#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব২২
#ইশরাত_জাহান
🦋
সকালে গোসল করে শাড়ি পরে দীপান্বিতা।একটু পর লাইভ করবে শাড়ি সেলের জন্য।ভেজা চুলে হিজাব বাধা সম্ভব না।তাই আপাতত চুল মেলে রেখে ভেজা জামা কাপড় নিয়ে ছাদে আসে।কাপড় চোপড় রোদে শুকাতে দিবে।ছাদে এসে কাপড়গুলো তারে মেলতে থাকে দীপান্বিতা।নীরব ছাদেই ছিলো। সিগারেটে নিজেকে ব্যাস্ত রেখেছিলো।একজন নিউট্রিশন হয়েও আজ নিজের সঙ্গী হিসেবে সিগারেট বেচে নিয়েছে।দীপান্বিতা ছাদে আসাতে আনমনে তার চোখ যায় সেদিকে।কতদিন পর আজ শাড়ি পরা অবস্থায় দেখলো নিজের মায়াবন বিহারিনীকে।দেখে নিজের চোখের পিপাসা মেটাতে থাকে নীরব।ঠিক তখনই অভ্র এসে দীপান্বিতার শাড়ির আঁচল ধরে টান দেয়।সাথে সাথে দীপান্বিতা হাত দিয়ে শরীরের কাপড় ঠিক রাখতে সক্ষম হয়।শাড়ি দিক বেদিক না হলেও কোমর থেকে হালকা শাড়ির পার সরে যায়।অভ্রকে দেখে নীরবের বিবেকে নাড়া দেয়।সে তার নিষিদ্ধ নারীকে দেখছে।
এদিকে শাড়ির এমন অবস্থা হওয়াতে নীরব দীপান্বিতাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,”লাইভে এসে তো আজকাল মানুষ নিজেদের রূপ যৌবন দেখিয়ে ইনকাম করছে।এখন কি তাদের ছাদে এসেও বাকিটুকু খোয়াতে হবে?না জানি কত কি দেখতে হয়।”
পিছন থেকে নীরবের এমন দৃষ্টিকটু কথা সহ্য করতে পারে না দীপান্বিতা।ছাদ থেকে সোজা ঘরে চলে আসে।ঘরে এসে হাউমাউ করে কান্না করতে থাকে।অভ্র দীপান্বিতার পিছনে এসে দীপান্বিতাকে বলে,”কি হয়েছে আম্মু?”
আজ প্রথম দীপান্বিতা রাগে দুঃখে অভ্রকে চড় মেরে বলে,”কে তোর আম্মু?আমি তোর আম্মু না।চলে যা চোখের সামনে থেকে।”
বলেই বালিশে মুখ গুজে কান্না করতে থাকে।বেশ কিছুক্ষণ কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে যায় দীপান্বিতা।আজ আর লাইভ করা হলো না তার।ঘণ্টা খানিক পর মিসেস সাবিনা এসে ডাক দেন দীপান্বিতাকে।দীপান্বিতাকে ডেকে বলেন,”লাইভ করিস নি?অভ্রকে তো গোসল করাতে হবে।”
“অভ্রকে আজ তুমি গোসল করিয়ে দেও মা।”
“নানাভাই কোথায়?”
“কোথায় মানে?ও তোমার কাছে নেই?”
“না।আমি তো রান্না করতে ব্যাস্ত।কিছু হয়েছে?”
“আমি আজকে ওকে রাগের মাথায় মেরেছি মা।কটু কথা শুনিয়েছি।মাথা গরম ছিলো তাই।গেলো কোথায় ছেলেটা আমার?”
বলেই খাট থেকে লাফ দিয়ে ওঠে দীপান্বিতা।নীরার পরীক্ষার আজ শেষ দিন।দ্বীপ নিজেও আজ পরীক্ষার সেন্টারে ব্যাস্ত।পিংকি ওইদিনের পরেই চলে যায় হোস্টেলে।মিস্টার সমুদ্র নিজের কাজে গেছেন।মিসেস শিউলি তালিমের দাওয়াত পেয়েছেন তাই সেখানে গেছেন।বাসায় শুধু মিসেস সাবিনা ও দীপান্বিতা ছিলো।মিসেস সাবিনা রান্না করছেন।এমনিতেই দীপান্বিতার ঘর রান্নাঘর থেকে দূরে তারউপর প্রেসার কুকারে সিটি বাজার শব্দে দীপান্বিতার কথা শুনতে পান না।যদি শুনতে পেতো তাহলে তখনই অভ্রকে নিজের কাছে নিয়ে নিতেন।
সাড়া ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে যাচ্ছে দীপান্বিতা।অভ্রকে খুঁজে পাচ্ছে না কোথাও।এবার যেনো নিজেই জ্ঞান হারাবে দীপান্বিতা।এই বাড়ি ওই বাড়ি খুঁজতে থাকে।মিসেস সাবিনা তাড়াতাড়ি খোঁজ নেন মিসেস নাজনীনের কাছ থেকে।কিন্তু না অভ্র সেখানেও নেই। নীরব বাসায় আছে আজ।বিকালে যাবে নিজের সেন্টারে।সোফায় বসে মায়ের কাছে শুনতে পেলো অভ্রকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।বাচ্চা অভ্রকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে বুকে মোচড় দিলো নীরবের নিজেরও।ভাবতে লাগলো ঘণ্টা দুই আগের ঘটনার জন্যই কি এমন হলো?তাড়াতাড়ি করে অভ্রকে খুঁজতে বাইক নিয়ে বের হয় নীরব।নীরার সাথে অভ্রর বেশ কয়েটা ছবি আছে।সেগুলো দেখিয়ে দেখিয়ে খুঁজবে অভ্রকে।
মিসেস সাবিনা ফোন করে দিলেন মিস্টার সমুদ্রকে।অভ্রকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে তিনিও দৌড়ে চলে এসেছেন।গোল্লিতে এ বাড়ি ও বাড়ি করেও অভ্রর কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না।দীপান্বিতার কানে এখন শুধু চার বছর আগের সেই পুরোনো প্রতিশ্রুতি ভেসে আসছে।কেউ একজন তাকে মারা যাওয়ার আগে বারবার বলেছিলো,”আমার অভ্রকে তুমি দেখে রেখো।আমার কলিজার টুকরোর এই দুনিয়ায় কেউ নেই।জন্ম দিয়ে আমি চলে যাচ্ছি।কিন্তু তার আসল গার্জিয়ান তুমি।”
পারলো না আজ দীপান্বিতা।এতগুলো বছর নিজের হাতে গড়ে তোলা অভ্রকে দুই মিনিটে হারিয়ে ফেললো।মাত্র চার বছরের এক শিশু তার মনে কি এতই ক্ষোভ?যে সামান্য একটু কথাতে সে আঘাত পেয়ে চোখের বাইরে চলে গেলো।বাচ্চা হলে কি হবে?সে তো মানুষ।হয়তো এই জন্যই অভ্রর মনেও দাগ কেটে নিয়েছে এই কথাটি।এমনিতেও কত মানুষ ওকে কত রকম কথা শুনিয়ে দেয়।শেষমেশ তার মাও কি না তাকে আজ কথা শুনিয়েছে।সহ্য করতে পারেনি অভ্র।
দ্বীপ নীরাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছে।এমন সময় দ্বীপের ফোনে কল আসে।মিস্টার সমুদ্র করেছে এই ফোন।দ্বীপ ফোন রিসিভ করতেই মিস্টার সমুদ্র বলেন,”অভ্রকে পাওয়া যাচ্ছে না তিন ঘণ্টা হতে চললো।দীপান্বিতার অবস্থা খুবই খারাপ।দুইবার অজ্ঞান হয়েছে।আমি আমাদের এলাকার ভিন্ন গোল্লিতে খুঁজছি।তুমি ওদিক দিয়ে আসার সময় একটু ভালোভাবে পরখ করে নিও।নীরব গেছে গোল্লির মাথায় অভ্রকে খুঁজতে।”
ফোন লাউডে ছিলো।নীরা ও দ্বীপ অভ্রর কথা শুনে দুজনেই নার্ভাস হয়ে গেছে।তারপরও দ্বীপ বলে,”আমরা ভালোভাবে খোঁজ নিচ্ছি বাবা।”
দ্বীপ আস্তে আস্তে ড্রাইভ করছে আর রাস্তায় কোনায় কোনায় ভালোভাবে তাকাচ্ছে।নীরা নিজের জানালার পাশ দিয়ে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখতে থাকে। গোল্লির মাথায় এসে গাড়ি থামিয়ে দ্বীপ ও নীরা একসাথে ভিন্ন জায়গায় খুঁজতে থাকে অভ্রকে।বেশ কিছুক্ষণ খোঁজার পর এক জায়গায় দাড়ায় দ্বীপ ও নীরা।হঠাৎ নীরার কানে ভেসে আসে ফোফানির শব্দ।কেউ রাস্তার পাশে একটি ডাস্টবিনের পিছনে কান্না করছে।নীরা তাড়াতাড়ি সেখানে যেয়ে দেখে অভ্র হাঁটু চেপে ধরে কান্না করতে থাকে।নীরা দ্বীপকে ডাক দিয়ে বলে,”অভ্র এখানে ক্যাডার সাহেব।”
দ্বীপ দৌড়ে আসে ওদের কাছে।নীরা অভ্রর হাঁটুতে হাত দিয়ে বলে,”এখানে কিভাবে লেগেছে বাবা?”
“একটা কুকুর আমাকে তাড়া করে।আমি দৌড়াতে দৌড়াতে পড়ে যাই।তারপর এখানে লুকিয়ে থাকি।”
দ্বীপ অভ্রকে কোলে নিয়ে বলে,”তুমি কাউকে কিছু না বলে এভাবে বাসা থেকে বেড়িয়েছো কেনো?তোমাকে সবাই খুঁজছে তো।”
অভ্রকে চোখের পানি মুছে বলে,”আম্মু বলেছে আমাকে চলে যেতে।আম্মু আমার মা না।আমার মা বাবা কে?”
দ্বীপ এবং নীরা একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে অভ্রকে নীরা বলে,”তোমার মায়ের নাম দীপান্বিতা।তোমার মাও যে বাবাও সে।”
বলেই কিছুক্ষণ দুষ্টুমি করে নীরা।তারপর বাড়ির দিকে রওনা দেয়।নীরা ফোন করে মিস্টার সমুদ্রকে বলে,”আমরা অভ্রকে পেয়েছি।বাসায় আসছি এখনই।”
মিস্টার সমুদ্র সাথে সাথে সবাইকে বলে।দীপান্বিতা তাড়াহুড়া করে মেইন গেটের কাছে এসে অপেক্ষা করে অভ্রর জন্য।নীরবকে কল করে জানিয়ে দেন মিসেস নাজনীন।দ্বীপের গাড়ি এসে বাড়ির সামনে থামতেই দীপান্বিতা অভ্রকে কোলে নিয়ে আদর করে।কান্না করতে করতে বলে,”আম্মুর কথায় কেউ রাগ করে,বাবা?একটু রেগে গেছিলো আম্মু। আর কখনও রাগ করবে না।”
ঠিক তখনই নীরব আসে সেখানে।অভ্রকে দেখে নিজেও এবার শান্তি পেলো।মিস্টার সমুদ্র ও মিসেস সাবিনা চলে গেলেন বাসার ভিতরে।বাচ্চারা সবাই না খেয়ে আছে।মিসেস নাজনীন অভ্রকে আদর করে নিজের ফ্ল্যাটে চলে যান।নীরব এসে দীপান্বিতাকে বলে,”বাচ্চাকে আগলে রাখতে পারেন না?এমন বেপরোয়া থাকেন কেনো আপনার সম্পর্কগুলো?”
দীপান্বিতা চোখের পানি মুছে বলে,”আমি আমার ছেলেকে কিভাবে আগলে রাখবো সেটা আমি বুঝে নিবো।আপনাকে দেখতে হবে না।”
বলেই অভ্রর হাত ধরে হাটা দেয় দীপান্বিতা।নীরব ক্ষিপ্ত হয়ে হাটা দেয় নিজের বাড়ির দিকে।দ্বীপ এদের কান্ড দেখলো।নীরা একবার তাকায় দীপান্বিতার যাওয়ার দিকে আরেকবার তাকায় নীরবের যাওয়ার দিকে।দ্বীপ নীরাকে ধাক্কা দিয়ে বলে,”কি হয়েছে?”
“কেমিস্ট্রি।”
ভ্রু কুঁচকে দ্বীপ বলে,”মানে?”
“যখন কোনো নারী ও পুরুষ একে ওপরের বিপরীত দিকে হাঁটতে থাকে তখন তার মানে কি বোঝায় জানেন?”
দ্বীপ মাথা নাড়ায় মানে না।নীরা আবার বলে,”এরা একে ওপরের বিপরীত মুখী।কিন্তু এদের মিলন আবারও হবে।”
“কোন কবির থেকে শুনেছো এই কথা?”
“লোকে চাইলে এই নীরাও হতে পারে এক কবি।”
“তোমার কি মনে হয়?দীপান্বিতা ও নীরবের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে?”
“বর্তমানে আমার সচক্ষে নেই।তবে আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি এদের মধ্যে কিছু একটা আছে।যেটা এখন প্রকাশ পাচ্ছে না।”
“অভ্রর কি হবে?দীপান্বিতা ওকে এখন নিজের প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসে।জীবনে প্রথম মা ডাক শোনার অনুভূতি।তার উপর কারো সাপোর্ট ছাড়াই মানুষ করে অভ্রকে।”
“অভ্রর জন্য এখন আমরা আছি।তখন নাহয় দায়িত্ব নিতে পারিনি।এখন তো পারবো। আর এমনিতেও অভ্রকে দীপান্বিতা আপু বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করাতে চেয়েছে।”
“ভাই হিসেবে বোনের জন্য আমি সবকিছু করতে পারি।নীরব ছেলে হিসেবে অনেক ভাল।আমার সাথে বসে যখন চায়ের আড্ডা দিতো আমার খুব ভাল লাগতো।তাই নীরবকে আমি না করবো না।কিন্তু অভ্রকে ছাড়া দীপান্বিতা এখন শূন্য।”
“চেষ্টা তো করতে থাকি।দেখা যাক ভাগ্যে কি হয়!”
“হুম।”
বলেই দ্বীপ ও নীরা বাড়ির ভিতরে ঢুকলো।আজ সন্ধায় রিক ও কেয়ার বিয়ের কেনাকাটা হবে।এই জন্য নীরা ও দ্বীপকে ডাকা হয়েছে।দ্বীপ ও নীরা রেডি হয়ে অভ্রকে নিয়ে চলে যায় শপিং মলে।কেয়ার পছন্দের ড্রেস কিনে দেওয়া হয় কেয়াকে। রিককেও কেয়ার পছন্দ করে দেওয়া পাঞ্জাবি কিনে দেওয়া হয়।সবকিছু কেনাকাটা করার পর সবাই বাড়ি ফিরবে কিন্তু নীরা দ্বীপকে খুঁজে পায় না।কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর নীরা দেখলো দ্বীপ বাইরে থেকে আসছে।
নীরা বলে,”কোথায় গিয়েছিলেন?”
“বাইরে একটু কাজ ছিলো তাই।”
“আচ্ছা,চলুন বাসায় যাই।”
বলেই সবাই বাসায় চলে যায়।
{শুনো গিটার সাহেব।তুমি যখন ব্যালকনি দিয়ে গিটারের তালে তালে গাইবে মায়াবন বিহারিনী আমি তখনই আমার জানালা দিয়ে তোমাকে দেখবো।রাতের আধারে প্রেমিক পুরুষের গানের সাথে চন্দ্র বিলাস করার মজা আলাদা।দুজন দুর দূরান্তে থেকেও আমরা গানের তালে করবো প্রেমের আবেদন।}
দীপান্বিতার এই পুরনো কথাগুলো মগজে বারবার বারি খাচ্ছে নীরবের।নীরব খুব সুন্দর গান গাইতে পারে।গিটার বাজানো এক নেশা নীরবের কাছে।সেই নেশায় যোগ দেয় দীপান্বিতা।তখন নীরবকে গিটার সাহেব বলে ডাকতো।আবার যখন নিরব বলতো সে নিউট্রিশন হতে চায় তখন দীপান্বিতা তাকে খাদ্য বিশেষজ্ঞ সাহেব বলে ডাকতো।
পুরনো স্মৃতি মাথা থেকে মুছে ফেলতে চায় নীরব।তাই সে মিসেস নাজনীনকে বলে,”আমার জন্য মেয়ে দেখা শুরু করো মা।আমি আর আপত্তি করবো না।”
চলবে…?