#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_২৪
#ইশরাত_জাহান
🦋
ভিতর থেকে ভাঙচুরের শব্দ আসছে।মিসেস নাজনীন বিরক্ত চোখে তাকিয়ে আছেন মিস্টার রবিনের দিকে।তারা দুজনে এটা বুঝতে পেরেছে দীপান্বিতা ও নীরবের ভিতর কিছু একটা চলছে।
নীরা বালিশ থেকে শুরু করে ঘরে থাকা যত কাচের জিনিস আছে সব ছুঁড়ছে।নীরব কিছু কিছু জিনিস কেস ধরে আবার কিছু জিনিস তার পাশ দিয়ে পড়ে ভেঙ্গে যায়।না পেরে নীরব বলে,”কি হয়েছে তা বলবি তো?”
“তুমি দীপান্বিতা আপুকে ধোঁকা দিয়েছো কেনো?”
কপাল কুঁচকে নীরব বলে,”আমি কোথায় ধোঁকা দিয়েছি?সে নিজেই তো তার জীবন সঙ্গী নিয়ে ভালো আছে।”
“জীবন সঙ্গী আসলো কোথা থেকে?”
“মানে?”
“মানে কে সে যার দ্বারা দীপান্বিতা আপুকে সঙ্গ দেয়?”
“আমি কি জানি?অভ্র তো আর আকাশ থেকে উড়ে আসবে না।”
কপাল চাপড়ে নীরা বলে,”আরে আমার ভাই।ওটা দীপান্বিতা আপুর বায়োলজিক্যাল সন্তান নয়।”
“তাহলে?”
“দীপান্বিতা আপুর বেস্ট ফ্রেন্ড তামান্না আপুকে তুমি চিনো কি না জানি না।অভ্র তার সন্তান।তামান্না আপু বেচে নেই।”
“তাহলে অভ্র দীপান্বিতার কাছে কেন?”
“খুব বেশি আমার স্পষ্ট মনে নেই।যতটুকু জানি ততুটুকু বলতে পারি।দীপান্বিতা আপু যখন অনার্স ভর্তি হয় তখন তাদের বাসায় এসে তামান্না আপু।তামান্না আপুর অবস্থা খুবই মর্মান্তিক ছিলো।মুখ হাত পা সব জায়গায় মারের দাগ।হাতের উপর পুড়ে যাওয়া কালচে চামড়া।দেখে বোঝা যায় কোনো নরপশুর অত্যাচার সহ্য করেছে।তামান্না ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করে।পালিয়ে বিয়ে করার সময় কিছু গহনা ও টাকা নিয়ে পালায়।বিয়ের প্রথম দিকে ওই গহনা টাকা নিয়ে সুখেই সংসার চলে।চাকরি করবে বলে গহনা বিক্রি করে টাকা উড়ায় তামান্না আপুর বর।সব শেষ হয়ে গেলে আবার আড্ডা যুয়াতে নেমে পড়ে তামান্না আপুর বর।সেই সময় তামান্না আপু প্রেগনেন্ট হয়।সাথে বেড়ে যায় তামান্না আপুর উপর অত্যাচার।এক সময় তামান্না আপুর বর তাকে বিক্রি করতে চায় এক নষ্ট এলাকায়।অনেক ঝগড়া ঝাটির পর তামান্না আপুর চুলের মুঠি ধরে দেওয়ালে বেশ কয়েকবার বাড়ি মারে।কপাল ফুলে ফেটে রক্ত বের হয়।না পেরে তামান্না আপু পালিয়ে আসে।পলাতক মেয়ে গর্ভবতী হয়ে ফিরেছে বলে মেনে নেয় মা তামান্না আপুর বাবা মা।বাধ্য হয়ে এদিক ওদিক আশ্রয় খুঁজতে থাকে।অতঃপর আসে দীপান্বিতা আপুর কাছে।মামনি বাবাইয়ের(দ্বীপের বাবা মা) হাত পা ধরে।তামান্না আপুর করুন অবস্থা দেখে সবাই রাজি হয় আপুকে কাছে রাখতে।এক কথায় লুকিয়ে ছিলো এখানে।
গর্ভবতী অবস্থায় মারধর সহ্য করে ছিলো।খাওয়া দাওয়ার ঘাটতি ছিলো প্রচুর। যার ফলে তামান্না আপুর শরীর দূর্বল থাকতো।রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।ডাক্তার বলেছিলো,’ রোগীর অবস্থা খুব খারাপ।এমন চললে বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাবে।’
ক্যাডার সাহেব নিজের বিসিএস নিয়ে ব্যাস্ত ছিলো।এদিকে পিংকির মায়ের ঝামেলা তো ছিলোই।তাই দীপান্বিতা আপু ব্যাস্ত থাকতো তামান্না আপুকে নিয়ে।হঠাৎ একদিন তামান্না আপু অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।তাড়াতাড়ি করে হসপিটালে নেওয়া হলে ডাক্তার জানায়,’ যেকোনো একজনকে বাঁচানো যাবে।’
তামান্না আপুর এক কথা,’ বেঁচে থাকতে বাবা মায়ের মুখে চুন কালি মিশিয়েছি এখন নিজের সন্তানকে খুন করে নিজের জীবন কিছুতেই বাঁচাবো না।আমার সন্তান না তাহলে আমি নিজেও থাকবো না।’
অগত্যা আমাদের তামান্না আপুর কথা শুনতে হয়।ডেলিভারির আগে তামান্না আপু রিকোয়েস্ট করে দীপান্বিতা আপুর সাথে কথা বলে।কি কি বলে আমি জানি না।আমি আব্বু আম্মু বাইরে ছিলাম।ক্যাডার সাহেব আর বাবাই ব্যাস্ত ছিলো তাই আমরা আসি।
নার্স যখন অভ্রকে কান্নারত অবস্থায় বের হয় দীপান্বিতা আপু সাথে সাথে কোলে নেয় অভ্রকে।অভ্রর কান্না নিজে থেকে থেমে যায়।অভ্রের জন্মের সাথে সাথে মৃত্যু হয় তামান্না আপুর। পিংকির আম্মু অনেক কথা শুনায় কিন্তু দীপান্বিতা আপুর এক কথা।আজ থেকে অভ্র তার ছেলে। অতটুকু অভ্রকে কোলে নিয়ে আমিও যেনো মায়ায় জড়িয়েছিলাম।প্রায় যেয়ে যেয়ে খেলা করতাম অভ্রর সাথে। আস্তে আস্তে আমরা সবাই অভ্রকে ভালোবাসতে শুরু করি।অভ্র আমাদের কাছের একজন হয়ে উঠেছে। পারা পড়শীরা কিছু বলতে আসলে প্রতিবাদ করে দীপান্বিতা আপু।এই জন্য কয়েকদিন পরই অভ্রকে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করবে।”
এইটুকু বলে থেমে যায় নীরা।নীরার চোখ দিয়ে পড়ছে পানি।পানিগুলো মুছে আবার বলে,”কিন্তু আমি এটা বুঝলাম না যে তুমি এগুলো জানো না কেন?”
“আমার সাথে দীপান্বিতার সম্পর্ক জার্মান যাওয়ার পরও থাকে।কিন্তু ছয়মাস পর হঠাৎ একদিন আমাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়।অনেক খুঁজি আমি ওকে।কিন্তু পাই না কোথাও।প্রায় বছর পর আম্মুর সাথে ভিডিও কলে কথা বলার সময় দেখি আণ্টি (মিসেস সাবিনা)অভ্রকে কোলে নিয়ে আছে।আমি জিজ্ঞাসা করি বাচ্চাটা কে।আম্মু বলে দীপান্বিতার ছেলে।আমি ভেবে নিয়েছিলাম ওর মনে হয় বিয়ে হয়েছে,সংসার করছে।একদিন ও আমাকে কল দেয় রাগে দুঃখে আমি আমার কন্টাক্ট নাম্বার অফ রাখি।সবকিছু পাল্টে ফেলি।”
মাথায় হাত দিয়ে নীরা বলে,”এতকিছু হয়ে গেছে।অথচ কিছুই জানতাম না।কিন্তু দীপান্বিতা আপু তোমার সাথে কন্টাক্ট অফ রেখেছিলো কেনো এটা আমিও জানি না।”
“হয়তো ব্যাস্ত ছিলো।কিন্তু আমি কত বড় ভুল করলাম।যদি ও একটিবার আমাকে ওর অবস্থাগুলো বলতো আমি সারাজীবন অপেক্ষা করতাম।”
“মানুষ মাত্রই ভুল।আমরা কাউকে দুই মিনিটে বিশ্বাস করে ঠকি আবার চোখের পলকে অবিশ্বাস করেও ঠকি।এটা অবস্থা বুঝে।”
“হুম।এখন কি করবো?”
“কি করবে মানে?দীপান্বিতা আপুকে বিয়ে করবে।মেয়েটা সারা জীবন তোমার অপেক্ষায় ছিলো।”(জোরেই বলে)
“ও কি মেনে নিবে?যেভাবে রেগে আছে।”
“ওহ কাম অন ভাই।তুমি এই মুনজেরিন নীরার ভাই।ক্যাডার সাহেব হলো তোমার দুলাভাই।তুমি অবশ্যই পারবে।”
“লিমার কি হবে?ওকে তো আজকে আংটি পড়িয়ে এসেছি।”
“ওই লিমা যদি হয় আমার ভাবী।আমার মাথা কিন্তু হয়ে যাবে আতা মাঝি ছাতাকলি।”
“বিয়েটা ভাঙবো কিভাবে?”
কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে নীরা দুষ্টু বুদ্ধি বেড় করে।নীরব ও নীরা সেগুলো নিজেই আলোচনা করে।তারপর বেড় হয় ঘর থেকে।ড্রয়িং রুমে এসে দেখে দ্বীপ এসেছে।মিসেস নাজনীন মিস্টার রবিন ও দ্বীপ সোফায় বসে গল্প করে।নীরা বলে,”বলে দিয়েছেন সব।”
দ্বীপ সোফায় বসা অবস্থায় বলে,”সব জানলে তো বলবো!”
মিস্টার রবিন বলেন,”না মা তেমন কিছুই বলেনি দ্বীপ।আমরা শুধু এটুকুই বুঝেছি নীরব ও দীপান্বিতার ভিতর জিলাপির প্যাচ আছে।”
মিসেস নাজনীন চোখ রাঙিয়ে বলেন,”এতদিন তো ছেলে মেয়ে হিসাব করে কথা বলনি।আজ অন্তত জামাইকে দেখে কথা বলো।”
নীরা মিস্টার রবিনের পাশে বসে বলে,”আরে ধুর।আমার আব্বু হলো সাদা মনের মানুষ।কত প্যাচ বুঝে না।তাই মনে যা আছে মুখ ফুটে বলে।”
তারপর নীরা সবাইকে সবকিছু প্রকাশ করে।নীরব ফ্লোরে তাকিয়ে আছে।সবকিছু বলার পর নীরা বলে,”আমি এটা বুঝলাম না!ভাইয়া জার্মানে যাওয়ার ছয় মাস পর দীপান্বিতা আপু কন্টাক্ট কেনো রাখে না?”
দ্বীপ বলে,”যদি ঘটনা ওই সময়ের হয়ে থাকে তাহলে তো তখন দীপান্বিতা ইন্টার এক্সাম দিবে।তখন ওর ফোন নষ্ট হয়ে যায় পানিতে পড়ে।বাবা বলেছিলো ওকে নতুন ফোন কিনে দিবে কিন্তু পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর।পরীক্ষার পর তো আমরা একটু ব্যাস্ত হয়ে পড়ি তারপর তামান্নার সমস্যা শুরু হয়।”
নীরা বলে,”হুম বুঝলাম।কিন্তু আমার ফোন কখন দিবেন?আমার ফোন তো সেই পরীক্ষার তিন দিন আগে থেকে নিয়েছেন।এদিকে আমার পরীক্ষা কাল শেষ হয়ে গেছে।ফোন তো দিলেন না!”
চলছে সিরিয়াস কথা।নীরা বলে উল্টা পাল্টা কথা।সবাই তাকিয়ে আছে নীরার দিকে।মেকি হাসি দিয়ে নীরা বলে,”না মানে মনে পড়লো হঠাৎ তাই আর কি।”
দ্বীপ কথা পাল্টে বলে,”তারমানে এই যে তোমাদের দূরত্ব বাড়লেও তোমাদের মনের গহীনে লুকিয়ে আছে জমানো অনুভূতিগুলো।”
“হ্যাঁ। আর তাদেরকে এক করার দায়িত্ত্ব আমাদের।”
মিসেস নাজনীন বলেন,”লিমার কি হবে তাহলে?”
নীরা লাফিয়ে উঠে বলে,”এই বাড়ির বউ যদি হয় লিমা!সত্যি বলছি তোমার ছেলের মাংস হয়ে যাবে কিমা।সারাদিন এই বাড়িয়ে আমি বাজাবো অক্ষয় কুমারের ডিজে গান বালমা।”
দ্বীপ বলে,”বাবা মা(নীরার বাবা মাকে দ্বীপ বাবা মা বলে) তো তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন।এখন কি করবে?”
“বিয়ে ভাঙবো।”
“কিভাবে?”
কনফিডেন্সের সাথে নীরা বলে,”যাহা পার নীরা হোতি হে টেনশন লেনেকা কোয়ী জারুরাত নেহি।মে হু না।”
মিসেস নাজনীন বলেন,”ওটায় তো বড় সমস্যা।নিজের বিয়ে ভাঙতে যেয়ে কি করেছিলে মনে আছে?বখাটে নান্টুকে টাকা দিয়ে রেখেছিলে নিজেকে কিডন্যাপ করার জন্য।ভাগ্য ভালো দ্বীপ দেখে ফেলে আর প্ল্যান ঘুড়িয়ে দেয়।”
বলেই জিহ্বায় কামড় দেন মিসেস নাজনীন।নীরা চোখ ছোট ছোট করে বলে,”তারমানে ওই ভুয়া গুন্ডাগুলো ক্যাডার সাহেবের লোক ছিলো?বিয়েতে যা দৌড়ানি গেছে সব ক্যাডার সাহেবের জন্য!আমি কি না ভয় পেয়ে ক্যাডার সাহেবের হাত ধরে দৌড়ে কমিউনিটি সেন্টারে আসি।নিজের বিয়েতে মিথ্যা গুন্ডা ভাড়া করে তাড়া খেতে লজ্জা করে না?”
“নিজের বিয়েতে গুন্ডাদের টাকা দিয়ে কিডন্যাপ করানোর প্লান করতে তোমার লজ্জা করে না?”বলেন মিসেস নাজনীন।
“আমি খুবই স্ট্রেট।আমাকে কেউ তার মনের সত্যিটা বললে নিজের বিয়েতে আমি বিরিয়ানি আর রোস্ট মজা করে ইনজয় করতাম।কত টেস্টি ছিলো খাবারগুলো।”
বলেই জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট নাড়ায় নীরা।দ্বীপ বুঝতে পারে এর পাগলামি শেষ হবে না।তাই বলে,”আচ্ছা পরশু তো রিক আর কেয়ার বিয়ে।দায়িত্ব আমাদের উপরেই বেশি।তাই আমরা ওদিকটায় ফোকাস দেই।চলো বাসায় চলো।”
“না আজ আমি এখানে থাকবো।বলেছিলাম তো আপনাকে।”
দ্বীপ কথা না বাড়িয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে নীরার হাত ধরে নিয়ে যায়।
চলবে…?