তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত লাবিবা_আল_তাসফি ২৮.

0
377

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
লাবিবা_আল_তাসফি

২৮.
‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে।
আমার সুরগুলি পায় চরণ,
আমি পাই নে তোমারে।
দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে।

বাতাস বহে মরি মরি,
আর বেঁধে রেখো না তরী।
বাতাস বহে মরি মরি,
আর বেঁধে রেখো না তরী।
এসো এসো পার হয়ে মোর
হৃদয় – মাঝারে।
দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে।’

পুরোনো রেডিওতে ক্যাসেটে ভাঙা স্বরে বেজে চলছে গানটা। সাহেদ প্রায় রাতেই এমন ভাবে গান শোনে। রবীন্দ্র সংগীতের প্রতি তার আলাদা রকম ঝোঁক রয়েছে। এই ঝোঁকটা কেন যেন হুটহাট করে রাতের বেলাতেই মাথা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। মৃদু শব্দের এ গান ভোর হওয়া অবদি ক্লান্তহীন বাজতে থাকবে। পাশাপাশি রুম হওয়ায় অন্তির রুম থেকে খুব স্পষ্ট শোনা যায় গানের প্রতিটা চরণ। গানের এ মৃদু শব্দ অন্তির পছন্দ না হলেও সে রাতে তার ঘুম হয় ভালো। তবে আজ অন্তির চোখে ঘুম নেই। দিহানের সাথে কথা হওয়ার পর থেকেই কেমন অস্থিরতার মধ্য দিয়ে তার সময় যাচ্ছে। আশ্চর্য জনক ভাবে আজ বাবার রুম থেকে আসা মৃদু গানের শব্দটা তার বিরক্ত ঠেকছে না। বরং অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে।

অন্তির রুমে ছোট একটা বুক শেলফ আছে। হাতে গোনা কতেক বই তাতে। এই বইগুলো তার ষোলতম জন্মদিনের উপহার হিসেবে তখর বাবা দিয়েছিলো। কিন্তু কখনো পাতা উল্টে দু লাইন পড়া হয়নি তার। আজ এতদিন বাদে বুক সেলফ থেকে তার একটা বই পড়তে মন চাইলো। বইয়ের মলাটে এক আঙুল সমান ধুলা জমেছে। কতদিন সেলফ পরিস্কার করা হয়না তার ঠিক নেই। পারুটা শুধু কাজে ফাঁকি দেয়। ওর নামে বিচার ঠুকতে হবে। নাহার জানতে পারলে এক চুল ছাড় দেবে না।

অন্তি যে বইটা পড়তে নিয়েছে তার নামটা বড়ই অদ্ভুত। ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’। কোথায় যাবে মেঘ? অন্তির উপন্যাস পড়া হলো না। এসবে তার আগ্রহ সবসময় শূন্যের কোঠায়। তবুও খুব সময় নিয়ে সে ভূমিকা পড়লো। বই বন্ধ করে যত্নে তুলে রাখলো পূর্বের ন্যায়। বিছানায় পড়ে থাকা ফোনটা হঠাৎ করেই জ্বলে উঠলো। টুং করে ম্যাসেজ আসার শব্দ হলে অন্তি এগিয়ে এসে ফোন হাতে তুলে নেয়। অপরিচিত এক নম্বর থেকে ছোট্ট একটা ম্যাসেজ এসেছে।

‘নিচে আসো। অপেক্ষা করছি।’

অন্তির এই ম্যাসেজের ব্যক্তিকে চিনতে দেরী হয়না। বুকটা হঠাৎ করেই ধুক করে ওঠে। দিহান এসেছে! আজ আসবেনা বলেও এসেছে। রোকটা নিজের কথা রাখতে পারেনা। কোনো কাজ করবে না বলেও করে ফেলে। আজ আসবেনা বলেও এসেছে। সে তো এটাও বলেছে আর হারিয়ে যাবেনা, সেই কথাটা কি রাখবে?

দিহান অপেক্ষা করছে যেনেও অন্তির মাঝে দ্রুত যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। সে সময় নিয়ে একটা সুতির শাড়ি পড়েছে। এই শাড়িটা রাতে খাওয়া শেষে মায়ের রুম থেকে চুপি চুপি এনে রেখেছিল সে। কাল এটা পড়েই দিহানের সাথে দেখা করতে যাওয়ার চিন্তা করেছিল। কিন্তু মানুষটাতো আগেই এসে পড়েছে। তাই বলে তার প্লান চেঞ্জ করা যাবে না। ইতিমধ্যে সে বেশ কয়েকবার ইউটিউব দেখে দেখে শাড়ি পড়েছে। তাই খুব একটা সমস্যা হলো না। শাড়ির রঙটা টকটকে লাল। অন্তির পড়নের জামাটা ছিল সাদা। ব্লাউজ পড়ার ঝামেলার মধ্যে সে যায়নি। পড়নের জামার উপরেই পেঁচিয়ে নিয়েছে লাল রঙা শাড়িটা। লাল সাদার কম্বিনেশনটা সুন্দর। এঅটু বেশেই সুন্দর। খুব বেশি সাজের মধ্যে ও সে যায়নি। ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক আর চোখ ভরা কাজল। লোকে বলে শ্যাম মেয়েদের গাড় লাল রঙে মানায়না। শ্যামদের পড়তে হয় হালকা রঙ। অন্তি ওসব কথায় বিশ্বাস করে না। তার চোখে যে রঙ ভালো লাগে সে সেটাই পড়ে। এইযে সে টকটকে লিপস্টিক পড়েছে, তাকে কি জংলি টাইপ লাগছে? লাগলে লাগুক। আজ সে এভাবেই দিহানের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করবে।
ঘড়িতে তখন প্রায় একটা। অন্তি নিজের রুমের লাইট বন্ধ করে চুপি চুপি রুম থেকে বের হয়ে সবার আগে পারুর ঘরে উঁকি দেয়। সে এখন ভারী ঘুমে আছে। নাহার ঘুমের ওষুধ খেয়ে অনেক আগেই শুয়ে পড়েছে। সাহেদকে নিয়ে চিন্তা নেই। সে ঠিক এগারোটায় বিছানায় যায়। শোয়ার দু মিনিটেই ভুস ভুস শব্দ তুলতে শুরু করে।

গেটে দারোয়ান নেই। রাতের সময় তার কড়াভাবে বাড়ি পাহারা দেওয়ার কথা। কিন্তু সে সেটা না করে ছোট ঘরটায় পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। এ বাড়িতে দারোয়ানের জন্য ও ছোট একটা ঘরের ব্যবস্থা আছে। দারোয়ান কাজে ফাঁকি দিচ্ছে জেনেও অন্তি এ ব্যাপারে কিছু করতে পারবে না। নিজের ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তাতে। লোহার গেটটায় বড় একটা তালা ঝুলছে। এই তালার চাবি কেবল দারোয়ানের কাছে থাকার কথা। কিন্তু অন্তির কাছেও আছে। অতি গোপনে সে এই কাজটা করেছে।

অন্তি যখন বাহিরে আসে তখন আশপাশে একটা কুকুরের ও উপস্থিতি নেই। অত্যন্ত রকম শান্ত পরিবেশ। কনকনে ঠান্ডায় দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়ার অবস্থা। এমন শীতের রাতে অচেনা নম্বর থেকে টেক্সট পেয়ে কাঁপতে কাঁপতে দেখা করতে চলে আসাটা বোকামির পর্যায়ে ফেলা যায়। অন্তি সেই বোকামিটাই করেছে। এখন তার চোখ ফেটে পানি আসার উপক্রম। তার নিজের সিদ্ধান্তের উপর কোনো অভিযোগ নেই। দিহান আসবেনা ভাবতেই তার কান্না পাচ্ছে। তার মন খুব করে চাইছে দিহান দিহানের কথা না রাখুক। সে সত্যিই আসুক দেখা করতে। অচেনা নম্বর থেকে আসা ম্যাসেজটা দিহানের হোক।

রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টটায় কিছুদিন যাবত সমস্যা দেখা দিয়েছে। মূলত সমস্যাটা ল্যাম্পপোস্টে নয় বাল্বে। আজ কালের মধ্যেই হয়তো ডেড হয়ে যাবে। কেমন জ্বলা নেভা করতে থাকে সারাক্ষণ। এমন আলোর নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে মাথায় চক্কর দিচ্ছে অন্তির। তবুও সে দাঁড়িয়ে আছে। তার বিশ্বাস দিহান আশপাশে কোথাও আছে। লুকিয়ে তাকে দেখছে। হয়তো একটু পরীক্ষা করতে চাইছে। এই পরীক্ষায় সে একশ তে একশ পেতে চায়।

ফোনে পুনরায় ম্যাসেজ এলে অন্তি দ্রুত চেক করলে দেখতে পায় সেখানে বলা আছে,

‘সামনে আগাও। কালো রঙের গাড়িটার ঠিক পাশে যে বাড়িটা ওখানে আসো।’

অন্তির বুক ঢিপঢিপ করে ওঠে। এটা যদি দিহান না হয়? তার কি একবার কল করা উচিত? কিন্তু পরক্ষণে সে উক্ত চিন্তা ঝেড়ে ফেলে। সাহসী প্রেমিকাদের ভয় পেলে চলে না। প্রেমিককে চিনতে না পারলে সে কেমন প্রেমিকা?

বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই কালো রঙের বিশাল এক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পাশে এক তলা বিশিষ্ট একটা ভবন। যা বেশ কিছুদিন যাবত বন্ধ রয়েছে। বাড়ির মালিক পরিবার সহ বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। এতদিন বাদে সে বাড়ির গেট খোলা হয়েছে। তাও এত রাতে! অন্তির বুকের ভেতর অস্বাভাবিক হারে কাঁপছে। সে কি ভুল করছে? কিছু হয়ে গেলে সাহায্যের জন্য কাউকে পাওয়া অসম্ভব। অন্তির ভাবনার মাঝেই একটা শক্ত হাত তাকে টেনে নেয় গেটের ভেতরে। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয় বুকের ভেতর। হঠাৎ ঘটনায় চমকে গিয়ে নড়ে উঠতেই তীব্র ব্যাথায় কঁকিয়ে ওঠে দিহান। তার শরীরের যখম ঠিক হতে বহু দেরী। পায়ের ফ্রাকচারটার জন্য এখনো মাস খানেক লাগবে। হুইল চেয়ারে বসা অবস্থায় অন্তিকে টেনে নিতেও তার বেশ কষ্ট হয়েছে। অন্তি পুনরায় চমকে উঠে দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেলে দিহান আবারো আঘাত পায়। পেটের কাছের ব্যান্ডেজটা ভিজতে শুরু করে। কিন্তু এবার সে মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বের করে না। কেবল কাতর গলায় বলে,

‘বাসার ভেতরে চলো? সমস্যা হবে? এখানে ঠান্ডা অনেক।’

চলবে……..

(ছোট পর্বের জন্য দুঃখিত। আগামীকাল আরো একটা পর্ব দেওয়ার চেষ্টা করবো। আজকে লিখতে বসে একটু বেশিই হতাশ হয়েছি নিজের উপর। লেখা আগাতে পারছিলাম না কোনোভাবে। দুঃখিত!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here