ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি 💞💞 #লেখিকা-Mehruma Nurr #পর্ব-৩৭

0
1053

#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি 💞💞
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-৩৭

★ রাত ৮-৩৫
পিটপিট করে চোখ খুলে চোখ খুলে তাকালো নূর। চোখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ও কোথায় আছে। জায়গাটা ওর খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে ওর। কিছুক্ষণ ভাবার পরে নূরের মনে পরলো, এটাতো আদিত্যদের ফার্মহাউস। নূর চমকে গেল। মনে মনে ভাবলো, আমিতো বাড়িতে ছিলাম। এখানে কখন কিভাবে এলাম। এসব ভেবে নূর তড়িঘড়ি করে উঠে বসতে নিলেই শরীরের ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো।
….আহহ্।

তানি পাশেই সোফায় বসে ছিল। নূরের আওয়াজ শুনে তড়িঘড়ি করে নূরের কাছ যেয়ে নূরকে ধরে বলে উঠলো।
….তোর জ্ঞান ফিরে এসেছে? যাক আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। তুই ঠিক আছিস তো? জানিস কতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমরা? আর তুই এই শরীরে একা একা কেন উঠতে যাচ্ছিস? আমাকে বললেই তো আমি হেল্প করতাম।
কথাগুলো বলে তানি নূরের বাহু ধরে ওকে বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসালো।

নূর তানির কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। নূর তানির দিকে কনফিউজ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
….আমি এখানে কিভাবে এলাম?আমিতো বাড়িতে ছিলাম। আর ছোট মা আমাকে,,,,,,

নূর বাকিটুকু বলতে পারলো না। কালকের কথা মনে পরতেই ওর গলাটা ধরে এলো।

তানি মুচকি হেসে বললো।
….তুই কি ভেবেছিলি? আমরা থাকতে, আর বিশেষ করে আদিত্য ভাইয়া থাকতে। তোকে ওভাবে ওখানে পঁচে মরতে দিবে? হিরো থাকতে হিরোইনের কিছু হতে পারে কখনো?

নূর ভ্রু কুঁচকে বললো।
…মানে?

তানি নূরকে সব খুলে বললো। তারপর বললো।
….তোকে নিয়ে সোজা হসপিটালে গিয়েছিলো ভাইয়া। তারপর তোকে ট্রিটমেন্ট করিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। ভাইয়ার ফ্লাটে নিয়ে গেলে।লোকজন নানা ধরনের কথা বানাতে পারে। তাই তোকে এখানে নিয়ে এসেছে। আমরাও সবাই এসেছি। আমি তোকে বলেছিলাম না? তোর জীবনে কেউ আসবে। যে তোকে ওই নরক থেকে বের করে নিয়ে আসবে। দেখলিতো আমার কথাই সঠিক হলো। আজ ভাইয়া তোকে ওই নরক থেকে একেবারে নিয়ে এসেছে। আর কখনও তোকে ওই নরকে আর ফেরত যেতে হবে না। তুই জানিস? ভাইয়া কেমন পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল তোর জন্য। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পুরো হসপিটাল মাথায় তুলে ফেলেছিল।

সবকথা শুনে নূর থ হয়ে গেলো। যে মানুষটাক ও এতো কষ্ট দিল।আজ সেই মানুষটাই ওর সব কষ্ট দূরে করে দিচ্ছে। এসব ভেবে নূরের মনে মনে অনেক খারাপ লাগলো। তানির দিকে তাকিয়ে বললো।
….কোথায় উনি?

তানি দুষ্টু হেসে বললো।
…কে উনি? উনি নামের তো এখানে কেউ নেই।

নূর লজ্জা পেয়ে বললো।
…তানিইই।

তানি হেসে দিয়ে বললো।
….তোর জন্য গরম গরম সুপ বানাতে গেছে, তোর উনি।

নূর নিচের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসলো।

ওদের কথার মাঝেই হঠাৎ আদিত্য একটা ট্রেতে করে সুপ নিয়ে ভেতরে ঢুকলো।
আদিত্যকে দেখে নূরের বুকের ভেতর ধক্ করে উঠলো। আদিত্যকে সত্যিই কেমন পাগল পাগল লাগছে। চুলগুলো এলোমেলো, চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে। পরনের টিশার্ট টাও কেমন কুচিমুচি হয়ে আছে। মনে হচ্ছে ওনার ওপর দিয়ে কোনো ঝড় বয়ে গেছে।

আদিত্য নূরের দিকে তাকিয়ে নূরের জ্ঞান ফিরেছে দেখে মনে মনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর কিছু একটা মনে আসতেই আদিত্য নূরের দিক থেকে নজর সরিয়ে নিল। তানির সামনে যেয়ে তানির দিকে তাকিয়ে বললো।
….এই সুপটা ওকে খাইয়ে দেও। তারপর মেডিসিন গুলোও খাইয়ে দিও।

তানি মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….ঠিক আছে ভাইয়া।

আদিত্য ট্রেটা তানির হাতে দিয়ে। নূরের না তাকিয়েই রুম থেকে বেড়িয়ে এলো।

আদিত্যের এমন ব্যবহারে নূর অনেক অবাক হলো। মনে মনে ভীষণ খারাপও লাগলো। তানির দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে বললো।
….উনিতো আমার দিকে তাকালেনও না। আবার কোনো কথাও বললো না।

তানি একটু মুচকি হেসে বললো।
…. ভাইয়া হয়তো একটু রেগে আছে তোর ওপর। তোর সেদিনের ব্যবহারের পর এটাতো একটু স্বাভাবিকই তাইনা?

নূরের চোখে পানি চলে এলো। নূর কাঁদো কাঁদো সুরে বললো।
……এখন আমি কি করবো? উনিতো অনেক রেগে আছে।

…..চিন্তা করিস না। একটু সময় দে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখনতো এখানেই থাকবি। সময় বুঝে ভাইয়াকে সরি বলে দিস। দেখবি ভাইয়া আর রাগ করে থাকতে পারবে না।

নূর মাথা ঝাকালো। মানে ঠিক আছে।

তানি বললো।
….এখন সুপটা খেয়ে ওষুধ খেয়ে শুয়ে থাক।
কথাটা বলে তানি নূরকে সুপটা খাইয়ে দিল। তারপর ওষুধ খাইয়ে দিয়ে নূরকে ধরে শুইয়ে দিয়ে তানিও অন্য রুমে যেয়ে শুয়ে পরলো।

নূরের কিছুতেই ঘুম আসছে না। বারবার শুধু আদিত্যের কথায় মনে পরছে। মনে মনে ভাবছে , উনি যদি আমাকে কখনো মাফ না করে, তাহলে কি করবো আমি? আচ্ছা উনি কি ঘুমিয়ে পড়েছেন? ধ্যাৎ এই শরীরের ব্যাথায় উঠে দেখতেও পাচ্ছি না কিছু।
এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নূর একসময় ঘুমিয়ে পরে।

নূর ঘুমিয়ে যেতেই আদিত্য আস্তে করে নূরের রুমের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলো। ধীর পায়ে নূরের কাছে এসে নূরের পাশে বেডের ওপর বসলো। তারপর নূরের মূখের ওপর ঝুকে কপালে আলতো করে একটা চুমু দিল। নূরের গালে আলতো করে হাত বোলাতে লাগলো আর নূরকে দেখতে লাগলো। আধাঘন্টা এভাবে থাকার পর আদিত্য আবারও নূরের কপালে সময় নিয়ে একটা চুমু দিয়ে নূরের রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।

—————————————-

সকালের মিষ্টি রোদ চোখে পরতেই নূরের ঘুমটা ভেঙে গেল। নূর আড়মোড়া ভেঙে চোখ খুলে তাকালো। ওষুধের কারণে শরীরের ব্যাথাটা একটু কমেছে। নূর ধীরে ধীরে উঠে বসলো। ব্যাথা কমলেও পুরোপুরি সারেনি। তাই এখনো নড়াচড়া করতে কষ্ট হচ্ছে নূরের। নূর পা দুটো আস্তে আস্তে বেডের নিচে নামালো। বেডের মাথায় হাত রেখে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে ওয়াশরুমে যাওয়ার চেষ্টা করলো। দুই পা এগুতেই নূর নিজের ব্যালেন্স না রাখতে পেরে পরে যেতে নেয়। কিন্তু পরে যাওয়ার আগেই আদিত্য দৌড়ে এসে নূরকে ধরে ফেলে।
নূর ভয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে নেয়। যখন বুঝতে পারে যে ও পরে যাইনি, তখন চোখ খুলে দেখে আদিত্য ওকে ধরে আছে। এটা দেখে নূরের অনেক খুশি লাগে। নূর আদিত্যের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। কিন্তু নূরের হাসি বেশিক্ষণ টেকে না। আদিত্য অন্য দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে তানির নাম ধরে ডাকলো।
একটু পরেই তানি তড়িঘড়ি এসে বললো।
…হ্যাঁ হ্যাঁ ভাইয়া। কি হয়েছে বলুন?

আদিত্য দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
….তানি তোমার বান্ধবীকে বলো বেশি পন্ডিতি না করতে। কোনো হেল্প লাগলে কাউকে যেন ডাক দেয়। আমার কথা নাহয় বাদ দিলাম। আমাকে তো আবার তার পছন্দ না। কিন্তু তোমাকে তো ডাকতে পারে। একা একা চলাফেরা করতে যেয়ে আবার কি কোনো দূর্ঘটনা বাধাতে চায় নাকি? আমিও কাকে কি বলছি। সব বিষয়ে এক লাইন বেশি বোঝা তো ওনার পুরাণ অভ্যাস। যাইহোক এখন ওকে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে যাও।

তানি মাথা ঝাকিয়ে এগিয়ে যেয়ে নূরকে ধরলো।
আর আদিত্য ওখান থেকে চলে গেলো।

আদিত্যের এমন ব্যবহারে নূরের চোখে পানি চলে এলো। তানি নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
….কাদিস নাতো। শুধু জানিস ভ্যা ভ্যা করে কাঁদা। কাঁদলে কি সবকিছুর সমাধান হবে নাকি? তারচেয়ে বরং ভাইয়াকে কিভাবে মানাবি সেই চিন্তা কর। এখন চল তোকে ওয়াশরুমে দিয়ে আসি।

নূরকে ওয়ায়রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে তানি মনে মনে ভাবলো। আমরা এখানে থাকলে ওদের ভেতর সহজে কিছু ঠিক হবে না। আমরা না থামলে ভাইয়ার তখন নূরের সাথে সরাসরি কথা না বলে কোনো উপায় থাকবে না। হ্যাঁ আমাদের আপাতত এখান থেকে চলে যাওয়ায় ঠিক হবে। যেই ভাবা সেই কাজ।

একটু পরে নূর বেড়িয়ে আসলে তানি ওকে ধরে বিছানায় বসালো। তারপর নূরকে নাস্তা করিয়ে দিয়ে বললো।
….আচ্ছা নূর। বাসা থেকে মা ফোন করেছে। আমাকে বাসায় যেতে বলেছে। তাই আমি আর থাকতে পারছি না। আমাকে বাসায় চলে যেতে হবে।

নূর তানির দিকে চমকে তাকিয়ে বললো।
….চলে যাবি মানে? আমি এখানে একা একা কি করে থাকবো? না না তুই কোথাও যেতে পারবি না।

….দেখ এটা সম্ভব না। তোর এখানে কতদিন থাকতে হয় তারতো কোনো ঠিক নেই তাইনা? তাই বলেকি আমি এখানে এতো দিন থাকতে পারি নাকি?মা বাবা এটা কখনোই মেনে নেবে না।আর তুই একা কোথায়? আদিত্য ভাইয়া তো আছেই তোর সাথে। উনি থাকতে আর তোর কোনো চিন্তা নেই। আর আমিও মাঝে মধ্যে আসবো তোর সাথে দেখা করতে। তুই চিন্তা করিস না কেমন?

নূর মুখ ছোট করে বললো।
…কিন্তু তবুও।

…..আর কোনো কিন্তু পরেন্তু নেই। এতো ভাবিস নাতো সব ঠিক হয়ে যাবে।

নূর আর কিছু না বলে জোরপূর্বক একটা হাসি দিল।

একটু পরে তানি আবির আর তাসির বেড়িয়ে চলে গেলো।

—————————————-

দুপুর ২ টা
তানিরা চলে যাওয়ার পর নূর একটু ঘুমিয়েছিল। একটু আগেই ওর ঘুম ভাঙলো। শুয়ে শুয়ে থেকে থেকে ওর আর ভালো লাগছে না। এদিকে কেও নেই সময়ও কাটছে না ওর। নিচে নেমে বাইরে যাওয়ারও সাহস পাচ্ছে না। ভয় পাচ্ছে আবারও যদি আদিত্য তখনকার মতো ধমক দেয় এটা ভেবে। নূরের ভাবনার মাঝেই হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে নূর দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো আদিত্য এসেছে। হাতে খাবারের ট্রে। তারমানে উনি দুপুরের খাবার খাওয়াতে এসেছে। কথাটা ভেবে খুশি হলো নূর। মনে মনে ভাবলো, এই সুযোগে ওনার কাছে মাপ চেয়ে নিতে হবে।

আদিত্য নূরের দিকে না তাকিয়েই খাবারের ট্রে টা নিয়ে বেডের পাশে ছোট টেবিলে রাখলো। তারপর চুপচাপ প্লেটে খাবার বেড়ে হাতে নিয়ে নূরের মুখের সামনে ধরলো।
নূর খুশী মনে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে থেকেই হা করে খাবার মুখে নিল।
আদিত্য চুপচাপ খাইয়ে যাচ্ছে। কোনো কথাই বলছে না। খাওয়া শেষ হলে নূরকে ওষুধ খাইয়ে দেয়। তারপর সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে চলে যেতে নিলেই নূর খপ করে আদিত্যের হাত টেনে ধরে। তারপর মিনতির সুরে বললো।
…..আমি জানি আপনি আমার উপর রেগে আছেন। আর এটাই স্বাভাবিক। আমি আপনার সাথে যে ব্যবহার করেছি তাতে আপনার রাগ করাটা জায়েজ। কিন্তু একবার শুধু আমাকে সবটা এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দিন। একবার আমার সাথে কথা বলুন। আমার কথাটা শুনোন প্লিজ।

আদিত্য এখনো উল্টো দিকে ঘুরেই দাঁড়িয়ে আছে। নূরের কথা শুনে ও ভেতরে ভেতরে অনেক দূর্বল হয়ে পরলো।আদিত্য চোখ বন্ধ করে নিজেকে একটু শক্ত করে নূরের দিকে না তাকিয়েই বললো।
…..এসব কথা পরে হবে। তুমি এখন অসুস্থ। তোমার রেস্ট নেওয়া উচিৎ।

….না আমি এখুনি কথা বলতে চাই প্লিজ। আপনার রাগ করে থাকা, আমার সাথে কথা না বলা এগুলো আমার সহ্য হচ্ছে না। প্লিজ কথা বলুন আমার সাথে। দরকার হলে বকাঝকা করুন তবুও কথা বলুন প্লিজ।

আদিত্য উল্টো ঘুরে থাকা অবস্থাতেই তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
….কেন? আমার মতো ছ্যাঁচড়া লোক তোমার সাথে কথা না বললে,তোমার তো আরো ভালো লাগার কথা। এইজন্যই তো আমি তোমার থেকে দূরে থাকি যাতে তুমি বিরক্ত না হও। এখন এখানে কেউ নেই বলে আমার আসতে হলো। নাহলে আমি তোমাকে ডিস্টার্ব করতে আসতাম না। তবে চিন্তা করোনা। আমি মালি কাকাকে বলে দিয়েছি। এখন থেকে উনার বউ এসে তোমার দেখাশোনা করবে। তারপর আর আমার মুখ তোমাকে দেখতে হবে না।

আদিত্যের কথায় নূর এবার কেঁদে উঠলো। কান্না জড়িত কন্ঠে বললো।
…..এভাবে বলবেননা প্লিজ। আমি সেদিন ওসব মন থেকে বলিনি। ওগুলো আমি মিথ্যে বানিয়ে বলেছিলাম। যাতে আপনি আমাকে ভুল বুঝে ঘৃণা করেন।আমাকে ভুলে যান। যাতে আমার জন্য আপনার কোনো ক্ষতি না হয়।

আদিত্য এবার ট্রেটা বেডের পাশে রেখে। নূরের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো।
….মানে? কি বলতে চাও তুমি?

নূর মাথা নিচু করে কান্না মিশ্রিত গলায় বলে উঠলো।
……ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি। আমি নাকি অপয়া। আমার জন্য সবার ক্ষতি হয়।আমি নাকি সবাইকে খেয়ে ফেলি। জন্ম নিতেই মা মারা গেল। বাবা থেকেও নেই। এক দাদি ছিল সেও আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। সবার কথা শুনতে শুনতে একসময় আমারও হতে লাগলো। আমি সত্যিই হয়তো অপয়া।আমি যার জীবনে যাবো তারই ক্ষতি হবে। তাই সেদিন যখন আমাকে বাচাতে যেয়ে আপনার এক্সিডেন্টে হলো। আমার মনে হলো আমার জন্যেই আপনার সাথে এমন হয়েছে । আমি সত্যিই একটা অপয়া। আমি আপনার জীবনে থাকলে আপনার জীবনের ঝুঁকি থাকতে পারে। তাই আমি আপনার জীবন থেকে সরে যাওয়ার জন্য ওসব করেছি।

নূরের কথা শুনে আদিত্য কতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো।তারপর হঠাৎ দূই হাত উঁচু করে তালি বাজাতে লাগলো। আদিত্য তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
….বাহ্ বাহ্ আমি আমার জীবনেও এমন ফালতু কথা শুনিনি। লাইক সিরিয়াসলি নূর। তুমি এইযুগের একটা শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এইসব ফালতু কথা কিভাবে মানতে। আবার এই কারণে তুমি আমার জীবন থেকে দূরেও চলে যেতে চেয়েছো? বাহ্ তুমি কতো গ্রেট, তাইনা নূর?

তারপর আদিত্য নিজের ভাবভঙ্গি পাল্টে চোয়াল শক্ত করে রাগী স্বরে বলে উঠলো।
……তুমি কি ভেবেছো? তুমি আমাকে এইসব লেইম স্কিউস দিবে আর আমি খুশি হয়ে যাবো? আসলে জানো কি নূর? তুমি সেদিন সত্যিই বলেছিলে। তুমি আমাকে আসলে ভালোই বাসোনা। কারণ ভালোবাসলে এইসব ফালতু কথা না মেনে ভালোবাসার ওপর ভরসা রাখতে। আমার কাছ থেকে কখনো দূরে যাওয়ার চেষ্টা করতে না। তুমি ভাবলে কি করে যে, তুমি আমার জীবন থেকে চলে গেলে আমি ভালো থাকবো? একটা কথা জেনে রাখো নূর তুমি আমার জীবনে থাকলে আমি বাঁচব কি মরবো জানিনা।তবে তুমি আমার জীবনে না থাকলে আমি নিশ্চিত মরে যাবো। অথচ তুমি কতো সহজেই আমার জীবন থেকে চলে যেতে চাইলে। আমাদের দুজনের বিষয়ে তুমি একাই ফয়সালা করে ফেললে? তাও আবার নিজের মতো করে। বাহ্ তুমি সত্যিই গ্রেট। আই সেলুট ইউ।
কথাগুলো বলে আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে ওখান থেকে বেড়িয়ে গেলো আদিত্য।

আদিত্য চলে যেতেই নূর হাটুর ভেতর মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো।

আদিত্য নিজের রুমে এসে বেডের ওপর বসে হাত দিয়ে নিজের চুল টেনে ধরে মাথা নিচু করে বসে রইলো। নূরের রুম থেকে কিভাবে এসেছে তা শুধু ওই জানে। নূরের কান্না ও কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলো না। আদিত্য মনে মনে বললো।
….আই এ্যাম সরি নূর। আমি তোমার ওপর একটুও রেগে নেই। আমিতো আগে থেকেই সব জানতাম। তানি আমাকে আগেই সব বলে দিয়েছে। আমি শুধু তোমাকে বোঝাতে চাই যে ভালোবাসার মানুষ দূরে গেলে কতো কষ্ট হয়। যাতে ভবিষ্যতে আর কখনো তুমি আমার কাছ থেকে দূরে যাওয়ার কথা চিন্তাও করতে না পারো। তাই আপাতত তোমাকে একটু কষ্ট পেতে হবে নূরপাখি। কারণ তোমাকে আমি কিছুতেই হারাতে পারবো না। তোমাকে ছাড়া যে আমি নিঃস্ব নূরপাখি।

নূর নিজের চোখের পানি মুছে মনে মনে বললো।
…তানি ঠিকই বলেছে। এভাবে বসে বসে শুধু কাঁদলে কাজ হবে না। আমিই যখন ওনাকে রাগিয়েছি তাহলে আমিই ওনার রাগ ভাঙাবো।
————————————–

রাত ৮ টা
নূর বসে অপেক্ষা করছে কখন আদিত্য খাবার নিয়ে আসবে। এবার আসলে ও আদিত্যকে মানিয়েই ছাড়বে। নূরের ভাবনার মাঝেই দরজা খোলার শব্দ পেল।নূর মনে মনে খুশি হয়ে গেলো আদিত্য আসছে ভেবে।
দরজা খুলতেই নূরের মুখ থেকে হাসি উড়ে গেল। কারণ খাবার নিয়ে আদিত্য আসেনি। একজন বয়স্ক মহিলা খাবার নিয়ে এসেছে। নূরের মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।

মহিলাটি দরজা থেকে বললো।
….ভেতরে আসতে পারি ম্যাডাম?

নূর মাথা ঝাকিয়ে বললো।
…হ্যা আসুন।

মহিলাটি ভেতরে এসে বললো।
…ম্যাডাম আদিত্য বাবা খাবার পাঠিয়েছে খাবারটা খেয়ে নিন।

নূর বুঝতে পারলো এটা সেই মালি কাকার বউ। যার কথা আদিত্য বলেছিল। তারমানে সত্যি সত্যিই উনি আর আমার সামনে আসবেনা? নূর মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বললো।
…উনি কোথায়? মানে আপনার আদিত্য বাবা কোথায়?

মহিলাটি বললো।
….আদিত্য বাবাতো নিজের রুমেই আছে। আমি কি আপনাকে খাইয়ে দিব ম্যাডাম? আদিত্য বাবা বললো আপনি নাকি অসুস্থ তাই আপনাকে খাইয়ে দিতে হবে। তাই জিজ্ঞেস করলাম।

নূর মুচকি হেসে বললো।
….প্রথমেতো আমাকে ম্যাডাম বলা বন্ধ করুন। আমি আপনার মেয়ের মতোই। তাই আমাকে নাম ধরেই ডাকবেন। আমার নাম নূর। তাই আমাকে নূর বলে ডাকলেই খুশি হবো।

নূরের কথায় মহিলাটি খুশি হয়ে বললো।
….ঠিক আছে। তাহলে খাবারটা কি খাইয়ে দিব এখন?

নূর বললো।
…..না আমি খাবোনা। আপনার আদিত্য বাবাকে যেয়ে বলুন। উনি যেন আমাকে এসে খাইয়ে দিয়ে যায়। নাহলে আমি খাবনা।

মহিলাটি সব বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো। তারপর বললো।
…ঠিক আছে আমি বলছি।
কথাটি বলে মহিলাটি বেড়িয়ে গেলো।

নূর বাঁকা হেসে মনে মনে বললো।
….এবার কোথায় যাবেন? আমাকে খাওয়াতে হলে আপনাকে আসতেই হবে।

কিছুক্ষণ পর মহিলাটি আবার আসলো। নূরের সামনে এসে মুখ ছোট করে বললো।
….আদিত্য বাবা বলেছে সে আসবেনা। তোমাকে আমার কাছেই খেয়ে নিতে বলেছে।

নূর মনে মনে বললো। এবার উনি একটু বেশিই করছে। এতো কিসের রাগ হ্যাঁ? আমিও দেখে ছাড়বো কিভাবে আমার সামনে না আসে। এসব ভেবে নূর মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বললো।
……ঠিক আছে। তাহলে আমিও খাবোনা। উনাকে যেয়ে বলে দিন।

মহিলাটি এবার করুন সুরে বললো।
….না না এমন করোনা দয়া করে। খাবার টা খেয়ে নেও। নাহলে আমার আর তোমার মালি কাকার কারোরই চাকরি থাকবে না। তাই দয়া করে খাবার টা খেয়ে নেও।

এবার নূর বিপাকে পরে গেলো। ওর জন্য বেচারা গরীব লোকগুলোর চাকরি চলে যাক। এটা নূর কখনই চাইবে না। অগত্যা নূর হার মেনে মুখ গোমড়া করে খাবারটা খেয়ে নিল। তারপর ওষুধ খেয়ে শুয়ে পরলো।

নূর ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আজও আদিত্য নূরের রুমে এসে নূরকে প্রাণভরে দেখে আদর করে গেল।
—————————————

এভাবে দুই দিন কেটে গেল। এখন নূর প্রায় সুস্থ। এখন নিজে নিজেই চলাফেরা করে। খাবারও নিজেই খায়। এই দুই দিনে নূর অনেক চেষ্টা করেছে আদিত্যর কাছে যাওয়ার ওর সাথে কথা বলার। কিন্তু আদিত্য সবসময় নূরকে ইগনোর করে ওর কাছ থেকে সরে যায়। নূর মনে মনে অনেক কষ্টও পায় আদিত্যের এমন আচরণে। তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আজ আদিত্য অফিসে গেছে। ফিরতে নাকি রাত হবে। মালি কাকার বউয়ের কাছে বলে গেছে নূরের খেয়াল রাখতে।

নূর বসে বসে ভাবছে কি করা যায়। কিভাবে আদিত্যকে মানানো যায়। নূর ফোন বের করে তানির নাম্বারে কল দিল। আদিত্য কালই ওকে এই ফোনটা কিনে দিয়েছে।

তানি ফোন রিসিভ করে বললো।
….হ্যাঁ নূর বল।কেমন আছিস?

নূর মুখ গোমড়া করে বললো।
….ভালো নেই।

….কেন? কি হয়েছে? শরীর বেশি খারাপ করছে?

…..শরীর খারাপ না।মন খারাপ আমার।

….কেন? মনের আবার গ্যাস্টিক হলো নাকি?

….ধুরর মজা করিস নাতো।ভালো লাগছে না।

….আচ্ছা আচ্ছা সরি। বল কি হয়েছে?

নূর তানিকে সব খুলে বললো।
….এখন বল কি করবো আমি? উনিতো কিছুতেই মানছে না।

সবকিছু শুনে তানি বললো।
….শোন আমার কাছে একটা আইডিয়া আছে। একদম হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর এটা কাজ করবেই।

নূর একটু উৎসাহ নিয়ে বললো।
….সত্যিই কি প্ল্যান বলনা?

তানি নূরকে সব প্ল্যান বুঝিয়ে দিয়ে বললো।
….আজকেই প্ল্যানটা কাজে লাগিয়ে ফেল।দেখবি সব একদম ঠিক হয়ে যাবে।

নূর একটু লাজুক হেসে বললো।
….ঠিক আছে।

রাত ৭-৩০
আদিত্য মাত্রই অফিস থেকে ফিরেছে। দরজার লক খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলো। সারা বারি কেমন অন্ধকার হয়ে আছে। আদিত্য একটু ঘাবড়ে গেল। মনে মনে ভাবলো সারা বারি এমন অন্ধকার কেন? নূর কোথায় ওর কিছু হলো নাতো। এসব ভেবে আদিত্য জোরে জোরে নূরের নাম ধরে ডাকতে লাগলো।
হঠাৎ করে সব লাইট জ্বলে উঠলো। আদিত্য সামনে তাকাতেই থমকে গেল।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here