠে আচমকা চাপড় খেয়ে রীতিমতো ব্যাকা হয়ে এলো অয়নের পিঠ। মুখে পুরে দেওয়া রুটির জন্য ‘উফ’ শব্দটা পর্যন্ত করতে পারল না। এদিকে টেবিলে বসা বাকিরা বিস্মিত হলো। নাঈম মজুমদার বলেই বসলেন -“এই, তোরা কি এখনো ছোট আছিস? বউদের সামনে বেতের বাড়ি খেতে চাস নাকি? কি মারামারি লাগিয়েছে!”
কলি ঠোঁট টিপে হাসল। এ দু’জন যে ভালো হবার নয় তা দেখলেই বোঝা যায়।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আধ খাওয়া চা রেখেই উঠে দাঁড়াল অহন। তারা ব্যস্ততা দেখে অনিমা জিজ্ঞেস করল -“আজও কি কলেজে যাবি নাকি? ছুটি নিস নি?”
মায়ের কথায় অয়ন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে চোখ টিপতেই ফের চোখ গরম করে তাকাল অহন। হেলমেটটা হাতে তুলতে তুলতে বলল -“কিসের ছুটি নেব আম্মা? সামনেই স্টুডেন্টসের পরীক্ষা, এখন ছুটি নেয়ার নামও নেয়া যাবেনা। তাছাড়া এখন যদি বলি রাতের আঁধারে চুরি করে বিয়ে করে নিয়েছি, তবে কপালে চোর বদনাম ছাড়া ছুটি জুটবে না।”
ভাইয়ের কথা শুনে হু হা করে হাসতে লাগল অয়ন। হাসতে হাসতে চেয়ার উল্টে থপ করে পড়ল সবার সামনে। পড়ার সময় অবশ্য বাবার হাত ধরে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল সে, তাতেই বাঁধল বিপত্তি। তার হাত লেগে গরম চায়ে রীতিমতো গোসল করে বসলেন নাঈম মজুমদার। চিৎকার করে দু্টোকে শাসানোর আগেই অহন বেরিয়ে গেছে। অয়নও হাসি থামিয়ে দৌড় লাগালো সদর দরজার পানে। পেছনে ঘুরলে দেখত নাঈম মজুমদারের রক্তচক্ষু আর বাকিদের উদ্বেল হাসির দৃশ্য।

বাইক স্টার্ট দিতেই পেছন থেকে অয়নের বাইকের বিপ পেল অহন। তাকে দেখেই অহন বলল -“আসার আগে আমাকে কল দিয়ে আসবি। কাজ আছে। এক জায়গায় যাব।”
অয়ন মুখ বাঁকা করে জবাব দিল -“তোর বউকে নিয়ে যা। আমি তোর সাথে কোথাও যাবোনা। আমার এত সুন্দর বউ আছে, তাকে রেখে আরেক বেডির জামাইর সাথে কেন আমি যাব!”
অয়নের উল্টো পাল্টা কথায় রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠল অহন। তেজী স্বরে বলল -“তোকে প্রেম করতে ডাকছিনা তো, কাজ আছে।”
ভাইয়ের ক্ষণে ক্ষণে বদলানো রূপটা সহজে ধরতে পারে অয়ন। এই যে বড় ভাই এখন একেবারে সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা বলছে তা আঁচ করে সে জবাব দিল -“আচ্ছা।”
বাইক ছুটিয়ে দু’জন দু’দিকে মোড় নিলো।

*************

সাদা রঙের কাগজে ক্যালকুলাসের সমস্যাগুলো গভীর মনোযোগ সহকারে সমাধান করার চেষ্টায় রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠল তোড়া। এইতো সবটা মনোযোগ দিয়ে সমাধান করছে কিন্তু পরীক্ষার হলে লিখতে পারলেই হয়। তার একঘেয়েমি পড়ার রাশ টানল রুবাবা, মৃদু স্বরে বলল -“আসব?”
চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হাসল মেয়েটা। পাল্টা জবাব দিল -“ফরমালিটি করছো কেন আম্মু?”
রুবাবা ম্লান হেসে মেয়ের গা ঘেঁষে বসল। বইয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন মেয়ের উদ্দেশ্যে -“ঠিকঠাক পড়াশোনা করিস তো?”
তোড়া মাথা চুলকে উশখুশ করে বলল -“কি জানি আম্মু, সব কেমন যেন বেরিয়ে যায় মাথা থেকে।”
রুবাবা হাসল। প্রাণ খুলে হাসল বেশ খানিকটা সময় নিয়ে। তোড়া চেয়ে দেখল মায়ের হাসি। তার মা বলে নয়, একজন সত্যিকারের সুহাসিনীকে দেখছে সে। কি মায়াবী হাসি। আজ হাসিতে কোন মলিনতা নেই, জিতে যাওয়ার উচ্ছলতা।
হাসি থামিয়ে রুবাবা মেয়েকে শুধাল -“আইন্সটাইন ফেল করেও কিন্তু বিজ্ঞানী হয়েছে, আবার আমাদের পাড়ার বাবলু ভাই ফেল করে রিকশা চালানো শুরু করেছে। তাহলে দেখা যায় সব মানুষ জিতে যায় না। কেউ হারে, কেউ জিতে। এক জীবনে সবাই সব পায়না। তাইনা?”
মায়ের কথার মর্ম ধরতে পারলো না তোড়া। নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল। কানের পেছনে চুল গোঁজার ভান করে বলল -“কেন এসব বলছ আম্মু?”
রুবাবা বা’হাতে বুকের বা’পাশটায় হাত বুলালো মুহূর্তের জন্য। তোড়া অবশ্য খেয়াল করেনি ব্যাপারটা, তার উৎসুক দৃষ্টি মায়ের চেহারায়। রুবাবা ফের বলল -“সব অবহেলিত নারী কিন্তু সফল হয়না, কেউ আবার ব্যর্থও হয়। সবার মনোবলতো দৃঢ় হয়না, তাইনা! যেমন ধর আমার জীবনটা দেখ, আমি অবহেলিত হয়েও ব্যর্থ হলাম কিন্তু তোর দৃঢ় মনোবল হয়ত তোকে সফল করবে। আমরা একই ঘরের বাসিন্দা অথচ দু’জনের সফলতার রেকর্ড আলাদা, ঠিক না!”
তোড়ার ভ্রূদ্বয় খানিক উপরে ওঠায় কপালে কুঞ্চন হলো কয়েকটা। চোখে-মুখে উদ্বেগ, মায়ের কথাবার্তায় কিছু একটার আভাস পাচ্ছে যেন। রুবাবা ফের হেসে মেয়েকে আবার বলল -“আমার জীবনটায় আর কিছু চাওয়ার নেই। তোর একটা ব্যবস্হা হলো। আমার উদ্বিগ্নতা অনেকটা কমল।”
তোড়া বইটা সরিয়ে রেখে মায়ের মুখোমুখি বসে জিজ্ঞেস করল -“এসব কেন বলছ আম্মু? তোমার মেয়ে সফল হলে তুমিও সফল হবে কারণ মায়ের দিকনির্দেশনায় সন্তানরা পথ চলে, তাইতো!”
মেয়ের গালটা আলতো হাতে ছুঁয়ে দিয়ে রুবাবা বলল -“হুম, তা ঠিক। তোর কাছে একটা আবদার করব, রাখবি তো?”
উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে সায় জানাল তোড়া। রুবাবা আমতা আমতা করে বলল -“কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না, তার আগে আরেকটা কথা শুন৷ আমাকে তোর বাবা বলল আমি কেন নির্লজ্জের মতো এখনো এখানে পড়ে আছি। এই কথার প্রেক্ষিতে বলছি আমার মৃত্যু যেদিন হোক, তুই যদি সামনে থাকিস তবে সবাইকে বলে দিবি ঐ মানুষটার একটা কড়িও যেন আমার জন্য না খরচ হয়। আমাকে যেন ঐ লোকটা শেষ দেখা না দেখে। তাকে বলে দিবি পরলোকে তার কাছ থেকে সব হিসাব বুঝে নিব আমি। তাকে ক্ষমা করিনি।”
কথাগুলো বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠল রুবাবা। বুকের বা’পাশটায় হাত চেপে চোখ-মুখ খিঁচলেন তিনি। নিজাম মজুমদারের কথাটায় বেশ অপমানিত বোধ করেছেন তিনি। নিঃশ্বাস যেন আঁটকে আসছে। ভগ্ন হৃদয়টা যেন নিষ্পেষিত হয়ে আসছে। এতদিনের করা অপমানগুলোর তালিকাটা সীলমোহর করা হয়েছে আজকের বলা কথাটায়।
ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকে রুবাবা ফের বলল -“আমার ছোট ভাইকে মানে তোর ছোট মামাকে কল করেছি। আসলে অনুরোধ করব এই জাহান্নাম থেকে আমায় উদ্ধার করতে।”
তোড়া নিষ্পলক মায়ের আহাজারি দেখছে। মায়ের রোদন আজ তাকে যেন হিংস্র করে তুলেছে। মনস্থির করে নিয়েছে সে, আজ ঐ মানুষটা আসলে তাকে সম্মুখ সমরে আহ্বান করা হবে। সব জবাব আজ আদায় করে তবেই ক্ষান্ত হবে সে। মায়ের অপমান আর বরদাস্ত করবে না। তার আগ্রাসনে ভাঁটা পড়ল বুক চাপড়ে মায়ের লুটিয়ে পড়া দেখে। তীব্র যন্ত্রণায় রুবাবা ডাঙায় চলে আসা মাছের মত ছটফট করছে। কপাল, গলা বেয়ে দরদরিয়ে ঘাম বেরিয়ে এলো। তোড়া গলা চড়িয়ে মা’কে ডাকতে শুরু করল -“আম্মু, আম্মু, কথা বলো। ও আম্মু, এমন করছ কেন? কোথায়,কষ্ট হচ্ছে বলো। আম্মু।”
চিৎকার করে উঠল তোড়া -“জ্যেঠীমা, ও জ্যেঠীমা। এদিকে আসো না।”
তোড়ার ডাকে পাশের ঘরটা থেকেই ছুটে এলো অনু। রুবাবার অস্হিরতা দেখে দৌড়ে নিচে নেমে এলো শাশুড়ির কাছে। ভীত সন্ত্রস্ত স্বরে জানালো চাচী শাশুড়ির অবস্থা। হাতের কাজ ফেলে অনিমা ছুটলো উপরে। বড় জা’য়ের হন্তদন্ত চলনে কলিও পিছু করল। অশ্রুহীন তোড়া। অন্য কেউ হলে হয়ত কেঁদে বুক ভাসাত কিন্তু তোড়া মায়ের কষ্ট লাঘবের জন্য একবার হাতের তালু,আরেকবার পায়ের তালু মালিশ করছে। তার ভেতরের উদ্বিগ্নতা খুব সূক্ষ্মভাবে সামলে মায়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
অনিমা ঘরে ঢুকতেই নজর গেল লুটিয়ে থাকা রুবাবার দিকে। বোনের মত এতদিন যাকে আগলে রেখেছে তার এই ঝরায় বুক ভেঙে হু হু করে কেঁদে উঠলেন তিনি। পরপরই কলি এসেছে। বড় বোনের মত যাকে শ্রদ্ধা করে এসেছে এতদিন, তার এই অবস্থা দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত বলতে লাগল -“কোথায় কষ্ট হচ্ছে ভাবী, ও ভাবী! কোথায় কষ্ট হচ্ছে? আমাকে বলো।”
অনিমাকে উদ্দেশ্য করে কলি ফের চেঁচাতে লাগল -“বড় ভাবী তাড়াতাড়ি গাড়ি আনতে বলো, এখনই হাসপাতালে না নিলে অঘটন ঘটবে যে।”
তোড়ার নির্লিপ্ত চাহনি আর বন্ধ জবান জানান দিচ্ছে আরেকবার ভেঙেচুরে গুটিয়ে যাবে মেয়েটা। এইতো সবে তার জন্য সুখের লেনদেন চলছিল। তার আগেই ঝরা এসে তার দু’হাত ভর্তি করে দিয়ে গেল। সুখ নেয়ার মত জায়গাই উদ্বৃত্ত রইলো না।

অনিমা উদভ্রান্তের ন্যায় ছুটল নিজের ঘরে। মুঠোফোনটা হাতে নিয়েই স্বামী আর ছেলেদের খবর দিল। হাতব্যাগটা নিয়েই আবার ছুটল উপরে। সবাই মিলে রুবাবাকে নিচে নামিয়ে আনল। গন্তব্য এখন হাসপাতালে।
তোড়ার আলগোছে বেঁধে রাখা খোঁপার বাঁধন অনেকটা ঢিলে হয়ে খোঁপা পিঠের উপরের অংশে ঝুলেছে। মায়ের মাথাটা বুকে চেপে ক্ষণে ক্ষণে চুমু খাচ্ছে মায়ের মাথায়। যেন ছোট্ট শিশুকন্যাটা মায়ের আঁচলতলে এসে মা’কে আধো আধো বুলিতে বলছে ‘আমি আছি’।
চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল রুবাবার। তার মনে পড়ল নীরবে নিভৃতে যখন সে কাঁদত শিশু তোড়া তখন অশ্রু মুছে দিয়ে বলত -“আমাল আম্মু ভালো। কাঁদেনা।”
মেয়ের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাসটা দীর্ঘতম হলো। বারবার তার মন জানান দিচ্ছে এই হয়তে অন্তিম যাত্রা।

চলবে……….

(দ্বিতীয়াংশটুকু সত্যি কাহিনী অবলম্বন করে লিখেছি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here