#শুধু_তোমাকেই_চাই
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব১৩
“আদৌতেও কোনোদিন সেই কাংখিত দিনটি আসবে কি স্যার?”
লিয়ার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জারিফ সোজা গটগট করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।জারিফের যাওয়ার দিকে লিয়া আহত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে লিয়া কিছুটা ব্যাথিত হয়।তবুও লিয়া নিরাশ হয়না।ডুবন্ত সূর্য মানেই দিন শেষ নয়।নতুন দিনের সূচনাও হতে পারে।তাই কোনো কিছুতেই নিরাশ না হয়ে,ভালো কিছুর জন্য ধৈর্য্য আর আশা রাখতে হয়।জারিফের ব্যাপারে লিয়ার ধৈর্য্য আর আশা দুইটাই আকাশ সমান।লিয়া বুক ভরা আশা নিয়ে আছে নিশ্চয় একদিন জারিফ লিয়ার ভালোবাসাটা উপলব্ধি করতে পারবে।আর সেইদিনটার অপেক্ষায় লিয়া হাজার বছর ধৈর্য্য ধারণ করে জারিফের জন্য ওয়েট করতে পারবে।লিয়ার নিজের উপর এতটুকু কনফিডেন্স আছে।
চারিদিকে সবুজ ঘাস।মাঝে সরু পিচঢালা রাস্তা। রাস্তার দুইপাশে সুন্দর সুন্দর দেশি বিদেশি গাছ।ক্যান্টনমেন্টের ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার রাস্তা দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে জারিফ যাচ্ছিলো,আর লিয়ার বলা শেষ কথাটি জারিফ কে বেশ ভাবাচ্ছিলো।জারিফ ভাবছে,সেই কাংখিত দিনটা আশা কি খুব জরুরী?আগে তো আমি এরকমটা কখনো ভাবিনি।তবে আজ কেনো আমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।সবসময় আমার ফোকাস ছিলো আগে আমার ক্যারিয়ার গঠন করে,ফ্যামেলি কে স্টাবলিশ করা।তারপর নিজেকে নিয়ে ভাবা।অথচ আমার চিন্তা গুলো কেমন এলোমেলো হয়ে আসছে।জারিফের মন আজ মস্তিষ্কের সাথে রেসলিং খেলছে বোধহয়।এসব ভাবার সাথে সাথেই মস্তিষ্ক বলে উঠে,এসব চিন্তা দূর করে আমার লক্ষ্যে আমাকে পৌঁছাতে হবে।এখনই এসব নিয়ে আমি চিন্তা করতে চাইনা।এসব ভাবার জন্য পরে আরো সময় পাওয়া যাবে। আমার ফাস্ট লক্ষ্য হওয়া উচিত ভালো কিছু করে বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করা।বাবা অনেক কষ্ট করছেন আমাদের কে মানুষ করতে। এখন আমার উচিত নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে,কিছুটা হলেও বাবার কষ্ট টাকে লাঘব করানোর চেষ্টা করা।আর এই মুহূর্তে নিজেকে কারো মায়ায় জড়িয়ে নেওয়া ঠিক হবে না।এসব কিছু আমার নিজের ক্যারিয়ারের উপর ইফেক্ট ফেলতে পারে।
আজ এক সপ্তাহ হলো লিয়া ক্যাডেটে চলে গিয়েছে।এই এক সপ্তাহে জারিফের সাথে কোনো যোগাযোগ হয়নি।হাজারো ইচ্ছে থাকা সত্বেও লিয়া নিজেও কল দেয়নি জারিফ এর কাছে।অরিন,ফিহা আর লিয়া তিনজনে এক রুমে থাকে।পড়া শেষ করে লিয়া চেয়ার থেকে উঠে দেখে,অরিন বেডে বসে হেডফোন গুঁজে ফোন সামনে ধরে আছে।আর ফিহা নিঃশব্দে পড়ছে।ফিহা কে দেখলেই লিয়ার মনে হয় জ্ঞানের জাহাজ একটা,সব সময় বইয়ে মুখ ডুবে থাকে।আরেক জন তো ফা’জলামি তে নোবেল পাওয়া বান্ধবী।এদের দুজনের মাঝে লিয়া কে মাঝামাঝি বলা যায়।না বেশি চুপচাপ আর না অতিরিক্ত চঞ্চল।
অরিন ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে লিয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হেসে উত্তেজিত কন্ঠে বলে,,”এই লিয়া তোর পড়া শেষ।এই দেখ ভি কে কি সুন্দর লাগছে।একদম কিউটের বস্তা একটা, ইচ্ছে করছে তো টুপ করে খেয়ে ফেলি।”
লিয়া সরু চাহনি দিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলে,,”তোর তো যাকে তাকে দেখেই টুপ করে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে।কি বাজে রুচি তোর।”
অরিন ঝাঁঝালো গলায় বলে,,”এই মোটেও আমার রুচি বাজে না। শুধু হ্যান্ডসাম কাউকে দেখলেই আমি ক্রাশ খাই তাছাড়া নয়,হুহ।”
ওদের দুজনের কথায় ফিহা বেশ বিরক্ত হয়।ফিহা অরিনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে,,”দেখছিস আমি পড়ছি।আর তাও তোরা চেঁচামেচি করেই চলেছিস, আশ্চর্য!কোনোদিনও কান্ডজ্ঞান হবে না অরিন তোর।”
অরিন তেতে উঠে বলে,,”এই চশমিশ এতো পড়ে কি হবে শুনি।না পড়েও আমি টেনে টুনে পাশ করে যাবো,হ্যা।আর পাশ করা মানে হলো ক্লাস বাই ক্লাস উঠা।আর ক্লাস বাই ক্লাস উঠার মানে জানিস তুই?সব সময় তো বইয়ে মুখ ডুবিয়ে থেকে নিজেকে মহাজ্ঞানী প্রুফ করতে চাস।অথচ মাথায় কোনো কমন সেন্স নেই।আরে এক ক্লাস থেকে উর্ত্তীণ হয়ে অন্য ক্লাসে পা দেওয়ার আসল কারণ হলো,বিয়ের পিঁড়িতে পা দেওয়ার জন্য এগিয়ে যাওয়া।কারন যখন কেউ মেয়ের পরিবার কে জিগ্গেস করে আপনার মেয়ে কিসে পড়ে?মেয়ের মা যদি কলেজ কিংবা ভার্সিটির কথা বলে,তখন সাথে সাথেই প্রশ্ন করা আন্টি বা আঙ্কেল বলে উঠবে, ওহ্!তাই নাকি মেয়ের তো বিয়ের বয়স হয়েই গিয়েছে।তাহলে কি বুঝলি চশমিশ?বিয়ে টাই হলো মূল টার্গেট।তাই আমি আমার ফোকাস বিয়েতেই।মনের মতো কাউকে পেলে পটিয়ে নিয়ে সোজা ফটাফট করে তিনবার কবুল বলে ফেলবো।”
শেষের কথা বলে অরিন লাজুক হাসে।লিয়া ঠোঁট চেপে হাসে।ফিহার রাগের পারদ তরতর করে বাড়তে থাকে।ফিহা মনে মনে আওড়ায়, বাঁচাল একটা।মাথা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য একাই যথেষ্ট এই অরিনটা।তারপর গলা ঝেড়ে গমগমে কন্ঠে বলে,,
“খালি ক্লাস বাই ক্লাস উঠলেই হয়না।এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে যেতে গেলে আপনা আপনি অনেক কিছু শেখা জানা যায়।এই জানা আবার মানুষ ভেদে বিভিন্ন যার জ্ঞানের গভীরতা যতো বেশি,সে তত বেশি ভালো মন্দ বাছ বিচার করতে পারে।জীবন চলাটা তার জন্য তত সহজ হয়ে যায়।এই দেখ কেউ কেউ একই জায়গা থেকে পাশ করে ভালো ডিগ্রি নিয়ে বের হয়ে ঘুষ খায়, দূর্নীতি করে।আবার কেউ আছে সেইম জায়গা থেকে পাশ করেছে আবার একই জব করে অথচ এসব খা’রাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখে।তাহলে নিশ্চয় দুজনের জ্ঞানের গভীরতায় ডিফারেন্স আছে।নিজেকে বিশুদ্ধ রাখা মানুষ ই হলো আসল জ্ঞানী মানুষ।আর নিজেকে পিওর রাখার জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন আছে।এর জন্য প্রচুর অধ্যায়ন করতে হয়।”
ফিহার কথা শুনে অরিন ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে,,”হয়েছে হয়েছে বোইন।তুই বেশি বেশি করে জ্ঞান অর্জন করে মহাজ্ঞানী হ বোন।তবে এখন একটু জ্ঞান দেওয়া টা বন্ধ কর। আমার মাথা ধরে আসছে।এতো জ্ঞান আমি আর নিতে পারছি না।”
ফিহা বিরক্তকর ফেস নিয়ে আবার বইয়ে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে পড়ায় মন দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়।লিয়া ফোনটা হাতে করে বাড়িতে কথা বলার জন্য।সেইসময়
অরিন স্মিত হেসে বলে,,
“লিয়া তুই তো তোর খরগোশের মতো দেখতে কাজিনটার সাথে আমাকে সেট করিয়ে দিলি না।তাই আমি ভাবছি, পার্সপোর্ট,ভিসা করে সোজা আমি আমার কিউট ভি এর কাছে চলে যাবো।ইশ!কত কিউট ভি টা। আমার ভি কে খুব ভালো লাগে।”
লিয়া ঠোঁট মেলে কিছু বলতে যাবে তার আগেই গমগমে স্বরে ফিহা বলে,,”হ্যা নিজে যেমন পছন্দ করেছেও ঠিক তেমন বদের হাড্ডি টা কে।নিজে যেমন সবাই কে জ্বালিয়ে বেড়ায়। ঠিক তেমন তোর ঐ কল্পনার ক্রাশ বিটিএস এর ভি ও একাই সবাইকে জ্বালিয়ে বেড়ায়।যে যেমন ঠিক তার চয়েজও তেমন।”
ফিহার কথা শুনে অরিন শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কঠোরভাবে বলে,,”তুই আমার প্রিয় ভি কে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছিস।তাই তোর পানিশমেন্ট হলো,তোর বাসর ঘরে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগিয়ে রাখব।একদম বিছানা বরাবর।আর লাইভ ছাড়বো সোশ্যাল মিডিয়াতে।অরিন দুই হাত নাড়িয়ে এক্সাইটেড হয়ে বলে,ওয়াও!রাতারাতি আমার ছোট্ট পেজটার রিচ তরতর করে আকাশ ছুঁয়ে যাবে।একদিনেই ভাইরাল হয়ে যাবে।”
লিয়া ধমক দিয়ে বলে,,”থামবি তোরা তখন থেকে কিসব আজেবাজে বকবক করছিস ।এখন মুখটা বন্ধ রাখ।আমি বাড়িতে কথা বলবো।”
লিয়া ওর আম্মুর সাথে কথা বলে কল কে’টে দিয়ে ভাবে জারিফের কাছে কল দিবে কি? দিবে না?
আকাশে মিটমিট করে তাঁরারা জ্বলছে। চারিদিক থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে,আকাশ পানে দৃষ্টি দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু সময় ভেবে নিয়ে লিয়া, অবশেষে জারিফের কাছে কল দেয়।
জারিফ খাবার খাচ্ছিলো, প্রায় শেষের দিকেই খাওয়া।এমন সময় জারিফের ফোনে কল আসে।বাম হাত দিয়ে পকেট থেকে ফোন টা বের করে দেখে লিয়া কল করেছে।জারিফ ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেখে নেয়,ওর মা আর ছোট বোনেরা সবাই খাবার খাচ্ছে। কিয়ৎক্ষন ভেবে নিয়ে ফোন রিসিভ করে সরাসরি বলে,,”আমি একটু বিজি আছি।ফাইভ মিনিটস পরে ব্যাক করছি কেমন।”
ফোনের ওপাশ থেকে লিয়া কিছু বলার আগেই জারিফ কল কে’টে দেয়।জারিফের কল কে’টে দেওয়াতে লিয়ার মনটা মলিন হয়ে যায়।লিয়া ভাবে,,স্যার কি আমার সাথে কথা বলতে বিরক্ত হয়?পরক্ষণেই আবার ঠোঁট আওড়িয়ে বলে,ধ্যাত কিসব ভাবছি আমি।স্যার নিজেই তো বললো ফাইভ মিনিটস পরে ব্যাক করবে।”
জারিফ দ্রুত খাবার খেতে থাকে।জেরিন খাবার চিবুতে চিবুতে বলে,,”ভাইয়া কে ফোন দিয়েছিলো?”
জেরিনের কথা শুনে জারিফ মনে মনে বিরক্ত হয়।বড় ভাইয়ের কাছে প্রশ্ন করছে কে ফোন দিয়েছিলো সেটা জানার জন্য।যে কেউ দিতেই পারে,এটা শোনা কি খুব জরুরী নাকি?জারিফ ঢকঢক করে পানি খেয়ে বলে,,”আমার একটা স্টুডেন্ট ফোন দিয়েছিলো।”
জেরিন ঠোঁট উল্টে বলে,,”ওহ্।পরক্ষণেই কিছু ভেবে বলে,তা রাত দশটার সময় যে স্টুডেন্ট ফোন দেয় তার মনে হয় কান্ড জ্ঞান খুব কমই আছে। সারাদিন কি করছিলো যে এতো রাতে ফোন দিয়েছে।”
জেরিন এর কথা শুনে জারিফের মেজাজ টা খা’রাপ হতে থাকে।জারিফ ভালো করেই জানে ওর এই বোনটা একটু বেশিই কথা বলে।আর মনে যেটা হয় সেটাই বলে ফেলে।কাল পাত্র বিবেচনা না করেই মুখ ফসকে কিছু বলে ফেলার ব্যাড হেবিট আছে।জারিফ গলা ঝেড়ে কিছু বলতে যাবে,তার আগেই জারা বলতে থাকে,,”এখন ফোন দিয়েছে হয়তো পড়ছিলো।পড়ার সময় কিছু বুঝতে সমস্যা হয়েছে,তাই স্যারের থেকে শুনে নিতে ফোন দিয়েছে হয়তো।”
জারার কথা শুনে জেরিন দাঁত কটমট করে বলে,,”আমি তোর থেকে শুনতে চেয়েছি নাকি যে,তুই আগ বাড়িয়ে বলছিস।আমি আমার ভাইয়া কে বলেছি।তোকে নয় বুঝলি,হুহ।”
জারিফ কিছু না বলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস রুমের দিকে পা বাড়ায়।এখানে কিছু সময় দুই বোনের তর্কাতর্কি হতে থাকবে ।সেই সময় জারিফের মা দুই বোন কে ব’কবে।তারপর ওরা দুজনে থামবে এর আগে নয়।যে কোনো বিষয় নিয়ে দুই বোন তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়ে নেয়।
জারিফ ব্যালকনিতে গিয়ে ফোনটা নিয়ে কল ব্যাক করে। ভার্সিটি, কোচিং এ আসা যাওয়া আরো বিভিন্ন ব্যাস্ততার মাঝে,এ কয়দিনে লিয়ার কথা জারিফের খুব কমই মনে পড়েছে।বিকেল টাইমে একটু আধটু মনে হয়েছে।কারন বিকেলেই লিয়া কে পড়াতো।
নেশা নয় এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বাজে এডিকশন হচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের মায়া আর ভালোলাগা।জারিফের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে লিয়া।যেই মায়া থেকে বের হওয়ার কোনো পথ নেই।দিনকে দিন আরো বেশি জারিফ কে অনুভব করছে লিয়া।এই যে এক সপ্তাহ না চোখের দেখা দেখেছে।আর না প্রিয় মানুষটার কন্ঠ শুনতে পেরেছে।এই দূরত্ব এতটুকু লিয়ার মন থেকে জারিফকে দূরে সরাতে পারেনি। বরঞ্চ দূরত্ব টা যেনো আরো ভালোবাসার গভীরতা বৃদ্ধি করেছে।
ফোনে সময় দেখে নিয়ে লিয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে ভাবে,,”অলরেডি ফাইভ মিনিটস এর জায়গায় টেন মিনিটস হতে চললো।কই স্যার তো কল ব্যাক করলো।আমার ধারনা টাই ঠিক স্যার মনে হয় আমার ফোনে বিরক্ত বোধ করে।সেটা মুখে সরাসরি বলতে পারিনি,তাই ইনডাইরেক্টলি বুঝিয়েছে।যাতে করে আমি স্যারকে ডিস্টার্ব না করি।অরিন লিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে মুখটা মলিন করেই বলে,,
“চল ঘুমাবি বেটা আহাম্মক মাস্টার মশাই কল ব্যাক করবে বলে মনে হচ্ছে না।তুই কি এখন সারারাত ফোনের আশায় এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি?
অরিনের কথার মাঝেই লিয়ার হাতে থাকা ফোনটায় আলো জ্বলে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে জারিফের নাম দেখে,লিয়ার মুখে হাসি ফোটে।রিসিভ করে মৃদু আওয়াজে বলে,,”আসসালামুয়ালাইকুম।স্যার”
সালামের উত্তর দিয়ে জারিফ বলে,,”সরি লেইট করে ব্যাক করার জন্য।”
জারিফের বলা সরি শব্দ টা লিয়া আশা করেনি। তারপরেও লিয়া আরো বেশি খুশি হয়।লিয়ার চোখ মুখ খুশিতে উপচে পড়ছে।লিয়া বুঝতে পারে জারিফ আসলেই বিজি ছিলো।লিয়া স্মিত হেসে বলে,,”ব্যাপার না।আমিই হয়তো এই সময় ফোন করে আপনাকে বিরক্ত করে ফেললাম।”
লিয়ার কথার উত্তর না দিয়ে জারিফ স্পষ্টভাবে বলে,,”হ্যা,লিয়া বলো কিজন্য ফোন দিয়েছিলে?”
লিয়া কাংখিত উত্তর টা না পেয়ে একটু আহত হয়।তবু নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,,”স্যার কেমন আছেন?”
“ভালো।তোমার পড়াশুনা কেমন হচ্ছে?”
“মোটামুটি ভালো স্যার।আসলে স্যার গতি বিদ্যার একটা টপিক বুঝতে সমস্যা হচ্ছিলো ।আপনি যদি কাইন্ডলি একটু বুঝিয়ে দিতেন।”
জারিফ বুঝতে পারে এই সময় এসব টপিক বোঝার জন্য ফোন করেছে লিয়া, নেহাতই এটা একটা অজুহাত মাত্র।তবে লিয়ার সাথে কথা বলতে জারিফের খা’রাপ বা বিরক্ত লাগছে না।লিয়ার কন্ঠস্বর জারিফের মনে অনুভূতির সঞ্চার করছে।
হালকা কেশে জারিফ শান্ত গলায় শুধায়,,”আচ্ছা বলো,কোন টপিক।”
লিয়া ভাবে এই রে কোন টপিক বলি এখন।কিছু সময় ভেবে নিয়ে লিয়া বলতে থাকে,,”ঐযে একটা অংক আছে না স্যার।বন্দুকের থেকে ছোড়া গুলি ফিফটি কিলোমিটার পার সেকেন্ড গতি বেগে কাঠের গুঁড়ির মধ্যে প্রবেশ করে টুয়েন্টি ইঞ্চি যেয়ে ফাইভ সেকেন্ড পর থেমে যায়। মন্দন কত ?কিভাবে বের করবো?বুঝতে পারছি না।”
জারিফ মৃদু কন্ঠে বলে,,”ওহ! ইঞ্চি টাকে সেন্টিমিটার এ প্রকাশ করে নাও।আদি বেগ দেওয়াই আছে আর শেষ বেগ শুন্য।যেহেতু গুলিটা থেমে গিয়েছে তাই শেষ বেগ জিরো। সূত্র ফেলে ক্যালকুলেশন করে নিলেই হবে।”
“থেংকিউ স্যার।বুঝতে পেরেছি।”
জারিফ এক হাত দিয়ে কপালে আশা চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিয়ে মনে মনে ভাবে,আমার সব চিন্তা ভাবনা গুলোও তোমার কাছে এসে থেমে যাচ্ছে মিস লিয়া।যতই চাচ্ছি তোমার থেকে দূরে থাকবো।ততই মন আর পরিবেশ সবটা তোমার অনুকূলে চলে যাচ্ছে।তোমায় নিয়ে ভাবনা গুলো হুটহাট করেই মাথা চাড়া দিচ্ছে।
লিয়া শান্ত গলায় বলে,,”স্যার ডিনার করেছেন?”
“হ্যা,করেছি।”
“আন্টি আঙ্কেল আপনার বাসার সবাই কেমন আছে?”
“সবাই ভালো আছে।”
এরমধ্যে হুড়মুড় করে অরিন এসে হুটহাট করে লিয়া কে উদ্দেশ্য করে দ্রুত বলে ফেলে,,”এই লিয়া ফোনটা স্পিকারে দেতো।দেখি মাস্টার মশাই কি বলে।”
অরিনের কথা শুনে লিয়ার মেজাজটা খা’রাপ হয়ে যায়।কলে আছে,আর সামনে দাঁড়িয়ে ফাটা স্পিকার এর মতো বেজে বেজে কথা গুলো বললো।ফোনের ওপাশে জারিফ শুনে ফেললো না কথাগুলো।লিয়া এক হাতে ফোন ধরে আরেক হাতে ফোনের স্পিকার এর জায়গায় চেপে ধরে ফিসফিস করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,”এই বেক্কেল একটা।আরেকটু জোরে এসে কথাগুলো বল।স্যার সব শুনে ফেলেছে নিশ্চয় তোর কথা। এখন আমাকে কি ভাববে বলতো?বলবে ফ্রেন্ডদের কে সাথে নিয়ে আমি নিশ্চয় ফ্লার্টিং করার জন্য এখন ফোন দিয়েছি।”
অরিন দুইহাত কানে দিয়ে অসহায় ফেস করে করুণ গলায় বলে,,”সরি, দোস্ত।খেয়াল ছিলো না।”
লিয়া ফোনের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে নিয়ে বলে,,”আসলে স্যার আমার বান্ধবী।ওর ও ঐ অংক টাতে প্রবলেম ছিলো তো।তাই আমার পাশে থেকে ও নিজেও বুঝতে চাইছিলো।”
জারিফ হালকা কেশে শান্ত গলায় বলে,,”ওকে।সমস্যা নেই।তবে আমাকে সবার পার্সোনাল টিচার বানিয়ো না, প্লিজ।তুমি পর্যন্তই ঠিক আছি এর বাইরে কারো পার্সোনাল টিচার হতে চাইনা।তারপর অস্ফুট স্বরে বলে,,আমি একজনেতেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই।”
তুমি পর্যন্তই ঠিক আছি।এই কথাটার অর্থ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।এই কথাটা কি আমার জন্য পজেটিভ বার্তা দিচ্ছে?এটা ভেবে লিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আর নিঃশব্দে লাজুক হাসে।
ফোনের ওপাশ থেকে সফট ভয়েজে জারিফ বলে,,”লিয়া”
জারিফের মুখে ছোট করে লিয়া ডাকটা আজ যেনো অন্যরকম শোনালো।যে ডাকের মাঝে জড়িয়ে আছে ভালোবাসা।লিয়া মনে মনে বলে,, আপনি আমার প্রথম প্রেমের প্রথম অনুভূতি। সারাজীবন ভালোবাসতে চাই আপনাকে যদি পাই অনুমতি।আর আমিও শুধু আপনাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই।
লিয়ার ধ্যান ভাঙল জারিফের দ্বিতীয় বার ডাকে।এবার জারিফ এবার গম্ভীর গলায়ই লিয়া বলে ডাকে।লিয়া নিজেকে তটস্থ করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,,
“হ্যা স্যার বলুন।”
“আচ্ছা ভালো থেকো।পড়ালেখায় ঠিকমতো কন্সেনট্রেট করো।ওহ আর একটা কথা বলছি,ছোট্ট ব্রেন টার উপর বেশি পেশার দিয়ো না উদ্ভট চিন্তা ভাবনা করে।সামনে অনেক সময় পরে আছে,তখন না হয় উদ্ভট চিন্তা গুলো করো।আর রাত হয়েছে এবার ঘুমিয়ে পড়ো কেমন।টেক কেয়ার,গুড নাইট।”
[চলবে…ইন শা আল্লাহ]