তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত #লাবিবা_আল_তাসফি ২৯.

0
633

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

২৯.
নিভু নিভু হলুদ রঙের আলো জ্বলছে ঘরটায়। বেশ বড়সড় আকারের এই ঘরটার একপাশ জুড়ে সোফা। আশপাশের অন্যকোনো আসবাবপত্র বোঝা যাচ্ছে না। সবকিছুই সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা। যার উপর ধুলা জমে স্থুপ আকার ধারণ করেছে। বাকি ঘরগুলো বন্ধ। দেয়ালের অবস্থা শোচনীয়। রঙ খসে খসে পড়েছে। ঘরের দুটো জানালাই বন্ধ। এই ঠান্ডায় জানালা খোলা রাখার প্রশ্নই আসে না।

অন্তি জুবথুব হয়ে বসে আছে সোফার এক কোণে। তার সামনেই টেবিলে পা তুলে আধবসা হয়ে শুয়ে আছে দিহান। নুহাশ খুব সাবধানে দিহানের শার্ট খুলে ব্যান্ডেজ পরিবর্তন করে দিচ্ছে। এই তিনজন বাদেও ঘরে আরো একজন মানবীর উপস্থিতি রয়েছে।‌ এই মেয়েটাকে অন্তি চেনেনা। কখনো দেখেনি। দিহানদের বয়সের আশপাশে বয়স মেয়েটার। রুমের এক কোণে দাঁড়িয়ে ঘুমে ঢুলছে। নিশ্চই তাকে ঘুম থেকে তুলে আনা হয়েছে। কেন আনা হয়েছে সেটাও অন্তি জানেনা। আপাতত সে বিষয়ে তার মাথা কাজ করতে চাইছে না। মস্তিষ্ক আটকে আছে দিহানের উপর। লোকটার এমন অবস্থা কিভাবে হলো? অন্তির কষ্ট হচ্ছে ভিষণ। মন চাচ্ছে চিৎকার করে কাঁদতে। লাল হয়ে আসা সাদা ব্যান্ডেজগুলো অন্তির বুকে কাঁটার মতো বিঁধছে। অন্তি নিরবে চোখের জল ফেলছে। মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছে না। এর অবশ্য কারণ রয়েছে। দিহান ইতিমধ্যে দুবার ধমক দিয়েছে তাকে। শেষবার ধমকের সাথে বলেছে,

‘আর একবার যদি কান্নার শব্দ পাই, সোজা বাসায় পাঠিয়ে দিব।’

এমন একটা মুহূর্তেও মানুষটার রাগ কমেনি। সমানে ধমক দিয়ে চলছে। অন্তি দিহানকে জানে। মানুষটা ভিষণ নিষ্ঠুর। পাথুরে হৃদয়ের মানব সে। তাকে বাসায় পাঠিয়ে দিতে একবার ও ভাববে না।

দিহানের ব্যান্ডেজ ঠিক করা হয়েছে। অন্তি এখনো মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে চলছে। দিহান নিরবে বসে অন্তির কান্না দেখছে। দিহান কিছু বলছেনা দেখেই হয়তো মেয়েটা সাহস পায় খানিক। কান্নার শব্দটা বাড়ে। এ পর্যায়ে দিহান রাশভারী গলায় বলে ওঠে,

‘মেয়ে এদিকে আসো। কাছে এসো বসে তারপর কাঁদো।’

নুহাশ মুখ টিপে হাসে। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে দিহানকে বলে,

‘এখানে আমার আর দরকার আছে বলে মনে হচ্ছে না। আমি কি এখন যেতে পারি?’

দিহান তার কথায় দারুন অবাক হয়ে বলে,

‘তোকে ধরে রেখেছে কে?’

নুহাশ জবাব না দিয়েই উঠে দাঁড়ায়। রুম ছেড়ে যেতে যেতে বলে,

‘আশপাশেই আছি। দরকার হলে কল দিস।’

যদিও নুহাশ জানে দিহানের কখনোই তাকে দরকার হবে না। কলটা সে ভুলেও দিবে না। তাকে নিজেকেই খানিক পরপর এসে দেখে যেতে হবে কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে কিনা। এতবছরের বন্ধুত্বে এতটুকু সে চিনতে পেরেছে দিহানকে। দাম্ভিকতায় ভরপুর দিহান কখনো নিজ থেকে কারো সাহায্য নিতে পছন্দ করেনা। হোক সেটা যত জটিল পরিস্থিতি। তবে আশ্চর্য জনক বিষয় আজ দিহান তার সাহায্য নিয়েছে। অন্তির সাথে দেখা করার জন্য। ভাবা যায় দিহান মির্জা তার দাম্ভিকতা লুকিয়ে একটা মেয়ের সাথে দেখা করতে নুহাশের সাহায্য নিয়েছে! নুহাশ মিটিমিটি হাসে। বন্ধু তার খুব ভালো ভাবেই ফেঁসেছে।

দিহানদের সাথে আসা মেয়েটার নাম নুহী। দিহানদের সাথে একসাথেই পড়ত মেয়েটা। বেশ ভালো বন্ধুত্ব ওদের। দিহানের এত ক্লোজ কোনো মেয়ে ফ্রেন্ড আছে জানা ছিল না অন্তির। দূরে বসে থাকার কারণে তখন ভালোভাবে না দেখতে পেলেও এখন স্পষ্ট ভাবে মেয়েটার মুখ দেখতে পাচ্ছে অন্তি। মেয়েটা ভিষণ সুন্দরী। কত সুন্দর করে হাসে! কিন্তু সে তো অত সুন্দর না। উহু ঐ মেয়েটার ধারে কাছেও না। দিহানের আশপাশে এত সুন্দর মেয়ে থাকতে দিহান কেন তাকে পছন্দ করলো? মুহূর্তে অন্তি কথাটাকে শুধরে নিলো। দিহান মোটেই তাকে পছন্দ করেনি।‌ সে দিহানকে বাধ্য করেছে।

‘তারপর বলো আমার বন্ধুকে কেমনে আটকালে? আমাদের ক্লাসের কত মেয়ে ওকে আঁচলে বাঁধার চেষ্টা করলো। কেউ পারলো না। তোমার মতো ছোট মিষ্টি মেয়েটা কেমনে পারলো ওকে আটকাতে? আমি সত্যিই ভিষণ কিউরিয়াস।’

নুহী নামের মেয়েটার চোখেমুখে সত্যিই কৌতুহলের ছড়াছড়ি। অন্তির এই কৌতূহল মোটেই ভালো লাগলো না। আর না ভালো লাগলো নুহী নামের এই মেয়েটাকে। ভালো না লাগার বিশেষ কোনো কারণ নেই। মেয়েটার মাঝে খারাপ লাগার মতো কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। এই না থাকার জন্যই হয়তো অন্তি তাকে মেনে নিতে পারছে না। অন্তি উপলব্ধি করলো সে এই মেয়েটাকে হিংসা করছে খুব। এই যে মেয়েটার কথায় দিহান মিটিমিটি হাসছে তাতেও তার হিংসা হচ্ছে। এতটাই হিংসা হচ্ছে যে এই মুহূর্তে তার কাঁদতে মন চাচ্ছে।
অন্তিকে এমন পরিস্থিতিতে বাঁচাতে দিহান কথা বলে উঠলো।

‘অনেক রাত হয়েছে। তোর এখন যাওয়া উচিত। নুহাশ বাহিরে আছে। ও তোকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।’

নুহী হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালো। ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে ব্যস্ত গলায় বললো,

‘সত্যিই অনেক বেজে গেছে। আসি গো পিচ্চি ভাবী। অন্যকখনো গল্প হবে তোমার সাথে।’

অন্তিও মুচকি হাসে। ভদ্রতা বজায় রাখতেই বলে,

‘আবার কখনো দেখা হলে অনেক কথা হবে আপু। ভালো থাকবেন।’

নুহী চলে যাওয়ার পর পরিবেশ নিরব। দিহান কিছু না বলে কেমন গভীর দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে। অন্তির অনেক কিছু বলার আছে। অনেক কিছু জানার আছে। এভাবে বসে থাকলে কিছুই জানা হবে না। অন্তি দিহানের কাছ ঘেঁষে বসে। আলতো হাতে দিহানের মাথার ব্যান্ডেজে হাত বুলায়। ভীতু স্বরে বলে,

‘অনেক ব্যাথা?’

দিহান ডানে বায়ে মাথা নাড়ায়। তবুও অন্তির চোখ ভরে আসে। চোখের পাপড়ি ভিজে ভারী হয়ে আসে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাতে চায় মেয়েটা। দিহান হাত বাড়িয়ে চোখের জলটুকু মুছে দেয়। কোমল গলায় বলে,

‘টাইম আপ রূপ। এখন আর কাঁদা চলবে না। তুমি কাঁদলে আমি সুস্থ হবো কিভাবে?’

অন্তি নাক টানে। কান্না আটকাবার চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে শ্যাম মুখখানি লাল বর্ণ ধারণ করেছে। দিহান হঠাৎ করেই হাঁসফাঁস করে ওঠে। অন্তির কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,

‘তোমাকে লোভনীয় লাগছে রূপ! তোমার এখন ফিরে যাওয়া উচিত। আমার ভেতরের দুষ্টু সত্তা তোমার লোভনীয় রূপ সহ্য করতে না পেরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।’

কান্না ভেজা চোখ দুটো লজ্জায় নিভে আসে। কান গরম হয়ে ওঠে। নিমিষেই কান্না লজ্জায় রূপ নেয়। দিহান ঠোঁট কামড়ে হাসে। পাশ থেকে ফোন তুলে সময় দেখে চিন্তিত ভঙিতে নুহাশকে কল করে। নুহাশের ফিরতে পাঁচ মিনিটের মতো লাগবে।

‘এভাবে প্রতিদিন দেখা করবেন?’

অন্তির কথায় দিহান কিছুটা গম্ভীর জবাব দেয়,

‘এভাবে আর দেখা করা হবে না। দিনের বেলা সুযোগ করে দেখা করবো।’

অন্তি মন খারাপ করে মাথা নামিয়ে ফেলে। কিছু একটা ভেবে চট করে বলে,

‘চলুন বিয়ে করে ফেলি।’

‘করবো।’

‘আজই চলুন।’

‘আমার আরো কিছুটা সময় লাগবে রূপ। নিজেকে একটু গুছিয়ে নেই।’

অন্তির মন খারাপ হয়। দিহানের থেকে এমন উত্তর সে আশা করেনি। দরকার হলে তারা কুঁড়েঘর থাকবে। তবুও দিহানের উচিত ছিল রাজী হওয়া। অন্তির মনঃক্ষুণ্ণ হয় এতে।

‘বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।’

দিহান ছোট করে বলে,

‘জানি।’

এই উত্তরটা অন্তিকে আরো কষ্ট দেয়। দিহান জেনেও চুপ করে আছে। সে কি চায় অন্তির অন্যকারো সাথে বিয়ে হয়ে যাক? অন্তির চোখে অভিমানের জল আসে। গলায় একরাশ বেদনা নিয়ে সে বলে,

‘আপনি আমায় ভালোবাসেন না দিহান। একদম বাসেন না।’

‘কখনো বলেছি সেটা?’

‘ভালোবাসেন সেটাও বলেননি।’

দিহান থামে। সে বুঝেছে মেয়েটার মাঝে জেদ চেপেছে। কথায় সমাধান হবে না। দিহান অন্তির মুখ ঘুরিয়ে চোখে চোখ রেখে তাকায়। বলে,

‘আমি সুস্থ হলে বিয়ে করবো। মাত্র কিছুদিনের ব্যাপার। এই কটা দিন একটু মানিয়ে নাও?’

অন্তি দিহানের নরম গলার কথা ফেলতে পারে না। দিহানের এই রূপটা বরাবর তাকে কাবু করে ফেলে। এবারো হলো তাই। ইচ্ছে থাকতেও সে জোর গলায় বলতে পারলো না যে আমার খুব দ্রুত আপনাকে চাই। আপনাকে ছাড়া দমবন্ধ লাগে আমার।

_____________

তন্নির বড় বোনের নাম তানিয়া। সরকারি একটা কলেজে অনার্স করছে। স্বভাবে সে কিছুটা তন্নির মতোই। শান্ত সভ্য। কিন্তু এই স্বভাবটা কেবল পরিবারের মানুষের সামনে। বাস্তবিক ভাবে সে ভিষণ অশান্ত প্রকৃতির মানুষ। ভাঁজা মাছ উল্টে খেতে না পারা টাইপ রূপের আড়ালে যে রূপটা আছে সেটা কেবল তন্নি একা জানে। নরম মনের দয়ার মানুষ হওয়ায় বোনের রাজ জানা সত্ত্বেও মুখ ফুটে রা উচ্চারণ করা হয়নি কখনো। এইতো কিছুদিন পরপর দুবোন ঘুরতে যাবে বলে বের হয় তারা। এ ব্যাপারে তাদের বাবার উৎসাহ একটু বেশি। দুই মেয়ে মাঝে মধ্যে একসাথে ঘুরতে বের হবে এতে মাইন্ড ফ্রেশ হবে। আলাদা রকম একটা ব্যাপার স্যাপার আছে। খুশি হয়ে হাজার দুয়েক টাকা বড় মেয়ের হাতে গুঁজে দেন তিনি। কিন্তু এই টাকার শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ ও ভাগে পায় না সে। বাদবাকি ঘুরতে যাওয়ার কাহিনী তো পুরোটাই যাচ্ছে তা। তন্নিকে নির্দিষ্ট একটা জায়গায় বসিয়ে রেখে প্রেমিকের সাথে পুরো দুনিয়া ঘুরে আসে সে। তন্নি কাঠের পুতুলের মতো পুরোটা সময় একই জায়গায় বসে থাকে। এজন্যই বোধহয় তার বোনটা তাকে একটু বেশিই পছন্দ করে।

আজ ও তন্নি তার বোনের সাথে ঘুরতে বের হয়েছে। তানিয়া বেছে বেছে তাকে গোলাপি রঙের একটা ওভারকোট পড়িয়েছে। সাথে হোয়াইট প্যান্ট। গলার মাফলার টাও সাদা রঙের। চুলগুলো উঁচু করে ঝুঁটি করা। তন্নি ভেবে পাচ্ছেনা বোনের ডেটে সে কেন এত সেজে যাচ্ছে।

‘কেন যেন মনে হচ্ছে ডেট টা তোমার না বরং আমার।’

তানিয়া তন্নির কানে ছোট স্টোনের দুল পরিয়ে দিতে দিতেই মুচকি হাসে। রহস্য করে বলে,

‘হতে কতক্ষণ!’

তন্নি ঠোঁট উল্টে তাকায়। না বোঝার মতো করে বলে,

‘মানে।’

‘মানে কিছুই না। ছোট মানুষের অত মানে টানে বুঝতে নেই। নিচে ওয়েট কর আমি রেডি হয়ে আসছি।’

তন্নিও বোনের কথা মেনে নেয়। তার সত্যিই অত মানে বোঝার দরকার নেই। এই পৃথিবীতে যে যত কম জানবে, কম বুঝবে সে হচ্ছে তত সুখী মানুষ। তন্নিও সুখী মানুষ হতে চায়। তাই তার জন্য কম জানা শ্রেয়।

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here