শুধু_তোমাকেই_চাই #শারমিন_হোসেন #পর্ব৩৩

0
560

#শুধু_তোমাকেই_চাই
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব৩৩

“পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে আলিফের বিএমডব্লিউ গাড়িটা শা শা শব্দে ছুটে চলছে।আলিফ একমনে ড্রাইভ করছে। তাসনিম জানালা দিয়ে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করছে।বাতাসে তাসনিমের খোলা চুলগুলো উড়ে এসে আলিফের মুখে পড়ছে। তাসনিম ক্লিপ দিয়ে চুলগুলো আটকাতে নিলে,আলিফ ইশারায় নিষেধ করে আবেগময় স্বরে বলে,,”এভাবেই থাক।খোলা চুলেই তোমাকে বেশি সুন্দর লাগছে।আর এই সুন্দর পরিবেশ টা আমি ইনজয় করছি।”

তাসনিম মিষ্টি হেসে ক্লিপ টা ব্যাগে রেখে দেয়।সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে আটটার দিকেই ওরা দুজনে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। প্রথমে ভার্সিটি যাবে।থিসিস জমা দিয়ে তারপর জামালপুর যাবে।এগারোটার আগেই ওরা ভার্সিটিতে পৌঁছে যায়।বাকৃবির মেইন গেইটের সামনে পার্কিং লনে গাড়ি পার্ক করে।আলিফ গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে দিতেই তাসনিম নামে।আলিফ কে উদ্দেশ্য করে তাসনিম বলে,,
“আপনি গাড়িতে ওয়েট করুন।আমি খুব দ্রুতই আসছি।”

আলিফ গাড়ির সাথে এক পা ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অমায়িক হেসে বলে,,”ওকে ম্যাম।ওকে সুইটহার্ট।”

ক্যাম্পাসে পা দিতেই পুরোনা স্মৃতি মনে পড়ে যায়। বন্ধুদের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো স্মৃতি পটে ভেসে উঠে।তবে সত্যি বলতে স্মৃতিচারণ হওয়া সত্ত্বেও আজকে আর জারিফকে নিয়ে কোনো কষ্ট অনুভব হচ্ছে না।জারিফকে বিশেষ করে মনেও পড়ছে না।আর তাসনিম চায়-ও না জারিফকে মনে করতে। তাসনিম ওর ভাবনার রাজ্যে আলিফকে নিয়েই ভাবতে চায়। প্রত্যেক টা মেয়ের কাছে স্বামী এক আলাদা অনুভূতি। হয়তো সম্পর্ক টা পবিত্র হওয়ার জন্যই স্বামী নামক মানুষ টা মেয়েদের কাছে স্পেশাল।যদি আবার সেই মানুষ টা হয় মানবীয় গুণাবলী সম্পন্ন একজন। সৎ চরিত্রবান,কেয়ারি এমন একজন স্বামী যেকোন মেয়েরই মন জয় করতে সক্ষম। তাসনিম মনে মনে আওড়ায়,উনি আমার শরীর ছোঁয়ার আগেই আমার মনটা ছুঁয়েছে।এমন একজন দায়িত্ব কর্তব্য জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ কে আমি নিরাশ করি কিকরে?উনার কাজ কর্ম,কেয়ার সব কিছু দিয়েই আমার মনে জায়গা করে নিয়েছে।

কিছুক্ষণ পর তাসনিম এসে দেখে আলিফ গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোন স্ক্রল করছে। তাসনিম আসতেই আলিফ ফোনটা পকেটে পুরে শান্ত কন্ঠে বলে,,”কমপ্লিট।”

তাসনিম ঘাড় নাড়িয়ে হ্যা সূচক উত্তর দেয়।আলিফ দরজা খুলে দেয়। তাসনিম গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় কেউ একজন পুরুষালী কন্ঠে হাঁক ছেড়ে ডেকে বলে,,”এই তাসনিম।”

ডাকটা শ্রবণ হওয়ার সাথে সাথেই তাসনিম ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেখে হাসি মুখে রোহান দাঁড়িয়ে।রোহান তাসনিম এর দিকে এগিয়ে আসে। তাসনিম ও একটু এগিয়ে যায়।আলিফ গেজ করে কোনো ফ্রেন্ড হবে তাই ওদেরকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে একটু দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ায়।

রোহান আনন্দিত কন্ঠে বলে,,”তা কি অবস্থা তোর?তোর তো কোনো খবরই নেই।”

তাসনিম ঠোঁটের কোণে হাঁসি নিয়ে বলে,,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।তোর কি অবস্থা?কেমন আছিস?”

“আছি আলহামদুলিল্লাহ ভালো।এই চলছে দিনকাল।কাজ সংসার সব নিয়ে বেশ পেশারেই আছি।আগের ফ্রি লাইফ টাকে মাঝে মাঝে মিস করি।”

তাসনিম ঠোঁট মেলে বলে,,”হুম।ঠিক বলেছিস।”

রোহান দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু ভেবে নিয়ে হতাশ স্বরে বলে,,”তা তোর বোনের কি খবর?আর এদিকে আমার শা’লা তো পুরাই দেবদাস হয়ে গিয়েছে।এখন শুধু হাতে বোতল উঠা আর সিগারেটে সুখটান দেওয়া বাকি আছে।”

রোহানের কথাটা শুনে তাসনিম এর হাসি পায়। তাসনিম ভাবে রোহান হয়তো মশকরা করে বলছে।এটা অবশ্য নতুন নয় কারন রোহানের মশকরা করার স্বভাব আছে। তাসনিম কে নিশ্চুপ দেখে রোহান ভ্রু নাচিয়ে আবার প্রশ্ন করে,,”তোর বোনের কি খবর?তার কি অবস্থা?”

তাসনিম ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলে,,”জানি না।আমার সাথে লিয়ার অনেকদিন দেখা হয়না।দিন বললে ভুল হবে।আজ তিনমাসের বেশি হবে ওর সাথে দেখা হয়নি।হাতে গোনা কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে।আর আমার বোনের খবর আমার থেকে তোর শা’লারই বেশি জানার কথা।তোর যদি এতই ইন্টারেস্ট থাকে।তাহলে তুই না হয় তোর শা’লার থেকেই শুনেনিস।”

রোহান কপাল কুঁচকে বলে,,”জারিফের সাথে আগের মতো কথা হয়না আমার।কথা বললেও মেপে মেপে বলি।যতই হোক আমার বউয়ের বড় ভাই ও।তাই ওর সাথে ফ্রিলি কথা বলিনা। বুঝতেই পারছিস লজ্জারও ব্যাপার স্যাপার আছে।”

রোহানের কথার মাঝেই তাসনিম ফোরন কে’টে বলে,,
“অবাক হলাম তোর কথা শুনে।তোর আবার লজ্জা আছে।তুই নাকি লজ্জা পাস এই কথা তোর মুখে শুনে আমি নিজেই লজ্জা পেলাম।”

রোহান দাঁতে দাঁত পিষে বলে,,”আমাকে নিয়ে তোকে আর লজ্জা পেতে হবে না।বাদ দে এসব।তা থিসিস জমা দিয়েছিস?জারিফেরও তো এই সপ্তাহেই আসার কথা।আজও তো আসলো না।”

“মাত্রই জমা দিয়ে আসলাম।আলিফকে দেখিয়ে তাসনিম বলে,চল পরিচয় করিয়ে দেই।”

আলিফের সাথে রোহান কে পরিচয় করিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ কুশলাদি বিনিময় করে,রোহানের থেকে বিদায় নিয়ে তাসনিম গাড়িতে ওঠে।গাড়িতে উঠে সিট বেল্ট বেঁধে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ক্যাম্পাসটা আরেকক নজর দেখে নেয়।

এক সপ্তাহ পর,,,
আজকে দুপুরে তাসনিম আসছে।এই এক সপ্তাহ জামালপুর বাবা মায়ের কাছে ছিলো।আলিফ সেদিন রাতটা থেকে পরেরদিন সকালেই ঢাকায় চলে আসছিলো।আবার কালকে রাতে আনতে গিয়েছিলো।একয়দিন আলিফকে ছাড়া থাকতে তাসনিম আলিফের শুণ্যতা অনুভব করেছে।বাড়িতে সবার সাথে সময় কাটালেও মাঝে মাঝেই আলিফকে মনে হতো।আর পাঁচ জন স্বামী স্ত্রীর মতো তাসনিম ওর আলিফের সম্পর্ক টা স্বাভাবিক করতে চায়।জাম কালারের একটা সুতি শাড়ি পড়েছে।চোখে চিকন করে কাজল দিয়েছে।ড্রেসি়ং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল চিরুনি করছিলো এমন সময় আলিফ আসে। তাসনিমকে একনজর দেখে নিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।একহাত দিয়ে শার্টের বোতাম খুলতে থাকে।আলিফের উপস্থিতি বুঝতে পেরে তাসনিম পিছন ঘুরে তাকিয়ে মিষ্টি হাসে।

আলিফ এক হাত বুকে দিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,,”মারডালা ইয়ার।”

তাসনিম সরু চোখে তাকিয়ে ভ্রু যুগল উঁচিয়ে ইশারায় বোঝায়,,”কি হয়েছে?”

আলিফ জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।দুইহাতে তাসনিম এর কোমড় জড়িয়ে ধরে দুজনের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে কানের পাশে মুখ নিয়ে সফট ভয়েজে বলে,,”তোমার মুখের টোল পড়া হাসি দেখলে আমি বেসামাল হয়ে যাই।তার উপরে আজকে কাজল চোখে তোমাকে খুব বেশিই আবেদনময়ী লাগছে।হাউ ক্যান আই কন্ট্রোল?”

তাসনিমের দুই কান উষ্ণ হতে থাকে। লজ্জা রাঙা মুখটা লুকাতে আলিফের বুকে মাথা রাখে।আলিফ মাথাটা নিচু করে তাসনিমের কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। তাসনিম শুকনো ঢোক গিলে নিয়ে।জড়ানো কন্ঠে বলে,,”ফ্রেশ হয়ে নিন।ডিনার করবেন।”

ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটার ঘর ছুঁই ছুঁই।ব্যালকনিতে রাখা ক্রেডেলে পাশাপাশি বসে তাসনিম আর আলিফ।আলিফের কাঁধের উপর মাথা দিয়ে আছে তাসনিম।আলিফ শান্ত গলায় বলে,,”যদিও আজকে পূর্ণিমা নয়।তারপরেও চাঁদ মামা কিন্তু কার্পণ্য করছে না,ধরণীর বুকে আলো দিতে।আমাদের স্পেশাল রাতটাকে বেশি আকর্ষণীয় করতে ধন্যবাদ চাঁদ মামা।

এক হাত দিয়ে তাসনিম কে জড়িয়ে নিয়ে স্লো ভয়েজে বলে,,”কোনো একদিন চাঁদনী রাতে তোমার ছবি দেখে যা বলেছিলাম আজ সেই চাঁদ কে সাক্ষী রেখে তোমার সামনে বলতে চাই।

তাসনিম মাথাটা তুলে আলিফের মুখশ্রীতে শান্ত চাহনিতে চেয়ে থাকে কথাটা শোনার জন্য বেশ উৎসুকভাবে।মুন ইজ দ্যা প্রিটি বাট মাই বেটার হাফ ইজ দ্যা প্রিটিয়েস্ট।লাভ ইউ সো মাচ সুইটহার্ট।স্বপ্নে নয়,তোমাকে বাস্তবে চেয়েছি।একদিনের জন্য নয়।তোমাকে সারাজীবনের জন্য চেয়েছি।হাজার জনকে নয়,তোমার মত কাউকে-ও নয়।আমার শুধু তোমাকেই চাই।মে আই।

তাসনিম আলিফের বুকের উপর মাথা রেখে নিশ্চুপ রয়।কিছু কিছু ক্ষেত্রে নীরাবতাই সম্মতির লক্ষণ।

দুই বছর পর,,,,,
এমন একটা সময় ছিলো যাকে ছাড়া এক মূহুর্তও থাকার কথা কল্পনাও করা যায়নি। অথচ পরিস্থিতির কারনে তাকে ছাড়াই জীবন কাটাতে হচ্ছে।অভ্যাস হয়ে গেলে সব কিছু শয়ে যায় ।যার সাথে কথা না বলে থাকাই যেতো না ।তাকে ছাড়াও বাঁচতে শিখে যায় মানুষ।তবে জীবন চলাটা অনেক কষ্টের আর কঠিন হয়।এই দুইবছরে সময়ের সাথে সাথে বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই।জারিফের বদলি হয়েছে।আজ প্রায় দুই মাস খানেক হবে জারিফ বগুড়া জেলা জজ আদালতে বদলি হয়ে আসছে।আর জারিফকে বিরক্ত করা কম্পিউটার অপারেটর রাইমার সেদিনের প্রায় এক মাস পরেই বদলি হয় অন্য জেলাতে।জারিফের রুটিন সারাদিন অফিসিয়াল কাজ নিয়ে নিজেকে বিজি রাখা। সন্ধ্যার পর অফিসার্স ক্লাবে গিয়ে আড্ডা দিয়ে সময় কাটানো।

তাসনিম আর আলিফের একটা ছেলে বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চার বয়স দশ মাস প্লাস। বাচ্চাটার নাম তাসনিধ শাহরিয়ার আসফি।নিক নেইম আসফি। প্রেগন্যান্সির সাত মাস চলাকালীন সময়েই জন্ম হয় আসফির।আসফিকে জন্ম দিতে গিয়ে অতিরিক্ত র’ক্তক্ষরণ হয়ে খুবই ক্রিটিক্যাল অবস্থা হয়েছিলো তাসনিমের। তাসনিম এর ব্লাড গ্রুপ ও-পজটিভ লিয়ার সাথে মিল থাকায় লিয়া ব্লাড ডোনেট করেছিলো।

প্রকৃতিতে ঋতুরাজ বসন্ত চলছে। প্রেমময় ফাগুন শেষ হয়ে চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহ চলছে। মিষ্টি সুরে কুহু কুহু কলরব ভেসে আসছে কলেজ প্রাঙ্গণের কোনো গাছে বসা কোকিলের থেকে।লিয়াদের কলেজে আজ র্যাগ ডে।লিয়া এবার থার্ড ইয়ারে উঠবে। কয়েকদিন আগেই সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল এক্সাম শেষ হয়েছে।অফ হোয়াইট কালারের থ্রি পিস পড়েছে লিয়া।লিয়া গাড়ি থেকে নেমে গেইটের কাছে যেতেই ওর ফ্রেন্ড রিভি কে দেখতে পায়।বেচারী হয়ত লিয়ার জন্য ওয়েট করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে।লিয়া কাছে যেতেই রিভি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলে,,

“এই লিয়ু এতো লেইট করে আসলি কেনো শুনি?”

লিয়া ভাবলেশহীন ভাবে বলে,,”এমনি।একবার তো আসতেই ইচ্ছে হচ্ছিলো না।তুই ফোন করলি তাই না এসে পারলাম না।আর তোকে কতবার বলবো শুনি।”

রিভি ভ্রু কুঁচকে বলে,,”কি?”

লিয়া দাঁতে দাঁত পিষে বলে,,”হোয়াট লিয়ু?লিয়ু কি শুনি?আমার এত সুন্দর নামটাকে এভাবে বিকৃতি করতে আমি তোকে কতবার নিষেধ করেছি। তারপরেও তুই এটা বলেই চলছিস, আশ্চর্য।”

রিভি দাঁত কেলিয়ে বলে,,”আমার না শর্টকাটে বলতে ভালো লাগে।তাই আমি লিয়ু বলি।”

কথাটা শুনে লিয়া অবাকের সুরে বলে,,”ডোন্ট কল মি লিয়ু।উ বাদ দিয়ে আ বললেই তো হয়।আর আমার নাম এমনিতেই ছোট আছে।একে আরো ছোটো করা মানে আমার নামটাকে নেই করা।”

রিভির হাতে থাকা একটা ক্যাপ লিয়ার মাথায় দিয়ে দেয়।অন্য একটা নিজে পড়ে নেয়।লিয়াকে তাড়া দিয়ে ভেতরে নিয়ে যায়।রিভির হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে আর এক সেকেন্ড এখানে ওয়েস্ট করলে পুরো অনুষ্ঠানটাই বোধহয় মিস হয়ে যাবে।

জারিফ অফিসে যেতেই অফিস সহকারী এসে জারিফকে বলে,,স্যার শাহ্ সুলতান কলেজ থেকে আপনাকে ইনভাইট চিঠি দিয়েছিলো।আজকে তো প্রোগ্রাম।”

জারিফ একটা ফাইলে সিগনেচার করতে করতে বলে,,
“মনে আছে।এইতো এখন যাবো।”

অনুষ্ঠান শুরুর পাঁচ মিনিট আগেই জারিফ উপস্থিত হয়। স্টেজের নিচে,সামনের সারিতে আমন্ত্রিত অতিথিদের বসার জন্য সিলেক্ট করা হয়েছে।জারিফ এডিসি স্যারের সাথেই যায়।জারিফ আর এডিসি স্যার পাশাপাশি চেয়ারে বসে। প্রথমে কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।লিয়া,রিভি আরো কয়েকটা মেয়ে একসাথে নিচে স্টেজে উঠার একসাইডে দাঁড়িয়ে আছে।রিভি গান পরিবেশন করবে।লিয়াকে ওর পাশে দাঁড় করিয়ে রেখেছে ওকে মানসিকভাবে সাহস যোগানোর জন্য।লিয়া দুই হাত কোমড়ে দিয়ে উল্টো দিক ঘুরে রয়েছে।লিয়ার পেইন হচ্ছে।পিরিয়ড়ের পূর্ব লক্ষণ।লিয়াকে উল্টো দিকে থাকতে দেখে রিভি বলে,,
“এই তোর কি হয়েছে?”

লিয়া ইশারায় রিভিকে কিছু বোঝায়।রিভি বিষয়টা বুঝতে পেরে ঠোঁট উল্টে বলে,,”এখন কি করবি?”

ব্যাথায় কপাল কুঁচকে নিয়ে ছোট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু কন্ঠে বলে,,”আমাকে ইমার্জেন্সি বাসায় যেতে হবে।”

ডান সাইডে তাকাতেই জারিফের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় কয়েকটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার মধ্যেকার অফ হোয়াইট কালারের থ্রি পিস পড়া মেয়েটার দিকে।মেয়েটার মাথায় ক্যাপ। অবশ্য প্রায় সবারই মাথায় ক্যাপ।মেয়েটা উল্টো দিকে আছে।পেছনের অবয়ব দেখে জারিফের লিয়ার কথা মনে হচ্ছে।না চাইতেও বারবার জারিফের দৃষ্টি ঐ জায়গাতেই যাচ্ছে।মেয়েটির খোলা চুলগুলো লিয়ার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।জারিফ এক নজর মেয়েটির মুখ দেওয়ার জন্য মনে মনে ছটফট করতে থাকে।জারিফ মনে মনে প্রে করছে।মেয়েটা যেনো একবার এদিকে ঘুরে তাকায়।জারিফের মন বলছে পিছন হতে দেখে মনে হচ্ছে,সেইম লিয়া।পরক্ষণে মস্তিষ্ক বলে,মেয়েটা তো এখানকার স্টুডেন্ট সেটা তো শিয়র।আর লিয়া তো খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট।ওর তো ইচ্ছে ছিলো,মেডিকেলে পড়ার।আর আমি নিজেও জানি লিয়া ওর মেধা দিয়ে যেকোনো ভার্সিটিতে চান্স পাবে। লিয়ার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স করার প্রশ্নই আসে না।

এতকিছু ভাবার পরও জারিফের মনটা চাইছে মেয়েটার ফেসটা এক নজর দেখতে।জারিফ মনে মনে বলে,পাশে এডিসি স্যার আছেন।আর ঐদিকে তো মেয়েরা আছে।বারবার দৃষ্টি দিলে সবাই আমাকে তো ক্যারেকটারলেস ভাববে।

পেইন টা বাড়তে থাকায় লিয়া অবশেষে চলে যেতে বাধ্য হয়। কিয়ৎক্ষন পরে ঐদিকে দৃষ্টি দিয়ে কাংখিত মেয়েটাকে না দেখতে পেয়ে জারিফের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করে।

বিকেলে লিয়ার ছোট চাচ্চু মইনুল খাঁন আসেন।লিয়াদের বাসায়। আজকে সোমবার সামনের শুক্রবার ওনার বিয়ে।বিয়ের প্রোগ্রামের ব্যাপারে লিয়ার আব্বুর সাথে কথা বলতে আসেন।উনি বগুড়াতেই চাকরি করেন।লিয়া রুমে শুয়ে ছিলো এমন সময় রাহবার ডেকে বলে ,”ছোটো চাচ্চু আসছে।তোকে ডাকছে।”

লিয়া ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে রুম থেকে বের হয়। মঈনুল খাঁন সোফায় বসে টিভি দেখছিলেন।লিয়া গিয়ে সালাম দিয়ে বলে,,
“চাচ্চু কেমন আছো?ছোট চাচিমা কেমন আছে?”

মঈনুল খাঁন জবাবে বলেন,,”আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি ‌।তবে তোমার চাচিমার কথা বলতে পারলাম না।কারন তুমি আমি একই যায়গায় আছি। আমার নিশ্চয় জানার কথা নয় তার খবর।”

লিয়া সোফায় বসে কপাল কুঁচকে বলে,,”হুম।তা অবশ্য ঠিক বলেছো।তোমার জানার কথা নয়।তবে তোমার ফোনটা চেক করলে কললিস্ট বলে দিবে সব।”

“আমার ছোট আম্মু তো দেখছি খুব ইনটিলিজেন্ট এন্ড ক্লেভার ।”

লিয়া ভাব নিয়ে বলে,,”আই নো।আ’ম ইনটিলিজেন্ট।”

“তা ছোটো আম্মু ছেলের বিয়ে তোমার কত শত দায়িত্ব।এখানে বসে থাকলেই হবে।বাড়িতে গিয়ে কাজ করতে হবে না।”

লিয়া মলিন হেসে বলে,,”সে আর বলতে।দুই একদিনের মধ্যেই বাড়ি যাবো।”

লিয়ার ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে যে কারোরই মায়া হবে।আগের লিয়ার সাথে এই লিয়ার অনেক তফাৎ।চেহারার মধ্যে আগের মতো উজ্জ্বলতা নেই।আগের ক্লিন ফেসে এখন লালচে লালচে কয়েকটা বর্ণ যায়গা করে নিয়েছে।লিয়াকে দেখলেই ওর কাছের মানুষ গুলো বলতে বাধ্য হবে,বাইরেরটা পরিপাটি থাকলেও ভিতরটা ক্ষয়।আর সবার সামনে ভালো থাকার অভিনয়।লিয়ার ম্লান মুখশ্রীতে চেয়ে মঈনুল খাঁন এর কষ্ট অনুভব হয়।আরো কিছু সময় কথা বার্তা বলে লিয়া ওর রুমে চলে যায়।

এনামুল খাঁন এর সাথে বিভিন্ন কথা বার্তা শলা পরামর্শ করে অবশেষে মঈনুল খাঁন ম্লান গলায় বলেন,,
“ভাই তোমাকে একটা কথা বলি।মেয়েটাকে দেখলে খুব খা’রাপ লাগে।আগের মতো চঞ্চলতা নেই।মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে রাখে।সবার সামনে নিজের কষ্ট প্রকাশ করে না।অথচ ভিতরে ভিতরে মেয়েটা অনেক কষ্ট পুষে রেখেছে।তাই বলছি কী তুমি অভ্র টভ্র এসবের চিন্তা মাথা থেকে বাদ দেও।”

অভ্রর পরিবারের সাথে লিয়ার বাবার এখনো যোগাযোগ আছে।এই দুই বছরে অভ্র দুই থেকে তিনবার লিয়াদের বাসায় আসছিলো।লিয়ার বাবা নিজেই বলে দিয়েছেন, লিয়া যখন রাজি হবে তখনই বিয়ে দিবেন।এছাড়া নয়। অভ্র ও বলেছে,সমস্যা নেই আমি ওয়েট করবো।আর লিয়ার অমতে বিয়েটা আমি নিজেও করতে চাইনা।লিয়া মত দিলেই হবে,এছাড়া নয়।এদিকে লিয়া পণ করে আছে,সে কিছুতেই বিয়ে করবে না।

এনামুল খাঁন হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কন্ঠে বলেন,,”সত্যি বলতে আমার নিজেরও খুব খা’রাপ লাগছে।মেয়েটার মুখের দিকে আমি তাকাতে পারি না।আমার জিদের জন্য আমার একমাত্র মেয়েটার আজ এই হাল হয়েছে।আমার একটা মাত্র।আমার যা কিছু আছে সব আমার ছেলে মেয়ের জন্যই তো।এখন আমার মেয়ের মুখে যদি হাসি না থাকে।তাহলে আমার অর্থ সম্পদ দিয়ে কি হবে?”

কিয়ৎক্ষন থেমে আবার বলেন,,”তবে কোথায় সেই ছেলেটা।তার তো আর কোনো খোঁজখবর-ই পেলাম না।কই একবারো তো আসলো না।আর এদিকে আমার মেয়েটা এখনো করুণ জীবন যাপন করছে।”

“ভাই আমরা আমাদের মেয়েকে দেখছি।তাই মেয়ের খবরটা জানি।ছেলেটার কি হয়েছে বা কেমন অবস্থায় আছে সেটা তো না দেখেই বলতে পারিনা। কি বলো?”

এনামুল দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন,,”জানিনা।তবে আমি ভাবছিলাম অভ্রর সাথে বিয়েটা হলে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই রাজি হয় না।আর আমি ওকে জোর করতেও চাচ্ছি না।”

আরো বিভিন্ন কথা বার্তা শেষে নাস্তা করে মঈনুল খাঁন ওনার বাসায় চলে যান।উনি বগুড়া শহরে ভাড়া বাসায় থাকেন।মাঝে মাঝেই ক্যান্টনমেন্ট এসে দেখা করে যান।

সন্ধ্যার পর জারিফ অফিসার্স ক্লাবে যায়।জারিফ আরো কয়েকজন অফিসার মিলে টেবিল টেনিস খেলছিলো।এতদিনের পুরানো কষ্ট টা যেনো আজ আরো বেশি করে জারিফের বুকে হতে থাকে।সকালে প্রোগ্রামের ঐ মেয়েটাকে দেখার পর থেকে বারবার লিয়ার কথা মনে হতে থাকে।কোনো কিছুতেই ভালো লাগছে না জারিফের।জারিফকে অন্যমনস্ক দেখে একজন তো বলে ফেললো,,”জারিফ সাহেব আপনি ঠিক আছেন?আপনাকে কেমন জানি লাগছে। অসুস্থ নাকি?”

“নো।আ’ম গুড।”

জারিফের কথার মাঝেই একজন বলে উঠে,,”আরে এসি ল্যান্ড সাহেব যে।আজ এতো দেরি করে আসলেন।”

কয়েকটা ইনভাইটেশন কার্ড হাতে লোকটা এগিয়ে এসে সবার উদ্দেশ্যে বলেন,,”কাজে বিজি ছিলাম।আর আপনাদের কে তো জানানোই হয়নি।আমার বিয়ে ফ্রাইডে।আপনাদের সবাইকেই আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনারা বিয়ের দিন সহ রিসেপশন পর্যন্ত থাকবেন কিন্তু।সবাই অবশ্যই যাবেন।”

কথাটা বলে একে একে উপস্থিত সবাইকে কার্ড দেয়।কেউ কেউ বলে নিশ্চয়।জারিফকে চুপ থাকতে দেখে লোকটা জারিফকে বলে,,”জারিফ সাহেব কিছু বলছেন না যে। অবশ্যই যাবেন।আমাদের শহরটা দেখার জন্য হলেও না হয় যাবেন।”

জারিফ হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে,,”ওকে। ট্রাই করবো।”

আরেকজন বলেন,,”মঈনুল সাহেব আপনার বাসা যেনো কোন জেলায়?”

“জামালপুর।”

জামালপুর কথাটা শুনে জারিফের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।জারিফ মনে মনে আওড়ায়,,কেনো জানি আজকে সব কিছুতেই শুধু তুমি জড়িয়ে যাচ্ছো।যতই চাচ্ছি তোমাকে ভুলে থাকতে ততই পরিস্থিতি তোমায় মনে করিয়ে দিচ্ছে।আমার নিজেকে খুব অসহায় লাগছে।যদিও সব সময় নিজেকে আমার হেল্পলেস-ই মনে হয়।তবে আজকে বড্ড ক্লান্ত লাগছে।আমি খুবই ট্রায়ার্ড।

মঈনুল খাঁন গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন,,”সবাই আসবেন কিন্তু।আপনাদের সবার দোয়া প্রার্থী আমার নতুন জীবনের জন্য।”

এক জন গলা ঝেড়ে বলতে থাকেন,,”তা জারিফ সাহেব বিয়ে করবেন কবে? আপনার বিয়ের দাওয়াত খেতে চাই।আর শুনেছি আপনাদের জেলা খুবই মনোমুগ্ধকর তাই দেখার খুবই ইচ্ছে আছে। আপনার বিয়ের উসিলায় যদি সেই আশা পূরণ হতো।”

জারিফ ছোট করে হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু আওয়াজে বলে,,”আমার বিয়ে হয়েছে তো।”

কথাটা শুনে সবাই চকিতে জারিফের দিকে তাকায়। সবারই চোখে মুখে বিস্ময় খেলে যায়। বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে সবারই একটা প্রশ্ন “রিয়েলি?”

জারিফ মলিন হেসে শান্ত স্বরে বলে,,”স্বপ্নে আমি আমার বিয়ে দেখেছিলাম।বাসর সাজানোর আগেই আমার স্বপ্নের কবুল না বলা বউটা হারিয়ে যায়।আমি আজও তাকে মন থেকে চাই।তাকে পাওয়া হয়তো সম্ভব নয়। তারপরেও আমি আজও তাকে সামনে পেলে চিৎকার করে সারা পৃথিবীকে জানিয়ে বলতে চাই, আমি #শুধু_তোমাকেই_চাই।”

জারিফের আবেগময় কথা শুনে একটা আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।বিষয়টা কেউ কেউ আন্দাজ করতে পারে।একজন মুখ ফস্কে বলে ফেলে,,”এক্স কে ভুলে যাওয়া কঠিন।তবে আমার মনে হয় ভুলে যাওয়াটাই বেটার।”

কথাটা কর্ণপাত হতেই জারিফ দৃঢ় কন্ঠে বলে,,”তাকে পায়নি তার মানে এই নয়,সে আমার এক্স।সে তো আমার না পাওয়া এক পবিত্র ভালোবাসা।”

বিয়ে বাড়ি হৈ হুল্লোড় অতিথিতে ভরপুর।লিয়ারা ওর দাদু বাড়িতে গিয়েছে। তাসনিম আলিফ আসছে। সন্ধ্যায় লিভিং রুমের সোফায় জান্নাত বেগম বসে আছেন । একপাশে লিয়া বসে খাতা কলম হাতে। জান্নাত বেগম বলছেন লিয়া লিস্ট করছে। তাসনিম আসফিকে কোলে করে এনে সোফায় বসে পড়ে। জান্নাত বেগম লিয়াকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর গলায় বলেন,,”তুলিরও তো বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। তাসনিম ঘর সংসার করছে । তাই বলছি কি লিয়া ,তোর সেই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব কে ভুলে নতুন করে শুরু করা যায়না। অভ্র ছেলেটাও তো তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে।সব ভুলে অভ্র কে মেনে নেওয়া যায়না?”

কোনো দ্বিধা ছাড়াই সোজাসুজি স্পষ্টভাবে দৃঢ় কন্ঠে লিয়া বলে,,”ইম্পসিবল।কখনোই সম্ভব নয়।স্যারের জায়গাটা কাউকে দিতে পারবো না।আমার শুধু স্যার নামক শব্দটি কেই চাই।কোনো সমার্থক শব্দ দিয়েও হবে না।স্যারের জায়গাটা কোনোদিন কেউ রিপ্লেস করতে পারবে না।উনি কি করেছেন , না করেছেন আমি সেটা জানিনা। তবে আমি এজীবনে অন্য কাউকে গ্রহণ করতে পারবো না।”

জান্নাত বেগম হতাশ হয়ে নিশ্চুপ রয়। তাসনিম কপাল কুঁচকে ভাবে,জারিফ আর লিয়ার মধ্যে হয়েছিলো কি?লিয়াকে অনেক বার প্রশ্ন করেছি। কিন্তু লিয়া কিছুই বলেনি। প্রতিবারই প্রশ্ন টা এড়িয়ে গিয়েছে, স্ট্রেইন্জ। তাসনিম এর ভাবনার মাঝেই আসফি কান্না শুরু করে দেয়। তাসনিম কোলে নিয়ে উঠে হাঁটতে থাকে।

বিয়ের আয়োজন কমিউনিটি সেন্টারে করা হয়েছে। খাঁন বাড়ি থেকে বেশ কয়েকটা গাড়ি করে কমিউনিটি সেন্টারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে।আলিফ ড্রাইভ করছে তাসনিম আসফিকে কোলে নিয়ে সামনে বসেছে। পিছনে লিয়া,তুলি আর রাহবার।লিয়ার আম্মুরা অন্য গাড়িতে।

কনে পক্ষের লোকেরা আগে থেকেই উপস্থিত ছিলো।বর কনে কে স্টেজে বসানো হয়। স্টেজের চারপাশে ভিড় থাকায় তাসনিম ওর ছেলেকে নিয়ে একটু দূরে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ায়।লিয়া গিয়ে কনের সাথে খোশগল্প করতে থাকে।কনে মাস্টার্স পড়ছে।লিয়া কনে কে উদ্দেশ্য করে বলে,,”ছোটো চাচিমা আমি কিন্তু তোমার ছোট শ্বাশুড়ি।”

বিয়ের কনে মিষ্টি করে বলে,,”আমি জানি ছোটো শাশুড়ি আম্মা।”

উপস্থিত সবাই হা হা শব্দ করে হেসে ফেলে।আরো কিছু কথা বার্তা বলে লিয়া স্টেজ ছেড়ে নেমে একটু ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়।লিয়ার দৃষ্টি যায় আলিফ আসফি কে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।পাশে হাসি মুখে তাসনিম বিভিন্ন কথা বলছে।আবার একটা চেয়ারে তুলি বসে ফোনে চ্যাট করছে।এসব দেখে লিয়া দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ভাবে,আজ যদি সব কিছু ঠিক থাকতো।তাহলে আমারও একটা সংসার হতো।কতটা সুখের হতো জানি না।তবে আর পাঁচ জনের মতো একটু স্বাভাবিক লাইফ পেতাম।

জারিফ আর বাকি চার-পাঁচ জন একসাথে মাইক্রোতে করে জামালপুর আসে বিয়ের দাওয়াত খেতে।জারিফের তেমন ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু সবার সাথে মিশতে গেলে কিছু ফর্মালিটিজ মেইনটেইন করতে হয়।জারিফ কফি কালারের শার্ট অফ হোয়াইট কালারের প্যান্ট ইন করে পড়া।পায়ে ব্ল্যাক কালারের সু।গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই একজন জারিফকে ইশারা করে বলে,,”ভেতরে চলুন।”

জারিফ ইশারায় হ্যা সূচক বলে। এরমধ্যে জারিফের ফোন বেজে উঠে।ফোনের ওপাশ থেকে জারা বলে,,

“ভাইয়া তুই কখন আসছিস?”

জারিফ আগে থেকেই ভেবে আসছে।আজকে এখান থেকে সোজা ময়মনসিংহ যাবে। অনেকদিন বাড়িতে যাওয়া হয়না।যদিও কালকে বউ ভাতের দাওয়াত ও আছে। কিন্তু জারিফ আর বউ ভাতে আসবে না।বিয়েতে আসছে বউ ভাতে না আসলে,সেটা কোনো ব্যাপার নয়।তাই বাড়িতে বলে রেখেছিলো আজকে আসতে পারে। সেইজন্য সকাল থেকে বাড়ি থেকে না হলে চারবার ফোন করে এই প্রশ্ন করা হয়েছে অলরেডি।

“আমি মাত্রই বিয়ের প্রোগ্রামে উপস্থিত হয়েছি।আমার বাসায় যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না রাত হলেও যাবো।”

মঈনুল খাঁন কলিগ সহ ক্লাবের অফিসারদের সাথে নতুন বউয়ের পরিচয় করিয়ে দেন।অন্য সবাই হাসি তামাশা করে এটা সেটা বলছিলো।জারিফের কেমন জানি আনইজি ফিল হচ্ছিলো ।তাই ওখান থেকে চলে এসে বড় ব্যালকনির মতো ফাঁকা স্পেসে এসে দাঁড়িয়ে ফোন স্ক্রল করে টাইম স্পেন্ট করতে থাকে।

লিয়া আরিয়ানের হাত ধরে হাটছিলো।এদিক টায় একটু ফাঁকা ছিলো। আরিয়ানের বয়স পাঁচ বছর সামথিং হবে।আরিয়ানের হাতে একটা পিংক বেলুন ছিলো।হাত থেকে বেলুন টা পড়ে যেতেই।বাতাসে দূরে যেতে থাকে।আরিয়ান কপাল কুঁচকে বলে,,
“আপু আমার বেলুন।”

লিয়া মিষ্টি হেসে বলে,,”তুমি এখানে দাঁড়াও আমি এনে দিচ্ছি।”

আরিয়ান ঘাড় নাড়িয়ে খুশি হয়ে হ্যা বলে।বেলুন টা বাতাসে উড়তে উড়তে ফাঁকা স্পেসে গিয়ে এক মানবের জুতার সাথে লেগে থেমে যায়।ওয়েটলেস বস্তু হওয়ায় মানবটা কিছু বুঝতে পারেনি। দুই হাত পকেটে গুঁজে কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে দৃষ্টি ছিলো বাইরে।লিয়া এক পা দু পা করে এগিয়ে যায়।গিয়ে দেখে লম্বা চওড়া একজন মানব। রাস্তার মুখি দৃষ্টি দিয়ে স্ট্রেইট দাঁড়িয়ে আছে।তার পায়ের সামনে বেলুনটা।লিয়া নিঃশব্দে গিয়ে কিছুটা ঝুঁকে বেলুনটা তোলে।এক হাতে বেলুনটা নিয়ে সোজা হতে গিয়ে চুলে টান পড়ে।চুলে টান পড়াতে ব্যাথায় মৃদু আওয়াজে “আহ্” শব্দ উচ্চারণ করে।

লিয়া মনে মনে ভাবে লোকটা চুলে হাত দিয়েছে নিশ্চয়।লিয়া মুখ তুলে তাকিয়ে কড়া করে কিছু বলতে যাবে।আর জারিফ কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই লিয়াকে দেখে আস্টোনিস্ট হয়।লিয়াও জারিফকে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়।মুখের ভাষা গুলো হারিয়ে যায়।কিছু সময় দু’জনে নির্বাক বিষ্ময়কর চাহনিতে চেয়ে থাকে।

জারিফ আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলে,,”লিয়া তুমি।”

লিয়া নিজেকে তটস্থ করে শক্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায়।লিয়ার মনের ভেতর ভালোলাগার অনুভূতি হচ্ছে।এতদিন পরে যেনো দুচোখ শান্তি খুঁজে পায়।সেই ফোন কলের কথা মনে হতেই সব ভালোলাগা উড়ে যেতে থাকে।লিয়া দ্রুত প্রস্থান করতে নেয়। পূর্বের ন্যায় আবার চুলে টান পড়ে।লিয়া জারিফের দিকে হয়ে কঠোরভাবে বলে,,”কোন সাহসে আপনি আমার চুলে হাত দিয়েছ

কথাটা শেষ করার আগেই লিয়া দেখতে পায়।কয়েকটা চুল জারিফের রিচ ওয়াচের সাথে আটকে আছে।এটা দেখে লিয়া আর কোনো বাক্য ব্যয় না করে এক হাত দিয়ে চুলগুলো ছড়াতে থাকে। আচমকা জারিফ এক হাত দিয়ে লিয়ার হাতটা ধরে।লিয়া চুলগুলো ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলে,,”হাত ছাড়ুন।হাতটা ছাড়ুন বলছি।”

কথাটা জারিফের কর্ণগোচর হয়েছে কিনা বুঝা মুশকিল।কারন জারিফ অবাক হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে লিয়ার ফেসের দিকে।লিয়া এক হাত দিয়ে জারিফের হাত থেকে অন্য হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যেতে বসে।জারিফ লিয়ার হাত শক্ত করে ধরে টান দিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।লিয়া কিছু বলার আগেই জারিফ বলতে থাকে,,”আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।লিয়া তুমি আমার সামনে। আমার মনে হচ্ছে এটা হয়তো আমার স্বপ্ন। স্বপ্ন টা ভেঙ্গে গেলে তুমিও চলে যাবে।”

লিয়া হাতটা ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে থাকে আর দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,”নাটক বন্ধ করুন।অনেক হয়েছে আর নয়।”

“তোমাকে ছাড়া আমি একদম ভালো নেই লিয়া।তুমি ছাড়া আমি শুণ্য কোনো মূল্য নেই আমার।তোমার একবারো আমার কথা মনে হয়নি।তুমি ছাড়া আমার কি অবস্থা হতে পারে।”

“আপনার মনে হয়েছে বা হয়েছিলো কখনো।আমার কি হতে পারে।আমি আমার মতো ভালো আছি।তাই নতুন করে কোনো নাটক না করার অনুরোধ রইল।”

লিয়ার কথা শুনে জারিফ অবাকের চরম সীমায় পৌছে যায়। জারিফ আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলে,,”হোয়াট লিয়া?এসব তুমি কি বলতে চাচ্ছো?”

এমন সময় রাহবার এসে বলে,,”আপু তুই এখানে। অভ্র ভাইয়া তোকে খুঁজছে।”

অভ্র নামটা শুনে জারিফের মনের আকাশ টা বিষাদে ছেয়ে যায়।জারিফ ভাবে, অভ্র ডাকছে। তারমানে অভ্র ই লিয়ার হ্যাজবেন্ড।এটা মনে হতেই জারিফের হাতটা আলগা হয়ে যায়।লিয়া হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে ধীরে ধীরে জারিফের হাতটা সরে যাচ্ছে।লিয়ার মনটা চাইছে।জারিফ ধরে রাখুক হাতটা। কখনো যেনো ছেড়ে না দেয়।আবার মস্তিষ্ক বলছে উনি তো চিট করেছে আমার সাথে।তবে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না স্যারের চোখ বলছে,আর যাইহোক স্যার কখনো আমার সাথে চিট করতে পারে না।

রাহবার জারিফকে দেখে সালাম দিয়ে বলে,,”স্যার আপনি।”

লিয়া আর দেরি না করে দ্রুত ওখান থেকে প্রস্থান করে। জারিফ মনে মনে আওড়ায়,তোমাকে ধরে রাখার কোনো অধিকার আমার নেই আর।

লিয়া ওর আম্মুর কাছে এসে বলে,,”আম্মু আমার ভালো লাগছে না।আমি বাসায় যাবো।”

রাজিয়া সুলতানা চিন্তিত হয়ে শুধায়,,”কি হয়েছে?শরীর খা’রাপ লাগছে?”

“তেমন কিছু নয়।আমার এত ভিড় ভালো লাগছে না।আমি একা থাকতে চাই।”

রাজিয়া সুলতানা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন,,”আচ্ছা ঠিক আছে।চল আমিও যাচ্ছি।”

“এখনো বিয়ে হয়নি।এই সময় তুমি চলে গেলে চাচ্চু কি ভাববে।আর আমার জন্য তুমি বাসায় চলে গেলে আমার নিজেরই খা’রাপ লাগবে।”

রাজিয়া সুলতানা কে অনেক করে বোঝানোর পর রাজি হয় লিয়াকে যেতে দিতে ‌।তবে উনি তুষারকে বলেন পৌঁছে দিতে।তুষারের সাথে বাইরে যেতে থাকে লিয়া।

জারিফের প্রচন্ড কষ্ট অনুভব হওয়ায় ও সিদ্ধান্ত নেয় এখনই বাসায় চলে যাবে।এখানে থাকলে দম বন্ধ হয়ে যাবে।এইভেবে জারিফ রাস্তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।এক হাত পকেটে গুঁজে অন্য হাতে চুলগুলো মুঠো করে ধরে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।এমন সময় দেখতে পায় লিয়াকে।লিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।লিয়া গাড়িতে উঠতে যাবে সেই সময় লিয়ার পায়ের দিকে জারিফের নজর যায়।লিয়ার পায়ে জারিফের দেওয়া পায়েল আজও আছে।এটা দেখে জারিফ আশ্চর্য হয়। তারমানে লিয়া আজও আমাকে ভুলতে পারেনি।

এরমধ্যেই কেউ একজন পুরুষালী গম্ভীর গলায় হাঁক ছেড়ে বলে,,হেই মিস লিয়া।”

লিয়া অভ্র কে দেখে বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।। অভ্র লিয়ার কাছে গিয়ে বলে,,”শুনলাম আপনার শরীর খা’রাপ।বাসায় চলে যাচ্ছেন।তা সিরিয়াস হলে আমার সাথে চেক আপ করতে ডক্টর এর কাছে যেতে পারেন।”

লিয়া ঠোঁট মেলে বলে,,”নো থ্যাংকস। মিস্টার অভ্র।আমি ঠিক আছি।”

“ওকে ফাইন।”

লিয়া গাড়িতে উঠে ডোর লক করে দেয়। অভ্র গলা ছেড়ে বলতে থাকে,,মিস লিয়া আপনাকে খুব বিষন্ন দেখাচ্ছে।টেক কেয়ার,বাই।”

অভ্রর আর লিয়ার কথাগুলো সব জারিফ শুনতে পায়। কথাগুলো জারিফের নিউরনে পৌঁছানো মাত্রই একরাশ ভালো লাগার অনুভূতি হয় মনে।জারিফ ঠোঁট নেড়ে রিপিট করে,,মিস লিয়া।তারমানে লিয়া আনম্যারিড।জারিফ মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ দেয় অভ্র কে শেষ মুহূর্তে এসে জারিফের ভুল ভাঙানোর জন্য।জারিফ উপরের দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বিড়বিড় করে বলে,,মিস লিয়া।রেডি থেকো।কালকে দেখা হচ্ছে জান।

[চলবে…ইন শা আল্লাহ]

(আজকের পর্বে যেই পর্যন্ত আসছি।এই পর্যন্ত আসার জন্য আমার আরো একটা পর্বের দরকার ছিলো। পাঠকদের জন্য কিছু শর্টকাট করে দ্রুত এই পর্যন্ত আসা।আর গল্প কে গল্প হিসেবে নেওয়ার অনুরোধ রইলো । ধন্যবাদ সবাইকে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here