শুধু_তোমাকেই_চাই #শারমিন_হোসেন #পর্ব২৯

0
467

#শুধু_তোমাকেই_চাই
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব২৯

“সৃষ্টিকর্তার ধরাবাঁধা নিয়ম অনুযায়ী প্রতিদিনের ন্যায় আবারও নতুন একটি দিনের সূচনা হলো।চারিদিক থেকে মুয়াজ্জিনের মিষ্টি কন্ঠস্বরে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে।ঘুম ভেঙ্গে যায় তাসনিম এর। ধীরে ধীরে নেত্র পল্লবদ্বয় মেলে তাকায়।সবুজ রঙের ডিম আলো জ্বলে আছে রুমে।বিছানা ছেড়ে নামার উদ্দেশ্যে শুয়া থেকে উঠে বসতেই,শাড়ির আঁচলে টান পড়ে।এতে তাসনিম বেশ অবাক হয়। সেকেন্ডের মধ্যেই মনমস্তিষ্ক নানান কিছু ভেবে নেয় আর কিছুটা বিচলিতও হয়।ঘাড় ঘুরিয়ে ডান সাইডে তাকাতেই তাসনিম নিজের মনমস্তিষ্ককে ভুল প্রমাণিত করে। তাসনিম ভেবেছিলো আলিফ হয়তো আঁচল টা ধরেছে। কিন্তু না। তাসনিম কপাল কুঁচকে তাকিয়ে দেখে,শাড়ির আঁচল টা আলিফের এক বাহুর তলায় আছে।আর আলিফ বাচ্চাদের মত বিভরে ঘুমাচ্ছে। আঁচলটা ছাড়িয়ে দিতে গিয়ে পরক্ষনে কিছু ভেবে তাসনিম আর টান দেয় না। এত সুন্দর প্রশান্তিতে ঘুমাচ্ছে।যদি ঘুম ভেঙ্গে যায়।এইভেবে তাসনিম নিশ্চুপ রয়। তাসনিম আলিফের ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে কালকে রাতে বলা আলিফের কথা গুলো ভাবতে থাকে।

কালকে রাতে ডিনার শেষে তাসনিম বিছানায় বসে ছিলো।এমন সময় আলিফ এসে দরজা লকড করতেই তাসনিম এর অস্বস্তি আকাশসম হয়।আলিফ লাইট নিভিয়ে ডিম আলো জ্বালিয়ে দেয়। তাসনিম এর উসখুস ভাব বেড়ে যায়। আলিফ তাসনিম এর পাশে বসে তাসনিম কে পরখ করে গলা ঝেড়ে বলতে থাকে,,
“কুল তাসনিম কুল।আমাকে দেখে এত আনইজি হওয়ার কিছু নেই।”

তাসনিম শুকনো ঢোক গিলে জড়তা নিয়ে বলে,,”নাহ্।তেমন কিছু নয়।”

আলিফ তাসনিম এর বোকা বোকা চাহনির দিকে চেয়ে নিঃশব্দে হেসে বলে,, “বুঝলাম তেমন কিছু নয়।তবে আমি কেমন কিছুর কথা বলেছি, হ্যা?”

ডান ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন টা করে আলিফ। প্রশ্ন টা মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই তাসনিমের হৃদস্পন্দন যেনো মিস হলো। তাসনিম এর লজ্জা অস্বস্তিতে সাফোকেটিং হতে থাকে। আলিফ মুচকি হেসে নির্বিকার গলায় বলে,,”টেনশন বাদ দাও। তোমার রেসপন্স না পাওয়া অব্দি আমি কখনো তোমাকে গভীর ভাবে স্পর্শ করবো না।যেদিন মন থেকে তুমি আমাকে মেনে নিবে।আমার ব্যাপারে তুমি ইজি হবে।যখন থেকে তোমার চিন্তা ভাবনা জুড়ে শুধুই আমি থাকবো। সেদিন থেকে আমাদের প্রণয় পরিপূর্ণতা পাবে।এর আগে নয়।”

তাসনিম মুগ্ধ নয়নে সামনে বসা সুদর্শন বলিষ্ঠ পুরুষের দিকে চেয়ে প্রতিটা কথা উপলব্ধি করতে থাকে।আলিফের প্রতিটা কথা শুনে আলিফের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায় তাসনিমের।একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে অপলক দৃষ্টিতে আলিফের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে তাসনিম মনে মনে ভাবে,,আমি আপনাকে যতই দেখছি,ততই আশ্চর্য হচ্ছি।আমার নিজের উপর আফসোস হচ্ছে এখন।কেনো আরো আগে আপনার দূর্বলতা নিয়ে আমি ভাবিনি?আপনার নীলাভাকার চোখের ভাষা নিয়ে কেনো আমি ভাবিনি?যে আমার মায়ায় আবদ্ধ।আমি কেনো তার মায়ায় আটকায়নি?এটা ছিলো আমার চরম ভুল।তবে এই ভুলটা আমি খুব দ্রুতই শুধরে নিবো।শুধরে নিতে তো আমাকে হবেই।নাহলে এই পৃথিবীর স্বর্গীয় সুখ থেকে নিজেই বঞ্চিত হবো।সত্যিকারের ভালোবাসা পেয়েও যে সেটা গ্রহণ করতে পারে না।তারচেয়ে হতভাগা বা হতভাগী কেউ নেই।আমি নিশ্চয় জেনে বুঝে নিজেকে এই হতভাগী দলে ফেলবো না।

আলিফ হালকা কেশে বলে,,”অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো।এমনিতেও সারাদিন তোমার উপর স্ট্রেচ পড়েছে।তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”

আলিফের ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে তাসনিম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে,আমাকে ফোর্স করা তো দূরের কথা।আমাকে কনভিন্স করার চেষ্টাও করেনি।সবটা আমার নিজের উপর ছেড়ে দিয়েছে। মানুষ টার সাথে আমি কি অন্যায় করে ফেললাম না-কি?আমাদের সম্পর্ক টা তো পবিত্র।এই পবিত্র সম্পর্ক থেকে বঞ্চিত করছি নাতো?তবে আমি বুঝতে পারছিনা আমার কি করা উচিত ছিলো।তবে আমি নিজেকে যত ফাস্ট সম্ভব আপনার ব্যাপারে ইজি করে নেবো।ভুল বুঝবেন না, প্লিজ।আমার একটু সময়ের প্রয়োজন।

তাসনিম এর ভাবনার মাঝেই আলিফ একটু নড়াচড়া করে পিটপিট করে চোখ মেলে দেখে তাসনিম একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।আলিফ হালকা কাশে।এতে তাসনিম নিজেকে তটস্থ করে সোজা হয়ে বসে।আলিফ শোয়া থেকে বসে তাসনিম এর কানের পাশে মুখটা নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,,”এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। তোমারি তো বর আমি।তাই লুকিয়ে চুরিয়ে নয়। সামনা-সামনি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে তোমার বরকে দেখতে পারো।আমি মানুষ টা পুরোটাই তোমার পার্সোনাল প্রোপার্টি।”

লজ্জায় তাসনিম এর নাকের ডগা লাল হয়ে যায়। তাসনিম জড়তা নিয়ে বলে,,”কে বলেছে আমি আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম?আমি তো উ

তাসনিম কে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে আলিফ দুষ্টু হেসে বলে,,”হুম।আমিও তো তাই বলছি।তুমি তো তোমার বিয়ে করা বরের দিকে তাকিয়ে ছিলে।আমার দিকে তো নয়।”

তাসনিম বুঝতে পারে আলিফের সাথে বাক্যব্যয় করে লাভ নেই।আলিফ কথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এক যায়গায়ই নিয়ে যাবে। তাসনিম বিছানা থেকে নামতেই,আলিফ গলা উঁচিয়ে বলে,,আমার দিক হতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও। তোমার দিকে কিন্তু কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি নেই।তাই তুমি চাইলেই তোমার কিউট বরকে আদর-টাদর করতেই পারো।আমি আবার খুব দয়াবান তো তাই মানা করবো না।”

তাসনিম এমন মুখাবয়ব করে যেনো কথাটা ও কানে শোনেনি,আর লম্বা পা ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে। আলিফ এক হাত চুলের মধ্যে চালনা করে বেড ছেড়ে নেমে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।ভোরের আলো ফুটতে শুরু করছে।নাম না জানা সুন্দর একটা ছোট্ট পাখি গ্রিল এর উপর বসে।অন্যদিন হলে আলিফ বিরক্ত বোধ করে হুস হুস করে তাড়িয়ে দিতো। কিন্তু আজকে আর আলিফের মন সায় দিলো না।আলিফের কাছে আজকের ভোর টা মনোমুগ্ধকর।মন ভালো থাকলে সব কিছুই ভালো লাগে।আলিফের মন মেজাজ চমৎকার আছে।এই নতুন সকালটা আলিফের কাছে খুব স্পেশাল মনে হচ্ছে।

তাসনিম ওযু করে এসে নামাজ আদায় করে। কিছুক্ষণ রুমে থেকে তারপর কিচেনে যায়। কিচেনে গিয়ে দেখে আতিকা বেগম সবজি কাটছে। তাসনিম বলে,,
“ফুপ্পি আমাকে দাও আমি করছি।”

আতিকা বেগম মিষ্টি হেসে বলেন,,”আমি করছি সমস্যা নেই।তুই বরং কফি বানিয়ে এক মগ কফি আলিফ কে দিয়ে আয়।”

তাসনিম ঘাড় নাড়িয়ে বলে,,”ঠিক আছে।”

কফি বানিয়ে এক মগে ঢেলে নিয়ে।কফি হাতে তাসনিম রুমে যায়।রুমে গিয়ে দেখে আলিফ রুমে নেই।ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে।এক হাত টাউজারের পকেটে গুঁজে অন্যহাতে ফোন স্ক্রল করছে।
তাসনিম মৃদু আওয়াজে বলে,,”আপানার কফি।”

আলিফ ফোনটা পকেটে রেখে ডান হাতটা বাড়িয়ে কফির মগটা নিয়ে শান্ত স্বরে বলে,,”থ্যাংকস।এখন এটার খুব প্রয়োজন ছিলো।”

সোমবার ঘড়ির কাঁটা রাত আটটার ঘরে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে কোনো সমস্যা ছাড়াই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সব সম্পন্ন হয়েছে।বিয়ে বাড়ি থেকে মেহমানরা সব যার যার গন্তব্যে ফিরেছে।এই কয়দিনের হইচই কোলাহল পরিবেশ আর নেই।লিয়া ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি লোহার গ্রিল ভেদ করে বাইরে। চাঁদের আলো ব্যালকনিতে মৃদু আলো ছড়াচ্ছে।রাতের আকাশে তাঁরা গুলো আজ আর তেমন দেখা যাচ্ছে না।মিটিমিটি করে হিরের মতো জ্বলতে থাকা অসংখ্য তাঁরা দেখা যাচ্ছে না।ভালো করে দৃষ্টি দিলে তবেই দূরে দূরে দু-একটা তাঁরা দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে কুয়াশা ঘিরে ধরেছে ধরনীকে। কুয়াশা ভেদ করে একট ফালি চাঁদের আলো ব্যালকনিতে এসে পড়ে। চাঁদ এর দিকে দৃষ্টি দিয়ে লিয়া অস্ফুট স্বরে বলে,, আমাবস্যা শেষে আকাশের বুকে চাঁদ টা ঠিকই উঠেছে। চাঁদ তার মতো করে আলো ছড়াচ্ছে।আপনি কেনো এখনো আসছেন না?আপনি এসে চাঁদের মতো করে আমার মনে আলো ছড়াবেন কবে?আপনি ছাড়া আমার হৃদয় বিষন্নতার ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে আছে।এই অন্ধকার দূর করার জন্য শুধু আপনাকেই চাই।আপনি আমার হৃদয় কুঠরিতে চাঁদের আলো ছড়াবেন।স্যার আপনার কি আমার কথা মনে হচ্ছে না?আমার কথা যদি মনেই হয়।তাহলে আপনি যোগাযোগ ছাড়া এখনো কিকরে না এসে আছেন?

লিয়ার ফর্সা গাল বেয়ে টসটসে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কিছু একটা ভেবে লিয়ার মনমস্তিষ্ক বলে উঠে,স্যার যদি আমার খোঁজ করতে বাসায় আসে।তাহলে তো কাউকে পাবে না।বাসায় ফেরা আমার জন্য খুব জরুরী। আম্মুর সাথে কথা বলে নেই।

লিয়া রুম থেকে বের হয়ে কয়েক পা আসতেই তহমিনা বেগম কে সিড়ি দিয়ে উপরে আসতে দেখে লিয়া শুধায়,,”বড়মা আম্মু কোথায়?নিচে আছে?”

তহমিনা বেগম শান্ত গলায় বলেন,,”নিচে নেই।উপরেই তো।দেখ রুমেই আছে হয়তো।”

লিয়া ঠোঁট মেলে বলে,,”ঠিক আছে।”

লিয়া ওর আম্মুর রুমে গিয়ে দেখে রাজিয়া সুলতানা বিছানায় বসে কিছু নিয়ে ভাবছেন।লিয়া পাশে বসতেই রাজিয়া সুলতানা লিয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু আওয়াজে বলে,,”কিছু বলবি?”

লিয়া ওড়নার কোণা আঙ্গুলে পেচাতে পেচাতে বলে,,”আম্মু আমরা বাসায় যাবো কবে?বিয়ে তো শেষ হয়েই গিয়েছে।তাই বলছি কালকেই চলো না বাসায় চলে যাই।”

রাজিয়া সুলতানা ম্লান স্বরে বলেন,,”আমরা আর ময়মনসিংহে ফিরছি না।”

“হোয়াট? কিন্তু কেনো? ময়মনসিংহে যাবো না মানে?”

রাজিয়া সুলতানা ছোট করে শ্বাস নিয়ে শান্ত গলায় বলেন,,”বিয়ের কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য তোকে বলা হয়ে উঠেনি। তোর আব্বু ট্রান্সফার হয়েছে বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে।তোর আব্বু বাসার জিনিসপত্র শিফট করছে।আর আমরা দু এক দিনের মধ্যেই বগুড়া যাচ্ছি।”

প্রত্যেকটা কথা লিয়ার কাছে কাঁটার মতো বিঁধছে।লিয়ার দুচোখে পানি টলমল করতে থাকে।লিয়া বুঝতে পারে এবারের বদলি ওর আব্বু ইচ্ছাকৃতভাবেই হয়েছে।জারিফের সাথে যাতে কোনো যোগাযোগ রাখতে না পারে সেই ব্যবস্থা। স্মৃতি গুলো মুঝে দেওয়ার জন্য।
লিয়া ভেজা গলায় বলে,,”খুব দরকার ছিলো কি এই সময় বদলি হওয়ার?”

রাজিয়া সুলতানা হতাশ স্বরে বলেন,,”জানিনা। তবে এক সময় না এক সময় তো বদলি হতোই।এরকম টাই ভাব না হয়।”

লিয়া মুখটা মলিন করে দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ করে চুপটি করে বসে থাকে।কিছুক্ষণ নীরবতা চলে। অবশেষে নীরাবতা ভেঙ্গে রাজিয়া সুলতানা দৃঢ় গলায় বলে,,
“আমার মনে হয় দূরত্ব কখনো কোনো সম্পর্ক ন’ষ্ট করতে পারে না।কেউ যদি মন থেকে সত্যিই চায় তবে হাজার হাজার মাইল বা এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত থাকলেও ঠিক খুঁজে নিবে।তাই মন খা’রাপ করিস না।সব শেষে বলবো ভাগ্যের উপর বিশ্বাস রাখ।”

লিয়া আর কথা না বলে ওর রুমে গিয়ে দরজা লক করে।দরজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। হাঁটুর ভাঁজে মুখ গুঁজে কান্না করতে থাকে।যে কান্নার সাক্ষী হয় ইট পাথর।কারন চারদেওয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে কান্নার আওয়াজ। কিছু সময় কান্না করে লিয়ার নিজেকে অনেকটা হালকা লাগছে।লিয়া মনে মনে ভাবে,, আম্মু তো ঠিকই বলেছে।স্যার যদি সত্যি আমাকে ভালোবাসে থাকে।আর যদি আমাকেই চায়।তাহলে আমি যেখানেই থাকি না কেনো।স্যার আমাকে খুঁজে নিবে।আর কাউকে খুঁজে বের করা এখন কোনো ব্যাপারই না।স্যার চাইলেই আব্বুর অফিস থেকে যোগাযোগ করে জেনে নিতে পারে আব্বু কোথায় বদলি হয়েছে।আর তারপর বাসা পাওয়া তো সিম্পেল।এটা ভেবে লিয়ার কিছুটা ভালো লাগে। কিছুক্ষণ আগের কষ্টের পাহাড় টা যেনো খানিকটা হলেও সরে যায়।

সুন্দর একটা ঝলমলে দিন।সকালে তাসনিম আতিকা বেগম এর সাথে রান্নার কাজে হাতে হাতে সাহায্য করেছে।ডায়নিং এ ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে উপরে তাকাতেই এমন সময় দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ভাঁজ করতে করতে সিড়ি দিয়ে নেমে আসা আলিফের দিকে।আলিফ কাছে আসতেই তাসনিম দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।আলিফ চেয়ার টেনে বসে পড়ে।গলা ঝেড়ে তাসনিম কে উদ্দেশ্য করে বলে,,
“দাঁড়িয়ে আছো কেনো?বসো ব্রেকফাস্ট করে নাও।”

তাসনিম পরে খাবো কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পাড়লো না। তাসনিম এর মনমস্তিষ্ক সায় দিলো না।বিনাবাক্য ব্যয়ে তাসনিম একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো।

আলিফ খাবার চিবুতে চিবুতে বলে,,”তোমার জয়েনিং তো সামনের সানডে।”

তাসনিম মৃদু আওয়াজে বলে,,”হুম।”

“জয়েনিং করার সময় পূর্বাহ্ণে করো।কারন সিনিয়র জুনিয়রের ব্যাপার আছে।”

“ওকে।”

“সিভিল সার্জন এর থেকে হেল্থ সার্টিফিকেট নিতে হয়।আমি বলে দেবো ওরা সার্টিফিকেট দিয়ে দিবে কেমন।”

তাসনিম ঠোঁট কামড়ে ধরে বলে,,”ওহ্হ।আমি জানতাম না তো।ধন্যবাদ।”

খাবার শেষ করে আলিফ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,,”তুমি একটু রুমে এসো ফাস্ট।”

“আপনি যান আমি আসছি।”

আলিফ রুমে বসে ফোন স্ক্রল করছিলো। তাসনিম টেবিলের উপর থাকা খাবার গুলো গুছিয়ে রেখে রুমে যায়। তাসনিম কে দেখে আলিফ সেন্টার টেবিলের উপর রাখা একটা প্যাকেট তাসনিম এর হাতে ধরিয়ে দেয়। তাসনিম কপাল কুঁচকে প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে ইশারায় বোঝায় কি?

আলিফ শান্ত গলায় বলে,,”তোমার হাতে প্যাকেট তাই তুমি নিজেই খুলে দেখো।”

প্যাকেটটার ভেতর একটা ওয়ানপ্রো মোবাইল বক্স। বক্স টা হাতে নিয়ে তাসনিম ভ্রু কুঁচকে বলে,,”মোবাইল। কিন্তু কেনো?”

আলিফ নির্বিকার গলায় বলে,,”তোমার ফোনটা তো সেদিন বাড়িতে ফেলে আসছো।”

“আবার বাড়ি যখন যাবো তখন নিয়ে আসলেই তো হবে।”

“ততদিন আমার বউ মোবাইল ছাড়া থাকবে।আর এটা আমার পক্ষ থেকে তোমার জন্য গিফট।”

“থ্যাংকস”

তাসনিম উৎসুকভাবে জানার জন্য বলে,,”কখন এনেছিলেন এটা?”

আলিফ তাসনিম এর কোমড় জড়িয়ে ধরে কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে মৃদু আওয়াজে বলে,,”কালকে রাতে।রাতেই তোমাকে দেবো ভেবেছিলাম।বাট কালকে পেশেন্ট দেখে আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে যায়।আর এসে দেখি আমার রাঙা বউটা ঘুমিয়ে আছে।মোটেও ইচ্ছে করলো না বউয়ের ঘুম ভাঙ্গতে।তাই আর ডেকে তুলিনি।আর সকালে ঘুম থেকে জেগে তো দেখি বউ রুমে নেই। রান্না করতে ব্যস্ত।”

আলিফের নিঃশ্বাস মুখে পড়ছে আর তাসনিম থেকে থেকেই কেঁপে উঠছে। তাসনিম ঢুক গিলে নিয়ে বলে,,”আসলে আপনার জন্য ওয়েট করতে করতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিলো বুঝতে পারিনি।”

আলিফ তাসনিম এর গলায় মুখ ডুবিয়ে বলে,,”ব্যাপার না। ওহ্! নিউ সিম আছে দেখে নিও।”

“ঠিক আছে।”

কিছুক্ষণ পর আলিফ তাসনিম কে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলে,,”বউ তো দেখছি আজ আমাকে ছাড়তেই চাইছে না।এদিকে আমার হসপিটালে যেতে লেইট হয়ে যাচ্ছে।”

আলিফের কথা শুনে তাসনিম আশ্চর্য হয়। তাসনিম এর কপালে বেশ খানিকটা ভাঁজ পরে। তাসনিম মিছিমিছি রা’গ দেখিয়ে বলে,,”মোটেও উল্টো কথা বলবেন না।”

আলিফ স্মিত হেসে ইন্নোসেন্ট ফেস করে বলে,,”সরি সুইটহার্ট।”

আলিফের বলার ভঙ্গি দেখে তাসনিম নিঃশব্দে হালকা ঠোঁট মেলে হাসে।আলিফ শান্ত স্বরে বলে,,”তোমার মুখের হাসিটা আমার জন্য মেডিসিন‌। তোমার এই হাসি মাখা মুখটা সারাদিন সব কাজের মাঝেও আমাকে প্রাণবন্ত রাখতে যথেষ্ট। সারাজীবন তোমাকে এভাবে হাসি খুশি দেখতে চাই।আমার নিজেকে ভালো রাখার জন্য আমার শুধু তোমাকেই চাই।”

আলিফ ফোনে সময় দেখে নিয়ে বলে,,”টেক কেয়ার।বাই।”

তাসনিম স্মিত হেসে বলে,,”দেখে শুনে যাবেন।”

জারিফের প্রতিবেদন তৈরি করা কমপ্লিট হয়েছে।জারিফ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।ডিসি স্যার বলেছেন গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া পূর্বের রিপোর্টের সাথে এই প্রতিবেদনের মিল আছে।তাই এই প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে অপরাধীদের কে আর্লি আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।জারিফ সাকসেসফুল ভাবে কাজটা করায়।ডিসি স্যার জারিফের কাজের প্রতি খুশি হয়ে থ্যাংকস লেটার দেয় জারিফ কে।তবে ওদিকে রাজনৈতিক হুমকি দেওয়া নেতার কথা মত প্রতিবেদন না করায়।তিনি জারিফের উপর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়েছেন‌।দলের ছেলেপেলেদের কে বলেছেন ঐ অফিসার কে তো আমি দেখে নিবো।আমার কথার বাইরে যাওয়ার পরিণাম কত ভয়াবহ তা সময় হলেই বুঝতে পারবে নতুন অফিসার।

বুধবারের দিন সকাল সকাল ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে জারিফ রওনা হয়।জারিফের মনে একরাশ ভালো লাগা কাজ করছে।জারিফ মনে মনে ভাবে,,তোমার অভিমান ভাঙাতে আমি আসছি লিয়া।তবে এবার তোমাকে রেখে আমি আসবো না।তোমাকে আনার সম্পুর্ন অধিকার নিয়েই আনব।তুমি যতই রা’গ ক্ষোভ করে থাকো না কেনো।আমি জানি আমাকে দেখলেই তোমার সব রা’গ,ক্ষোভ,অভিমান বরফের মত গলতে শুরু করবে।তুমি যতই শক্ত হওনা কেনো আমি জানি আমার জন্য তুমি শুধুই মোমের মত।মম যেমন আগুনের পাশে থাকলে গলতে শুরু করে।ঠিক তেমনি তোমার সামনে আমি দাঁড়ালেই তোমার রা’গ ক্ষোভের কঠোর মনটা নিমিষেই গলে যাবে।আমার অশান্ত মন কে শান্ত করার জন্য তোমার দর্শন খুব জরুরী।

জারিফের বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যায়।বাড়িতে গিয়ে মা বাবার সাথে কথা বলে খোঁজ খবর নিয়ে।রুমে গিয়ে ওয়াশরুমে যায় শাওয়ার নিতে।শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে রেডি হয় বাইরে যাওয়ার জন্য।ড্রয়িং রুম দিয়ে যাওয়ার সময় জাহানারা বেগম হাঁক ছেড়ে ডেকে উঠেন,,”জারিফ বাবা আয় খাবার খেয়ে নিবি।”

জারিফ নির্বিকার ভাবে বলে,,”এখন খাবো না।আমার একটু দরকার আছে।বাইরে যেতে হবে।এসে খাবো।”

জাহানারা বেগম গম্ভীর কন্ঠে বলেন,,”মাত্রই জার্নি করে আসলি এখনি বাইরে যাবি।”

জারিফ শান্ত স্বরে বলে,,”তুমি চিন্তা করো না। তাড়াতাড়িই ফিরবো।”

এই বলেই জারিফ বেড়িয়ে যায়। রিক্সা করে যাওয়ার সময় লিয়ার কথা স্মরণ হতে থাকে। লিয়াদের ফ্লাটের সামনে গিয়ে বড় একটা তালা ঝুলানো দেখে জারিফের কপালে ভাঁজ পরে।জারিফ কপাল কুঁচকে ভাবে,তালা দেওয়া।লিয়ার বাসায় নেই।ওর দাদু বাড়িতে যায়নি তো ?

জারিফের ভাবনার মাঝেই কারো পায়ের শব্দ পেয়ে জারিফ পিছন ফিরে দেখে একজন মহিলা হাতে কয়েকটা কাপড় চোপড় নিয়ে সিড়ি দিয়ে নিচে নামছে। জারিফ বুঝতে পারে লিয়াদের সামনের ফ্লাটটাই ওনার। ছাদ থেকে শুকনো কাপড় নিয়ে বাসায় ঢুকবেন।এমন সময় জারিফ মহিলাটিকে সালাম দিয়ে বলে,,”আচ্ছা আন্টি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলতাম আরকি।”

মহিলাটি সালামের উত্তর দিয়ে ভদ্রভাবে বলেন,,”সমস্যা নেই তুমি বলো বাবা।”

জারিফ গলা ঝেড়ে বলে,,”লিয়াদের তো চিনেন নিশ্চয়?ওরা বাসাই নেই?”

মহিলাটি কপাল কুঁচকে বলে,,”ওহ্।লিয়ারা।ওরা তো এক সপ্তাহ আগেই চলে গিয়েছে।লিয়ার আব্বু তো বদলি হয়েছে।”

বদলি হয়েছে কথাটা শুনে জারিফ অবাক হয়।জারিফ অবাক গলায় বলে,,”হোয়াট? বদলি হয়েছে।তা আন্টি আপনি কী জানেন ওরা কোথায় শিফট করেছে?”

মহিলাটি ঘাড় নাড়িয়ে না বোধক জবাব দেয়। তারপর কিয়ৎক্ষন ভেবে গমগমে কন্ঠে বলে,,সেটা তো জানিনা বাবা। কয়েকদিন আগে থেকেই লিয়ার আম্মু কে কেমন জানি চুপচাপ দেখতাম।আর যাওয়ার আগে বলেও যায়নি ওনারা একেবারে চলে যাচ্ছেন।সেদিন লিয়ার বাবা এসে জিনিস পত্র নিয়ে গেলো তাই শুনতে পেলাম বদলি হয়েছেন।”

জারিফ ছোট করে বলে,,”ওহ্।”

জারিফ ভাবে তাসনিম এর কাছ থেকে ফোন করে জেনে নেওয়া যাবে। লিয়ারা এখন কোথায় আছে। এরমধ্যে মহিলাটি বলতে থাকে,,”ওদের যাওয়ার দুইদিন আগে রাহবার কে বলতে শুনেছিলাম। আমার ছেলের সাথে খেলার সময় ছাদে রাহবার বলছিলো ওর আপুর নাকি শুক্রবারে বিয়ে।তাই বিয়ের জন্য ওরা ওর দাদু বাড়ি যাবে।”

ওর আপুর বিয়ে কথাটা শুনে জারিফ আস্টোনিস্ট হয়। জারিফ ভাবে ওর আপুর বিয়ে মানে?

মহিলা টি আফসোসের সুরে আরো বলেন,,”মেয়ের বিয়ের কথাও জানালো না।আবার যাওয়ার সময়ও একবার বলে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না।অথচ আজ দুই বছর হলো আমরা এই বাসায় এসেছি। আচ্ছা যাইহোক বাবা ভিতরে আসো।চা খাবে চলো।”

জারিফ মহিলার কথা শুনে নির্বাক হয়ে যায়।জারিফ কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,,”আপনি শিওর শুনেছেন বিয়ের কথা।না মানে আপনার কোথাও ভুল হয়নি তো।”

মহিলাটি ভ্রু কুঁচকে বলে,,”হ্যা আমি শিওর শুনেছিলাম।রাহবার বলছিলো,আমার আপুর বিয়ে।আর সেদিন লিয়ার আব্বু মালামাল নেওয়ার সময় ফোনে কথা বলছিলো। জোরে জোরে বলার কারনে আমি আমার ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় শুনলাম।উনি বলছেন,এ কয়দিন বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।তাই জিনিসপত্র গুছিয়ে উঠতে পারিনি।”

মহিলাটির কথা শুনে জারিফের মাথায় বাজ পড়তে থাকে। জারিফ ভাবে রাহবার বলেছে,আপুর বিয়ে।আবার লিয়ার আব্বু বলেছে বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।তারমানে লিয়ার বিয়ে।লিয়ার বিয়ে হয়েছে হাউ পসিবেল?

[চলবে…ইন শা আল্লাহ]

(সরি লেইট হওয়ার জন্য।দশটার আগেই দেওয়া যেতো। টেকনিক্যাল প্রবলেম হয়েছিলো।মেইন এফবিতে লগইন করতে পারছিলাম।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here