##এলোকেশী_সে
#মাহমুদা_লিজা
পর্বসংখ্যাঃ২৮
পরীক্ষা নিয়ে তোড়ার চাপা উৎকন্ঠা। আহামরি ভালো ছাত্রী সে নয়। তার অনেক পড়তে হয়, তবেই মনে আটকায়। মাঝে মধ্যে আবার গুলিয়ে ফেলে। হুটহাট ভুলেও যায়। কাকভোরে জেগে নামাজটা আদায় করেই পড়াটা শেষবারের মত পড়ে নিয়েছে। বরাবরই ইংলিশে ভয় তার। ভয়ে গলা শুকিয়ে এলেও চেহারা স্বাভাবিক রেখেছে। তার মনের এপিঠ ওপিঠ কাউকেই জানাতে নারাজ সে। কলেজের শুভ্র পোষাকটা গায়ে জড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। বুকটা হু হু করে কেঁদে উঠল। রুবাবা থাকলে বারবার মনে করিয়ে দিত প্রবেশ পত্র ঠিকঠাক রেখেছে কিনা, কলম পেন্সিল ফাইলে রেখেছে কিনা, জামাকাপড় ইস্ত্রি করা আছে কিনা, পড়া ঠিকঠাক হয়েছে কিনা!
চোখ মুছে টেবিলের সামনে আসতেই তার দিকে ফাইলটা বাড়িয়ে ধরল অহন। গলার স্বরটা সর্বোচ্চ শীতল করে বলল -“প্রবেশ পত্র, রেজিষ্ট্রেশন কার্ড, কলম, পেন্সিল, ইরেজার, শার্পনার আর রুলার আছে। আইডি কার্ডটা গলায় ঝুলাও। মন শান্ত রেখে লিখবে। তাড়াহুড়ো করবে না। প্রশ্নের সমাধান বাদে অন্য কোন চিন্তা বা স্মৃতি যেন স্নায়ুতে প্রবেশ না করে। নিজের প্রতি আস্হা রেখে লিখতে হবে। তোমার জন্য কাকীমা চিন্তা করত, পরীক্ষা এলে দোটানায় থাকত তাইনা!”
তোড়া এবার শব্দ করেই কেঁদে উঠল। দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সামনের মানুষটাকে। তার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদল সময় নিয়ে। অহন এক হাতে ফাইলটা ধরে অন্য হাতে স্ত্রীকে নিজের বুকে আগলে বলল -“তোমার জন্য এই মানুষটারও চিন্তা হয়, উচাটন থাকে মন। তোমার এত বড় পরীক্ষা অথচ আমি সাথে যেতে পারছিনা। তুমি পরীক্ষা দিবে আর আমাকেও হলে থাকতে হবে। অয়নকে পাঠাচ্ছি তোমার সাথে। সুযোগ পেলে একবার তোমার কেন্দ্রে গিয়ে দেখে আসব। কেঁদো না। তোমার কান্নায় আমি অভ্যস্ত নই, তোমার কান্না আমার বুকে গিয়ে শেল হয়ে বিঁধে।”
থামল না তোড়া। সবার সামনে স্বাভাবিক থাকা মেয়েটার অশ্রুপাতের সাক্ষী শুধু তার মাস্টারমশাই। তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অহন বলল -“হয়েছে তো, এভাবে কাঁদলে সব ভুলে যাবে।”
তোড়ার কান্নার বেগ কমলেও এখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে।
অয়ন এসেছিল অহনকে কিছু বলার জন্য। দরজা খোলা থাকায় কোন সতর্কতামূলক শব্দ না করেই দু’কদম ঢুকে এসেছিল ঘরটায়। ঘরের ভেতরের দৃশ্যটা তাকে অপ্রস্তুত করেনি বরং মুগ্ধ করেছে। তার ভাইয়ের শক্ত বাহু বেষ্টনীতে ঐ মেয়েটা মন খুলে কাঁদতে পারছে, এর চাইতে কাঙ্খিত চাওয়া মনে হয় অন্য কিছু হতে পারেনা। সবার তো বিশ্বস্ত একজোড়া হাত থাকেনা। অন্য সময় হলে অয়ন রসিকতা করত কিন্তু এত মনোমুগ্ধকর মুহূর্তটা সে নিজের মুঠোফোনে বন্দী করতে ভুলল না। মিষ্টি হেসে প্রস্হান করল সে, ভাইকে এ মুহূর্তে বিরক্ত করতে চায় না। সে ভালো করেই জানে তার ভাইটা প্রতি ক্ষণে এই কিশোরীকে আঁকড়ে নিতে চায়।
বেশ খানিকক্ষণ পর অহনকে ছেড়ে দাঁড়াল তোড়া। চোখ-মুখ মুছে বলল -“দোয়া করবেন, যেন ভালো হয় পরীক্ষা।”
স্ত্রীকে নিজের কাছে টেনে কপালে অধরের উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে বলল -“হুম, তাড়াহুড়ো করো না একদম। শান্ত মনে লিখবে।”
নিজেকে আয়নায় আরেকবার দেখল তোড়া। চোখ-মুখ স্বাভাবিক কিনা তা পরখ করে ঘড়ির দিকে তাকাল। পরীক্ষা শুরু হতে আর মাত্র এক ঘন্টা বাকি। সকালের নাস্তার পর্ব আগেই শেষ হয়েছে। তাই আর দেরী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পরীক্ষার হলটাও বেশ একটা দূরে নয়।
বসার ঘরে উপস্থিত সবার কাছে দোয়া চাইল তোড়া আর অনু। নিজাম মজুমদার ঘর ছেড়ে বের হন নি। তোড়া তাচ্ছিল্যের হাসিটা হেসে মনে মনে বলল -“আম্মু, তুমিও দোয়া করো আমার জন্য। ঐ মানুষটা আমায় দোয়া করতে চায় না, তাইতো আসেনি আমার সামনে।”
অহন বাইক নিয়ে বাড়ির মূল ফটকে অপেক্ষা করছে। অস্হির মনটায় বেশ উত্তেজনা। তার এলোকেশীর পরীক্ষাটা যেন ঠিকঠাক হয়। যে পেশা নিয়ে সবসময় গর্ব হতো তার, আজ সে পেশাকে বারবার বকে যাচ্ছে সে। তার এলোকেশীর সাথে সে যেতে পারছে না, ব্যাপারটা তাকে পোড়াচ্ছে।
****************
রাস্তার পাশের চা দোকানের সামনে বসে তোড়া আর অনুর জন্য অপেক্ষা করছে অয়ন। কলেজের সামনে দাঁড়ায়নি সে। ভিড়ে চ্যাপ্টা হওয়ার জোগাড়। তাই খানিকটা দূরে দাঁড়িয়েছে। অহন আবার কল দিয়ে বলেছে তার জন্য অপেক্ষা করতে। সে-ও আসবে। এলোকেশীর পরীক্ষা কেমন হয়েছে তা সবার আগে সে জানতে চায়।
ঘন্টা বেজে ওঠার মিনিট পাঁচেক আগে থেকেই একজন-দুজন করে পরিক্ষার্থী বের হওয়া শুরু করেছে। অয়ন সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে, কখন অনু আর তোড়া বের হবে। ইতোমধ্যে ঘন্টাও বেজে গেল। স্রোতের মত বের হচ্ছে পরিক্ষার্থীরা। কারো মুখে হাসি, তো কারো মুখ বেজার। অয়ন হাত উচিয়ে ঘড়িটা দেখে নিল। ভেতর থেকে এখন আর কোন পরিক্ষার্থী বের হচ্ছে না। অনেকক্ষণ আগেই কেন্দ্র খালি হয়ে গেছে। উৎকন্ঠায় অয়নের গলা শুকিয়ে আসছে। রোদের তেজ তাকে অতিষ্ঠ করে দিচ্ছে। মাথার উপর যেন খাঁড়াভাবে সূর্যমামা চোখ রাঙিয়ে আছে। তার উপর অনুরও দেখা নেই, তোড়ারও দেখা নেই। অস্হির লাগছে এবার। দৌড়ে এসে গেটের সামনে দাঁড়ানো আধ বয়সী লোকটাকে বলল ভেতরে গিয়ে দেখার জন্য। তাদের কোন সমস্যা হলো কিনা। দারোয়ান মুখে বিরক্তির ছাপ টেনে জবাব দিল সে পারবেনা।
হাতের পিঠ দিয়ে কপাল মুছতেই অয়ন দেখল অনুকে এক প্রকার টেনে আনছে তোড়া। মেয়েটা যেন দাঁড়াতেই পারছে না। তোড়ার কাঁধে ভর দিয়ে কোনরকমে এগিয়ে আসছে। চোখেমুখে জলকণার উপস্থিতি স্পষ্ট। অয়ন গেটের ভেতরে ঢুকতে চাইল, দারোয়ান তাকে বাঁধা দিল হাত দিয়ে। অয়নের চোখমুখ রক্তিম হয়ে উঠল। এক ধাক্কায় লোকটাকে ছিটকে ফেলে দৌড়ে গেল অনুর কাছে। তোড়ার কাঁধ থেকে নিজের কাছে আগলে নিয়ে এক হাত তার গালে রেখে শুধাল -“কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ করেছে? বলো না কি হয়েছে?”
অনু এক প্রকার নিস্তেজ হয়ে গেছে ততক্ষণে। তোড়া ইশারা করল আগে বাহিরে আসার জন্য। অয়ন ছোট্ট করে বলল -“হু, চল।”
গেট পেরিয়ে বের হতেই অহনকে দেখল তারা। অনুকে অমন অসুস্থ দেখে অহন ইশারা করল তোড়াকে, যার অর্থ ছিল -“ওর কি হয়েছে?”
তোড়া অবশ্য অহনকে দেখে যারপরনাই অবাক হলো। এই মুহূর্তে সে মোটেও অহনকে আশা করেনি। সে জানত যখন তার স্বামী ব্যস্ত তখন আশা করাটাও উচিত না। অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি সর্বদা সুন্দর। তোড়ার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি।এগিয়ে এসে বলল -“বলছি পরে।”
অহন ঘাড় হালকা কাত করে চোখের ইশারায় বোঝালো -“ঠিক আছে।”
অয়নের উৎকন্ঠা দেখে অহন এগিয়ে এসে শুধাল -“ডাক্তার কাছে নিয়ে যাবি নাকি, মনে তো হচ্ছে বেশি অসুস্থ।”
অয়ন ছলছল চোখজোড়া নিয়ে ভাইয়ের পানে তাকাল তখন। নিভু কন্ঠে বলল -“কাছেপিঠে কোন হাসপাতালেই নিয়ে যাই, কি বলিস?”
অয়নের চোখের কোণে জলের উপস্থিতি তার ভাইকে আরো দূর্বল করে দিয়েছে। ভাইয়ের অশ্রুটুকু মানতে পারল না অহন। তার কাঁধে হাত রেখে বলল -“টেনশন করিস না তো। আছিতো আমরা।”
অনু কোনমতে মিনমিন করে বলল -“বাসায় যাবো, কোথাও যাবো না।”
অয়ন ভ্রু কুঁচকে বলল -“না, এই অসুস্থ শরীর নিয়ে বাসায় যাবে মানে কি? আচমকা এত অসুস্থ হলে, যদি খারাপ কিছু হতো?”
এবার তোড়া এগিয়ে এলো। উশখুশ করে বলল -“ভাইয়া, বাসায় চলেন। হাসপাতালে সন্ধ্যার দিকে গেলেই হবে।”
তোড়ার কথাটা হজম হলোনা দু-ভাইয়ের। অয়ন অবাক হয়ে বলল -“তোড়া! কি বলিস এসব? অনু অসুস্থ নিজের চোখে দেখেও..”
অহন ইশারা করে চুপ করতে বলল তোড়াকে। সে থামল না বরং দ্বিগুণ জোরে বলল -“বলছিতো বাসায় চলেন, কিছু হয়নি।”
অয়ন নিজেকে যথাসম্ভব সংযত করে জবাব দিল -“তোরা বাসায় চলে যা, আমি একাই ওকে হ্যান্ডেল করতে পারব। আমি বুঝতে পারছি, তুই টায়ার্ড।”
অয়নের কথা শুনে চমকালো তোড়া। অনুর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসার চেষ্টা করল। কথার মর্মার্থ তার ছোট্ট মনে বড় দাগ কেটেছে। অহন ভাইয়ের কথা শুনে তোড়ার পানে চাইল। ভাইয়ের উপর সূক্ষ্ম অভিমান হলো, তার এলোকেশীকে অমন বিদ্রূপ না করলেও পারত। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে তোড়ার কাঁধে হাত রেখে বলল -“অয়ন, আমি গাড়ি আনছি। অনুকে ডাক্তার দেখিয়ে একসাথেই ফিরব। অয়ন গম্ভীর স্বরে বলল -“সমস্যা নেই আমি পারব। তোরা যা। তোড়া মনে হয় একটু বেশিই টায়ার্ড।”
অয়নের শেষোক্ত কথাটা শুনে তোড়া চোখের কোণে আসা জলটাকে আড়াল করল। কোন সমস্যা হলে অয়নের কাছেই ছুটে আসত বেশি। অথচ এই মানুষটার কথাগুলো তার বুকে বিষাক্ত শর হয়ে বিঁধছে। অনু নির্বাক হয়ে রইল। আচম্বিত পরিস্থিতিতে সে নাজেহাল। অয়ন তোড়াকে এভাবে বলবে এটা মোটেও বিশ্বাস হচ্ছে না তার। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল অয়নকে, তার আগেই তোড়া এগিয়ে এসে অয়নকে বলল -“ভাইয়া, এ সময়টায় ভাবীর এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। যদি আমার ধারণা ভুল না হয়, তাহলে বলব she is going to be a mom.”
তোড়ার কথায় অনু লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিল। অয়ন চকিতে তাকাল অনুর দিকে। অনু মাথা নোয়ানোর পরও চোখের উপর হাত দিয়ে নিজেকে আড়াল করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে।
অহন ভ্রুজোড়া কপালে তুলে অয়নের পানে তাকিয়ে দুষ্টু হাসল। হাতের পিঠ দিয়ে নিজের হাসি আড়াল করে মাথা চুলকে বলল -“আচ্ছা, আমি তাহলে গাড়ি ডাকছি।”
অয়ন যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। সে ফের শুধাল অনুকে -“আমি কি সত্যি শুনলাম?”
অনুর লজ্জা যেন কমছেই না। ইশারা করল মাথা দুলিয়ে, যার অর্থ -“সত্যি তাই।”
এটা রাস্তা না হলে অয়ন নির্ঘাত জড়িয়ে ধরত স্ত্রীকে। তার খুব ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে মেয়েটাকে একটা চুমু খেতে। পরক্ষণে হাসল। তার মনে হলো এমন খবর রাস্তায় শোনার কি খুব দরকার ছিল!
তাকে ভাবনার গহীনে যেতে না দিয়ে অহন বলল -“গাড়ি এসেছে, বাড়ি যা। বাসায় গিয়ে ভালোমতো গালে হাত দিয়ে ভাবিস। আর হ্যা সাবধানে যা।”
অয়ন কিছু বলার আগেই অহন ড্রাইভারকে বলল -“সাবধানে চালাবেন।”
ভাইকে ফের ইশারা করল গাড়িতে বসার জন্য।
অনুকে গাড়িতে বসিয়ে তোড়ার মুখে দৃষ্টি রাখল অয়ন। এমন একটা দিনে সে যে তোড়াকে কথা দিয়ে বাজেভাবে আঘাত করেছে তা ভেবেই অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। বেশ অনুতাপের স্বরে বলল -“তোড়া আয়।”
তোড়া মুখ খোলার আগেই অহন জবাব দিল -“ওকে আমি নিয়ে যাব, তোরা যা।”
অয়ন কিছু বলার জন্য উশখুশ করছে। তোড়ার শান্ত, স্বাভাবিক আদলের পানে চেয়ে ধরতে পারল না সে ঠিক কতটা গভীরভাবে আঘাত করেছে মেয়েটাকে। তার শীতল চাহনি বেশ রহস্যময় লাগছে। ঈষৎ হাসল তোড়া, স্বল্প ভাষায় বলল -“সাবধানে যাবেন, ভাবীর শরীরটা বেশিই খারাপ।”
অয়নের খানিকক্ষণ আগের মুহূর্তটা মনে পড়তেই লজ্জায় মাথা নুইয়ে বলল -“হুম।”
বেশ অপরাধবোধ হচ্ছে। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত মেয়েটাকে সে আজ কষ্ট দিয়েছে। কষ্টের পরিমাণটা তো মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না। যদি মন পড়তে জানত, তাহলে বুঝত ঠিক কতটা ভেঙেচুরে গেছে ঐ ভগ্ন হৃদয়টা।
গাড়িতে উঠে বসল সে-ও। এক হাতে অনুকে নিজের দিকে টেনে বলল -“তোড়া কষ্ট পেয়েছে আমার কথায়।”
অনু চোখজোড়া বন্ধ করে উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে সায় জানাল।
গাড়িটা দৃষ্টিসীমা পেরোতেই অহন বলল -“কুইন, কেমন হয়েছে পরীক্ষা?”
তোড়া হাসার চেষ্টা করল অথচ হাসি আসল না ঠোঁটের কোণে। মলিন চাহনি নিয়ে বলল -“ভালো হয়েছে।”
ঐ বিষণ্ণ চাহনির মানে বোঝে অহন। ভাইয়ের উপর বিদ্বিষ্ট হলো বেশ। খুব কি দরকার ছিল ওভাবে আঘাত করার! সৌজন্যতার খাতিরেও তো একটু ছাড় দিতে পারত। হাত বাড়িয়ে প্রশ্নপত্রটা নিল। মনোযোগ সহকারে পুরোটা দেখে বলল -“সবই তো কমন পড়েছে। পেরেছ লিখতে?”
শব্দ উচ্চারণ না করেই মাথা দুলালো তোড়া। এলোকেশীর নীরবতা কষ্ট দিচ্ছে তার প্রেমিক পুরুষকে। স্বল্প আওয়াজে বলল -“আমার কুইনের নিস্তব্ধতা আমাকে পোড়াচ্ছে।”
মাথা তুলল তোড়া। আসলেই তো সে প্রিয় পুরুষটাকে কেন কষ্ট দিচ্ছে! ছোট্ট একটা চিমটি কেটে তোড়া জবাব দিল -“ভাঙাচোরা মানুষ আমি, ভেঙেচুরেই তো আবার গড়ি।”
অহন হাসল, ভীষণ মায়াবী সে হাসির জালে আটকা পড়েছে তার লৌহ মানবী।
চলবে……….
পরীক্ষা নিয়ে তোড়ার চাপা উৎকন্ঠা। আহামরি ভালো ছাত্রী সে নয়। তার অনেক পড়তে হয়, তবেই মনে আটকায়। মাঝে মধ্যে আবার গুলিয়ে ফেলে। হুটহাট ভুলেও যায়। কাকভোরে জেগে নামাজটা আদায় করেই পড়াটা শেষবারের মত পড়ে নিয়েছে। বরাবরই ইংলিশে ভয় তার। ভয়ে গলা শুকিয়ে এলেও চেহারা স্বাভাবিক রেখেছে। তার মনের এপিঠ ওপিঠ কাউকেই জানাতে নারাজ সে। কলেজের শুভ্র পোষাকটা গায়ে জড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। বুকটা হু হু করে কেঁদে উঠল। রুবাবা থাকলে বারবার মনে করিয়ে দিত প্রবেশ পত্র ঠিকঠাক রেখেছে কিনা, কলম পেন্সিল ফাইলে রেখেছে কিনা, জামাকাপড় ইস্ত্রি করা আছে কিনা, পড়া ঠিকঠাক হয়েছে কিনা!
চোখ মুছে টেবিলের সামনে আসতেই তার দিকে ফাইলটা বাড়িয়ে ধরল অহন। গলার স্বরটা সর্বোচ্চ শীতল করে বলল -“প্রবেশ পত্র, রেজিষ্ট্রেশন কার্ড, কলম, পেন্সিল, ইরেজার, শার্পনার আর রুলার আছে। আইডি কার্ডটা গলায় ঝুলাও। মন শান্ত রেখে লিখবে। তাড়াহুড়ো করবে না। প্রশ্নের সমাধান বাদে অন্য কোন চিন্তা বা স্মৃতি যেন স্নায়ুতে প্রবেশ না করে। নিজের প্রতি আস্হা রেখে লিখতে হবে। তোমার জন্য কাকীমা চিন্তা করত, পরীক্ষা এলে দোটানায় থাকত তাইনা!”
তোড়া এবার শব্দ করেই কেঁদে উঠল। দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সামনের মানুষটাকে। তার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদল সময় নিয়ে। অহন এক হাতে ফাইলটা ধরে অন্য হাতে স্ত্রীকে নিজের বুকে আগলে বলল -“তোমার জন্য এই মানুষটারও চিন্তা হয়, উচাটন থাকে মন। তোমার এত বড় পরীক্ষা অথচ আমি সাথে যেতে পারছিনা। তুমি পরীক্ষা দিবে আর আমাকেও হলে থাকতে হবে। অয়নকে পাঠাচ্ছি তোমার সাথে। সুযোগ পেলে একবার তোমার কেন্দ্রে গিয়ে দেখে আসব। কেঁদো না। তোমার কান্নায় আমি অভ্যস্ত নই, তোমার কান্না আমার বুকে গিয়ে শেল হয়ে বিঁধে।”
থামল না তোড়া। সবার সামনে স্বাভাবিক থাকা মেয়েটার অশ্রুপাতের সাক্ষী শুধু তার মাস্টারমশাই। তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অহন বলল -“হয়েছে তো, এভাবে কাঁদলে সব ভুলে যাবে।”
তোড়ার কান্নার বেগ কমলেও এখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে।
অয়ন এসেছিল অহনকে কিছু বলার জন্য। দরজা খোলা থাকায় কোন সতর্কতামূলক শব্দ না করেই দু’কদম ঢুকে এসেছিল ঘরটায়। ঘরের ভেতরের দৃশ্যটা তাকে অপ্রস্তুত করেনি বরং মুগ্ধ করেছে। তার ভাইয়ের শক্ত বাহু বেষ্টনীতে ঐ মেয়েটা মন খুলে কাঁদতে পারছে, এর চাইতে কাঙ্খিত চাওয়া মনে হয় অন্য কিছু হতে পারেনা। সবার তো বিশ্বস্ত একজোড়া হাত থাকেনা। অন্য সময় হলে অয়ন রসিকতা করত কিন্তু এত মনোমুগ্ধকর মুহূর্তটা সে নিজের মুঠোফোনে বন্দী করতে ভুলল না। মিষ্টি হেসে প্রস্হান করল সে, ভাইকে এ মুহূর্তে বিরক্ত করতে চায় না। সে ভালো করেই জানে তার ভাইটা প্রতি ক্ষণে এই কিশোরীকে আঁকড়ে নিতে চায়।
বেশ খানিকক্ষণ পর অহনকে ছেড়ে দাঁড়াল তোড়া। চোখ-মুখ মুছে বলল -“দোয়া করবেন, যেন ভালো হয় পরীক্ষা।”
স্ত্রীকে নিজের কাছে টেনে কপালে অধরের উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে বলল -“হুম, তাড়াহুড়ো করো না একদম। শান্ত মনে লিখবে।”
নিজেকে আয়নায় আরেকবার দেখল তোড়া। চোখ-মুখ স্বাভাবিক কিনা তা পরখ করে ঘড়ির দিকে তাকাল। পরীক্ষা শুরু হতে আর মাত্র এক ঘন্টা বাকি। সকালের নাস্তার পর্ব আগেই শেষ হয়েছে। তাই আর দেরী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পরীক্ষার হলটাও বেশ একটা দূরে নয়।
বসার ঘরে উপস্থিত সবার কাছে দোয়া চাইল তোড়া আর অনু। নিজাম মজুমদার ঘর ছেড়ে বের হন নি। তোড়া তাচ্ছিল্যের হাসিটা হেসে মনে মনে বলল -“আম্মু, তুমিও দোয়া করো আমার জন্য। ঐ মানুষটা আমায় দোয়া করতে চায় না, তাইতো আসেনি আমার সামনে।”
অহন বাইক নিয়ে বাড়ির মূল ফটকে অপেক্ষা করছে। অস্হির মনটায় বেশ উত্তেজনা। তার এলোকেশীর পরীক্ষাটা যেন ঠিকঠাক হয়। যে পেশা নিয়ে সবসময় গর্ব হতো তার, আজ সে পেশাকে বারবার বকে যাচ্ছে সে। তার এলোকেশীর সাথে সে যেতে পারছে না, ব্যাপারটা তাকে পোড়াচ্ছে।
****************
রাস্তার পাশের চা দোকানের সামনে বসে তোড়া আর অনুর জন্য অপেক্ষা করছে অয়ন। কলেজের সামনে দাঁড়ায়নি সে। ভিড়ে চ্যাপ্টা হওয়ার জোগাড়। তাই খানিকটা দূরে দাঁড়িয়েছে। অহন আবার কল দিয়ে বলেছে তার জন্য অপেক্ষা করতে। সে-ও আসবে। এলোকেশীর পরীক্ষা কেমন হয়েছে তা সবার আগে সে জানতে চায়।
ঘন্টা বেজে ওঠার মিনিট পাঁচেক আগে থেকেই একজন-দুজন করে পরিক্ষার্থী বের হওয়া শুরু করেছে। অয়ন সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে, কখন অনু আর তোড়া বের হবে। ইতোমধ্যে ঘন্টাও বেজে গেল। স্রোতের মত বের হচ্ছে পরিক্ষার্থীরা। কারো মুখে হাসি, তো কারো মুখ বেজার। অয়ন হাত উচিয়ে ঘড়িটা দেখে নিল। ভেতর থেকে এখন আর কোন পরিক্ষার্থী বের হচ্ছে না। অনেকক্ষণ আগেই কেন্দ্র খালি হয়ে গেছে। উৎকন্ঠায় অয়নের গলা শুকিয়ে আসছে। রোদের তেজ তাকে অতিষ্ঠ করে দিচ্ছে। মাথার উপর যেন খাঁড়াভাবে সূর্যমামা চোখ রাঙিয়ে আছে। তার উপর অনুরও দেখা নেই, তোড়ারও দেখা নেই। অস্হির লাগছে এবার। দৌড়ে এসে গেটের সামনে দাঁড়ানো আধ বয়সী লোকটাকে বলল ভেতরে গিয়ে দেখার জন্য। তাদের কোন সমস্যা হলো কিনা। দারোয়ান মুখে বিরক্তির ছাপ টেনে জবাব দিল সে পারবেনা।
হাতের পিঠ দিয়ে কপাল মুছতেই অয়ন দেখল অনুকে এক প্রকার টেনে আনছে তোড়া। মেয়েটা যেন দাঁড়াতেই পারছে না। তোড়ার কাঁধে ভর দিয়ে কোনরকমে এগিয়ে আসছে। চোখেমুখে জলকণার উপস্থিতি স্পষ্ট। অয়ন গেটের ভেতরে ঢুকতে চাইল, দারোয়ান তাকে বাঁধা দিল হাত দিয়ে। অয়নের চোখমুখ রক্তিম হয়ে উঠল। এক ধাক্কায় লোকটাকে ছিটকে ফেলে দৌড়ে গেল অনুর কাছে। তোড়ার কাঁধ থেকে নিজের কাছে আগলে নিয়ে এক হাত তার গালে রেখে শুধাল -“কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ করেছে? বলো না কি হয়েছে?”
অনু এক প্রকার নিস্তেজ হয়ে গেছে ততক্ষণে। তোড়া ইশারা করল আগে বাহিরে আসার জন্য। অয়ন ছোট্ট করে বলল -“হু, চল।”
গেট পেরিয়ে বের হতেই অহনকে দেখল তারা। অনুকে অমন অসুস্থ দেখে অহন ইশারা করল তোড়াকে, যার অর্থ ছিল -“ওর কি হয়েছে?”
তোড়া অবশ্য অহনকে দেখে যারপরনাই অবাক হলো। এই মুহূর্তে সে মোটেও অহনকে আশা করেনি। সে জানত যখন তার স্বামী ব্যস্ত তখন আশা করাটাও উচিত না। অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি সর্বদা সুন্দর। তোড়ার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি।এগিয়ে এসে বলল -“বলছি পরে।”
অহন ঘাড় হালকা কাত করে চোখের ইশারায় বোঝালো -“ঠিক আছে।”
অয়নের উৎকন্ঠা দেখে অহন এগিয়ে এসে শুধাল -“ডাক্তার কাছে নিয়ে যাবি নাকি, মনে তো হচ্ছে বেশি অসুস্থ।”
অয়ন ছলছল চোখজোড়া নিয়ে ভাইয়ের পানে তাকাল তখন। নিভু কন্ঠে বলল -“কাছেপিঠে কোন হাসপাতালেই নিয়ে যাই, কি বলিস?”
অয়নের চোখের কোণে জলের উপস্থিতি তার ভাইকে আরো দূর্বল করে দিয়েছে। ভাইয়ের অশ্রুটুকু মানতে পারল না অহন। তার কাঁধে হাত রেখে বলল -“টেনশন করিস না তো। আছিতো আমরা।”
অনু কোনমতে মিনমিন করে বলল -“বাসায় যাবো, কোথাও যাবো না।”
অয়ন ভ্রু কুঁচকে বলল -“না, এই অসুস্থ শরীর নিয়ে বাসায় যাবে মানে কি? আচমকা এত অসুস্থ হলে, যদি খারাপ কিছু হতো?”
এবার তোড়া এগিয়ে এলো। উশখুশ করে বলল -“ভাইয়া, বাসায় চলেন। হাসপাতালে সন্ধ্যার দিকে গেলেই হবে।”
তোড়ার কথাটা হজম হলোনা দু-ভাইয়ের। অয়ন অবাক হয়ে বলল -“তোড়া! কি বলিস এসব? অনু অসুস্থ নিজের চোখে দেখেও..”
অহন ইশারা করে চুপ করতে বলল তোড়াকে। সে থামল না বরং দ্বিগুণ জোরে বলল -“বলছিতো বাসায় চলেন, কিছু হয়নি।”
অয়ন নিজেকে যথাসম্ভব সংযত করে জবাব দিল -“তোরা বাসায় চলে যা, আমি একাই ওকে হ্যান্ডেল করতে পারব। আমি বুঝতে পারছি, তুই টায়ার্ড।”
অয়নের কথা শুনে চমকালো তোড়া। অনুর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসার চেষ্টা করল। কথার মর্মার্থ তার ছোট্ট মনে বড় দাগ কেটেছে। অহন ভাইয়ের কথা শুনে তোড়ার পানে চাইল। ভাইয়ের উপর সূক্ষ্ম অভিমান হলো, তার এলোকেশীকে অমন বিদ্রূপ না করলেও পারত। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে তোড়ার কাঁধে হাত রেখে বলল -“অয়ন, আমি গাড়ি আনছি। অনুকে ডাক্তার দেখিয়ে একসাথেই ফিরব। অয়ন গম্ভীর স্বরে বলল -“সমস্যা নেই আমি পারব। তোরা যা। তোড়া মনে হয় একটু বেশিই টায়ার্ড।”
অয়নের শেষোক্ত কথাটা শুনে তোড়া চোখের কোণে আসা জলটাকে আড়াল করল। কোন সমস্যা হলে অয়নের কাছেই ছুটে আসত বেশি। অথচ এই মানুষটার কথাগুলো তার বুকে বিষাক্ত শর হয়ে বিঁধছে। অনু নির্বাক হয়ে রইল। আচম্বিত পরিস্থিতিতে সে নাজেহাল। অয়ন তোড়াকে এভাবে বলবে এটা মোটেও বিশ্বাস হচ্ছে না তার। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল অয়নকে, তার আগেই তোড়া এগিয়ে এসে অয়নকে বলল -“ভাইয়া, এ সময়টায় ভাবীর এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। যদি আমার ধারণা ভুল না হয়, তাহলে বলব she is going to be a mom.”
তোড়ার কথায় অনু লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিল। অয়ন চকিতে তাকাল অনুর দিকে। অনু মাথা নোয়ানোর পরও চোখের উপর হাত দিয়ে নিজেকে আড়াল করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে।
অহন ভ্রুজোড়া কপালে তুলে অয়নের পানে তাকিয়ে দুষ্টু হাসল। হাতের পিঠ দিয়ে নিজের হাসি আড়াল করে মাথা চুলকে বলল -“আচ্ছা, আমি তাহলে গাড়ি ডাকছি।”
অয়ন যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। সে ফের শুধাল অনুকে -“আমি কি সত্যি শুনলাম?”
অনুর লজ্জা যেন কমছেই না। ইশারা করল মাথা দুলিয়ে, যার অর্থ -“সত্যি তাই।”
এটা রাস্তা না হলে অয়ন নির্ঘাত জড়িয়ে ধরত স্ত্রীকে। তার খুব ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে মেয়েটাকে একটা চুমু খেতে। পরক্ষণে হাসল। তার মনে হলো এমন খবর রাস্তায় শোনার কি খুব দরকার ছিল!
তাকে ভাবনার গহীনে যেতে না দিয়ে অহন বলল -“গাড়ি এসেছে, বাড়ি যা। বাসায় গিয়ে ভালোমতো গালে হাত দিয়ে ভাবিস। আর হ্যা সাবধানে যা।”
অয়ন কিছু বলার আগেই অহন ড্রাইভারকে বলল -“সাবধানে চালাবেন।”
ভাইকে ফের ইশারা করল গাড়িতে বসার জন্য।
অনুকে গাড়িতে বসিয়ে তোড়ার মুখে দৃষ্টি রাখল অয়ন। এমন একটা দিনে সে যে তোড়াকে কথা দিয়ে বাজেভাবে আঘাত করেছে তা ভেবেই অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। বেশ অনুতাপের স্বরে বলল -“তোড়া আয়।”
তোড়া মুখ খোলার আগেই অহন জবাব দিল -“ওকে আমি নিয়ে যাব, তোরা যা।”
অয়ন কিছু বলার জন্য উশখুশ করছে। তোড়ার শান্ত, স্বাভাবিক আদলের পানে চেয়ে ধরতে পারল না সে ঠিক কতটা গভীরভাবে আঘাত করেছে মেয়েটাকে। তার শীতল চাহনি বেশ রহস্যময় লাগছে। ঈষৎ হাসল তোড়া, স্বল্প ভাষায় বলল -“সাবধানে যাবেন, ভাবীর শরীরটা বেশিই খারাপ।”
অয়নের খানিকক্ষণ আগের মুহূর্তটা মনে পড়তেই লজ্জায় মাথা নুইয়ে বলল -“হুম।”
বেশ অপরাধবোধ হচ্ছে। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত মেয়েটাকে সে আজ কষ্ট দিয়েছে। কষ্টের পরিমাণটা তো মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না। যদি মন পড়তে জানত, তাহলে বুঝত ঠিক কতটা ভেঙেচুরে গেছে ঐ ভগ্ন হৃদয়টা।
গাড়িতে উঠে বসল সে-ও। এক হাতে অনুকে নিজের দিকে টেনে বলল -“তোড়া কষ্ট পেয়েছে আমার কথায়।”
অনু চোখজোড়া বন্ধ করে উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে সায় জানাল।
গাড়িটা দৃষ্টিসীমা পেরোতেই অহন বলল -“কুইন, কেমন হয়েছে পরীক্ষা?”
তোড়া হাসার চেষ্টা করল অথচ হাসি আসল না ঠোঁটের কোণে। মলিন চাহনি নিয়ে বলল -“ভালো হয়েছে।”
ঐ বিষণ্ণ চাহনির মানে বোঝে অহন। ভাইয়ের উপর বিদ্বিষ্ট হলো বেশ। খুব কি দরকার ছিল ওভাবে আঘাত করার! সৌজন্যতার খাতিরেও তো একটু ছাড় দিতে পারত। হাত বাড়িয়ে প্রশ্নপত্রটা নিল। মনোযোগ সহকারে পুরোটা দেখে বলল -“সবই তো কমন পড়েছে। পেরেছ লিখতে?”
শব্দ উচ্চারণ না করেই মাথা দুলালো তোড়া। এলোকেশীর নীরবতা কষ্ট দিচ্ছে তার প্রেমিক পুরুষকে। স্বল্প আওয়াজে বলল -“আমার কুইনের নিস্তব্ধতা আমাকে পোড়াচ্ছে।”
মাথা তুলল তোড়া। আসলেই তো সে প্রিয় পুরুষটাকে কেন কষ্ট দিচ্ছে! ছোট্ট একটা চিমটি কেটে তোড়া জবাব দিল -“ভাঙাচোরা মানুষ আমি, ভেঙেচুরেই তো আবার গড়ি।”
অহন হাসল, ভীষণ মায়াবী সে হাসির জালে আটকা পড়েছে তার লৌহ মানবী।
চলবে……….