এলোকেশী_সে #মাহমুদা_লিজা **১৬(বর্ধিতাংশ)**

0
350

#এলোকেশী_সে

#মাহমুদা_লিজা

**১৬(বর্ধিতাংশ)**

বিষণ্ন চিত্তে এলোমেলো পায়ে সিঁড়ি বেয়ে মেয়ের ঘরে এল রুবাবা। উঁচু আওয়াজে পড়ছে মেয়েটা। ঘড়িতে সময় দেখে নিঃশব্দে বিছানায় এসে বসল সে।
ঘরে কারো উপস্থিতি জানান দিচ্ছে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। বিশেষ মানুষটার উপস্থিতি আঁচ করে তোড়া মনস্থির করেছে আজ সে তাকাবে না। আজকাল তাকে বাচ্চামো ভর করেছে। সময়ে অসময়ে মানুষটাকে রাগিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। তার সকল ভাবনার শেষ প্রান্তে দাঁড়িরেখা এঁকে রুবাবা ডাকল -“তোড়া!”
মায়ের কম্পিত স্বরধ্বনিতে থমকালো তোড়া। কাল বিলম্ব না করেই চেয়ার ছেড়ে মায়ের পাশে এসে বসল। মায়ের থমথমে মুখটা দেখে উদ্বিগ্ন স্বরে শুধালো -“শরীর খারাপ লাগছে, আম্মু?”
শাড়ির আঁচলটা কচলাতে কচলাতে মনে মনে কথাগুলো আবার আওড়ে নিল রুবাবা। কোথা থেকে কিভাবে শুরু করবে তা মেপে বুঝে নিজ মনে সাজিয়ে নিল। অসংযত কথাগুলো বাদ দিতে হবে নচেৎ মেয়ের মনে সন্দেহ দানা বাঁধবে। গলা ঝেড়ে পরিষ্কার করে রুবাবা স্বল্প আওয়াজে বলল -“ভেবেছি এখান থেকে চলেই যাব। নিজের মত করে বাঁচব। যেথায় জীবনের সমাপ্তি টেনেছিলাম সেথা থেকে পুনরায় আরম্ভ করব। এখানে থাকলে আমি নিজের প্রতি দৃঢ়তা রাখতে পুনঃ পুনঃ ব্যর্থ হব।”

মায়ের কথায় ঘটিত অনর্থকের আঁচ পেল তোড়া। বাড়াবাড়ি কিছু একটার ঘটন হয়ত সাধন হয়েছে। কন্ঠে না তেজ ছিল, না শীতলতা ছিল, তবে কন্ঠে ছিল উৎকন্ঠা। সেই উৎকন্ঠা নিয়ে শুধালো -“কোথায় যাওয়ার মনস্হির করেছ?”
উদাস কন্ঠে ভাঙা ভাঙা আওয়াজে রুবাবা জানাল -“গ্রামেই ফিরতে চাই।”
মায়ের কন্ঠে যে আক্ষেপ ছিল তা উপলব্ধি করতে তোড়ার বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি। মায়ের চাপা দীর্ঘশ্বাসের আড়ালের সুপ্ত ঝরার ইংগিত। মায়ের সিদ্ধান্তে আকুন্ঠা সমর্থন জানিয়ে তোড়া বলল -“আমার পরীক্ষা শেষ হোক, তখন যাবো। দেখতে দেখতে আট মাস কেটে যাবে। এই পরীক্ষার পর তো চূড়ান্ত মূল্যায়ন পরীক্ষা। আপাতত পড়ায় ফোকাস করি। তুমিও মানসিকভাবে গোছগাছ করে নাও।”

মেয়ের সোজাসাপটা স্বীকারোক্তিতে যেন প্রাণ ফিরে পেল রুবাবা। নিজের ডানহাতটা দিয়ে মেয়ের গালে আলতো ছোঁয়া রেখে বলল -“তুই আমার সব। ধরে নে তোর জন্য এখনো এই ধরার আলো বাতাস দেখছি।”
মায়ের অকস্মাৎ নেয়া সিদ্ধান্তটা আজ আর মনটাকে আন্দোলিত করতে পারেনি। বুকটা যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে সপ্তদশী কিশোরীর। ছোট্ট বুকটায় অনুভূতির জোয়ারে মন ভাসিয়েছিল দু’জনে। বিচ্ছেদের ঘন্টা বুঝি অনুভূতি জন্মের আগেই শ্বাসরোধ করে মেরে দিবে! আচ্ছা মাস্টারমশাই কি জানবে এই কিশোরীর নীরব কান্নার শব্দ! দৈহিক অনুপস্থিতি কি দূরত্ব বাড়িয়েই দিবে! নাকি একবার মাস্টারমশাইকে জানিয়ে দেয়া উচিত এই নিষ্ঠুরতম ভবিতব্য!
মায়ের বুকে মাথা রাখল তোড়া। কেমন ভারী ভারী লাগছে বুকটা। হু হু করে কান্না আসছে। ভালবাসার কাছে বুঝি মানুষ এতটাই অসহায়! তবুও নিজেকে স্বভাব-সিদ্ধ রেখে বলল -“পড়া এখনো অনেক বাকি আম্মু। ঘুমোতে যাও তুমি, আমি পড়াটা শেষ করি।”

মেয়ের অন্তর্দহন অজ্ঞাত রইলো না রুবাবার নিকট। মেয়ের হৃদয়ের করুণ রক্তক্ষরণে নিজের মনটাও দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। আচ্ছা একবার, না-হয় একবার মেয়ের জন্য কারো কাছে মেয়ের সুখটা চেয়ে নিলে কি খুব ক্ষতি হবে! মেয়ের জন্য মা হয়ে ওটুকু করাটা কি খুব অন্যায়ের হবে! সংসারে ফাটল ধরার অনর্থক ভাবনাটা কি একবার জলাঞ্জলি দিবে! আর ভাবতে পারছে না রুবাবা। ধীরগতিতে উঠে দাঁড়াল, শ্লথ গতিটুকু নিয়েই মেয়ের ঘরটা ত্যাগ করল।

উদাস হয়ে মায়ের গমন দেখল তোড়া। শান্ত ভঙ্গিতে নিজেকে জানাল – “মাস্টারমশাইকে একবার জানাতে হবে, নয়ত ঐ মানুষটার সাথে ঘোর অন্যায় হবে।”

সাহস করে পা বাড়াল ঐ ঘরটার পানে। আজকাল তার সাহসটা যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ডর ভয় কাবু করেনা তাকে। সে তোয়াক্কা করেনা লোক কি বলবে সেই বাক্যের। চিকন তর্জনীটা দিয়ে দু’টো মৃদু আঘাত বসাল দরজার দেয়ালে। মনে দ্বিধাদ্বন্দ্বের আনাগোনা, দরজা আধৌ খুলবে তো! রাত তো কম হলোনা। তার সকল দ্বিধাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দরজা খুলে দিল ঘরটার মালিক। শীতল স্বরে জিজ্ঞেস করল -“ভুল করে আসা হয়েছে নাকি?”
মানুষটার শীতল চাহনি যেন শরীরটাকেই হিম করে দিল। কি মায়াবী হাসি! নৈসর্গিক সৌন্দর্যের তুলনায় এই হাসিটুকু ততোধিক মনোমুগ্ধকর। দরজার দুপাশের দেয়ালে রাখা দু’হাতের বেষ্টনী দেখে তোড়া নিচু আওয়াজে শুধালো -“ব্যারিকেড দিয়েছেন কেন? আমি কি অস্পৃশ্য? ও ঘরে যাওয়ার যোগ্য নই!”
কি মায়াবী অভিমান! মুগ্ধ হলো অহন, হাত সরিয়ে বলল -“আসুন, অভিমানীনি হবেন না। আমি অধিকার পাইনি আপনার মান ভাঙানোর।”

ধীর কদমে এগিয়ে গেল তোড়া। মনের উচাটন বারবার গলায় চৈত্রের খরা বানিয়ে দিচ্ছে। ঠোঁটজোড়াও শুকিয়ে কথা আঁটকে যাচ্ছে বারবার। তার নীরবতায় যন্ত্রণা বাড়ল প্রেমিক পুরুষের হৃদয়ে। তীব্র দহনে অন্তর জ্বলছে। তবুও অপেক্ষা, কিসের তরে এত জরুরী আগমন!
মৌনতা হটিয়ে তোড়া বলল -“মাস্টারমশাই এত জটিল জটিল সমাধান করতে পারেন অথচ সামনের দিনগুলোতে আসা জটিলতায় কোন সূত্র বসালে সঠিক সমাধান পাবেন? নাকি সমাধানের শেষ লাইনের গরমিল সূত্র বহির্ভূত নিপাতনে সিদ্ধ?”

রহস্যময়ীর কঠিন ভাষা বোধগম্য হতো না অহনের, কিন্তু আজকাল রহস্যময়ীকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করে সে। তাই বেগ পেতে হলো না এলোকেশীর করুণ আক্ষেপ বুঝতে। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে বলল -“আবার কে কি বলেছে? কে আবার ভিলেন হয়ে আপনার মনকে শঙ্কিত করছে? আপনার অশান্ত মনটাকে স্হির করার জন্য যা করা দরকার আমি তা নির্দ্বিধায় করব। কোন ঝড়-ঝাপটা মানব না। আসুক না কোনো বাঁধা, হুলস্থুল বাঁধিয়ে দেব। আমার তোড়ারাণীকে অস্হিরতায় রেখে কেউ স্বস্তিতে বাঁচবে না, কেউ না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। পড়ায় মন দেন, ওসব ভেবে আগামীকালের পরীক্ষায় গলদ করবেন না।”

সামনের মানুষটাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল তোড়া। তার প্রতিটি শব্দে ছিল সুপ্ত হুংকার। তাকে আগলে রাখার দৃঢ় পণ। তবুও অনাহুত ঝড়ে সে আর উড়ে যেতে চায়না। সহজাতভাবে বলল -“আম্মু বলেছে গ্রামে চলে যাবে আমার পরীক্ষার পর। থাকবে না আর এখানে। আপনি সত্যি আমায় তখন ভুলে যাবেন না তো! আমি বিস্মৃত হবো না তো, মাস্টারমশাই?”
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো অহনের। বা’হাতের আঙ্গুল দিয়ে চুল টেনে ধরল। অমন অদ্ভুত সিদ্ধান্তের কোন হেতু দেখছে না সে। হুটহাট এসব সিদ্ধান্তের পাল্টা সমাধান তো চট করেই মাথায় আসে না। কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নেয়া যেত কিন্তু অয়নের একতরফা সিদ্ধান্তের পর তার একই সিদ্ধান্ত বাবা-মাকে আঘাত দিবে। তারচেয়ে বরং মা’কে কোনভাবে বুঝিয়ে এলোকেশীকে হালাল বাঁধনে আগলে নিলে দুনিয়াশুদ্ধো মানুষের বিরুদ্ধে লড়তেও প্রস্তুত সে। নিজেকে সংযত করে মৃদু হেসে বলল -“দুশ্চিন্তা করো না, যাও। পরীক্ষা দাও মন দিয়ে। আমার উপর আস্হা রেখ, আমার সিদ্ধান্তে অমত করো না। আমার সিদ্ধান্তের ভিতে নিশ্চয়ই কোন সূত্র থাকবে, জটিল সেই সূত্রই না হয় সমস্যার সঠিক সমাধান করবে।”

অহনের দুচোখের ইশারায় আশ্বস্ত হলো তোড়া। ভারী নিশ্বাসটা যেন ক্রমশ শীতল হলো। বুকের অস্হির ছটফটানি লঘু হলো ক্রমে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বলতে -“ভালবাসি মাস্টারমশাই।”
কোথায় যেন জড়তা ভর করেছে তবুও। গুটি গুটি কদমে প্রস্হান করল অহনের ঘর। গুমোট মনটায় ক্ষীণ আলোর বিচ্ছুরণ ঘটছে ধীরে।
এলোকেশীর নীরব প্রস্হান দেখলো অহন। তার সুপ্ত আহ্বান, তীব্র অনুনয় জানতে পেরে তার হৃদয় জানান দিল -“আসুক শত বাঁধা, দমাতে পারবেনা আধৌ। সে-ও প্রেমিক পুরুষ, রণে ভঙ্গ দেবে না মোটেও।”

_________

ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল অয়ন। প্রেয়সীর ছোট্ট পায়ের পাতাটা টেনে নিজের হাঁটুতে এনে রাখল। মৃদু টান পড়তেই শক্তভাবে ধরে রাখল পায়ের পাতাটা। দ্বিধায় পড়ে অনু শুধালো -“পাপ হবে।”
নিজের হাতে থাকা রূপোলী রঙা শীতল বস্তুটা আলতো করে জড়িয়ে দিল স্ত্রীর পায়ে। ফর্সা পায়ের গোড়ালিতে স্হান নেয়া বস্তুটা পায়ের সৌন্দর্য যেন বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে অনুর। এই উপহারের জন্য নয় বরং প্রিয় মানুষটার অদ্ভুত ভালবাসা তাকে রীতিমতো আহ্লাদী করে দিচ্ছে। হাতে উষ্ণ স্পর্শে গোর ভাঙে তার। মিষ্টি স্বরে কানের কাছটায় কেউ ফিসফিসিয়ে বলল -” ভালবাসি অনু, ভীষণ রকমের ভালবাসি, যতটা ভালবাসলে তুমি বুঝবে আমার আকাশে তোমার বিচরণ শুধুই। তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী, অভিমানীনি, রাগিণী।”
লজ্জা পেয়ে স্বামীর বুকেই মুখ লুকাল অনু। হয়ত এটাই চেয়েছিল অয়ন, নয়ত অত কায়দা করে মেয়েটাকে অপ্রস্তুত করত নাকি!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here