#নব_প্রেমের_সূচনা
#Sumaiya_Akter_Bristy
#পর্ব_৩৬
আরভীর কথায় সমুদ্র স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আরভী এরকম একটা সারপ্রাইজ দিবে তা সমুদ্রের কল্পনার বাহিরে ছিলো। সমুদ্র বারবার নিজের মনকে বুঝ দিচ্ছে এই বলে যে এসব সত্যি নয়। সব তোর ভ্রম সমুদ্র অথবা তুই হয়তো কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছিস।
মনকে নানা ভাবে বুঝাতে চাইলেও অবাধ্য মনটা সেসব কথা বুঝতে চাইলো না। তাই সত্যি মিথ্যে যাচাই করতে অনেক আশা নিয়ে সমুদ্র কম্পনরত স্বরে আরভীকে জিজ্ঞেস করলো,”এসব কি বলছেন ললনা? আপনি নিশ্চয়ই আমার সাথে ঠাট্টা করছেন। তাই না?”
“আমাদের মধ্যে কি ঠাট্টার সম্পর্ক আছে সমুদ্র? আমি যা বলেছি সব সত্যি বলেছি। কি জানেন তো? আমি আবার আপনার মতো এতো মিথ্যে বলতে পারি না।”
“হ্যাঁ আমি মানছি আমি মিথ্যে বলেছি কিন্তু আমার ভালোবাসা মিথ্যে নয় ললনা। আট বছর ধরে আপনাকে ভালোবেসে এসেছি। আপনার নতুন নতুন রুপের প্রেমে পড়েছি। কিন্তু বিনিময়ে কি পাচ্ছি? প্রেম দহন?”
“আপনি যদি আমার আর আমার প্রতিশোধের মাঝে প্রবেশ না করতেন তাহলে হয়তো আমি আপনাকে একটা সুযোগ দেওয়ার কথা ভেবে দেখতাম।”
“আপনার সুযোগ দেওয়া আর না দেওয়ায় আমার কিছু যায় আসে না। আপনি আমার না হলে আর কারো হতে পারবেন না। আমি আর আপনাকে হারাতে পারবো না।”
এতোক্ষণ নরম গলায় কথা বললেও এবার সমুদ্রের গলায় কঠোরতা দেখা গেলো। শেষোক্ত কথাগুলো অনেকটাই উচ্চস্বরে বললো। আর যা দেখে আরভীর ভীষণ হাসি পেলো। কিছুটা শব্দ করে হেসে তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,”একটা বাহিরের মেয়েকে ভালোবেসে তাকে হারানোর ভয় আপনার এতো কষ্ট দিচ্ছে। কেমন উন্মাদের মতো কথা বলছেন আপনি। আর আমি যে আমার জন্মদাতা পিতাকে হারিয়েছি? সেটা কিছু না?”
“সেই ঘটনার সাথে আমি কোনোভাবে জড়িত নই তা আপনিও ভালো করে জানেন।”
“তা নিয়ে আমি কখনো আপনাকে কোনো প্রশ্ন করি নি। কিন্তু আপনি সেদিন মিনহাজকে বাঁচিয়ে অনেক বড় ভুল করেছেন।”
“আরে আমার ভাই হয় মিনহাজ। আমি কিভাবে আমার চোখের সামনে আমার ভাইকে মরতে দিতাম?”
“আর আপনার ভাই যে আমার সাথে প্রেমের মিথ্যে নাটক করেছে? আমার বাবার অস্তিত্ব চিরতরে পৃথিবী থেকে বিলীন করে দিয়েছে তার বেলা?”
“ওরা ভুল তা আমিও জানি। ওরা অন্যায় করেছে, পাপ করেছে। কিন্তু তাদের পাপের মাশুল কেন আমাকে দিতে হচ্ছে?”
“অন্যায় যে করে এবং অন্যায় যে সহে দুজনেই সমান অপরাধী জানেন তো?”
আরভীর কথা শেষ হলে সমুদ্র নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠে। আরভী ঈষৎ কেঁপে উঠে সমুদ্র চিৎকারে।
এতিমখানার প্রাঙ্গনে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কদম গাছে এক ঝাক পাখি বসে ছিলো। সমুদ্রের চিৎকারে তারাও দ্বিকবিদিকের ভুলে ছুটতে শুরু করে।
সমুদ্র এবার চোখ তুলে পিয়াসের দিকে তাকায়। সমুদ্রকে পিয়াসের দিকে তাকাতে দেখে আরভী সমুদ্রের চোখের দিকে দৃষ্টি স্হাপন করে। সমুদ্রের রক্তিম বর্ণের চোখ যুগল দেখে বড়সড় ঢোক গিলে। সমুদ্রের চোখে ক্রোধের আগুন দেখতে পাচ্ছে আরভী। যে আগুনে হয়তো ভস্ম করে দিবে সবকিছু সমুদ্র।
সমুদ্রকে নিজের দিকে এভাবে তাকাতে দেখে পিয়াস ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলে উঠে,”আরে ব্রোহ! যেভাবে তাকাচ্ছো আমার তো তোমাকে দেখে ভয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে,,,”
সমুদ্র পিয়াসকে আর কিছু বলতে না দিয়ে এক থাবায় পিয়াসের শার্টের কলার টেনে ধরে। এক ঘুষি বসায় পিয়াসের নাক বরাবর।
সমুদ্রের হঠাৎ আক্রমণে পিয়াস দু কদম পিছিয়ে যায়। নাকে বেশ ব্যাথা পেয়েছে। তরল জাতীয় পদার্থ নাক দিয়ে নির্গত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে নাক মুছতেই দেখতে পায় আঙ্গুলে লাল বর্ণের রক্ত লেগে আছে।
সমুদ্র এভাবে গায়ে হাত তুলবে তা আরভী ভাবতে পারে নি। কেননা সমুদ্রকে কখনো এই রুপে দেখে নি আরভী।
আরভী সমুদ্রের দিক এগিয়ে গিয়ে দু’একটা কটু কথা শুনাবে সমুদ্রকে তার আগেই সমুদ্র আবার পিয়াসের দিকে এগিয়ে যায় পিয়াসকে মারার জন্য। দু হাত দিয়ে পিয়াসের কলার টেনে ধরে বলে,”আমার থেকে আমার সর্বনাশিনীকে ছিনিয়ে নেওয়ার কথা ভাবলে একদম জানে মেরে ফেলবো তোকে। সময় থাকতে কেটে পড়। অন্যথায় তোর মৃত্যু আমার হাতে।”
কথাটি বলে সমুদ্র আবার পিয়াসকে আঘাত করতে যায়। কিন্তু তার আগেই আরভী সমুদ্রকে টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সমুদ্রের গালে কষে এক থাপ্পড় মারে। ক্রোধান্বিত স্বরে বলে,”একদম নিজের মামার মতো হয়েছেন। যেমন মামা তেমন তার ভাগ্নে। মানুষের গায়ে হাত তুলতে কারোর’ই বিবেকে বাধে না।”
আরভীর দিকে তাকিয়ে সমুদ্রের ক্রোধানল খানিকটা নিভে আসে। কন্ঠ স্বর নরম করে আরভীর দিকে তাকিয়ে বলে,”ললনা, আপনি আমাকে মারুন। যতো ইচ্ছে মারুন। আমি কিছু মনে করবো না। কিন্তু আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ের কথা ভাববেন না প্লিজ। আমি আর আপনাকে হারাতে পারবো না।”
“একটা কথা ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে রাখুন সমুদ্র। ইহকাল বা পরকাল, কোনো কালেই এই আরভী রায়হান সমুদ্র মুনতাসিনের হবে না।” তর্জনী আঙুল দেখিয়ে সমুদ্রকে শাসিয়ে কথাটি বললো আরভী।
অপরদিকে আরভীর এই কথাটি সমুদ্রের একদম’ই পছন্দ হলো না। ফলস্বরূপ ক্রোধের আগুন আবারও জ্বলে উঠলো।
“আর আপনিও একটা কথা ভালো করে মাথায় সেট করে রাখুন। আরভী সমুদ্রের নয় তো কারো নয়। আপনার সব কথা মেনে নিবো কিন্তু আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে জীবনে জায়গা দেওয়ার কথা বললে একদম জানে মেরে ফেলবো।”
“এই ত্রিভুবনকে সাক্ষী রেখে বলছি, আরভী রায়হান বেঁচে থাকতে সমুদ্র মুনতাসিনকে নিজের জীবনে এক বিন্দু জায়গা দিবে না।”
“আর আমিও এই ত্রিভুবনকে সাক্ষী রেখে বলছি, ইহকাল হোক বা পরকাল, আরভী রায়হানের নামের সাথে সমুদ্র মুনতাসিন ব্যাতিত অন্য কারো নাম জুড়বে না।”
কথাটি বলে সমুদ্র আর এক মূহুর্তের জন্যও দাঁড়ায় নি। উল্টো ঘুরে নিজের বাইকের দিকে এগিয়ে যায়। বাইক স্টার্ট দিয়ে সর্বোচ্চ গতিতে চালাতে থাকে বাইক।
সমুদ্র এখান থেকে চলে যেতেই যেনো পিয়াস হাফ ছেড়ে বাঁচলো। মনে হচ্ছে বাঘের গুহা থেকে জীবিত অবস্থায় ফিরে এসেছে। তাও স্বয়ং বাঘ ছেড়ে দিয়েছে বলে।
জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে আরভীর দিকে তাকাতেই আরভী মলিন কন্ঠে বললো,”সরি পিয়াস। আমার জন্য তোমাকে শুধু শুধু মার খেতে হলো।”
“আরে রাখো মারের কথা। মনে করিয়ে দিয়ে আর ব্যাথা বাড়িয়ো না। আগে বলো এই বারুদকে তুমি কোত্থেকে খুঁজে পেলে?”
“আমি তাকে খুঁজে পাই নি। সে আমাকে খুঁজে পেয়েছে।” চোখমুখ কুচকে প্রতিত্তোর করলো আরভী।
“কি জিনিস মাইরি। এক ঘুষিতেই পুরো পৃথিবী ঘুরিয়ে এনেছে আমাকে। এখনো মাথাটা ঘুরছে। কেমন ঝিম মেরে আছে।”
সমুদ্রের চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে অশ্রুতে। যার জন্য ঠিকমতো বাইকও চালাতে পারছে না। লোকে বলে ছেলেরা সহজে কাঁদে না। কিন্তু সবাই হয়তো ভুলে যায় ছেলেদেরও একটা মন রয়েছে। আর এই মনেতেও আঘাত হানে, কাল বৈশাখী ঝড় উঠে। যেমন করে আজ সমুদ্রের মনে ঝড় উঠেছে।
সমুদ্রের পক্ষে আর বাইক চালানো সম্ভব হচ্ছে না। আর কিছুক্ষণ এভাবে বাইক চালাতে থাকলে নির্ঘাত এক্সিডেন্ট ঘটবে। তাই বাইক থামিয়ে রাস্তার একপাশে রাখলো এবং নিজে গিয়ে ফুটপাতের উপর বসে পড়লো। নিজেকে আজ বড় অসহায় মনে হচ্ছে। আরভী কেন সমুদ্রকে ভালোবাসে না তা নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছে। কিন্তু সেসব প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলে না।
আর কতকাল এভাবে চলবে? আর কতকাল সমুদ্র আরভীর পথ চেয়ে বসে থাকবে? তবে কি সমুদ্রের’ই ভুল ছিলো? তখন মিনিহাজের থেকে আরভীকে কেড়ে নেওয়া উচিত ছিলো? হয়তো হ্যাঁ। কেননা তখন আরভীকে মিনহাজের থেকে কেড়ে নিলে আজ আরভী ও সমুদ্রের সুন্দর এক সংসার হতো। দুজনের জীবনটাই সম্পূর্ণ অন্যরকম হতো। সুখের প্রজাপতিরা খেলা করতো দুজনের সেই ছোট্ট সংসারে।
———
মিনহাজ ঘরের সব লাইট বন্ধ করে অন্ধকারে বসে আছে। নাহিদ চৌধুরী মিনহাজের ঘর অন্ধকার দেখে দরজায় নক করলেন। কিন্তু মিনহাজ দরজা খুললো না। বাংলাদেশ থেকে ফিরার পর থেকেই মিনহাজের মাঝে অদ্ভুত সব ব্যবহার লক্ষ্য করেছেন নাহিদ চৌধুরী। হঠাৎ মিনহাজের কি হলো উনি তাই বুঝতে পারছেন না। বড্ড চিন্তা হচ্ছে ছেলেটাকে নিয়ে। অনেক বার জিজ্ঞেস করেছেন কি হয়েছে। কিন্তু মিনহাজ কোনো উত্তর দেয় নি। তাই উনি ভেবে রাখলেন যে করেই হোক আজ মিনহাজের থেকে জেনেই ছাড়বেন মিনহাজের আসলে কি হয়েছে।
যেই ভাবা সেই কাজ। উনি মিনহাজের ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। দরজা ভেতর থেকে লক করা ছিলো না বিধায় উনার কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় নি এই নিয়ে।
ঘরে ঢোকার পরেই উনি দেখতে পেলেন মিনহাজ দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে অ্যালকোহল পান করছে। সামনে দু বোতল খালি পড়ে আছে। তার মানে অনেক ক্ষণ ধরেই ড্রিংক করছে মিনহাজ।
নাহিদ চৌধুরী আস্তে-ধীরে মিনহাজের দিকে এগিয়ে যান। মিনহাজের পাশে বসে আহ্লাদী স্বরে মিনহাজকে ডেকে বলেন,”বাবা মিনহাজ! কি হয়েছে তোর? হঠাৎ এতো ড্রিংক করছিস যে?”
চলবে…..