#মায়াবিনী_(২)
#Ayrah_Rahman
#পর্ব_৪১
______________
” কেমন আছো ফুল? ”
অপরিচিত কারো কন্ঠ শুনতে পেয়ে চকিত নজরে কেবিনের দরজার দিকে তাকালো মেয়েটা। চোখে মুখে উৎকন্ঠা তার। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সে আরুহীর মুখের দিকে। আরুহী মুচকি হেসে পকেটে হাত গুঁজে ভেতরে প্রবেশ করলো।
পুরো ওয়ার্ড জুড়ে নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে, নিরাপত্তার কোন ক্রুটি রাখে নি আরুহী। এখনো মেইন কালপ্রিট ধরা পড়েনি, এটাই ভাববার বিষয়। বেশ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি লোকটার, কোন ভাবেই কোন ক্লু সে রাখছে না। পাক্কা খেলোয়াড়!
কেবিনের মধ্যে দুজন নার্স রয়েছে। আরুহী মুচকি হেসে মেয়েটার কাছে গিয়ে দাড়ালো,
” কি হলো বললে না তো আগের থেকে বেটার ফিল করছো তো? নাকি কোন সমস্যা হচ্ছে? ”
মেয়েটা চুপচাপ আরুহীকে দেখতে লাগলো, ভ্রু কুঁচকে পাশে থাকা নার্সের দিকে তাকাতেই নার্স কিছু একটা ইশারা করতেই মেয়েটা তৎক্ষনাৎ উঠে আরুহীর পেট বরাবর জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। আরুহী প্রথমে হকচকিয়ে উঠে নিজেকে সামলে মেয়েটার মাথায় হাত রাখল।
” বোকা মেয়ে কাঁদছ কেন? তোমার পরিবারে কে তো খবর দেওয়া হয় নি, ঠিকানা বলতে পারবে? ”
মেয়ে টা তখন ও ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে, আরুহী মেয়েটাকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে মেয়েটার সামনে বসলো, মেয়েটা মাথা নুইয়ে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।
আরুহী মেয়েটার মুখ আজলে তুলল, আদুরে আদুরে কন্ঠে বলল,
” কি হয়েছে ফুল? পরিবারের কথা মনে পড়ছে?”
মেয়েটা মাথা দুই দিকে নাড়িয়ে না করলো, আরুহী অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
” তাহলে কি মায়ের কথা মনে পড়ছে? ”
মেয়েটা এবারেও মানা করলো, আরুহী কিছু একটা ভেবে বলল,
” তোমার পরিবার নেই? ”
মেয়েটা মাথা নেড়ে না করলো, আরুহী দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল,
” তাহলে কোথায় থাকতে তুমি? ”
মেয়েটা ভেজা ভেজা চোখ তুলে আরুহীর দিকে তাকালো, কেমন মায়া ভরা দৃষ্টি তার, ডাগর ডাগর আঁখি তে কেমন মায়াময় দৃষ্টিতে আরুহীর দিকে তাকিয়ে আছে,
” এএএতিমখানায়”
আরুহী মেয়েটার মাথা নিজের কাছে এনে কপালে একটা চুমু একে দিয়ে বলল,
” তোমার নাম কি ফুলবানু? ”
মেয়েটা কাপা কাপা কন্ঠে বলল,
” প্রীতি আহমেদ ”
আরুহী মুচকি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” তোমার মতো তোমার নামটাও ভীষণ মিষ্টি কিন্তু আমি তোমাকে ফুল ডাকবো ”
মেয়েটা ভেজা চোখে তাকিয়ে হাসলো।
” শুনো ফুল আমি তোমার বড় তাই আমাকে আপু বলেই ডাকবে কেমন ”
মেয়েটা মাথা হেলিয়ে সায় জানালো,
” এখন বোন ভেবে আমাকে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিবে কেমন? একদম ভয় পাবে না। এখানে সব সিকিউরিটি দ্বারা পরিচালিত, কেউ তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না, তুমি নির্বিঘ্নে আমাকে সবটা বলতে পারো”
মেয়েটা মাথা হেলিয়ে সায় জানালো,
আরুহী আসন পেতে বসে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
” তুমি কি ছোট থেকে ই এতিমখানায় থাকো? ”
মেয়েটা কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,
” জন্মের পর মা বাবাকে দেখি নি আমি, চোখ খুলে আমার পৃথিবী হিসেবে ওই এতিমখানা ই দেখেছি”
” তোমার এতিমখানা টা ঠিক কোথায়? ”
” যাদবপুর উপজেলার কড়াইখাল গ্রামে ( কাল্পনিক) ”
আরুহী চমকে উঠে মেয়ে টার দিকে তাকিয়ে বলল,
” আর ইউ সিউর জায়গাটা যাদবপুর? ”
” জি, আমার গ্রাম ”
” তুমি ঠিক কতদিন ওদের হাতে বন্দি ছিলে আর তোমাকে ধরে নিলো কিভাবে? ”
মেয়েটা আরুহীর কথা শুনে ঠোঁট ভিজিয়ে বলতে লাগলো,
” আমাদের গ্রামটা ভীষণ শান্তি প্রিয় ছিলো, গ্রামে কখনো অনাচার হতো না, মেয়েরা নির্বিঘ্নে চলাচল করতো কিন্তু হঠাৎ করে শুনতে পেলাম পাশের গ্রাম থেকে নাকি দু দুটো মেয়ে নিখোঁজ, কোথাও তাদের হদিস পাওয়া গেলো না, তার সপ্তাহ খানেক ঠিক ছিলো আবার তিনটে মেয়ে এভাবে মাসের পর মাস যাচ্ছে সপ্তাহ পনেরো দিন পরপর মেয়ে মানুষ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে, পুরো গ্রামে তখন ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে, রাতবিরাতে কি দিনের বেলায় মেয়েরা বাইরে বের হতো না ”
এইটুকু বলে মেয়েটা থামলো, বেডের পাশে রাখা টেবিল টা থেকে পানির গ্লাস টা নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করে গলা টা ভিজিয়ে বলল,
” আমাদের শান্ত গ্রামটা হঠাৎ অশান্ত হয়ে গেলো যেন হুট করেই কালবৈশাখীর বাঁধ ভাঙা ঝড় এসে লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেলো আমাদের প্রিয় গ্রাম টাকে। পুলিশ অনেক তদন্ত করলো কিন্তু একটা কিছু তারা বের করতে পারলো না, অথচ দিনের পর দিন মেয়েরা হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। কেউ কিচ্ছু করতে পারছে না, আমার কি মনে হয় জানেন আপু, ওই খচ্চর পুলিশ গুলা মনে হয় ওই খারাপ লোক গুলোর কাছ থেকে টাকা খেয়েছে তাই তারা কিচ্ছু বের করতে পারছে না”
বলতে বলতেই মেয়েটার গলার স্বর ভারী হয়ে উঠলো, রাগে ফুসে উঠছে মেয়েটা।
আরুহী ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
” কেন তোমার এমন মনে হলো যে পুলিশ ঘুষ খেয়েছে! ”
মেয়েটা কাটকাট কন্ঠে বলল,
” কেন মনে হবে না বলুন তো আপু! আমাদের গ্রামে যখন কু দৃষ্টি টা ছড়িয়ে পড়লো পুলিশের কাছে যখন গিয়েছি ডায়েরি করার জন্য কিন্তু পুলিশ আমাদের কোন কথায় শুনলো না, দুর দুর করে তাড়িয়ে দিলো থানা থেকে! ”
আরুহী দীর্ঘ শ্বাস ফেলল,
” তারপর তোমাকে কি করে ধরলো? আর কতদিন ছিলে?”
” দিনটা নভেম্বরের ২৮ তারিখ। হালকা ঠান্ডা বাতাস ছিলো সেদিন বাহিরে। আমার কিছু প্রয়োজনে বাজারে এসেছিলাম, বাজার টা এতিমখানা থেকে বেশি একটা দুর ছিলো না। জিনিস পত্র কেনা শেষ হলে এতিমখানা ফেরার পথে একটা বুড়ো মতোন লোক হাতে অনেক ভারী বোঝা এসে আমাকে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, তার বোঝা টা একটু এগিয়ে দিতে। বেশ মায়া হলো লোকটার জন্য। তার হাত থেকে বোঝা টা নিয়ে এগিয়ে গেলাম লোকটার পিছু পিছু। আমাদের গ্রামের পশ্চিম দিকে অনেক টা জঙ্গলের মতো, অবাক করা বিষয় হলেও লোকটা আমাকে সেই দিকেই নিয়ে গেলো। আমার বোকা মন তখন ও কোন বিপদের আশঙ্কা করে নি। লোকটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে আমাকে একটা পুরাতন বট গাছের নিচে দাড়াতে বলে কোথায় একটা গেলো। বেশ অনেক ক্ষন হয়ে গেলেও যখন লোকটার কোন হদিস পাচ্ছিলাম না তখনই মনের মধ্যে ভয়ের আনাগোনা শুরু হলো”
বলেই মেয়েটা আবারো থামলো, আরুহী আগ্রহী চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটার মুখ পানে। আরুহীর কেন যেন মনে হচ্ছে মেয়েটা ভীষণ সাহসী আর শক্ত ধাঁচের।
ঠোঁট ভিজিয়ে আবারো বলতে শুরু করলো মেয়েটা।
” হঠাৎ পিছনে থেকে কারো পদশব্দ শুনতে পেয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশে তাকালাম, পিছনে তাকাতে গিয়েও পারলাম না, পিছনে থেকে কেউ মুখে কাপড় চেপে ধরলো, ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেলো আমার সমস্ত শরীর, হাত থেকে খসে পড়লো বোঝা টা, আর… আর কিছু ই মনে নেই। যখন চোখ খুললাম তখন নিজেকে আর কিছু মেয়েকে একটা অন্ধকার রুমে বন্দি অবস্থায় পেলাম। ”
আরুহী নড়েচড়ে বসলো,
” তোমাদের উপর অত্যাচার করতো?”
” হুমম, কারণে অকারণে ”
আরুহী পকেট থেকে ফোন বের করে গ্যালারি ঘেটে একটা ছবি বের করে মেয়েটার সামনে রাখলো,
” দেখো তো এই লোকটাকে চেনো নাকি? ”
মেয়েটা চোখ দুটো ছোট ছোট করে বলল,
” হ্যা হ্যা এই লোকটাই ছিলো, কি যেনো নাম!
কিছু একটা ভেবে বলল,
ওহ হ্যা মনে পড়ছে সাজিদ।
আরুহী মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো, মেয়েটার কান্না পুরোপুরি ভাবে থেমে গেছে।
” তবে আপু একটা জিনিস আমি ঢের বুঝতে পেরেছি, আমাদের মতো মেয়ে পাচারে সাজিদ ছিলো শুধু মাত্র ই তদারকদার, তাকে কন্ট্রোল করেছে অন্য কেউ ”
” মানে?”
” ওই সাজিদ লোকটা কলে অন্য কাউকে বস বলে ডাকতো আর ওই পাশের লোকটা তাকে নির্দেশনা দিতো ”
” কখনো দেখেছো? ”
” না আপু ”
আরুহী ভাবনার মধ্যে ই ছোট করে বলল,
” ওহহ”
আরুহী উঠে দাঁড়ালো,
” আমাকে যেতে হবে বোন, আবার দেখা হবে আর ভয় পেয়ো না ”
মেয়েটা মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো।
চলবে…
[ আজকের পর্ব টা কেমন হ’য়েছে জানাবে কিন্তু ]