#শুধু_তোমাকেই_চাই
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব২৩
“জীবন চলার পথ অজানা হওয়ায়,কখনো সহজ আবার কখনো কঠিন অনুভব হয়।যখন সহজ অনুভব হয় তখন মনে হয়,সঠিক ট্রাকে আছি।আবার যখন কঠিন অনুভব হয় তখন মনে হয় কোথাও কি ভুল হয়েছিল?জীবন চলার পথে সঠিক ও ভুলটা ভালোভাবে জানা দরকার।যা খুবই বাস্তব।জীবনের এই বাস্তবতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো,যতই নিষ্ঠুর হোক বা কষ্ট হোক না কেনো সব কিছু সয্য করে নিয়ে,মেনে নিয়ে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলা।যে যত সহজেই বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারে,সে তত সহজেই সুখি হতে পারে।তার জন্য জীবন চলাটা তত সহজ হয়।
জীবন চলার পথের বাঁকে বাঁকে থাকে খুবই নির্মম, নিষ্ঠুর বাস্তবতা।যা চাইলেই কেউ সহজেই মেনে নিতে পারে না।আর মেনে নেওয়াটা এত সহজও নয়।ঠিক তেমনি তাসনিম এই মুহূর্তে এই অবস্থাকে মেনে নিতে পারছে না।মনটাকে শান্ত করার হাজারো চেষ্টা করে,ফলশুণ্য হচ্ছে।বেপরোয়া মনটা মানতে নারাজ।মন এর সাথে শরীরের সম্পর্ক ব্যাপক।তাই মন ভালো না থাকলে শরীরও ভালো থাকে না।জারিফের পাশে বসা ছোট বোনকে,জারিফের প্রেয়সী হিসেবে কিছুতেই সয্য করা যাচ্ছে না। তাসনিম এর প্রচন্ড সাফোকেটিং হতে থাকে। নিঃশ্বাস নেওয়াটা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে চতুর্দিকে ক্লোরাইডে ছেয়ে গিয়েছে, পর্যাপ্ত অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে না।দম বন্ধ হয়ে আসছে।দম বন্ধ কর এই পরিবেশে থাকা তাসনিম এর জন্য কষ্টদায়ক হয়ে উঠে।
তাই তাসনিম উঠে দাঁড়িয়ে রুপকের উদ্দেশ্যে মৃদু আওয়াজে ঠোঁট আওড়িয়ে বলে,,” আমার কেমন জানি,শরীর খা’রাপ লাগছে।তাই বলছি যে,আমি আসছি এখন।”
তাসনিম এর কথাটা উপস্থিত কেউ এক্সপেক্ট করেছিলো না।সবাই বিস্ফোরিত নয়নে তাসনিম এর দিকে তাকায়।রুপক তাসনিমের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে শান্ত গলায় বলে,,”তাই হয় নাকি?তুই এখনই চলে যাবি?কারন আরেকটু পর আমরা সবাই মিলে ছাদে আড্ডা দেবো।তাই তোর এখন যাওয়া যাবে না।”
তাসনিম ছোট করে শ্বাস নিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,,
“রুপক আ’ম রিয়েলি সরি,এইভাবে চলে যাওয়ার জন্য।বাট এছাড়া আমার কোনো উপায় নেই।সত্যি আমার শরীর খা’রাপ লাগছে।আই নীড রেস্ট।তাই আমাকে এখন যেতেই হবে।তুই জোর করিস না, প্লিজ।”
এরমধ্যে লিয়া উঠে তাসনিম এর পাশে গিয়ে বলে,,
“আপু তোমার শরীর খা’রাপ লাগছে? তুমি এখন হলে না গিয়ে,আমার সাথে বাসায় চলো।আমি ড্রাইভার আঙ্কেল কে ফোন করে এখনই আসতে বলি।”
এই বলে লিয়া ফোন করতে যাবে,সেই সময় তাসনিম ঠোঁট কামড়ে ধরে কঠোরভাবে বলে,,”একদম নয়।তুই আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না।আমি ঠিক আছি।আর আমি একাই থাকতে পারবো।সো তুই আমাকে নিয়ে ভাবা বাদ দিয়ে এই সময়গুলো ইনজয় কর।”
শেষের কথাটা তাসনিম তাচ্ছিল্য করেই বলে।আর বলার সময় আড়চোখে একবার জারিফের দিকে তাকায়। এরমধ্যে জারিফ তাসনিম কে উদ্দেশ্য করে শান্ত গলায় বলে,,”আমার মনে হয় লিয়া ঠিকই বলেছে। অসুস্থতা নিয়ে হলে না গিয়ে বাসায় যাওয়াটাই বেটার হবে।”
জারিফের কথাগুলো কর্ণগোচর হতেই তাসনিম মনে মনে আওড়ায়,,আমার জন্য কোনটা বেটার,সেটা যদি তুই জানতিস,তাহলে আজ আর আমার এই অবস্থা হতো না।না আমি বিধ্বস্ত হতাম আজ।অবশ্য এতে তোর কোনো দোষ নেই।দোষ টা আমার নিজেরই তোকে তো কখনো মুখ ফুটে বলিনি।
এই কথাগুলো মনের মাঝেই রেখে।মাথা ঝাড়া দিয়ে তাসনিম ভরাট গলায় বলে,,”আমি বলছি তো ঠিক আছি।হালকা হেডেক হচ্ছে,হলে গিয়ে রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।আর আমার জন্য তোরা এই আনন্দঘন পরিবেশটা উপভোগ না করে চলে গেলে আমার নিজের কাছেই খা’রাপ লাগবে।”
তাসনিম যাওয়ার সময় স্টেজে বসা রোজের সাথে দেখা করতে যায়। তাসনিম এর বিধ্বস্ত ফেস দেখে রোজ এর মন খা’রাপ হয়।আর তাসনিম এর বিধ্বস্ততার কারন কি?তা রোজ ভালো করেই জানে।রোজ আসন ছেড়ে উঠে তাসনিম এর সামনে দাঁড়িয়ে, তাসনিম এর হাত ধরে মুখটা মলিন করে ঠোঁট প্রসারিত করে কিছু বলতে যাবে,তার আগেই তাসনিম শান্ত গলায় বলে,,”রোজ তোকে একটা রিকোয়েস্ট করবো রাখবি প্লিজ।তুই তো আমার অনুভূতির কথা জানিস তাই বলছি তুই কখনো কাউকে এই বিষয়টা বলবি না।এই বিষয়ে যেহেতু আমার ছোট বোন জড়িত।তাই তুই আমাকে প্রমিজ কর কখনোই কাউকে বলবি না।”
রোজ ছলছল নয়নে তাসনিম এর দিকে চেয়ে ঘাড় নাড়িয়ে ইশারায় হ্যা সূচক বলে।
রোজের থেকে বিদায় নিয়ে তাসনিম চলে যেতে থাকে।গেইটের কাছাকাছি আসতেই লিয়া ছুটে এসে তাসনিম কে ডেকে বলে,,”আপু তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো।”
তাসনিম নির্বাক হয়ে থাকে। দৃষ্টি সামনের দিকে রেখে নিশ্চুপ হয়ে রয়।কোনো কথা শোনার মত একটুও আগ্রহ নেই।আর না আগ্রহ দেখায়।
লিয়া তাসনিম এর মলিন ফেসের দিকে তাকিয়ে মৃদু আওয়াজে বলে,,”আপু বলছিলাম যে,জারিফ স্যারের বিষয়টা এখনই বাড়িতে কাউকে বলো না। বিশেষ করে দাদিমনি কে এখনই বলো না।আর আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি।আর যদি ভুল হয়ে থাকে তাহলে তুমি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখো।”
তাসনিম ঘাড় ঘুরিয়ে লিয়ার দিকে তাকিয়ে ভরাট গলায় বলে,,”তুই চিন্তা করিস না। ভালোভাবে বাসায় যাস।আর অনুষ্ঠান বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের মানুষ থাকে,তাই সাবধানে থাকিস। ওহ্!তোকে দেখে শুনে রাখার জন্য তো একজন আছেই এখানে। তোকে তো চোখের আড়াল হতে দিবে না।আচ্ছা থাক লিয়া,আসছি
কথাটি বলে লিয়াকে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তাসনিম দ্রুত বেড়িয়ে যায়।লিয়া নির্বাক হয়ে তাসনিম এর যাওয়ার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়।লিয়া তাসনিম এর কথায় আর আচরনে বেশ অবাক হয়।
তাসনিম হলে গিয়ে প্রথমে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দেয়।এত সময়ের আটকানো,দলা পাকানো কান্না গুলো আর যেনো বাঁধ মানতে চাইছে না। আষাঢ়ের আকাশ ভেঙ্গে যেভাবে ভারী বর্ষণ নামে ঠিক তেমনি করে তাসনিম এর চোখ ফে’টে বর্ষণ হতে থাকে। অনেকক্ষন কান্না করে তাসনিম চেয়ারে বসে গা এলিয়ে দেয়। কান্না করলে না-কি মানুষ কিছুটা হলেও হালকা হয়।এই কথাটা কতটুকু সত্য তা তাসনিম জানে না।আর ওর তো হালকা লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে বুকের উপর কষ্ট গুলো পাহাড় সমান ভারী হয়ে চেপে আছে। তাসনিম ফোনটা হাতে নিয়ে ওপেন করে, প্রথমে জারিফের কন্টাক্ট নম্বর ডিলেট করে।গ্যালারিতে জারিফের যে কয়টা ছবি ছিলো,সেসব ছবি ডিলেট করে দেয়।
তাসনিম চোখ দুটো বন্ধ করতেই টসটসে কয়েকফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। অস্ফুট স্বরে ঠোঁট আওড়িয়ে বলে,,ঠিক এইভাবেই যদি মন থেকে তোকে মুছে দিতে পারতাম। তবে আমাকে পারতেই হবে।আমার এই একপাক্ষিক ভালোবাসাটার ইতি আমি টেনে নিলাম।আমি যাকে চেয়েছি সে আমাকে চায়নি,আর যে আমাকে চেয়েছে।আমি তাঁকে গুরুত্ব দেয়নি।
তাসনিম এর ভিতর থেকে বলে উঠলো,,শুনেছি ইফ ইউ মিস এ ট্রেন,ইউ ক্যান ক্যাচ আ্যনাদার ট্রেন। তাসনিম তুই ভেঙ্গে পড়িস না।কালকে কি হবে?আজকে তুই জানিস না।এমনও তো হতে পারে,তোর ভালোর জন্যই হয়েছে।ভাগ্য কে মেনে নিতে হবে।হয়ত জারিফ তোর ভাগ্যে ছিলো না।
এতকিছুর পরও জারিফের নিষ্পাপ মুখটি মনের কোণে বারবার ভেসে আসেতেই দু চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তাসনিম এর কাছে মনে হচ্ছে, পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে। তাসনিম অস্ফুট স্বরে বলে,,মায়া নামক জিনিস টা খুবই খা’রাপ।একবার যদি কারো উপর মায়া সৃষ্টি হয়।সে মায়া কে’টে উঠাটা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।তবে এখান থেকে শিক্ষা পেলাম ,সবার সাথে পরিচয় রাখবো, কিন্তু কোনো মায়ায় জড়াবো না।এই শিক্ষার জন্য থেংকিউ জারিফ।ফর লার্নিং দিস।এটা মনে করেই উঠে দাঁড়ালো।আবার সব দুশচিন্তা দূর করার জন্য বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দিলো।আয়নায় প্রতিবিম্ব বলে উঠলো, তাসনিম তোর মূল্য বোঝ।
আত্বীয় স্বজন সহ নিমন্ত্রিত অতিথিরা সবাই যার যার মত তাদের গন্তব্যে ফিরতে ব্যস্ত।লিয়া ফোনটা হাতে ধরে চিন্তিত হয়ে আছে।কারন ড্রাইভারকে ফোন করেছিলো একটু আগে।ড্রাইভার বলেছে কোনো একটা কাজে আটকিয়ে গিয়েছে।তাই আসতে ঘন্টা খানেক দেরি হবে।লিয়া বিরক্তিতে মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে চ জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করে দাঁড়িয়ে হাঁসফাঁস করতে থাকে।লিয়ার পাশে সটান দাঁড়িয়ে এক হাত প্যান্টের পকেটে গুজে আরেক হাত দিয়ে চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করে নিয়ে, লিয়ার দিকে শীতল চাহনিতে চেয়ে মৃদু আওয়াজে বলে,,”রাত নয়টা বেজে গিয়েছে তো অলরেডি।আমাকেও বাসায় ফিরতে হবে।তোমাকে রেখে কিকরে যাই।তাই বলছি চলো তোমাকে পৌঁছে দেবো।”
কথাটি কর্ণগোচর হতেই লিয়া জারিফের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে কিয়ৎক্ষন ভেবে শান্ত গলায় বলে,,”আচ্ছা ঠিক আছে।তবে আগে আম্মু কে বলে দেই। আঙ্কেল কে আসতে নিষেধ করে দিতে।”
লিয়া রাজিয়া সুলতানার কাছে কল করে। রাজিয়া সুলতানা রিসিভ করতেই লিয়া সোজাসুজি স্পষ্টভাবে বলে,,”আম্মু বলছি যে, আঙ্কেলের আসতে যেহেতু দেরি হবে।তাই আমি স্যারের সাথে চলে আসছি।স্যারের ফ্রেন্ডের বিয়ে,তাই স্যার এখানে আছেন।”
ফোনের ওপাশ থেকে অস্ফুট স্বরে রাজিয়া সুলতানা ঠোঁট আওড়িয়ে বলে,,”জারিফ?”
“হুম।রুপুর ভাই স্যারের ফ্রেন্ড।”
রাজিয়া সুলতানা কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে শান্ত গলায় বলে,,”ওহ্।আচ্ছা চলে আয়।রাতও হয়ে গিয়েছে।ওয়েট না করে জারিফের সাথে চলে আসাই বেটার হবে।তাহলে আমি ফোন করে ড্রাইভারকে নিষেধ করে দিচ্ছি।আর ভালোভাবে দ্রুত চলে আয় কেমন।”
“ওকে” বলে লিয়া ফোন কে’টে দিয়ে জারিফের মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,”চলুন।”
জারিফ সামনের দিকে ইশারা করে আগাতে বলে।জারিফ আর লিয়া রাস্তায় এসে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে।রাস্তার পাশে ল্যামপোষ্টের সোডিয়ামের ঘোলাটে আলো জ্বলে আছে।ল্যামপোষ্ট যেনো আলো দিতে কৃপণতা করছে।তার উপরে কুয়াশা যেনো সেই আলোকে ঢেকে দিচ্ছে।শীতের রাতে বেশি রাত না হলেও রাস্তায় লোক সমাগম, যানবাহন এর চলাচল কমে যায়।দোকান পাট ও বন্ধ হয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি। কুয়াশা আর মৃদু ঠান্ডা বাতাসে লিয়ার শরীরটা কেঁপে উঠে।জারিফ দুই আঙ্গুল দিয়ে কপালে স্লাইড করে বিরক্তকর গলায় বলে,,”এই সময় রিকশা পাওয়া মানে যেনো আমাবস্যায় চাঁদ পাওয়া।চলো আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখা যাক।”
কুয়াশাচ্ছন্ন রাত চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। হালকা আলোয় পিচঢালা জনমানব শূন্য পথ দিয়ে জারিফের পাশাপাশি হাঁটতে লিয়ার মন্দ লাগছে না।লিয়া সময়টা উপভোগ করতে থাকে। এরমধ্যে একটা রিকশার দেখা মিলে।
টুংটাং শব্দে রিকশা যাচ্ছে।জারিফ আর লিয়া পাশাপাশি বসে।রিকশা চলতে শুরু করার পর বেশ বাতাস লাগছে। ঠান্ডা বাতাসে লিয়ার শরীরের লোমকূপ যেনো ঠান্ডায় শিহরিত হয়ে উঠে।লিয়ার শীত অনুভব হচ্ছে। লিয়া জড়সড় হয়ে বসে।এক হাত অন্য হাতের উপর রাখে।লিয়ার শীত অনুভব হচ্ছে এটা বুঝতে পেরে জারিফ ওর ব্লেজার টা খুলে দুই হাত দিয়ে পিছন থেকে লিয়ার পিঠের উপর দিয়ে জড়িয়ে দেয়।এই মুহূর্তে লিয়ার মনের ভেতর স্বর্গীয় অনুভুতি হয়।লিয়া জারিফের কেয়ার দেখে মুগ্ধ হয়।লিয়ার খুব ভালো লাগতে লাগে।লিয়ার প্রচন্ড ইচ্ছা করছে জারিফের কাঁধে মাথা রাখতে।তবে কিছু লজ্জা,জড়তা, দ্বিধা কাজ করছে।লিয়ার খুব ইচ্ছে হচ্ছে এই সকল দ্বিধা কে দূরে সরিয়ে মনের ইচ্ছা কে প্রাধান্য দিতে। অবশেষে লিয়া মনের ইচ্ছে কেই জয়ী করলো।
লিয়া জারিফের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে জারিফের কাঁধের উপর মাথা রাখে।হালকা আলোতেও সেই হাসি জারিফের দৃষ্টির আড়াল হয়না।জারিফ লিয়ার পিঠের উপর দিয়ে এক হাত দিয়ে আলতোভাবে লিয়াকে জড়িয়ে নেয়।
লিয়ার কাছে এই পরিবেশ এই ক্ষণ খুব ভালো লাগছে।লিয়ার মনে হচ্ছে এই সময়টা এখানেই আঁটকে যাক।কি দরকার ভালো সময় গুলোর ইতিটানার বা পিছনে ফেলার?লিয়ার ইচ্ছে করছে বিখ্যাত সেই গানের মত বলতে,এই পথ যদি না শেষ হয়,তবে কেমন হতো তুমি বলোতো?দূরে বিদঘুটে অন্ধকারের দিকে দৃষ্টি দিয়ে লিয়া আনমনেই আওড়ায়,তবে বেশ হতো।
কিছু সময় পর নীরাবতা ভেঙ্গে লিয়া মৃদু কন্ঠে বলতে থাকে,,”ওহ্!একটা কথা শুনতে চেয়েছি মনেই ছিলো না তো।”
জারিফ ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বোঝায়,,”কি?”
লিয়া জারিফের কাঁধে মাথা রেখেই শান্ত গলায় বলে,, “আপনি তো কালকে বলেছিলেন। আপনার ফ্রেন্ড এর বিয়েতে ত্রিশালে আছেন।আবার আজকে এখানে যে।”
জারিফ লিয়ার প্রশ্ন টা বুঝতে পের মৃদু কন্ঠে বলে,,
“রোজের বাড়ি ত্রিশালে।কালকে বিয়ের সাথে গিয়েছিলাম।”
লিয়া ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,,”ওহ্।”
লিয়া রিকশা থেকে নেমে ব্লেজার টা জারিফের হাতে ধরিয়ে দেয়।তারপর নির্বিকার ভঙ্গিতে সোজাসুজি সহজভাবেই বলে,,”স্যার বাসায় আসুন। আম্মুর সাথে দেখা করে যাবেন।”
জারিফ এক হাত দিয়ে মাথা চুলকিয়ে নরম গলায় বলে,,”এখন তো রাত হয়ে গিয়েছে।আর এরকম ভাবে যাওয়াটাও ঠিক নয়।”
থেমে আবার মুচকে হেসে বলে,,”আমি তোমার বাড়িতে বর বেশে-ই যাবো।”
জারিফের হাসি দেখে লিয়া মনে মনে বলে,,”স্যারের হাসিটা খুবই অমায়িক আর কিউট।আমার মন ছুঁয়ে যায়।লিয়া এসব ভেবে আনমনেই হাসে।তারপর আবেগী গলায় বলে,,”সেই দিনের জন্য আমি ওয়েট করছি।”
লিয়া বাসায় আসতেই রাজিয়া সুলতানা লিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন,,”সব ঠিকঠাক ছিলো,কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
“না কোনো সমস্যা হয়নি।”
রাজিয়া সুলতানা নির্বিকার ভাবে বলেন,,”জারিফকে ভেতরে আসতে বলতিস?”
মায়ের কথা শুনে লিয়া কিছুটা লজ্জা পায়।লিয়া দৃষ্টি নিচু করে মৃদু আওয়াজে বলে,,”রাত হয়ে গিয়েছে তো সেইজন্য আসলো না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়েনে।”
রাতে ঘুমানোর সময় বিছানায় শুয়ে লিয়া নিজে নিজেই ভাবে।ব্যাপার টা কি?আমি প্রথমে আপুকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দেখলাম।তারপর হঠাৎই আপুকে কেমন জানি বিধ্বস্ত লাগলো।আপুর মুখটা মলিন হয়ে গেলো। পূর্ণিমার চাঁদের মধ্যে আমাবস্যা হলে যেমন হয়, ঠিক তেমন আপুও মূহূর্তেই চেন্জ হয়ে গেলো।আর আমি আপুকে কতবার বাসায় আসার কথা বললাম,আপু কিছুতেই রাজি হলো না।এর আগে তো কখনো এমন হয়নি।আর যেটুকু সময় আপু ছিলো,আমাকে কেমন জানি ইগনোর করেছে। কিন্তু কেনো?
অনেক ভাবাভাবি করেও এই কেনোর জবাব পেলো না লিয়া। অবশেষে এসব ভাবা বাদ দিয়ে ফোন টা নিয়ে জারিফের কাছে কল করে। ঠিকঠাক বাসায় পৌঁছেছে কি-না জানার জন্য।
জারিফ ফোন রিসিভ করতেই লিয়া মিষ্টি কন্ঠে বলে,,”স্যার আপনি বাসায় পৌঁছেছেন?”
জারিফ বিছানায় শুয়ে ছিলো। মাথার পাশ থেকে এক হাত দিয়ে একটা বালিশ বুকের উপর নিয়ে শীতল কন্ঠে বলে,,”হ্যা।তুমি কি করো?ঘুমাওনি এখনো?”
“এই তো ঘুমাবো। ভাবলাম জেনে নেই, আপনি বাসায় পৌঁছেছেন কি-না।”
জারিফ আবেগময় কন্ঠে বলতে থাকে,,”আজকের দিনটা আমার জন্য খুবই স্পেশাল ছিলো। আর এই স্পেশাল এর কারন তুমি।তোমাকে পাশে পেয়ে প্রতিটা মুহূর্ত আমার কাছে ছিলো সুন্দর ইনজয়েবল।তোমার সাথে কাটানো সময়ের অনুভূতি গুলো একদম আলাদা।”
লিয়া আনন্দিত গলায় বলে,,”আমারো খুব ভালো লেগেছে আপনাকে পাশে পেয়ে।”
জারিফ শান্ত গলায় বলে,,”সব কিছু ঠিক থাকলে আমরাও খুব শীঘ্রই এমন একটা পরিবেশ তৈরি করব।রোজ রুপকের মত আমরাও বিয়েটা করে নেবো।তোমাকে অনুভব এর মাত্রা দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।”
আরো কিছু সময় কথা বলে জারিফ বলে,,”তুমি নিশ্চয় টায়ার্ড।এবার ঘুমিয়ে পড়ো কেমন।”
ঝকঝকে নীল আকাশ।রৌদ্রজ্জ্বল সুন্দর একটা সকাল।তবে তাসনিম এর মন মস্তিষ্কে উজ্জ্বলতা নেই। বরং মন মস্তিষ্ক জুড়ে আছেই বিদঘুটে নিকষ কালো অন্ধকার। তাসনিম এর কাছে মনে হচ্ছে এই শহরের বাতাসে বিষাক্ততা ছেয়ে গিয়েছে।এই শহরে থাকলে ওর দম বন্ধ হয়ে যাবে।ওর জন্য এই শহরে বসবাস করাটা মুশকিল হয়ে আসছে।এখানে থাকলে প্রতিনিয়ত জারিফের কথা স্মরণ হবে।এই তো হলের জানালা দিয়ে তাকালেই বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখা যায়।যেখানে আছে অনেক স্মৃতি। চোখের সামনে ভাসে এই তো জারিফের পাশাপাশি বসে বন্ধুদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেওয়ার দৃশ্য।এসকল দৃশ্য যখনই মনের কোণে উঁকি দেয়।তখনই তাসনিম এর মনে হয় বুকের মধ্যে র’ক্ত ক্ষরণ হচ্ছে।বুকের উপর কেউ ছুরিকাঘাত করছে।তাই তো তাসনিম দেরি না করে সিদ্ধান্ত নেয় এখনই বাড়ি যাবে। তাসনিম রওনা হয় জামালপুরের উদ্দেশ্যে।
বিকেলে জারিফদের বাসায় রোহানের বাবা আর মা আসেন।ড্রয়িংরুয়ের সোফায় পাশাপাশি রোহানের বাবা মা বসে আছেন।আইনাল হোসেন সিঙ্গেল সোফায় বসে।আর জাহানারা বেগম একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। রোহানের বাবা তাদের পরিচয় দেন।
রোহানের মা গলা ঝেড়ে নরম গলায় বলেন,,”আসলে জারিফ আমাদের বাসায় মাঝে মাঝে যায়।আসতে বলে। সময় সুযোগ হয়ে উঠেনা তাই আসা হয়না।আজকে সময় পেলাম তাই চলে আসলাম।”
জাহানারা বেগম হাস্যোজ্জ্বল মুখে শান্ত গলায় বলে,,”ভালো করেছেন।”
রোহানের মা গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন,,”জারিফকে দেখছি না।বাসায় নেই। মেয়েদের কেও দেখছিনা।”
আইনাল হোসেন গম্ভীর কন্ঠে বলেন,,”জারিফ বাসায় নেই। ছোট মেয়ে কোচিং এ আছে।বড় মেয়ে রুমেই আছে।”
ভদ্র মহিলা অমায়িক হেসে বলেন,,”জারিফের থেকে মেয়েদের কথা শুনেছিলাম।দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো।”
মহিলাটি যে পরোক্ষভাবে জেরিনকে দেখার কথা বলছে তা জাহানারা বেগম আর উনার স্বামী ভালো ভাবেই বুঝতে পারছেন। জাহানারা বেগম ঠোঁট মেলে বলেন,,”আপনারা বসেন আমি জেরিন কে ডাকছি।”
মাথার উপর ওড়নাটা টেনে নিয়ে জেরিন ড্রয়িংরুমে আসে। এসে সালাম দেয়। মহিলাটি জেরিনকে ওনার পাশে বসতে বলেন।নাম,কিসে পড়ে এসব কিছু জিগ্গেস করে,আরো কিছু কথা বলে।তারপর মিষ্টি হেসে বলে তুমি ভিতরে যাও,মা।
নাস্তা করে,যাওয়ার সময়।রোহানের বাবা গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন,,”আসলে ভাইজান আমরা যে জন্য আসছিলাম।”
ভদ্র লোকের কথা শুনে আইনাল হোসেন একটু নড়েচড়ে বসেন। রোহানের মা হালকা কেশে বলতে থাকেন,,”আসলে ভাইজান আপনাদের বড় মেয়েকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে।আমার ছেলে রোহান কে তো চিনেনই।ওর তো বিসিএস লাইভ স্টোক এ চাকুরি হয়েছে।সামনের মাসে জয়েন করবে।রোহানের পোস্টিং হয়েছে মুক্তাগাছা উপজেলায়।”
আইনাল হোসেন মুখে গম্ভীরতার ছাপ টেনে নিয়ে ভরাট গলায় বলেন,,”আমি জানি।জারিফ বলেছে।”
ভদ্রলোক নির্বিকার গলায় বলেন,,”তো আপনারা চাইলে, আপনার মেয়েকে আমাদের পূত্র বধূ করতে চাই।”
আইনাল হোসেন গম্ভীরভাবে বলেন,,”এটা তো ভালো কথা।আসলে বিয়ে বিষয় তো,তাই একটু ভালো করে বুঝে নেই। তারপর নাহয় জানাবো।”
ভদ্রলোক নির্বিকার ভঙ্গিতে স্পষ্টভাবে বলেন,,”ঠিক আছে আমরা এখন উঠছি। আপনারা যাবেন। দাওয়াত দিলাম যাবেন কিন্তু।”
রাতে ডায়নিং টেবিলে বসে খাবার খাওয়ার সময় আইনাল হোসেন জারিফকে বিকেলের ঘটনা বলেন।জারিফ খাবার খেতে খেতে ভাবে,,এইজন্য সেদিন রোহান বলছিলো মেয়ে ওর দেখাই আছে।আর আমার হেল্প লাগবে।এবার বুঝতে পারছি,সেদিন এই কথা বলার কারন কি ছিলো।তবে ওর তারিফ করতে হবে,আমার বোনের জন্যই প্রস্তাব পাঠালো।ওর করা ফাজলামি সত্যি করতে চলেছে।
আইনাল হোসেন জারিফকে উদ্দেশ্য করে শান্ত গলায় বলেন,,”তা এই ব্যাপারে তোমার মতামত কি?তুমি কি বলো?”
জারিফ শান্ত গলায় বলে,,”এক কথায় যদি বলি তাহলে আমার মতামত পজেটিভ।কারন রোহান কে আমি নিজে খুব ভালো করে চিনি জানি।ছেলে হিসেবে খুব ভালো। তারপর স্টাটাস ভালো।সব শেষে আমি বলবো,জেরিনের মতামত নেওয়াটাও জরুরী।”
জেরিন দূর থেকে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিলো।জেরিনের খুব ভালো লাগছে।কিছুটা লজ্জাও লাগছে।জেরিন মনে মনে ভাবছে,সেদিনকার ঐ ছেলেটা নিজে আমাকে পছন্দ করে,আবার বাবা -মা কে দিয়ে সরাসরি প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
ঘড়ির কাঁটা রাত দশটার ঘর ছুঁই ছুঁই।সারা রুম জুড়ে নিকষ কালো অন্ধকার। রুমজুড়ে বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা।এই অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ করে ঘরে আলো জ্বলে উঠে।চোখ বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে ছিলো তাসনিম।আলো জ্বলতেই চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে তহমিনা বেগম কে।
তহমিনা বেগম খেয়াল করেছেন।আসার পর থেকেই তাসনিম কে কেমন জানি স্বাভাবিক লাগছে না।সবার চোখ ফাকি দিলেও মায়েদের চোখ ফাঁকি দেওয়া যায়না। আর কেউ বুঝুক বা না বুঝুক মায়েরা ঠিকই বুঝতে পারেন সন্তানের মনের অবস্থা। তহমিনা বেগম আন্দাজ করতে পেরেছেন কিছু একটা হয়েছে,তার জন্য তাসনিম না জানিয়েই হঠাৎ আজকে বাড়িতে চলে আসছে।আর আসার পর থেকে প্রায় সময়ই একা একা রুমে থাকছে।যদিও তাসনিম সবার থেকে একটু চুপচাপ থাকে।তারপরেও আজ যেনো একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে। তহমিনা বেগম তাসনিম এর মাথার পাশে বসে তাসনিম এর মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলে,,”তোর কি হয়েছে?আসার পর থেকেই লক্ষ্য করছি তোকে কেমন জানি ঠিক লাগছে না।”
তাসনিম মায়ের কোলের উপর মাথা দিয়ে ভেজা গলায় বলে,,”কিছু হয়নি। এমনি শরীর টা একটু খারাপ লাগছে তাই।”
তহমিনা বেগম বুঝতে পারেন,মেয়ে কিছু আড়াল করছে।তাই উনি আর জোর করে জানার জন্য কিছু বলেন না।চুলের মধ্যে বিলি কে’টে দিয়ে শান্ত গলায় বলে,,” সব সময় এক জায়গা থাকতে থাকতে মানুষ বোর হয়ে যায়।তাই বলছি যে,মাঝে মাঝে আবহাওয়া চেন্জ করা দরকার।তুই না হয় কিছুদিনের জন্য কোথাও থেকে ঘুরে আয়।তোর নানু বাড়ি বা তোর ফুপ্পির বাসা থেকে ঘুরে আয়।তাহলে দেখবি মন ভালো হয়ে যাবে।আর তোর ফুপ্পিও কত করে তোকে যেতে বলে।”
তাসনিম চোখ বন্ধ করেই ঠোঁট আওড়িয়ে বলে,,”আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।আমার ভালো লাগছে না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।তবে চল এখন খাবার খেয়ে নিবি। দুপুরে তো তেমন কিছুই খাসনি।”
তাসনিম করুণ গলায় বলে,,”আমার এখন খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না। প্লিজ, আম্মু জোর করো না। আমার এইভাবে তোমার কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে।আমাকে একটু আদর করবে আম্মু?”
তাসনিম এর কথাটা তহমিনা বেগম এর কলিজায় গিয়ে বিঁধে।ওনার বুকটা কেঁপে উঠে।উনি ভাবেন,,কত আবদার করে মেয়েটা আজকে আদর করার কথা বলছে।মেয়েটা হয়তো কোনো কষ্টের মধ্যে আছে,তাই এমন করে বলছে।কত ছোট আবদার।মেয়ের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন,হে আল্লাহ!তুমি আমার মেয়ের সকল কষ্ট দূর করে দাও।আমার মেয়ের জন্য যা উত্তম,তুমি তাই ই দিও।”
কয়েকদিন পর,,
লিয়ার ভীষণ মন খা’রাপ।যখন থেকে শুনেছে জারিফের জয়েনিং এর ডেট দিয়েছে।শুনে প্রথমে খুশি হলেও পরক্ষণে যখন শুনল যশোর ডিসি অফিসে মেজিস্ট্রেট হিসেবে সামনের মাসের এক তারিখে জয়েন করবে।
[চলবে…ইন শা আল্লাহ]