#শুধু_তোমাকেই_চাই
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব২৭
“পড়ন্ত বিকেল। সূর্যের প্রখরতা নেই,নিভু নিভু আলোয় ছেয়ে আছে ধরনীর চারিদিকে। পশ্চিম আকাশে সূর্য টা লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে। ঝিরিঝিরি মৃদু ঠান্ডা বাতাস বইছে।পাখিরা তাদের নীড়ে ফিরতে ব্যস্ত।আরিয়ানের ছোট্ট হাতটি ধরে তাসনিম ধীর পায়ে হেঁটে বাসায় এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। তাসনিম এর হাত ছাড়া পেয়ে আরিয়ান এক দৌড়ে এলোমেলো পা ফেলে ধপধপ করে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো।আরিয়ানের যাওয়ার পানে চেয়ে তাসনিম স্মিত হাসে।রুমে ভালো লাগছিলো না,আরিয়ান কে সাথে নিয়ে বাগানে হাঁটতে বেড়িয়ে ছিলো।আরিয়ানের আধো বলা কথাগুলো তাসনিম এর খুব ভালো লাগে।বাইরে থাকাকালীন আরিয়ান পাখি দেখিয়ে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলছিলো পাকি,পাকি।আবার ফুল দেখিয়ে পুল। নিষ্পাপ বাচ্চাদের মুখ নিঃসৃত প্রতিটি বাক্যই আসলে শুনতে সুমধুর লাগে। তাসনিম সিড়িতে পা দিতে যাবে এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠে।
বেলের শব্দ কর্ণগোচর হওয়ার সাথে সাথেই তাসনিম বাড়ানো পা থামিয়ে দেয়।আর দরজা খুলতে যায়। দরজা খুলে এই সময় আতিকা বেগম কে দেখে তাসনিম অবাক হয়।অবাক কন্ঠে তাসনিম বলে,,
“ফুপ্পি তুমি?তুমি হঠাৎ না বলে এই সময়।”
আতিকা বেগম একগাল হেসে বলেন,,”আমার আসায় খুশি হোসনি?”
তাসনিম ঠোঁট মেলে বলে,,”খুব খুশি হয়েছি।এই তো একটু আগেই বাইরে হাঁটাহাঁটি করার সময় তোমার কথাই ভাবছিলাম।”
তাসনিম আতিকা বেগমের হাত থেকে ফলমূল আর মিষ্টির প্যাকেট গুলো হাতে নেয়।আতিকা বেগম ভেতরে আসতে আসতে ঠোঁট প্রসারিত করে বলেন,,”দেখো মেয়ের চিন্তার সাথে আমার কত মিল।মেয়ের সাথে তো আমার আত্মার টান হয়েছে দেখছি।আমার এবারের আসাটা কিন্তু তোর জন্যই।”
আতিকা বেগমের শেষের কথা শুনে তাসনিম এর কপালে বেশ কিছু ভাঁজ পড়ে। দৃষ্টি সরু করে ঠোঁট কামড়ে কথাটার মিনিং বোঝার চেষ্টা করে। কিয়ৎক্ষন ভেবে নিয়েও তাসনিম ফেইলুর হয় কথাটা বুঝতে।আতিকা বেগম গলা ঝেড়ে শুধালেন,,
“তোর আম্মু কই?তোর দাদিমনি আসছে কি?”
তাসনিম প্রতি উত্তরে বলে,,”আম্মু উপরে আছে।আর দাদি মনি আজকে দুপুরেই আসছে।ছোট চাচ্চু নিয়ে আসছে।”
আতিকা বেগম গম্ভীর কন্ঠে বলেন,,”ওহ্।ভালো হয়েছে।আমিই অবশ্য মইনুল কে বলেছিলাম মাকে আনতে যাওয়ার কথা।”
তাসনিম ভ্রু কুঁচকে বলে,,”তারমানে ছোট চাচ্চু জানতো তোমার আসার কথা?”
আতিকা বেগম প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান ব্যস্ত গলায় বলেন,,”আমি ফ্রেশ হয়ে নেই মামনি।পরে কথা বলবো।”
আতিকা বেগম গেস্ট রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে বিছানায় বসতেই তহমিনা বেগম আসেন। বিভিন্ন কথার শেষে তহমিনা বেগম মুখটা ফ্যাকাশে করে হতাশ গলায় বলেন,,”জানো আপা তাসনিম এর না কিছু একটা হয়েছে আমার মনে হয়।কারন মেয়েটাকে কেমন যেনো বিষন্ন দেখা যায়।সব সময় রুমেই থাকে।কারো সাথেই মিশতে চায় না।আমি ওকে প্রশ্ন করলে ও এড়িয়ে যায়। সেইজন্য আমি আর ওকে জোর করিনা।মেয়েটা আমার খুব আদরের ওর মলিন মুখ দেখতে আমার একদম ভালো লাগছে না।”
আতিকা বেগম নির্বিকার কন্ঠে বলেন,,”তুমি চিন্তা করো না।আমি আসছি তাসনিম এর সাথে কথা বলবো।আর আমার এবারের আসার পিছনে একটা কারন আছে।মূলত তাসনিম এর জন্যই আসা।ভাই আসুক ভাইয়ের সাথে কথা বলবো।”
রাতে ডায়নিং টেবিলে বসে খাবার খাওয়ার সময় আতিকা বেগম সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে কোনো প্রকারের ভনিতা ছাড়াই সোজাসুজি স্পষ্টভাবে বলেন,,”আমার একটা মাত্র ছেলে।আমার ছেলের জন্য একটা ভালো মনের মেয়ে চাচ্ছি।যাকে আমি পুত্র বধূ করবো।অবশ্য মেয়ে দেখাই আছে।মেয়ে আমার খুব পছন্দের।”
কথাটা শুনে উপস্থিত সকলে চোখে মুখে উৎসুকতা নিয়ে আতিকা বেগমের পানে চেয়ে থাকে।মেয়েটা কে?বাড়ি কোথায়?তবে জান্নাত বেগম আর ওনার ছোটো ছেলে বাদে।কারন ওনারা দুজন মনে হয় জানেন বিষয়টা মুখাবয়ব দেখে সেটা বোঝা যাচ্ছে। তহমিনা বেগমও কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন।তুলি,তুষার খাবার খাওয়া বাদ দিয়ে ফুপ্পির পছন্দের মেয়ে কে তা জানার জন্য আকাশসম আগ্রহ নিয়ে আছে। তাসনিম নির্বিকার আছে।শোনার প্রতি কোনো ইন্টারেস্টড হচ্ছে না,আর না দেখাচ্ছে।
তুলি একরাশ উৎসুকতা নিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে শুধায়,,
“ফুপ্পি মেয়েটা কে?কেমন দেখতে?”
আতিকা বেগম স্মিত হেসে তাসনিম এর বাবাকে উদ্দেশ্য করে শান্ত গলায় বলেন,,”ভাই তুমি যদি রাজি থাকো তবে আমি তাসনিম কে আমার আলিফের বউ করে নিতে চাই।”
কথাটা শুনে তাসনিম এর গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইছে না। তাসনিম মুখে থাকা খাবার টুকু অনেক কষ্টে গলাধঃকরণ করে।সহজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে আসতে পারছে না।ভাতের প্লেটে খাবার নেড়ে যাচ্ছে আর অস্বস্তি হচ্ছে। তাসনিম এর বাবা গম্ভীর গলায় বলেন,,”এতো খুব ভালো কথা।আলিফ ছেলে হিসেবে এক কথায় পারফেক্ট।আর আমাদের নিজেদের মধ্যে হলে,মানিয়ে নেওয়ারো কোনো ঝামেলা থাকবে না।সব দিক দিয়ে চিন্তা করলেই দেখা যায় খুব ভালো সিদ্ধান্ত এটা।”
তহমিনা বেগম নিজেও খুব খুশি হয়েছেন।তারপরেও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলেন,,”এরকমটা হলে তো খুবই ভালো।তারপরেও তাসনিম এর মতামত নেওয়া টাও জরুরী।”
আতিকা বেগম দ্রুত বলে উঠেন,,”হুম।সেটা তো অবশ্যই নিতে হবে।”
তাসনিম দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু আওয়াজে বলে,,”আমার খাওয়া শেষ।”
কথাটি শেষ করেই দ্রুত ডায়নিং থেকে প্রস্থান করে। উপস্থিত সবাই ভাবে তাসনিম হয়তো লজ্জা পেয়ে চলে যায়। জান্নাত বেগম তহমিনা বেগম কে উদ্দেশ্য করে দৃঢ় কন্ঠে বলেন,,”বড় বৌমা তুমি মেয়ের থেকে মতামত জেনে নিও।পাছে যাতে আর কোনো সমস্যা না হয়।এমনি ওদিকে আরেক সমস্যা
এতটুকু বলে জান্নাত বেগম থেমে যান।
রুম জুড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।হালকা নিয়ন আলোর ডিম লাইট জ্বলে আছে। তাসনিম বালিশের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে বিভিন্ন চিন্তা ভাবনা করতে থাকে। তাসনিম ভাবে, শুনেছিলাম বাস্তবতা বড় কঠিন হয়।এখন দেখছি শুধু কঠিন ই নয় বড় নিষ্ঠুর ও হয়।যদি কিছু স্মৃতি মুছে ফেলা যেতো,তাহলে এই পৃথিবীতে কেউ কখনো আত্ম”হ”ত্যা করতো না।তবে আমি আমার আহরিত নলেজ দিয়ে বলবো, সময় যত খা’রাপই হোক বা যত দুঃখ কষ্টই থাক না কেনো।তার জন্য নিজেকে শেষ করে দেওয়া বড্ড বোকামি।সময় যেমন থেমে থাকে না।তেমনি জীবনও থেমে থাকে না।জীবনও চড়াই উতরাই পেরিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে।কারো জন্য জীবন থেমে রাখা উচিত নয়।ভাগ্যকে মেনে নিতে হয়।আর ভাগ্য সেতো নিজ হাতে গড়া নয়,যে মন মতো হবে।আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি।জারিফ কখনো আমার ছিলো না।তাই তাকে পাওয়ার আশা করাটা আমার চরম বোকামি ছিলো।আর এখন জারিফকে নিয়ে এক সেকেন্ড ভাবা আমার জন্য পাপ আমি মনে করি।কারন আমার ছোটো বোনের সাথে জারিফ জড়িত।আমার উচিত যত দ্রুত সম্ভব জারিফের প্রতি আমার যে ভালোলাগা আছে তা দূর করা ।আর আমাকে গ্রো আপ করা।হয়তো সময় লাগবে তারপরেও আমি গ্রো আপ করবো।আর যে আমাকে সত্যিই ভালোবাসে তাকে দূরে ঠেলে দেওয়া আমার উচিত হবে না আলিফ ভাইয়া আমার উপর দূর্বলতা ফিল করে এমনকি বারবার প্রকাশ-ও করেছেন।আর আমি হয়তো বেটার কাউকে খুঁজতে বেস্টটাকে গুরুত্ব দেয়নি। প্লেস্যান্ট পার্সোনালিটি সম্পন্ন একজন ভালো মনের মানুষ আলিফ ভাইয়া।
তাসনিম এর ভাবনার মাঝেই তহমিনা বেগম আসেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু আওয়াজে শুধালেন,,
“তাসনিম ঘুমিয়ে পড়েছিস?”
তাসনিম সোজা হয়ে বসতে বসতেই বলে,,”নাহ্ আম্মু।আসো।”
তহমিনা বেগম বিছানায় তাসনিম এর এক পাশে বসে গলা ঝেড়ে শান্ত স্বরে বলেন,,”দেখ মা আদিকাল থেকেই চলে আসছে মেয়েরা ঘর সংসার নিয়ে জীবন কাটায়।এদিকে তোর পড়াশোনাও শেষের দিকে।আমার মনে হয়,আর বসে না থেকে এবার বিয়ে শাদি করে নেওয়াই ভালো হবে।তোর ফুপ্পির কথা তো সব শুনলি?তোর মতামত কি?তোর কি নিজস্ব কোনো পছন্দ আছে?থাকলে নির্দ্বিধায় আমাকে বলতে পারিস।”
তাসনিম মাথাটা নিচু করে মায়ের বলা প্রত্যেকটা কথা শ্রবণ করে। তাসনিম মনে মনে আওড়ায়,আমি যাকে পছন্দ করি।সেই কথাটা না সে জানবে আর না অন্য কাউকে কোনোদিন জানতে দেবো। পছন্দ করি শব্দ টাকে পেসেন্ট না রেখে আমাকে খুব দ্রুতই পাস্ট করতে হবে।
তাসনিম মনে মনেই মাথা ঝাড়া দিয়ে মৃদু আওয়াজে বলে,,”নাহ্।তেমন কিছু নেই।তোমরা আগাতে পারো।”
তহমিনা বেগম মনে মনে মহান রবের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।হাসি মুখে মায়া জড়ানো গলায় বলেন,,”ঠিক আছে।রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়।”
পরের দিন,,,,
ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যা সাতটার ঘরে। তাসনিম ওর রুমে বসেছিলো।এমন সময় তুলি এসে চোখে মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে,,”আ্যই আপু জানিস।”
তাসনিম কপাল কুঁচকে তুলির দিকে তাকিয়ে রয়।তুলির ফেস দেখে মনে হচ্ছে নিশ্চয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানাতে এসেছে।আর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা তাসনিম এর জন্য জানাটা খুবই জরুরী। তাসনিম ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বোঝায় “কি?”
তুলি আরেকটু ভালো করে বসে দাঁত কেলিয়ে বলে,,”আলিফ ভাইয়া এসেছে।”
তাসনিম ভাবলেশহীন ভাবে নির্বিকার গলায় বলে,,
“জানি তো।”
তুলি অবাক হয়ে শুধায়,,”তুই জানিস?কিকরে?কারন মাত্রই তো ভাইয়া আসলো। তোর সাথে দেখা হলো কখন?”
তাসনিম বিরক্ত মিশ্রিত গলায় বলে,,”ফুপ্পি বলে ছিলো।আলিফ ভাইয়া ফুপ্পি কে নিতে আসছে। সন্ধ্যায় আসবে বলেছিলো, সেইজন্য বললাম জানি তো।”
তুলি ঠোঁট নেড়ে বলে,,”ওহ্।”
কিছু একটা ভেবে তুলি গমগমে স্বরে বলে,,”তুই খুব বোকা আপু।যদিও বলছে ফুপ্পি কে নিতে এসেছে।আমার মনে হয় এটা একটা অজুহাত মাত্র।কারন ভাইয়া ওনার হবু বউকে দেখার জন্য এসেছেন।কি বলিস তুই?আর ভাইয়া কিন্তু কৌশলে তোর জয়েনিং এর কজ দেখিয়ে বিয়ের ডেটটা এত তাড়াতাড়ি দিয়েছে।এসব কিছু ফুপ্পি বললেও।কথা গুলো কিন্তু ভাইয়ারই।আমি জানি।তোর কি মনে হয়?”
তাসনিম চোখ রাঙিয়ে মৃদু রা’গ দেখিয়ে বলে,,”জানি না আমি।”
তুলি কপাল কুঁচকে মৃদু কন্ঠে বলে,,”আমার না,আলিফ ভাইয়াকে দেখে কেমন জানি লজ্জা পাচ্ছিলো।আমার জিজু হবেন উনি সেইজন্য।তবে আজকে ভাইয়াকে দেখেই আমার মনে জিজু জিজু ফিলিংস এসেছে।আর তোর তো মনে হয় ভাইয়াকে দেখেই বর বর ফিলিংস আসবে।”
তাসনিম চোখে মুখে বিরক্তিকর ছাপ নিয়ে ধমকের সুরে বলে,,”তুই যাবি এখান থেকে।তখন থেকে আজাইরা কথাবার্তা বলেই চলছে।”
তুলি মুখটা মলিন করে ম্লান কন্ঠে বলে,,”আমি তোর আর আলিফ ভাইয়ার বিয়ের কথাটা লিয়াকে জানানোর জন্য সেই বিকেল থেকে লিয়ার কাছে ফোন দিচ্ছি বাট ফোন সুইচড অফ বলছে।”
লিয়ার নামটা শুনতেই তাসনিমের মন বিষাদে ছেয়ে যায়।কারন লিয়ার কথা শুনলেই অটোমেটিকলি জারিফের কথা মনে পড়ে যায়।লিয়া আর জারিফের পাশাপাশি হাত ধরে থাকার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে আসে। লিয়াকে উদ্দেশ্য করে সবার সামনে জারিফের বলা কথাগুলো বারবার কানে বাজতে থাকে।না চাওয়া সত্বেও তাসনিম এর মন জুড়ে বিষন্নতায় ছেয়ে যায়।বুকের মধ্যে কষ্ট হতে থাকে।
রাতে ডায়নিং টেবিলে বসে এনামুল খাঁন খাবার খেতে খেতে বলেন,,”তাসনিম আর আলিফের বিয়ে এই শুক্রবারে।”
কথাটা শুনে রাজিয়া সুলতানা সহ চেয়ারে বসা লিয়াও বেশ অবাক হয়।লিয়া মনে মনে ভাবে বিয়ে ঠিক আছে।তবে হঠাৎ করেই এত তাড়াতাড়ি যে ডেট।
রাজিয়া সুলতানা বলেন,,”এত তাড়াতাড়িই যে বিয়ের ডেট।না মানে আগে কখনো এই সমন্ধে শুনিনি তাই বলছি।”
এনামুল খাঁন খাবার চিবুতে চিবুতেই বলে,,”তাসনিম এর জয়েনিং এর আগেই বিয়েটা দিতে চায় আপা।আর ওর পোস্টিং যেহেতু ঢাকাতেই হয়েছে সেইজন্য ভালো হবে।”
রাজিয়া সুলতানা ছোট করে বলেন,,”ওহ্।”
এনামুল খাঁন গম্ভীর কন্ঠে বলেন,,”সবাই তো আর তোমার আর তোমার মেয়ের মত নয়যে।মন যা চাইবে তাই করবে,ইচ্ছে হলো না মান সম্মানের কথা না ভেবে মর্জিমত কাজ করবে।”
রাজিয়া সুলতানা বেশ বুঝতে পারেন অভ্র এর সাথে লিয়ার বিয়ে দেওয়া নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। সেই খোঁটা টা এখন তাকে দিলেন।লিয়া মাথাটা নিচু করে হাত দিয়ে ভাত নেড়ে যাচ্ছে শুধু।
এনামুল খাঁন দৃঢ় কন্ঠে বলেন,,”লিয়া তোমার উচিত,তোমার বড় বোনের থেকে আদব কায়দা শেখা।বাবা মা ভালোর জন্য যা করছে, তাসনিম নির্দ্বিধায় একবাক্যে সেটা মেনে নিচ্ছে।তুমিও কিন্তু একই পরিবারের মেয়ে।তোমার শিক্ষাও এমন হওয়া উচিত।”
কিয়ৎক্ষন থেমে আবার বলেন,,”আমরা দুই এক দিনের মধ্যেই বাড়ি যাচ্ছি।সেইভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখো।”
রাহবার আনন্দিত কন্ঠে বলে,,”ইয়াহু!কি মজা হবে বাড়ি যাবো।আরো বেশি মজা হবে আপুর বিয়েতে।”
রাত দশটা পার।বই সামনে নিয়ে বসে আছে লিয়া। দৃষ্টি বইয়ে থাকলেও মন নেই। বিষন্ন মন নিয়ে পড়ার টেবিলে বসে জারিফের কথা স্মরণ করতে থাকে।লিয়া মনে মনে ভাবে,, প্রতিটি সেকেন্ড যাচ্ছে আর আমি ভাবছি, হঠাৎ করেই আপনি চলে আসবেন।আমার সাথে কথা বলতে না পেরে আপনি হয়তো উন্মাদের মতো ছুটে আসবেন আমাকে দেখতে। আপনার কি জানতে ইচ্ছে করছে না? আপনার সাথে কথা না বলতে পেরে আমি কতটা কষ্টের মধ্যে আছি? সমুদ্রের অথৈ কষ্টে নিমজ্জিত হয়ে আছি আমি।না পারছি এই নিমজ্জিত দশা থেকে চিরতরে মুক্তি পেতে আর না পারছি ঠিকঠাক বেঁচে থাকতে।সময়ের সাথে সাথে কষ্টের পরিমাণ টাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।আপনি কেনো এখনো আসছেন না?
লিয়া হতাশ মন নিয়ে ভাবে,আমি আকাশ থেকে টুপ করে পড়িনি।মাটি ফেটেও হয়নি আবার গাছেও ধরিনি।আমার এত বড় হওয়ার পিছনে আমার আব্বুর অবদান অনস্বীকার্য।সব সময় চাওয়ার আগেই আমার আব্বু সব কিছু দিয়েছেন।আমার পরিবার তো আমার কাছ থেকে কিছু এক্সপেক্ট করতেই পারে।আমি বারবার তাদের হতাশ করতে পারিনা।স্যার আপনি দ্রুত আসুন।আর সব কিছু ঠিক করে আমাকে নিজের করে নিন।
রাতে সবার সাথে ডিনার করতে বসে তাসনিম।এমন সময় আলিফ এসে আড়চোখে তাসনিম এর দিকে তাকিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ে।আলিফকে দেখে তাসনিম এর অস্বস্তি হতে থাকে। তাসনিম এর সামনা-সামনি চেয়ারে আলিফ বসেছে। তাসনিম মাথা নিচু করেই আছে।তবুও তাসনিম এর সিক্স সেন্স বলছে আলিফ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।আলিফ বাকিদের সাথে স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছে। তহমিনা বেগম আর রুমানা বেগম আলিফকে খাবার দিতে খুব ব্যস্ত।কোন পদ রেখে কোনটা দিবেন ভেবে পাচ্ছেন না।খাবার খেতে খেতে আলিফ মনে মনে আওড়ায়,, এবার তো মনে হচ্ছে দুই মামিই একটু বেশিই আদর করছে।মনে হচ্ছে বিয়ে করার আগেই জামাই আদর পাচ্ছি।আর এবারের আসায় কেমন যেনো জামাই জামাই ফিলিংস পাচ্ছি।আর আমার হবু বউ তো মাথা ডুবিয়ে রেখেছে প্লেটে। যদি খাবার খেতো তাও হতো।একবার মুখে পুরা খাবার নিয়েই ক্লান্ত সে।আমি এখানে থাকা অব্দি সে মনে হয় মুখের খাবার টা গলাধঃকরণ করতে পারবে কিনা? আল্লাহ মালুম।এত সুন্দর হ্যান্ডসাম হবু বর সামনে বসে আছে,একবারো চোখ তুলে দেখার প্রয়োজন বোধ করছে না।
তাসনিম হালকা কিছু খেয়ে দ্রুত রুমে চলে যায়।রুমে গিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিতে থাকে।আগেও তো আলিফ ভাইয়ার সাথে এক টেবিলে বসে খাবার খেয়েছি,তখন তো এরকম দম বন্ধকর পরিস্থিতি হয়নি।তবে আজ কেনো এতো অস্বস্তি আমাকে ঘিরে ধরলো?
রাত সাড়ে এগারোটা বাজে।পিনপতন নীরবতা বইছে পুরো বাড়ি জুড়ে। সবাই হয়তো যার যার রুমে ঘুমিয়ে পড়েছে বা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাসনিম ও বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতেই টুং টুং শব্দ করে ফোনে মেসেজ আসে।এতো রাতে কে মেসেজ দিলো।জানার জন্য উৎসুকভাবে তাসনিম ফোন ওপেন করে।কারন তাসনিম সেদিনের পরে অনলাইনে যায়না।বাকি বন্ধুদের সাথেও এখন যোগাযোগ নেই।ওদের সাথে কথা বললেই কথা প্রসঙ্গে জারিফের কথা উঠে। এখন জারিফের সাথে জারিফের গার্লফ্রেন্ড লিয়ার কথাও আসে।যা শুনলে না চাইতেও তাসনিম এর কষ্ট হয়।তাই আর কারো সাথে কোনো যোগাযোগ করে না।মেসেজ টা ওপেন করে দেখে,,
“আ’ম ওয়েটিং ফর ইউ ইন দ্যা রুফ,ইউ কাম সুন”
মেসেজ টা দেখে তাসনিম এর কপাল কিছুটা কুঞ্চিত হয়। তাসনিম মনে মনে বলে,এতরাতে হঠাৎ আলিফ ভাইয়া ছাদে দেখা করতে বলছেন কেনো? অদ্ভুত।আর উনি মেসেজটা অনুরোধ করে নয় একদম আদেশের সুরে দিয়েছেন।তবে ভাইয়া তো কখনো শুধু শুধু সময় নষ্ট করে না। কোনো জরুরী বিষয় হতে পারে।এসব ভেবে নিয়ে তাসনিম গায়ের উপর শাল চাদর টা জড়িয়ে একপা দু পা করে ছাদের দিকে যেতে থাকে। ছাদের চারকোনায় থাকা হালকা হলুদ আলোর লাইট জ্বলে আছে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ঝিঝিপোকার ডাক শোনা যাচ্ছে শুধু।হালকা হলুদ আলোয় নিস্তব্ধ পরিবেশ টা বেশ চমৎকার। তাসনিম ছাদে গিয়ে দেখে ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফোন স্ক্রল করছে আলিফ।হলুদ টিশার্ট এর উপরে ব্ল্যাক জ্যাকেট।জ্যাকেটের চেইনটা খুলা, ব্ল্যাক টাউজার।তাসনিম এক পলক আলিফ কে দেখে নিয়ে হালকা কেশে এগিয়ে যেতে থাকে।আলিফ ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাসনিম কে এক নজর দেখে আবার ফোন স্ক্রল করতে থাকে। কিজন্য এই সময় এখানে ডাকা সেটা জানার জন্য আর দ্রুত এখান থেকে প্রস্থান করার জন্য তাসনিম উসখুস করতে থাকে। তাসনিম আলিফের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আবার হালকা কাশে। আলিফ ফোন স্ক্রল করতে করতেই বলে,,”তোমার ঠান্ডা লেগেছে?না মানে আসার পর থেকে কাশছো যে।”
কথাটা কর্ণগোচর হয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই তাসনিমের আরো শুকনো কাশি হতে থাকে।আলিফ ফোনটা টাউজারের পকেটে রেখে। তাসনিমের আরেকটু কাছে গিয়ে শীতল চাহনিতে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলে,,”রিলেক্স তাসনিম।এতো ভ’য় পাওয়ার কিছু নেই। আমি বাঘ নই ভাল্লুক-ও নই যে এতরাতে এই নির্জন পরিবেশে তোমাকে একলা পেয়ে খেয়ে ফেলবো।”
আলিফের বলা কথাটা শুনে তাসনিমের আনইজি আরো বেড়ে যায়। তাসনিম দুই হাতের তালু ঘষতে থাকে।আলিফ তাসনিম কে পর্যবেক্ষণ মনে মনে বলে,এই মেয়েকে এখানে বেশিক্ষণ রাখা নিজের জন্যই রিস্ক।দেখা যাবে লজ্জা,ভয়ে জ্ঞান হারাবে। তখন বাড়ির সবার সামনে আমাকে লজ্জায় পড়তে হবে।মান এর সাথে সম্মানেরও দফারফা হয়ে যাবে।ভাববে বিয়ের আগেই হবু বউয়ের সাথে এমন কিছু করেছি তাতে আমার কবুল না বলা বউটা হুঁশ হারিয়েছে।
আলিফ মাথা ঝাড়া দিয়ে এক হাত চুলের মধ্যে চালনা করে গম্ভীর গলায় বলে,,”শোনো তাসনিম এই সময় এখানে তোমাকে ডাকার কারন বা আজকে আমার তোমাদের বাড়িতে আসার মূল কারন হলো।আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।তুমি এই বিয়েতে রাজি কিনা?তুমি নির্দ্বিধায় কোনো প্রকারের জড়তা ছাড়াই সত্যি টা আমাকে বলবে।তুমি যদি এই বিয়েতে রাজি না থাকো,তবে এখনো এই বিয়ে ক্যান্সেল করার দায়িত্ব আমার থাকবে। সমস্ত দায়ভার আমি নিয়ে, আমি নিজে বিয়টা ক্যান্সেল করবো। কারন আমি কখনোই তোমাকে জোর করে পেতে চাইনা।আমি যদি জোর করে পেতে চাইতাম,তাহলে আরো আগেই আমি তোমাকে নিজের করতে পারতাম।এটা বিলিভ করো তুমি?”
তাসনিম মনে মনে ভাবে,আলিফ ভাইয়া বিয়ের প্রস্তাব দিলে,সেটা কখনোই আমার বাড়ির কেউ নাকোচ করতো না।ভাইয়া কিছু বললে আব্বু চাচ্চু সবাই সেটা মেনে নিতো আমি জানি। আলিফের কথাটা তাসনিম কে মুগ্ধ করে।আলিফ যে তাসনিমের মতামতকে ফাস্ট প্রায়োরিটি দিচ্ছে,এই বিষয়টা তাসনিম এর কাছে খুব ভালো লাগছে।
আলিফের প্রশ্নের উত্তরে তাসনিম মাথা নাড়িয়ে ছোট করে বলে,,”হুম।আমি জানি তা।”
আলিফ দৃঢ় কন্ঠে বলে,,”তুমি এই বিয়েতে রাজি?কি রাজি না?ইয়েস অর নট।”
তাসনিম গোলাপী পাতলা ঠোঁট নেড়ে বলে,,”আমি তো আমার মতামত বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছি।আর আপনি ফুপ্পির কাছ থেকে শুনে নিতে পারেন।”
আলিফ কপাল কুঁচকে বলে,,”আমি তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই।তোমার মুখ থেকে।”
তাসনিম নিশ্চুপ হয়ে থাকে।আলিফ দুই হাত বুকে গুঁজে দূর আকাশ পানে দৃষ্টি দিয়ে আবেগী স্বরে বলে,,”এই পৃথিবীতে হয়তো সুন্দর মানুষের অভাব নেই।তবে আমি যাকে ভালোবাসি তার থেকে সুন্দর আমার চোখে কেউ নেই।আমি তার ক্ষনিকের প্রেম হতে চাই-না। সারাজীবন এর জন্য একান্ত করে তাকে পেতে চাই।”
তাসনিম মাথাটা উঁচু করে আলিফের দিকে তাকিয়ে মৃদু আওয়াজে বলে,,”পৃথিবীর বুকে যার কাছে আমার এতো ইম্পর্ট্যান্ট।আমার জীবনেও সেই ব্যক্তি ছাড়া সব কিছু ইনকম্পিলিট।”
তাসনিম এর মুখ নিঃসৃত দুইটা বাক্য শুনে আলিফের মনে একরাশ ভালো লাগা কাজ করে।আলিফ মনে মনে বলে, থেংকস মাই আল্লাহ এন্ড থেংকস মাই লর্ড।
তাসনিমের দিকে কিছুটা ঝুঁকে আলিফ মুচকে হেসে স্লো ভয়েজে বলে,,”ইউ আর মাই এভরিথিং,আই ওয়ান্ট ইউ ফর এভার।থেংক ইউ সো মাচ সুইটহার্ট।”
কথাটা শুনে তাসনিম এর কান উষ্ণ গরম হয়। তাসনিম আলিফকে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত ছাদ থেকে প্রস্থান করে। তাসনিম এর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আলিফ ঠোঁট চওড়া করে শব্দহীন হাসে।
ওদিকে জারিফ খুব ব্যস্ত। তদন্ত করতে গিয়ে দেখে অপরাধীরা রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় আছে।তাদের বিরুদ্ধে সহজেই কেউ মুখ খুলতে চায়না।এদিকে সাত দিনের মধ্যে সঠিক তদন্ত করে প্রতিবেদন তৈরি করে জমা দিতে হবে।অন্যদিকে লিয়ার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই।সব মিলিয়ে সময়টা খুবই খা’রাপ যাচ্ছে জারিফের।তবে জারিফ আপ্রাণ চেষ্টা করছে দ্রুত কাজটা সেরে ময়মনসিংহে যাওয়ার।
বুধবারের দিন লিয়ারা জামালপুরে আসে তাসনিম এর বিয়ে উপলক্ষে। শুক্রবারের দিন তাসনিম এর বিয়ে।লিয়ার মনে জারিফের উপর এক আকাশ অভিমান জমেছে।আজ কয়দিন হয়ে গেলো লিয়ার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই অথচ জারিফ আসছেই না।লিয়া মনে মনে ভাবে, স্যারের কাছে সব সময় আমার থেকে জড় বস্তু গুলোই বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। প্রথম দিনের ন্যায় সেই একই আচরণ স্যার আমার সাথে করলেন।জারিফের প্রতি অভিযোগ নিয়ে লিয়া ভাবে,খুব তো বড় করে বলেছিলেন,সেদিন আমি আপনার কাছে স্পেশাল কেউ ছিলাম না,একটা সাধারন মেয়ে ছিলাম।তাই হয়তো আপনি আমার হাতটা ছেড়ে দিয়েছিলেন।তবে এখন তো আমি আপনার স্পেশাল কেউ।তাহলে কেনো আমার থেকে আপনার কাছে আপনার চাকরী ইম্পর্ট্যান্ট হলো?এমন একটা অবস্থায় কিকরে আপনি এখনো না এসে থাকতে পারছেন?
[চলবে…ইন শা আল্লাহ]
(আজকের পর্বে একটা ওয়ার্ড লিখতে গিয়ে ইহানের কথা মনে পড়ে গেলো😞আজকের পর্ব টা বেশ এলোমেলো হয়েছে। মানসিক ভাবে একটু সমস্যায় আছি।রিচেইক করা হয়নি। ভুলত্রুটি মার্জনীয়।ধন্যবাদ সবাইকে।)