শুধু_তোমাকেই_চাই #শারমিন_হোসেন #পর্ব৩১

0
535

#শুধু_তোমাকেই_চাই
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব৩১

“নতুন একটি ভোর।পূর্ব আকাশে রক্তিম আভা জাগলো। সূর্য মামা তার উপস্থিতি জানান দিতে ধরণীর বুকে রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ত।মোরগ কুকুড়ুকু ডেকে যেনো পৃথিবীর মানুষ কে বোঝায়,উঠো মানব জাতি। প্রভাতে যে ঘুমিয়ে থাকলে নিভবে ভাগ্যের বাতি।সারারাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি জারিফ।শেষ রাতের দিকে চোখটা লেগেছিলো।আবার এখন পাখপাখালির শব্দ পেয়েই ঘুমটা উড়ে যায়।ঘুম থেকে জেগে নামাজ আদায় করে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।শিশির ভেজা ঘাসের উপর পড়ছে রবির আলো।দক্ষিণা ঠান্ডা মৃদু বাতাসে গাছের সবুজ পাতা দোল খাচ্ছে।রবির আলোয় চারিদিকে ঝলমল করছে। শান্ত সুন্দর ঝলমলে একটি নতুন সকাল।এই ঝলমলে সকালের মত সুন্দর ঝলমলে জারিফের মনটা নেই।মনটা জুড়ে আছে নীকষ কালো মেঘ।জারিফের মন থেকে এই কালো মেঘ কেবল একজনই পারে দূর করতে।তবে ভাগ্যের পরিহাসে সে আর কখনো জারিফের মনে প্রশান্তি হয়ে আসবে কিনা?তা জারিফ জানে না।কারন গতকাল কের শোনা কথা যদি সত্য হয়।তাহলে তার আসা আর সম্ভব নয়।জারিফ মনে প্রাণে প্রার্থনা করছে, গতকাল যা শুনেছে সেসব যেনো মিথ্যে হয়। মহিলাটির বলা কথাগুলো যেনো ভুল হয়।

ঘড়ির কাঁটায় আটটা পঁয়ত্রিশ বাজে।জারিফ রেডি হয়ে রুম থেকে বের হয়।জারিফের উদ্দেশ্য প্রথমে ক্যান্টনমেন্ট যাবে।যতক্ষণ ধরে জামালপুর গিয়ে বাড়ি খুঁজে বের করতে লাগবে।তারচেয়ে বেটার হবে।ক্যান্টনমেন্ট এ গিয়ে জানবে কোথায় বদলি হয়েছে লিয়ার আব্বু।ব্যস তারপর সেই ক্যান্টনমেন্টে গিয়েই শিয়র হবে। আদৌতেও বিয়েটা হয়েছে কি-না?রুম থেকে বের হয়ে কয়েক পা যেতেই পিছন হতে জাহানারা বেগম জারিফকে ডেকে শুধালেন,,”জারিফ বাবা।না খেয়ে দেয়ে এত সকালে কোথায় যাচ্ছিস?”

জারিফ থেমে যায়।ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে সাবলীল কন্ঠে বলে,,”এখন আপাতত ক্যান্টনমেন্টে যাবো।”

এতটুকু শুনেই জাহানারা বেগম বেশ বুঝতে পারেন।তাই আর এই বিষয়ে না ঘেঁটে সরাসরি বলেন,,”আচ্ছা ঠিক আছে।তবে যেখানেই যাস না কেনো খাবারটা খেয়ে যা।এমনিতেও কাল রাতেও কিছুই খাসনি।”

জারিফ মাথাটা নিচু করে হতাশ গলায় বলে,,”আমার ভালো লাগছে।খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না।”

জাহানারা বেগম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে গম্ভীরভাবে বলেন,,”দেখ বাবা,এভাবে খাবার না খেয়ে থেকে তো আর সব সমস্যার সমাধান হবে না।আরো সমস্যা হবে।এতে করে তোর নিজেরই শরীর খা’রাপ হবে।আর তোর কিছু হলে আমরা নিশ্চয় ভালো থাকতে পারবো না।তোর মলিন মুখ দেখতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।আর সব শেষে বলবো ধৈর্য্য ধারন কর এক সময় সব ঠিক হয়ে যাবে।”

অবশেষে জারিফ ডায়নিং এ গিয়ে বসে।জারিফের খাওয়ার মাঝেই আইনাল হোসেন এসে চেয়ার টেনে বসেন। ছেলেকে পরখ করে মুখে গম্ভীরতার রেশ নিয়ে বলেন,,”জারিফ বাবা তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারারাত নিশ্চয় নির্ঘুম কাটিয়েছো।তো বাবা আমি বলি কি এতো পেরেশানি হয়ো না। মানুষের জীবনে সব সময় সব চাওয়া পাওয়া পূরণ হয় না।দেখ বাবা তুমি তো যথেষ্ট বড় হয়েছো। উচ্চ শিক্ষিত হয়েছো। এবং বৃহত বড় প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি করছো।তোমাকে বোঝানোর মতো সেই অবস্থা আমার আর নেই।তবে বাবা হিসেবে কিছু কথা বলি তুমি শোনো। আমার মনে হচ্ছে তুমি প্রচন্ড টেনশনে আছো।তবে এটাই স্বাভাবিক।তুমি জানো জীবনে সফল হতে হলে পরাজয় টাকে সহজেই মেনে নিতে হয়।আর এই পরাজয়ের উপর দাঁড়িয়ে বিজয় উল্লাসের জন্য নিজেকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হয়।”

জারিফ হালকা কিছু খেয়ে হাত ধুয়ে নেয়। আইনাল হোসেন কিয়ৎক্ষন থেমে আবার নির্বিকার কন্ঠে বলেন,,”তোমার মায়ের কাছ থেকে আমি সবটা শুনেছি।তাই বলছি তুমিও গ্রো আপ করার চেষ্টা করো।”

জারিফ কোনো প্রকারের ভনিতা ছাড়াই সোজাসুজি স্পষ্টভাবে দৃঢ় গলায় বলে,,”সম্ভব নয়।”

আইনাল হোসেন দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিয়ে নিরস স্বরে বলেন,,”তুমি বড় হয়েছো।যেটা ভালো বুঝো তাই করো। সেখানে আমাদের কোনো জুড়াজুড়ি নেই।তবে তোমাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে আমাদের খুব খা’রাপ লাগছে। আমার এখানে যেটুকু করার ছিলো,আমার সর্বোচ্চ দিয়ে আমি ট্রাই করেছিলাম।বাট দুর্ভাগ্য বশত সাকসেস হইনি।আমি সেদিন ভদ্রলোক এর অফিসে গিয়ে অনেক করে রিকুয়েস্ট পর্যন্ত করেছিলাম। উনি অনড় ছিলেন ওনার সিদ্ধান্তে।উনি বারবারই একটা কথায়ই বলেছেন।উনি নাকি কমিটমেন্ট ভাঙ্গতে পারবেন না।তোমার বিষয়টা যদি আগে জানতো তাহলে উনি ভাবতেন বিষয়টা নিয়ে। কিন্তু যেহেতু আগে থেকেই এক জায়গায় কথা দিয়েছেন তাই কোনো ভাবেই সম্ভব নয়।আর ভদ্রলোক আমাকে সেদিন বলেছিলো ঐদিনই নাকি এনগেজমেন্ট ।আর এও বলেছিলেন খুব দ্রুতই বিয়ে দিয়ে দিবেন।তাই আমরা যেনো আর এসব নিয়ে ওনাদেরকে বিরক্ত না করি।”

এনগেজমেন্টের কথা শুনে জারিফ আশ্চর্য হয়।জারিফের বুকের ভেতর ছলাৎ করে উঠে।বুকের ভেতর থাকা হৃদপিন্ড নামক যন্ত্রটায় তোলপাড় শুরু হয়।যতটা কষ্টে ছিলো তার চেয়ে এখন বেশি ব্যাথা অনুভব হচ্ছে বুকের ভেতর।বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথাটা বাড়তে শুরু করে।জারিফ মনে মনে বলে, তারমানে মহিলাটির বলা কথাগুলো সত্য।লিয়ার সেদিন এনগেজমেন্ট হলে,বিয়ে হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়।ওহ্ শিট!এখন বুঝতে পারছি।কিজন্য লিয়া সেদিন সকালে ব্যতিব্যস্ত হয়ে কল করেছিলো।আর বারবার বলছিলো জরুরী কিছু বলার আছে।আমি কেনো যে লিয়ার পুরো কথাটা ভালো করে শুনিনি? তারমানে অভ্রর বাবা মা এনগেজ করতেই আসছিলো।লিয়া সেইটাই বলতে চেয়েছিলো।তাহলে বিয়েটা লিয়া করেই নিয়েছে?”

জারিফ ওর বাবার উপর অভিযোগ করে বলে,,
“তুমি কেনো আমাকে এটা বলোনি?লিয়ার আব্বু তোমাকে এসব বলেছে।যদি তুমি আমাকে সেইদিনই বলতে,তাহলে আজ হয়তো এরকমটা হতে নাও পারতো।”

আইনাল হোসেন দুই হাত টেবিলের উপর রেখে শান্ত গলায় বলেন,,”আমি যদি বলতাম।তাহলে তুমি হয়তো সব কিছু ফেলে সেদিনই যে করেই হোক চলে আসার চেষ্টা করতে।তবে এসে কি করতে শুনি?”

জারিফ বাবার প্রশ্ন শুনে মাথা নিচু করে নিশ্চুপ হয়ে থাকে।আইনাল হোসেন গলার স্বর একটু শক্ত করে বলেন,,”তুমি হয়তো শেষমেষ লিয়ার বাবার বিরুদ্ধে গিয়েই বিয়েটা করে নিতে। কিন্তু এটা আমার নীতির বিরুদ্ধে।কারন মেয়েকে মানুষ করেছেন।লালন পালন করে এত বড় করেছেন।তার ও তো কিছু এক্সপেক্ট থাকতেই পারে।তিনি এক জায়গায় কথা দিয়েছেন।তার কথারও তো ওয়েট রাখতে হবে।আর মেয়ের বাবা বেঁচে থাকতে মেয়ের একমাত্র গার্জিয়ান বাবাই হয়। সেখানে গার্জিয়ান এর সাক্ষী ছাড়া যে বিয়ে হয়।সে বিয়ে বাতিল হয়।তুমি নিশ্চয় জানো এটা।আর আমি এটা বিশ্বাস করি। সর্বোপরি বলবো,তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছো।ভাল মন্দ জ্ঞান তোমার আছে।যেটা ভালো বুঝো তাই করো।না খেয়ে,না ঘুমিয়ে নিজেকে কষ্ট দিওনা।কারন তোমাকে কষ্টে থাকতে দেখলে আমাদের মোটেও ভালো লাগবে না।তোমার চিন্তায় তোমার আম্মু ও ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি। পরিবারের সবার কথা ভেবে হলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করো। আল্লাহর উপর ধৈর্য্য রাখো।তিনিই সব কিছু ঠিক করে দিবেন ইন শা আল্লাহ।”

জারিফ চেয়ার ছেড়ে উঠে সোজা রুমে চলে যায়।কালকে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে খোঁজ নেওয়ার যে অদম্য ইচ্ছে ছিলো যে সব ইচ্ছে আইনাল হোসেন এর কথা শুনে দমে যায়। বিছানায় বসে এক হাত কপালে রেখে জারিফ ভাবে,সেদিন যদি এনগেজমেন্ট হয়।তাহলে সত্যি হয়তো বিয়েটা হয়ে গিয়েছে।আর যদি বিয়েটা হয়েই থাকে।তাহলে আমি গিয়ে কি করবো?লিয়াকে অন্য কারো পাশে আমার এই দুচোখ কিছুতেই দেখতে পারবে না।তার আগে যেনো আমার এই দুচোখ আলো হারায়।লিয়া তোমাকে পাওয়ার ইচ্ছা আমার ততটা।একজন অন্ধ ব্যক্তির এই পৃথিবীতে আলো দেখতে পাওয়ার ইচ্ছা যতটা।তারপরেও সবশেষে চাইবো তুমি যেখানেই থাকো না কেনো ভালো থেকো।আমার ভালোবাসার মানুষ টাকে যে পেয়েছে।সে সত্যিই খুব লাকি।হয়তো তুমিও মেনে নিয়েছো তাকে।নাহলে তো আমার সাথে এ কয়দিনে যোগাযোগ করতে।কি আছে তোমার সামনে গিয়ে তোমার নতুন জীবনে সমস্যা সৃষ্টি করে।তারচেয়ে বলবো ভালো থেকো।সুখে থেকো।এই শহরটা যেমন আছে তেমনই থাকবে।তবে বদলে যাবে কিছু জীবনের গল্প আর স্মৃতি।তুমি কাছে থাকো বা দূরে তাতে কি আসে যায়।আমি তো তোমাকে ভেবেই প্রতিটা সময় পার করবো।ভালোবাসি বড্ড বেশিই ভালোবাসি আমার পা’গলিটাকে।

সময় নদীর স্রোতের মত বয়ে যায়।দেখতে দেখতে তিন তিনটে মাস কে’টে গিয়েছে। লিয়ার রেজাল্ট দিয়েছে। প্রত্যেক সাবজেক্টে নাইনটির উপরে ছিলো।হ্যান্ডসাম মার্ক ছিলো প্রত্যেক টা সাবজেক্টে।মেডিকেলে এডমিশন টেস্ট দিয়েছিলো।বাট আনফরচুনেটলি চান্স পায়নি।আর না পাওয়ার পিছনে অবশ্য কারনও আছে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকার কারনে লিয়া ঠিকমতো প্রিপারেশন নিতে পারেনি।বই সামনে নিয়ে বসেই ছিলো। দৃষ্টি বইয়ের পাতায় থাকলেও মনমস্তিষ্ক ছিলো না পড়ায়। মনমস্তিষ্ক তো উদাস হয়ে জারিফের কথাই সর্বক্ষণ ভেবে যায়।মেডিকেলে চান্স না পাওয়ায় লিয়ার মনে এতটুকু আক্ষেপ হয়নি।কোনো রিয়াকশনই হয়নি।কখনো আওড়ায়নি উফ! চান্স পেলাম না কেনো?হেন তেন। কখনো এতটুকু আফসোস হয়নি।মন সারাক্ষণ বলে, যেখানে যাকে চেয়েছি তাকেই পেলাম না।সেই কষ্টের কাছে এটা কোনো বিষয়ই না।নতুন করে হারানোর আর কিছু আমার নেই।এবার আমি হারিয়ে গেলেই আমার জীবনের গল্প এই পৃথিবী নামক গ্রহ থেকে সমাপ্ত।লিয়ার বাবা মেডিকেলে চান্স না পাওয়াতে বেশ মনক্ষুণ্ণ হয় লিয়ার উপর। অবশেষে এক প্রকার রা’গ করেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা বগুড়ায়, সরকারী শাহ্ সুলতান কলেজে ইকোনমিক্স এ ভর্তি করান।

প্রকৃতিতে এখন গ্রীষ্ম ঋতু চলছে। এবারের গ্রীষ্ম ঋতু টা লিয়ার কাছে বেশিই বেদনাদায়ক।ধরণীতে সন্ধ্যা নামার বার্তা দিতে সূর্য মামা পশ্চিম আকাশে লালাভ রঙ ধারণ করছে।ব্যালকনিতে দুই হাত বুকে গুঁজে এক রমণী দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি লোহার গ্রিল ভেদ করে সবুজ খোলা মাঠে।মাঝারি বয়সের কিছু ছেলেরা ফুটবল খেলছে।এমন সময় রাহবার এসে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে,,”আ্যই আপু।কি করিস?”

লিয়া চকিতে রাহবারের দিকে তাকিয়ে বলে,,”এইভাবে হুট করে কানের পাশে এসে কেউ চিল্লিয়ে কথা বলে।আমি তো চমকে গিয়েছিলাম।”

রাহবার কপাল কুঁচকে বলে,,”তা কি এতো ভাবনায় ডুবে আছিস?যে আমার আসার শব্দ শুনতে পাসনি।”

লিয়া ছোট করে শ্বাস টেনে নিয়ে বলে,,”কিছু বলার থাকলে ফটাফট বলে ফেল।আর তা না হলে এখন যেতে পারিস।”

রাহবার নাক মুখ কুঁচকে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,,”যাবো তো অবশ্যই।তবে তার আগে তোকে নিউজ দিতে আসলাম।”

লিয়া ভ্রু কুঁচকিয়ে ইশারায় বোঝায়”কি?”

“আব্বু কে বলতে শুনলাম। সামনের সপ্তাহে আমরা দাদু বাড়িতে যাচ্ছি।আমার তো সামার ভেকেশন চলছে।তাই আমি খুব এক্সাইটেড।মজা করে ছুটিগুলো দাদু বাড়িতে কাটাতে পারবো।”

লিয়া ম্লান স্বরে বলে,,”যাস।সমস্যা কোথায়?তবে আমি কোথাও যেতে পারবো না। আব্বু কে বলে দিস।”

“তুই যাবি কি যাবি না।সেটা আমার জানার বিষয় না।আমি তো যাবোই।”

কথাটা বলেই দেরি না করে হনহনিয়ে রাহবার দ্রুত চলে যায়।লিয়া মনে মনে আওড়ায়,আজ থেকে দুইবছর আগে এই সামার ভেকেশনে আপনার সাথে আমার ফাস্ট দেখা হয়েছিলো। আপনি কোথায় স্যার?আপনি আর আমার কাছে ফিরলেনই না।আমি আপনার জন্য এখনো অপেক্ষায় আছি। মানুষ মুখে শুনেছিলাম,কেউ যখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।তখন না-কি বদলে যায় তার নেচার।তবে কি আমি ধরে নিবো আপনিও সেই সব মানুষদের তালিকায় আছেন। আপনিও কি প্রতিষ্ঠিত হয়ে বদলে গিয়েছেন? আপনার উপর আমার যে সব ধারনা ছিলো সেসব কিছু কি ভুল ছিলো?আপনাকে আমি চিনতে ভুল করেছিলাম কি?আপনি পাল্টে গিয়েছেন কি?আমার থেকে বেটার কাউকে পেয়ে আমায় ভুলে গিয়েছেন হয়তো।তা না হলে কেনো আপনি একবারো আমার খোঁজ করতে আসেননি? কেনো?এসব কিছু ভেবে লিয়ার মনটা হুহু করে কেঁদে উঠে।লিয়া অস্ফুট স্বরে বলে,জীবনের প্রথম ভুল ছিলো আপনার সাথে দেখা হওয়া। দ্বিতীয় ভুল ছিলো আপনাকে ভালো লাগা।আর তৃতীয় ভুল যেটা আমি জেনে বুঝে ইচ্ছাকৃত ভাবেই করি।সেটা হলো নিজের থেকে আপানাকে বেশি ভালোবাসে ফেলি।

রাতে ব্যালকনিতে রাখা চেয়ারে জারিফ বসে আছে।সেদিন দুপুরেই জারিফ যশোরে চলে আসে।যদিও হাতে ছুটি ছিলো,তবুও না থেকে চলে আসে।আজ তিনমাস হচ্ছে ময়মনসিংহে যায়নি আর।ঐ শহরে আছে ভালোবাসার মানুষটার সাথে কাটানো অনেক স্মৃতি।নিজ শহরে থাকতে জারিফের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো।তাই বিলম্ব না করে দ্রুত চলে আসে।এখানে কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জারিফ।তবে কতটুকু স্বাভাবিক আছে,তা জারিফ নিজেই জানে শুধু। ফোনের স্ক্রিনে লিয়ার একটা ছবির দিকে তাকিয়ে জারিফ অস্পষ্ট স্বরে বলে,,তুমি যতবার না আয়নায় তোমার নিজেকে দেখো।তার থেকেও বেশি বার আমি তোমার ছবি দেখি।খুব ইচ্ছে করে তোমায় প্রাণ ভরে দেখতে। কিন্তু তুমি তো আছো ধরা ছোঁয়ার বাইরে।কিছু ব্যাথা অনুভব করা যায়। কিন্তু প্রকাশ করা যায়না।আবার কিছু স্মৃতি মনে রাখা যায়। কিন্তু কিছুতেই মুছে ফেলা যায়না।তুমি আমার সেই স্মৃতি যাকে আমি মৃ”ত্য”র আগ পর্যন্ত-ও ভুলতে পারবো না। আর আমি কখনো চাইবোও না ভুলতে।রেখে দেবো তোমাকে আমার কল্পনায়।ভুলতে পারবো না কখনো তোমায়।কিছু দিনের জন্য তোমাকে পেয়ে ভেবেছিলাম ,জীবনের সব পেয়ে গিয়েছি। কিন্তু আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে পানির উপর চাঁদের আলো ক্ষনিকের জন্য আসে।ঠিক তেমনি তুমিও বুঝি ক্ষনিকের জন্যই এসেছিলে আমার জীবনে। তুমি আমার অদ্ভুত এক মায়া।যাকে ভুলতে পারবো না কখনো। নিজেকে পাহাড়ের মতো শক্ত রাখতে গিয়ে,ভেতরে ভেতরে নদীর মতো ভেঙ্গে যাচ্ছি।তবুও কাউকে বুঝতে দেয়নি আমি কতটা কষ্টে আছি।

জারিফের ভাবনার মাঝেই ফোন বেজে উঠে। জারিফ রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলে,,”হ্যা আম্মু বলো।”

ফোনের ওপাশ থেকে ভেজা গলায় জাহানারা বেগম বলেন,,”জারিফ বাবা কেমন আছিস?”

“আমি ভালো আছি।তুমি কেমন আছো?আব্বু কেমন আছে?”

“সবাই আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।”

“তোমার শরীর স্বাস্থ্য ভালো আছে?”

জাহানারা বেগম ভরাট গলায় বলেন,,”শরীর স্বাস্থ্য আছে ভালো।তবে মনটা একদম ভালো নেই।আজ তিনমাস হয়ে যাচ্ছে তোকে চোখের দেখা দেখিনা।
তোকে খুব দেখতে মন চাইছে।তুই বাড়িতে এসে ঘুরে যা।”

জারিফ জড়তা নিয়ে বলে,,”আসলে আম্মু অফিসে খুব ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে।যাবো পড়ে সময় করে।”

যখনই জারিফ কে বাড়িতে আসার কথা বলা হয়।তখনই অফিসের কাজের অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে যায়। জাহানারা বেগম হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে কান্না জড়ানো গলায় বলেন,,”মা বাবার কথা তোর মনে পড়ছে না?তুই সেই এসে একদিন থেকেই চলে গেলি।আর আসার নামই নেই।”

মায়ের কথা শুনে জারিফ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু আওয়াজে বলে,,”আচ্ছা ঠিক আছে।তুমি চিন্তা করো না। সামনের সপ্তাহে যাবো।আর ভার্সিটিতেও যেতে হবে থিসিস জমা দিতে।”

ছেলের মুখে আসার কথাটা শুনে জাহানারা বেগম কিছুটা হলেও আনন্দিত হোন।এতোদিন আসার কথা বললেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতো ‌আজ অনন্ত যাবো বলেছে তো।এতেই মায়ের অশান্ত মনটা শান্ত হয়।

ঘড়ির কাঁটা রাত দশটার ঘরে। তাসনিম রুমে বসে ম্যাগাজিন পড়ছে ।আর মাঝে মাঝেই দৃষ্টি দিচ্ছে দেওয়াল ঘড়িতে।আলিফের জন্য অপেক্ষা করছে।একেক দিন একেক সময় আলিফ আসে। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ পেয়ে মাথা তুলে দরজার দিকে নজর দিতেই আলিফ কে দেখতে পায়।ম্যাগাজিন টা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে পা ঝুলিয়ে বসে তাসনিম। মৃদু কন্ঠে আলিফকে শুধায়,,”আজ এতো লেইট হলো আপনার।”

আলিফ টাইয়ের নাটটা এক হাতে ঢিল করতে করতে কপাল কুঁচকে ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে,,”তা তুমি কি আমাকে মিস করছিলে?”

তাসনিম নির্বিকার ভাবে জবাবে বলে,,”জানিনা।তবে চিন্তা করছিলাম।”

আলিফ পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,,”এই দুইটা ওয়ার্ডের মধ্যে ডিফারেন্স কি?”

তাসনিম প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলে,,”আপনাকে ট্রায়ার্ড দেখাচ্ছে। ফ্রেশ হয়ে নিন খাবার খেয়ে নিবেন।”

আলিফ বিছানার এক পাশে বসে পা থেকে মোজা খুলতে খুলতে বলে,,”আজকে একটা প্রোগ্রাম ছিলো।ওখানে সবার জন্য খাবারের ইনভাইট ছিলো।আমি ডিনার করে এসেছি।তোমাকে তো ফোনে বলেছিলাম।বাই দ্যা ওয়ে তুমি ডিনার করোনি এখনো?”

তাসনিম ঘাড় নাড়িয়ে হ্যা সূচক উত্তর দেয়।আলিফ ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে তাসনিম এর পাশে বসে শান্ত গলায় বলে,,”তোমার অফিস কেমন চলছে?কোনো প্রবলেম নেই তো?”

আলিফের ক্লান্ত মুখশ্রীতে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মৃদু আওয়াজে বলে,,”হুম ভালোই চলছে।আপাতত কোনো প্রবলেম নেই।আজকে আপনাকে একটু বেশিই ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”

আলিফ তাসনিম এর কোলের উপর মাথা দিয়ে কোমড় জড়িয়ে ধরে বলে,,”মাথাটা ধরেছে খুব।ব্যাপার না তোমার মিষ্টি মুখটা দেখলে আমার সব ক্লান্তি নিমিষেই উড়ে যাবে।”

তাসনিম আলিফের চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।আর ভারি গলায় বলে,,”আমার মনে হয় আপনার উপর বেশি চাপ হয়ে যাচ্ছে।হসটপিটাল, চেম্বার সব সামলিয়ে আবার আমাকে আনা নেওয়া করা এজন্য আপনার উপর বেশিই স্ট্রেচ পড়ছে।আমি বলছি তো,আমি একাই পারবো যেতে।এই কয় মাসে তো রাস্তা ঘাট আমার চেনা জানা হয়েছে।”

আলিফ কাটকাট গলায় বলে,,”একদম নয়।তোমাকে আনা নেওয়া এসবে আমি কখনোই ক্লান্ত হইনা। বরঞ্চ যতটা তোমার সংস্পর্শে থাকি ততটা প্রফুল্ল আমি থাকি।ভালোবাসা বলতে আমি শুধু তোমাকেই বুঝি তাইতো দিনশেষে আমি শুধু তোমাকেই খুঁজি।তুমি আছো বলেই আমার নিজেকে মনে হয় পরিপূর্ণ।তুমি ছাড়া আমি একদম শূণ্য।তাই বলছি আর কখনো এরকমটা বলবে না।”

তাসনিম ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,,”ওকে।”

“আচ্ছা তুমি তো কালকে বলছিলে,তোমাকে ভার্সিটিতে একবার যেতে হবে থিসিস জমা দিতে।তা ঠিক করেছো কবে যাবে?”

“সামনের সপ্তাহেই যাবো ভেবেছি।”

[চলবে…ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here