শুধু_তোমাকেই_চাই #শারমিন_হোসেন #পর্ব২৫

0
505

#শুধু_তোমাকেই_চাই
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব২৫

“ঘুটঘুটে অন্ধকারে দূরে কোন গাছে নিশাচর পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ ভেসে আসে।দূর থেকেই বেপরোয়া শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক আসতে থাকে।ব্যালকনিতে অন্ধকারে বসে আছে লিয়া।আজকে আর অন্ধকারে ভ’য় করছে না। ভ’য় করছে না দূর থেকে আসা কোনো শব্দ শুনেই।মৃদু ঠান্ডা বাতাসে শরীরের লোমকূপ শিহরিত হয়। শীত অনুভব হতে থাকে।তবুও সেদিকে লিয়ার কোনো প্রকারের ভ্রুক্ষেপ নেই। নানান কিছু ভাবনা চিন্তা করে নিয়ে অবশেষে জারিফের কাছে কল দেয়।

কালকে সকাল দশটার গাড়ির টিকিট কে’টে রেখেছে জারিফ।কালকে যশোরের উদ্দেশে রওনা দিবে।সকাল সকাল ঘুম থেকে জাগতে হবে।তাই আজকে দশটা বাজতেই ঘুমোতে যায়।এখন রাত বারোটা বাজতে চললো।ফোনের শব্দে জারিফের ঘুম ভেঙ্গে যায়।এক হাত দিয়ে বালিশের পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে নেত্র পল্লবদ্বয় টেনেটুনে তুলে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই দেখতে পায় ইংরেজিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা Liya নামটি।এই সময় লিয়ার কল দেখে ঘুমুঘুম চোখে মুখেই জারিফের মুখে এক চিলতে হাসি ফোটে।জারিফ ফোন রিসিভ করে শীতল কন্ঠে বলে,,”আমি জানি তোমার মন খা’রাপ করছে।আমার কালকে যাওয়াতে।তাই বলে কি তুমি এভাবে ঘুম বাদ দিয়ে জেগে থাকবে। ইটস্ নট ফেয়ার,লিয়া।এরকম করলে তোমার শরীর খা’রাপ হবে তো।আমি তোমাকে যেমন রেখে যাচ্ছি,এসে যেনো তেমনই দেখি।আমার জন্য হলেও নিজের যত্ন নিবে।”

এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে থামে জারিফ।জারিফের কথা শুনে লিয়ার দুচোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে নরম ফর্সা গাল বেয়ে।লিয়া কিছু না বলে নিশ্চুপ রয়।জারিফ লিয়ার টু শব্দ না পেয়ে আবার বলে,,”লিয়া,এই লিয়া।কিহলো?তুমি এখনই এরকম করলে, কিকরে হবে বলো তো?আমি ঠিকমত কাজে মন দেবো কিভাবে?প্লিজ লিয়া ছেলে মানুষি করো না।আমি দ্রুত ছুটিতে আসবো।এবার হ্যাপি।”

এবার লিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।ফোনের ওপাশ থেকে জারিফ চিন্তিত হয়ে ব্যতিব্যস্ত গলায় বলে,,”কি হয়েছে লিয়া? সামথিং হ্যাপেন্স?”

লিয়া হাতের উল্টো পাশ দিয়ে গাল বেয়ে পড়া পানি টুকু মুছে নেয়। নাক টেনে নিয়ে কান্না মিশ্রিত গলায় সবটা বলতে থাকে।এক এক করে আজকের সব ঘটনা আর অভ্র এর কথা জারিফ কে জানায়।সবটা শুনে জারিফ নিশ্চুপ হয়ে ভাবতে থাকে।লিয়া ভেজা গলায় বলতে থাকে,,”আমি এখন কি করব?বুঝতে পারছি না।স্যার আপনি কিছু একটা করে সব কিছু ঠিক করুন, প্লিজ।”

জারিফ এক হাত দিয়ে চুল গুলো মুঠো করে ঠোঁট কামড়ে ধরে কিয়ৎক্ষন ভেবে নিয়ে শান্ত গলায় বলে,,
“তুমি টেনশন করো না।আমি আছি তো। সব ঠিক হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ। কিন্তু এখানে এখন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার জয়েনিং টা।এমন ভাবে সব কিছুর টাইমিং টা হলো। আচ্ছা তুমি টেনশন করো না।আমি আমার আব্বু আম্মু কে তোমাদের বাসায় পাঠাবো।”

লিয়া ছোট করে শ্বাস নিয়ে হতাশ গলায় বলে,,”স্যার বলছি যা করার একটু দ্রুতই করুন।আমি এসব কিছু নিতে পারছিনা।আমার খুব খা’রাপ লাগছে,আর ভীষণ টেনশন হচ্ছে।”

লিয়ার কথাগুলো জারিফের মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই বুকের ভেতর থাকা চার প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট লাল যন্ত্রটা যেনো অস্বাভাবিক ভাবে সংকোচন প্রসারণ করতে থাকে।জারিফের বুকে কষ্ট হতে থাকে।লিয়ার কান্না জড়ানো কথাগুলো জারিফের হৃদয়কে আহত করছে। প্রিয় জনের কান্না সয্য করা খুবই কষ্টের।তার উপরে জারিফ এখন অত দূরে আছে,চাইলেই সহজে কাছে এসে চোখের পানি মুছে দেওয়া সম্ভব নয়।জারিফ শ্বাস টেনে নিয়ে লিয়াকে অভয় দিতে শান্ত গলায় বলে,,”বলছি তো লিয়া,তুমি টেনশন করো না।সব ঠিক হয়ে যাবে।আমার উপর তোমার বিশ্বাস নেই?”

লিয়া ছোট করে অস্ফুট স্বরে বলে,,”হুম।”

জারিফ নির্বিকার ভাবে নরম গলায় বলে,,”তাহলে এখন সব দুশচিন্তা দূর করে ঘুমিয়ে পড়ো,কেমন।”

লিয়া ঠোঁট নেড়ে বলে,,”ওকে।”

ফোন কে’টে ব্যালকনি থেকে রুমে এসে লাইট জ্বালিয়ে বিছানায় বসে লিয়া।এমন সময় রাজিয়া সুলতানা আসেন। বিভিন্ন রকমের টেনশনে ওনারো ঘুম আসছিলো না।তাই লিয়া কে দেখতে আসেন।যেমনটা ভেবেছিলেন এসে ঠিক তেমনটাই দেখলেন। লিয়া এখনো ঘুমায়নি।মেয়ের মলিন মুখটা দেখে ওনার চোখে পানি টলমল করতে থাকে। দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে লিয়ার পাশে বসে বলেন,,”চিন্তা করিস না।সব ঠিক হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ।অনেক রাত হয়েছে এবার ঘুমিয়ে পড়।তোকে এইভাবে দেখতে আমার মোটেও ভালো লাগছে না।”

লিয়া মায়ের কোলের উপর মাথা দিয়ে দুই হাতে কোমড় জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে।রাজিয়া সুলতানা লিয়ার চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন।চোখ বন্ধ করে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে লিয়া ঘুমিয়ে যায়।রাজিয়া সুলতানা লিয়ার মাথার নিচে বালিশ দিয়ে।গায়ে ব্লাঙ্কেটটা ভালো করে টেনে দেন। অতঃপর লাইট নিভিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যান।

কুয়াশাচ্ছন্ন একটি সকাল। কুয়াশা কে ভেদ করে সূর্য মামা উঁকি দিতে শুরু করেছে।ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এক হাত টাউজারের পকেটে অন্য হাতে ফোন কানে ধরে আছে জারিফ।গায়ে পাতলা ট্রিশার্ট। সকালের ঠান্ডা বাতাস গায়ে এসে পড়তেই লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠে।শীতকে উপেক্ষা করে জারিফ ব্যস্ত ফোন করতে।চোখে মুখে স্পষ্ট দুশচিন্তার ছাপ।একবার রিং হয়ে কে’টে যাওয়ার পর দ্বিতীয় বারের মাথায় ফোন রিসিভ করে ঘুমুঘুম কন্ঠে লিয়া বলে,,”হ্যা বলুন।”

লিয়ার কন্ঠস্বর শুনে জারিফের মনে শীতলতা বয়ে যায়।মনের মধ্যে প্রশান্তি হয়।তারপর ঘুমুঘুম কন্ঠ শুনে জারিফ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।মনে মনে ভাবে,যাক পাগলি টা অবশেষে ঘুমিয়ে ছিলো।আমি তো ভেবেছিলাম সারা রাত চোখের জল নাকের জল এক করে না ঘুমিয়ে থাকবে।

লিয়ার ভয়েজ জারিফের টেনশন কিছুটা হলেও হালকা করতে সক্ষম হয়।জারিফ রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি।ভোরে উঠে নামাজ আদায় করে।মায়ের কাছে লিয়ার বিষয়টা খুলে বলে।আর জারিফ আজকেই লিয়ার বাড়ি প্রস্তাব নিয়ে যেতে বলে।

জারিফ লিয়াকে বলে,আজকে ওর বাবা মা যাবে।লিয়া কথাটা শুনে খুব খুশি হয়। এরপরেও কিছুটা টেনশন রয়ে যায়।লিয়ার আব্বু সহজেই মানবে কি-না?”

লিয়া শোয়া থেকে উঠে বসে ম্লান গলায় বলে,,”আপনি আজকেই যাচ্ছেন?”

জারিফ ছোট করে বলে,,”হুম।”

কিয়ৎক্ষন পর জারিফ গম্ভীর গলায় বলে,,”তুমি চিন্তা করো না।আমি জয়েন করে দ্রুত ছুটি নিয়ে আসার চেষ্টা করবো।আর ফোনে তো সব সময় যোগাযোগ করবোই।তুমি ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করো কেমন।”

লিয়া মুখটা ম্লান করে নির্বিকার গলায় বলে,,”হুম।আপনিও বেশি টেনশন নিয়েন না। প্রথম দিন নিজেকে খুব ভালোভাবে প্রেজেন্ট করেন। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করেন।নিজের যত্ন নিয়েন।”

জারিফ শীতল কন্ঠে বলে,,”ওকে জান।লাভ ইউ সো মাচ।”

লিয়া স্মিত হেসে বলে,,”লাভ ইউ টু।”

বিকেলে জাহানারা বেগম আর আইনাল হোসেন লিয়াদের বাসায় আসেন।কয়েক রকমের মিষ্টি ফলমূল নিয়ে হাজির হন। কলিং বেলের শব্দ হওয়ায় রাজিয়া সুলতানা গিয়ে দরজা খুলে দেন।লিয়া ওর আম্মু কে বলে রেখেছিলো ওনারা আজকে আসতে পারেন।তাই দরজা খুলে নতুন কাউকে দেখে উনি আন্দাজ করেন জারিফের বাবা মা হবেন। রাজিয়া সুলতানা সালাম দিয়ে ভেতরে আসতে বলেন।আইনাল হোসেন সালামের উত্তর দিয়ে নিজেদের পরিচয় দেন।

ড্রয়িংরুমের সোফাতে বসে আছেন জারিফের বাবা মা।রাজিয়া সুলতানা জান্নাত বেগমের সাথে পরিচয় করে দেন। জান্নাত বেগম বেশ গম্ভীর মুখাবয়ব করে আছেন। ভদ্রতার খ্যাতিরে কথা বলছেন।তবে মনে মনে রাজিয়া সুলতানার উপর বেশ চটে আছেন।মনে মনে ভাবেন,,আমার ছেলের উপর দিয়ে এই মেজো বউয়ের মাতব্বরি করার স্বভাব একালে যাবে না।যেখানে স্বামী রাজি না। সেখানে এতো আদিখ্যেতা করার কি আছে। সোজাসুজি বলে দিলেই তো হয়।

মাথায় ওড়না দিয়ে হাতে করে ট্রেতে নাস্তা নিয়ে লিয়া আসে।এসে দৃষ্টি নিচু করে বড় করে মৃদু আওয়াজে সালাম দেয়।

চার আসন বিশিষ্ট সোফার পাশাপাশি জারিফের বাবা মা বসে আছেন। সিঙ্গেল সোফায় জান্নাত বেগম বসে।রাজিয়া সুলতানা শাশুড়ির একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন।

রাজিয়া সুলতানা লিয়াকে দেখিয়ে শান্ত গলায় বলেন,,”আমার মেয়ে লিয়া।আর একটা ছেলে আছে ছোট ।ছেলেটা কোচিং এ আছে।”

আইনাল হোসেন গম্ভীর কন্ঠে শুধালেন,,”ভাইজান বাসায় নেই?”

রাজিয়া সুলতানা শান্ত স্বরে বলেন,,”নাহ্।লিয়ার আব্বু বাসায় নেই।অফিসে আছে।”

জাহানারা বেগম অমায়িক হেসে লিয়াকে শুধায়,,” কিসে পড়াশুনা করো মামনি?”

লিয়া মৃদু আওয়াজে বলে,,”এইচএসসি দিয়েছি।আর প্রিপারেশন নিচ্ছি এডমিশন টেস্ট এর জন্য।”

অতঃপর লিয়া কুশলাদি বিনিময় করে ওখান থেকে প্রস্থান করে।লিয়া পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে কানটা সজাগ রাখে।

লিয়াকে দেখে লিয়ার অমায়িক ব্যবহার দেখে স্বামী স্ত্রী দুজনেরই বেশ পছন্দ হয় লিয়াকে। জাহানারা বেগম মনে মনে আওড়ায়,,আমার ছেলের পছন্দ আছে।

আইনাল হোসেন নির্বিকার ভাবে শান্ত গলায় বলেন,,”আসলে আমাদের এখানে যেজন্য আসা।আমার ছেলে জারিফ কে তো চিনেনই।জারিফ তো ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে। আগামীকাল যশোরের ডিসি অফিসে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে জয়েন করবে।জারিফকে তো দেখেছেন।আমার ছোট দুইটা মেয়ে আছে,বড় মেয়েটার বিয়ে হয়েছে।আর ছোট মেয়ে ক্লাস টেন এ পড়ে। আমি প্রাইমারি স্কুলের হেড টিচার।আমাদের ছোট খাটো নিরঝঞ্ঝাট একটা পরিবার।

একটু থেমে কিছুটা জড়তা নিয়ে বলেন,,”আপনারা রাজি থাকলে আপনাদের মেয়েকে আমার পুত্র বধূ করতে চাই।”

জান্নাত বেগম চোখ মুখ অন্ধকার করেই বসে থাকেন। রাজিয়া সুলতানা বেশ ভদ্রভাবে বলেন,,”আসলে লিয়ার আব্বু তো নেই।তাই ফাইনাল ডিসিশন আমি দিতে পারছি না।এজন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।ফোনে জানাবো ইন শা আল্লাহ।”

আইনাল হোসেন শান্ত স্বরে ছোট করে বলেন,,”ঠিক আছে।”

জাহানারা বেগম একটু নড়েচড়ে বসে আইনাল হোসেন কে উদ্দেশ্য করে বলেন,,”চলো এবার আমরা উঠি।ফোনে তো জানিয়ে দিবে।”

জারিফের বাবা মা জান্নাত বেগমকে উদ্দেশ্য করে শান্ত গলায় বলেন,,”খালা আম্মা আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগলো।কিছু হোক বা না হোক,আপনি কিন্তু একবার এই গরীবের ঘরে পদধূলি দিবেন।আমাদের বাসায় বেড়াতে যাবেন কিন্তু।আপনি গুরুজন, দোয়া করবেন আমাদের সবার জন্য।”

অমায়িক আচরণ, নির্মল ব্যবহার দেখে জান্নাত বেগমের মনটা একটু নরম হয়।মনে মনে ভাবেন,,বাবা মায়ের ব্যবহার তো খুবই অমায়িক।ছেলেটারো ব্যবহার তো দেখেছি খুবই ভদ্র।

রাজিয়া সুলতানা কে উদ্দেশ্য করে যাওয়ার জন্য অনেক করে বলেন।রাজিয়া সুলতানা স্মিত হেসে নরম স্বরে বলেন,,”আসলে জারিফকে তো আমি চিনিই।জারিফকে আমার খুব পছন্দ।আর আপনাদের সাথে পরিচয় হয়ে আমার আরো ভীষণ ভালো লাগছে।আমার তো ইচ্ছে করছে কালকেই যেতে। আল্লাহ তায়ালা চাইলে নিশ্চয়ই যাবো।”

রাজিয়া সুলতানা অতঃপর লিয়া কে ডাকেন।লিয়া আসতেই জাহানারা বেগম লিয়ার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে মৃদু আওয়াজে বলেন,,”মামনি থাকো।”

জারিফের বাবা মা বাসায় যেতেই। জাহানারা বেগম কে উদ্দেশ্য করে জারা হাস্যোজ্জ্বল মুখে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে,,”আম্মু ভাবিকে কেমন দেখলে?দেখতে কেমন?ভাইয়ার সাথে মানাবে তো?”

মেয়ের কথা শুনে জাহানারা বেগমের কপাল কুঞ্চিত হয়। জাহানারা বেগম দৃষ্টি সরু করে কঠোরভাবে বলেন,,”আহ্। মাত্রই আসলাম আর এখনই এক সাথে এত প্রশ্ন করছিস।একসাথে এত প্রশ্ন করলে কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দেবো শুনি?”

জারা ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,,”সেইজন্য তোমাদের সাথে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমরা তো নিলে না আমাকে।নিজে চোখে দেখলে তো আর প্রশ্ন করতাম না।”

জাহানারা বেগম হাসি মুখে বলেন,,”মেয়ে দেখতে শুনতে মাশআল্লাহ।আর জারিফের সাথে মানাবে ভালো।তবে

জাহানারা বেগম থেমে যান।জারা ইশারায় বলে “তবে কি”

জাহানারা বেগম ছোট করে শ্বাস নিয়ে হতাশ গলায় বলেন,,”তারা এখনো ফাইনাল ডিসিশন জানায়নি।ফোন করে পড়ে জানাবে বলেছেন।”

কথাটা শুনে জারার উজ্জ্বল মুখটা কিছুটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।তারপর কিছু একটা ভেবে জারা গমগমে স্বরে বলে,,”দেখো ঠিক পজেটিভ মতামত দিবে।কারন আমার ভাইয়ার মত এত ভালো পাত্র কেউ হাতছাড়া করবে নাকি?আমার ভাইয়া সব দিক দিয়েই একদম পারফেক্ট।”

জাহানারা বেগম মনে মনে আওড়ায়,,”পজেটিভ মতামত দিলেই ভালো।ছেলেটা আমার নিজে থেকে পছন্দ করেছে।”

সন্ধ্যায় ড্রয়িংরুমের বসে আছেন জান্নাত বেগম, এনামুল খাঁন। রাজিয়া সুলতানা এক কাপ চা শাশুড়ির হাতে দেন।আরেক মগ কফি লিয়ার বাবার হাতে দেন। পিনপতন নীরবতা বইছে, অবশেষে নীরাবতা ভেঙ্গে রাজিয়া সুলতানা এক পাশে বসে শুকনো ঢোক গিলে নিয়ে কিছুটা জড়ানো গলায় বলেন,,”জারিফের বাবা মা আসছিলেন।”

বাক্যটা কর্ণগোচর হতেই এনামুল খানের কপালে ভাঁজ পড়ে।উনি মনে মনে আওড়ায় লিয়াকে তো কালকে ওর আম্মু আমার মতামত জানিয়ে দিয়েছে।তারপরেও লিয়া জারিফের সাথে যোগাযোগ করেছে।মেয়েটা এইভাবে আমার সিদ্ধান্তের বাইরে যাবে,তা আমি কোনোদিন ধারনাও করি নাই।জারিফের বাবা মা কিজন্য আসছিলো তা এনামুল খাঁন বুঝতে পারেন।তাই সেই প্রশ্ন না করে সরাসরি রাজিয়া সুলতানা কে উদ্দেশ্য করে স্পষ্ট স্বরে শুধালেন,,”তা তুমি কি বলেছো?”

রাজিয়া সুলতানা নির্বিকার গলায় বলেন,,”আমি বলেছি তুমি বাসায় নেই। সেইজন্য তেমন কিছু বলতে পারিনি।বলেছি পড়ে ফোনে জানিয়ে দেওয়া হবে।”

কফির মগে চুমুক দিয়ে এনামুল খাঁন বলেন,,”আর ফোন দেওয়ার প্রয়োজন নেই।বাদ দেও এসব।”

জান্নাত বেগম কিছু একটা ভেবে বেশ শান্ত গলায় বলেন,,”দেখ মেজো খোকা বলছি যে,একটু ভেবে দেখ। ওদের হয়ত প্রচুর পরিমাণে অর্থ সম্পদ নেই। কিন্তু দেখে যা বুঝলাম বেশ ভদ্র আর ভালো মনের মানুষ।এখন তো নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ পাওয়া দায়।সেইজন্যই আমি বলছি একটু চিন্তা ভাবনা করে দেখলে হয় না।”

এনামুল খাঁন কফির মগ টা নামিয়ে রেখে গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন,,”আসলে মা আমি বলছি না তো ওনারা মানুষ ভালো নয় হেন তেন।আমি আগে থেকে অভ্র আর ওর বাবার কাছে কিছুটা হলেও কমিটমেন্টে আছি।আর ওদের সাথে আমার একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।আমি চাচ্ছি না সম্পর্কটা ভাঙ্গতে।আর লিয়া ছোট ও এখন ওর আবেগ দিয়ে ভাবছে।বিয়ে হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। অভ্রদের পরিবেশ লিয়ার কাছে খুব ভালো লাগবে আমি আশাকরি।আর মা তুমি লিয়াকে একটু বোঝাও।আর জারিফের বিষয়টা বাদ দেও।”

শেষের কথাটা শুনে রাজিয়া সুলতানা বেশ আহত হন। স্বামীর মুখের উপর আর কিছু বলার সাহস হয় না। শুধু সাহসই নয় ওনার ইচ্ছেও হয়না জোর করে কিছু বলার।কারন রাজিয়া সুলতানা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন অভ্র এমন করে ওনার স্বামীর মন জয় করে নিয়েছেন যে,সেখানে অন্য কারো জায়গা আপাতত সম্ভব নয়।আর উনার স্বামী একবার যখন একজন কে ওয়ার্ড দিয়েছেন সেই ওয়ার্ড রাখতে তিনি সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করবেন।

পড়ার টেবিলের উপর মাথা দিয়ে চেয়ারে বসে আছে লিয়া।গায়ে একটা শাল চাদর জড়ানো। চিন্তা করছে ওর আব্বু কি বলবে?এমন সময় কাঁধের উপর কারো স্পর্শ পেয়ে মাথা তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে রাজিয়া সুলতানা কে দেখতে পায়।লিয়ার উৎসুক চোখ মুখ দেখেই রাজিয়া সুলতানা বুঝতে পারেন মেয়ের চোখ মুখে এখন একটা প্রশ্নই শুধু।সেটা হলো “আব্বু কি বলেছে?”

রাজিয়া সুলতানা নিরস গলায় বলেন,,”লিয়া তোর আব্বু বরাবরের মতই নেগেটিভ মতামত দিয়েছে।”

মায়ের কথাটি শুনে লিয়ার ছোট্ট হৃদয় টা আহত হয়।লিয়া আহত দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে রয় নির্বিকার ভঙ্গিতে বাক শুণ্য হয়ে।রাজিয়া সুলতানা লিয়াকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,,”তুই চিন্তা করিস না।আমার মনে হয় একটু সময়ের প্রয়োজন।সময় গেলে আপনা আপনি তোর আব্বু হয়তো ডিসিশন টা চেঞ্জ করতেও পারে।এখনই এত ভেঙ্গে পড়িস না।আমি আছি তো, তোর আব্বু কে কনভিন্স করবো।তবে এখনই নয় ধীরে ধীরে করতে হবে।এখনই যদি পেশার দেই,তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে।”

জারিফ যশোরে পৌঁছেছে সন্ধ্যার দিকেই। অফিসার্স দের থাকার জন্য ডরমেটরিতে উঠেছে জারিফ।জারিফ ফ্রেশ হয়ে বেডে বসতেই লিয়ার ফোন আসে। রিসিভ করার সাথে সাথেই ফোনের ওপাশ থেকে জড়ানো গলায় লিয়া শুধায়,,”স্যার পৌঁছেছেন?”

জারিফ ছোট করে উত্তর দেয়,,”হুম”

লিয়া গম্ভীর কন্ঠে বলে,”বিকেলে আন্টি আঙ্কেল আসছিলো।”

“আমি জানি। আম্মু ফোন করে বলেছে। আঙ্কেল বাসায় আসছেন?না মানে আন্টি না-কি বলেছেন ফোনে জানানো হবে।”

লিয়া ছোট করে শ্বাস টেনে নিয়ে মনে মনে আওড়ায়,আমার ইচ্ছে করছে না নেগেটিভ কথা আপনাকে জানাতে। কিন্তু কি করবো?আমাকে সবটা স্যারকে জানাতেই হবে।স্যারকে কিছু করে এই নেগেটিভ কে পজেটিভ করতে হবে। করতে তো হবেই এখানে আমাদের দুজনের জীবন জড়িত।

এসব ভাবনা মনের মধ্যে রেখে লিয়া আহত গলায় বলে,,”স্যার আব্বু রাজি হচ্ছে না।তবে আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো।”

জারিফ ফাইভ সেকেন্ড ভেবে নিয়ে শান্ত গলায় বলে,,”দেখো লিয়া আমার জন্য যতটুকু করার আমি তো করলাম,বাবা মা কে পাঠানো হলো।আর আমি তোমাকে কখনো ওরকম বলবো না,তুমি সব কিছু ছেড়ে চলে আসো।পালিয়ে,লুকিয়ে,চুরিয়ে আমি কখনো কিছু করতে পছন্দ করি না,এটা ঠিকও নয় ।এটা আমার ইথিকস।তোমার বাবা মা রাজি না

জারিফকে থামিয়ে দিয়ে লিয়া বলে,,”আম্মু নয়। আম্মু পজেটিভ,শুধু আব্বুর কথা বলুন।”

জারিফ গম্ভীরভাবে বলে,,”আমি আমার দিক হতে হার্ট এন্ড সোল ট্রাই করবো তোমার আব্বু কে কনভিন্স করতে।তুমি চিন্তা করো না,আমি খুব দ্রুতই আসার ট্রাই করবো।আর এসে আমি সরাসরি আঙ্কেল এর সাথে কথা বলবো। তারপরেও যদি উনি রাজি না হন,তখন আমি অন্য কিছু ভাববো,এর আগে নয়।”

“ঠিক আছে।”

কিছু সময় থেমে লিয়া ম্লান স্বরে বলে,,”খাওয়া দাওয়া করেছেন।”

“নাহ্। মাত্রই রুমে এসে ফ্রেশ হলাম। তুমি নিজের যত্ন নিও।আর একদম টেনশন করো না।”

“আচ্ছা।খাবার খেয়ে নিন।”

“ওকে।টেক কেয়ার।বাই।”

পরের দিন সকালে,,

খাওয়ার টেবিলে বসে এনামুল খাঁন বলেন,,”সকালে অভ্রর বাবা ফোন দিয়েছিলো।অবশ্য ফোন দেওয়ার কারন হলো, গতকাল রাতে আমি ওনাকে বলেছিলাম বিয়েটা দ্রুতই দিতে চাই। আগে বলেছিলাম তাসনিম এর বিয়ের পর। কিন্তু এখন পরিস্থিতি দেখে সেই সিদ্ধান্ত চেন্জ করেছি।তো এসব কথা রেখে মূল পয়েন্টে আসি।

রাজিয়া সুলতানা কে উদ্দেশ্য করে এনামুল খাঁন বলেন,,”অভ্রর বাবা মা আজ সন্ধ্যায় আসছেন লিয়াকে দেখতে।আর অভ্রর যেহেতু লিয়াকে পছন্দ তাই ওনারা নিশ্চয় দ্বিমত করবেন না।তা তো বুঝতেই পারছো। অভ্রর মায়ের না-কি ইচ্ছা শুধু দেখতে উনি আসবেন না।একবারে রিং পড়ানোর প্রস্তুতি নিয়ে আসবেন।তো তোমাকে বলছি,লিয়াকে সেইভাবে প্রস্তুত থাকতে বলো।আর তোমাকে বলছি,মা মেয়ে এমন কিছু করবেনা যাতে আমার অসম্মান হয়।সো,বি কেয়ারফুল।”

রাজিয়া সুলতানা বাকশূন্য হয়ে অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।লিয়া ডায়নিং এ আসতে গিয়ে শেষের কথাগুলো শুনতে পায়।লিয়ার কাছে মনে হচ্ছে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছে।চারিপাশটা ঘুরতে শুরু করেছে।

[চলবে…ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here