যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয় #আফসানা_মিমি |পর্ব: বিশ|

0
200

#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: বিশ|

চায়ের দোকানে বসে আরামে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে রুস্তম। চঞ্চল চোখ জোড়া নতুন শিকারের খোঁজ করছে। মালিকের আদেশে দুইদিনে লুকিয়ে নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরে আসে। সেখান থেকে ১০০ টাকা ভাড়া দিয়ে লাল পাহাড়ের আদিবাসীদের এলাকায় এসেছে। হাশেমের দোকানে বসে অদূরেই চৌদ্দ পনেরো বছর বয়সী মেয়ে নালার পানিতে ঝিনুক কুড়াচ্ছে। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে একটা বিস্কুটের প্যাকেট হাতে এগিয়ে যায় মেয়েটির দিকে। হ্যাংলা পাতলা রুস্তম লাফ দিয়ে সহজেই নালায় নেমে পড়ে। ঝিনুক কুড়ানোর বাহানায় মেয়েটির সাথে কথা বলতে চেষ্টা করে,
” তোর গতরের কাপড়টা দেহি খুব সুন্দর। কইত্তে নিছিলি রে!”

সহজসরল মেয়েটির নাম আসমা। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামারঙা। একগাল হেসে উত্তর দিল, ” বড়ো আফা ঢাহা থেইকা আনছিল। পায়জামায় ছিঁড়া পাইয়া আমারে দিয়া দিছে।”

রুস্তম নড়েচড়ে দাঁড়ায়। অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলছে তারমানে মেয়েটি বড্ড বোকা অথবা সহজসরল। রুস্তম ভাবে, ঘরে যদি বউ রাইখা না আসতো তাহলে এই মাইয়ারে নিজের করে নিতো। অবশ্য বিয়ের আগে যে সে সুপুরুষ ছিল সেটাও বলা পাপ হবে। তার চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করে ওঠে। যাদুমিশ্রিত কথা শুরু করে,
” আহারে আহারে কী কইলি রে তুই! পরীর লাহান মাইয়া নাকি অন্যের গতরের কাপড় পরে?”
” তুমি কেডা?”
আসমা ঘাড় ঘুরিয়ে রুস্তমের দিকে তাকায়। চোখে মুখে তার প্রশ্নের সমাহার। সুযোগ পেয়ে রুস্তম পুনরায় বলতে শুরু করে,” লাল পাহাড়ে ম্যাডামের লগে আইছি। বস্তা ভইরা টেহা লইয়া আইছে দান করার লাইগা। ধলিপাড়ার সবাই যাইয়া আনছে। হাশেম ভাইরে জিজ্ঞেস করো, হের বউও তো আনলো।”
আসমা গলা উঁচু করে হাশেমকে জিজ্ঞেস করে, ” ও গো হাশেম ভাই, হাঁচা কথা নাকি?”

বোকা ছেলেটা হ্যাঁ বলে মাথা নাড়ায়। আসমার মনে সন্দেহের বীজ তখনও বিদ্যমান। নালা থেকে উঠে কাপড় ঝেড়ে সে বলে, ” তোমার ম্যাডাম লাল পাহাড়ে তাইলে তুমি এইহানে কি করবার আইছো?”

” আমি তো বিঁড়ি টানতে আইছিলাম। পাহাড়ে দোকান নাই তুমি জানো না?”

কুপ্রকৃতির মানুষ অভিনয়ে সর্বদা পটু থাকে।রুস্তম তার প্রমাণ। দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য পুরষ্কার সে পাবে। আসমা সহজেই বিশ্বাস করে ফেলে। কোমড়ে গুঁজে রাখা ওড়না গায়ে জড়িয়ে লাল পাহাড়ের চূড়ায় এগোতে থাকে।

কথায় আছে, লোভে পাপ পাপে মৃত্যু। আসমার বিষয়টাও এমন। জবুথুবু হয়ে গাড়ির ভেতরে বসে আছে সে। ঠোঁট কে’টে র’ক্ত ঝড়ছে তার। গাড়িতে সে একা নয়, আট থেকে দশজন মেয়েও তার মতো অসহায় অবস্থায় পড়ে আছে।
বাহিরে রুস্তম বিস্তৃত হেসে টাকা গুনছে। এবার তার মালিক তার উপর সন্তুষ্ট হবেই হবে। টাকার ঘ্রাণ নিয়ে রুস্তম লোভাতুর স্বরে বলে, ” কাওয়া কা কা করলেই ফিরতে হয় না, বোকার দল! কাওয়া যে কখন শকুনের রূপ নিবো কইবার পারবা না।”

মোটা অঙ্কের টাকা পকেটে ঢুকিয়ে গাড়ির পেছনটায় দুইবার আঘাত করে চিৎকার করে বলে ওঠে,” লও মিয়া রওনা হও! বর্ডারে লোক পাইয়া যাইবা। মালগুলারে সাবধানে লইয়া যাইয়ো যেন পালাতে না পরে।”

রুস্তম হেসে সিগারেট ধরায়। আবারও এই পৃথিবীতে কুৎসিত বিকৃত মস্তিষ্ক বহুরূপীর জয় হয়ে গেলো।

——————————–

ঘুমের ঘোরে মিষ্টির মনে হলো কেউ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রেখেছে যেন ছেড়ে দিলেই সে পালিয়ে যাবে। পেটের কাছটায় বেশি ভারী অনুভব হয় তার। চোখ খুলতেই তার চোখ জোড়া চড়কগাছ হয়ে যাবার উপক্রম হয়। অন্তিক তার পেটের কাছে মুখ গুঁজে কী যেন বিড়বিড় করে বলছে। মিষ্টি আধশোয়া হয়ে জিজ্ঞেস করে,” কি বলছে সে?”

অন্তিক নিরুত্তর। শ্রবণহীনতার ভঙ্গিতে পুনরায় বলতে থাকে,” আমার প্রিন্সেস, বলে দাও তো! আমি কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নই!”

অন্তিকের নীরবতার কারণ মিষ্টির বুঝে আসে। বার কয়েকবার সে অন্তিককে ডাকে। অন্তিক ভুলেও টু শব্দ পর্যন্ত করেনি। মিষ্টি চুপচাপ অন্তিকের পাগলামো দেখে গান ধরে,

যদি দেখার ইচ্ছা হয়
তোমার নিঠুর মনে লয়
কালিন্দীর ঘাটে আইসো দুপুরের সময়

আমি জল ভরিবার ছল করিয়া
দেখব নয়ন ভরিয়া জল ভরিবার
আমি জল ভরিবার ছল করিয়া
দেখব নয়ন ভরিয়া
দেইখো আসিয়া

আমার বন্ধু চিকন কালিয়া,,,,,,,,,

মুগ্ধ দৃষ্টিতে অন্তিক মিষ্টির গান শোনে। মোহিত হয়ে মিষ্টির কাছাকাছি বসে। চোখে চোখ রেখে বলে,” আমি তোমাকে ভালো রাখতে চাই, চন্দ্রিমা! তুমি বরাবরই আমার কাছে অচেনা একজন নারী হয়ে আছো। আমি কী বিশ্বাসের যোগ্য ছিলাম না? মনিমা-ই যে আমার মা তা জানালে কী খুবই অপকার হয়ে যেত, বলো?”

মিষ্টি অন্তিকের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। মানুষটার চেহারায় সে মিথ্যা রাগ খুঁজে পেয়ে দুর্বল হেসে বলে,” তুমি হয়তো জানো না, অন্তু। আমি এতিম। আমার বাবা, মা আসল বাবা মা নয়। পূন্যালয়ে আমাকে যখন আনা হয়েছিল তখন আমার বয়স তিন কী চার হবে। মনি মা আমাকে দেখে নিজ সন্তানের মতো যত্ন করতে শুরু করেন। এর পরের বছরই বাবা মা আমাকে দত্তক নেয়। দাদীই মূলত আমাকে দেখে মায়ায় জড়িয়ে যায়। আর রইলো মনি মার কথা! সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করতে বলা হয়েছিল আমাকে। মনি মার কাছে তোমার গল্প শুনতাম। ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম। কিন্তু তোমাকে এভাবে পেয়ে যাব কল্পনাও করতে পারিনি। তুমি আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছো তোমারই অগোচরে। আমি কীভাবে তোমাকে সত্য বলতাম যদি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও! সইতে পারব না। আমাকে মনি মা তেমনভাবে শিক্ষা দিয়েছেন যেভাবে আমি মোল্লা বাড়ির কীটদের সাথে লড়াই করতে পারব। কতটুকু পেরেছি জানি না। তবে আমার অন্তুকে মিথ্যা জাল থেকে বের করে আনতে পেরেছি তাতেই ধন্য।”

অন্তিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে।এই পৃথিবীতে কেউ পূর্ণ নয়। মিষ্টিকে বুকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় অধর ছুঁয়ে বলে, ” আমি যেমন তোমার কাছে সাদা কাগজের মতো পরিষ্কার থাকতে চাই, তোমার ক্ষেত্রেও তাই। জীবনে যতোই ঝড় আসুক না কেন। কোনো কথা লুকাবে না।”

মিষ্টি মাথা সায় দিয়ে অন্তিকের বুকে মুখ গুঁজে।

————

পোলাও রান্না হচ্ছে মোল্লা বাড়িতে। লায়লা বেগম খুশিতে গদগদ প্রায়। খুশিতে জবরদস্ত রান্না করছেন। কলি মুখে কালো মাক্স লাগিয়ে সারা বাড়ি ঘুরছে আর বেসুরে গান গাইছে। গানের সুরে লায়লা বেগমের পিত্ত জ্বলে ওঠে। এমন কুৎসিত স্বরে কেউ গায় নাকি? প্রশ্নটা মনে আসতেই হাঁক ছাড়ে, ” কই গেলি রে কলি, মানুষটা আইজ কতদিন পরে বাসায় আসবো! ঘর দোরে ঝাড়ু ও তো লাগাতে পারোস! কী দিন আসলো! পুলাপাইন মায়ের কাজে হাত বাড়ায় না।”

” রান্না করার জন্য তুমি তো আছোই! এতদিন পর শান্তিতে বাড়িতে থাকছি তোমার সহ্য হচ্ছে না বুঝি! ক্যাচাল না পেরে কাজ করো।”

” আমি তো কাজ করবোই,কাজের মহিলা যে! তোরা কী পরের বাড়ি আর যাবি! মায়ের ঘাড়ে আছোস বুঝোস না। পরের ঘরে গেলে চুলের মুঠি ধরে কাজ করাবো। আর কাজে ফাঁকিবাজি করলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব।”

” ঠিক যেভাবে আমাদের বের করে দিয়েছো, সেভাবেই। তাই না মা!”

আকস্মিক পিয়াসের স্বর শুনে চমকায়িত লায়লা বেগম। ইতঃস্তত হয়ে বলে, ” ইয়ে মানে আমি!”

” থাক আর বলতে হবে না। পাপ বাপ কেও ছাড়ে না কথাটা জানো তো! ভেবেছিলাম তুমি অন্তিকের কাছে পরনারী হলেও আমার তো মা! অন্ততঃ আমাকে বা আফিয়াকে মেনে নিবে কিন্তু আমার ধারণা ভুল, অহংকার ও দাম্ভিকে তুমি অন্ধকারে ডুবে আছো। কীভাবে পারলে তুমি অন্তিককে মিথ্যা অপবাদ দিতে?”

” মিথ্যা কখন বললাম। ডাক্তার যা বলেছে তাই বলেছি।”

পিয়াসের রাগ চরম পর্যায়ে। সে চিৎকার করে বলতে শুরু করে, ” তোমার ডাক্তার, রিপোর্ট তোমার মতোই ছলনাময়ী। দিনের পর দিন ছেলেটাকে তুমি অন্ধকারে রেখেছো। মিথ্যা রিপোর্টের ভয় দেখিয়ে যা ইচ্ছে করিয়েছো। এভাবেই তুমি ক্ষমা পাবে? কখনোই না। তোমার বিচার হবে, দুনিয়াতে না হোক হাশরের মাঠে হবে। একজন নিরপরাধ মানুষকে তিলে তিলে শেষ করার শাস্তি তুমি পাবে।”

পিয়াস যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে যায়। লায়লা বেগম কিছুক্ষণ ছেলের কথা ভেবে পুনরায় গোস্তের লবন চাখতে এগিয়ে যায়। ফিরোজ আজ দশদিন পর বাড়ি আসবে। মানুষটা প্রায় সময় বাহিরে কাজে মগ্ন থাকে। এসব কষ্ট কী আর আজকালকার ছেলে মেয়ে বুঝবে? তারা তো সম্পর্ক কী তাই বুঝে না। এত বছরের বৈবাহিক জীবনে লায়লা বেগম কতো মা’র খেয়েছে হিসাব নেই। প্রত্যেকবারই সে সব ভুলে স্বামীকে খুশি করার প্রায়শ করতে থাকে।
———————-

ছোট্ট এই পৃথিবীতে মানুষের চাহিদার শেষ নেই। এসব চাহিদা মেটাতে মানুষ অবশ্যই ভালো কাজ করবে না। অসৎপথ বেছে নিবে। নাজিমউদ্দীনের মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মিষ্টির মনে হয়নি। সে অন্তিককে অবগত করলে বিষয়টা গাঢ় চোখে দেখে। আড়ালেই কাজ শুরু করে বন্ধু শাওনের মাধ্যমে। শাওন পেশায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা। আজই সে ময়মনসিংহ থেকে এসেছেন অন্তিকের কাছে। অনেকটা জরুরী তলবে নিজের অফিসে ডেকেছেন অন্তিককে। অন্তিক এসে উপস্থিত হয় আড়াইটার মধ্যে। শাওন দেখা মাত্র কুশল বিনিময় করে একজন সহকারীকে কাউকে নিয়ে আসার খবর পাঠায়। মিনিট পাঁচেক পর একজনকে নিয়ে উপস্থিত হয় সহকারী। শাওন তাকে দেখিয়ে বলতে শুরু করে, ” একে চিনো? এই ছেলের নাম রুস্তম। নারী ব্যবসা করে। নেত্রকোণা থেকে ধরে নিয়ে এসেছি ব্যাটাকে। নারী পাচার করছিল, হাতেনাতে ধরা পড়ে। তোমার দাদার ঘরের খাট থেকে যেই হাতের ছাপ পেয়েছিলাম তা এর সাথে মিলে।”

অন্তিক অবিশ্বাস্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রুস্তমকে তার খুব ভালে করেই চেনা। তার চাচার কাঠের দোকানের কর্মচারী রুস্তম। বিগত এক বছর যাবত তাকে দেখেনি অন্তিক। নাজিমউদ্দীন একবার তার কথা জিজ্ঞেস করায় ফিরোজ বলেছিল সে নাকি কাজ ছেড়ে দিয়েছে। তবে কীভাবে তার হাতের ছাপ মোল্লা বাড়িতে থাকবে?
তবে কী অন্তিক যা ভাবছে তাই! এসবের পিছনে কী ফিরোজ চাচা দায়ী?

চলবে………….

[ লায়লা বেগমকে খুব মিস করছিলাম তাই একটু নিয়ে আসলাম। আপনারা মিস করেছেন তো? তা ফিরোজকে কে কে সন্দেহ করেছিলেন, দেখি তো?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here