#শুধু_তোমাকেই_চাই
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব২০
“ট্রাফিক সিগন্যাল এ সবুজ বাতি জ্বলে উঠতেই এক এক করে যানবাহন গুলো চলতে শুরু করলো।আর এদিকে লিয়া প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে লাগলো।লিয়া দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে,,”উফ্! বাঁচা গেলো।এই জ্যামে আটকা পড়ে আমার ছোট্ট প্রাণ পাখিটা এতক্ষণ ছটফট শুরু করে দিয়ে ছিলো।ভয়ে আমার তো হাত পা জমে আসছিলো।আর কপাল করে এই সময় আব্বু কেও এদিক দিয়ে যাওয়ার ছিলো।আমার হার্টবিট ফেইল করানোর জন্য।আরেকটু হলে সত্যি সত্যিই হার্টবিট মিস করতাম।”
জারিফ পকেট থেকে টিস্যু বের করে লিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে শান্ত চাহনিতে পাশে বসা কিশোরীর পানে চেয়ে স্মিত হেসে বলে,,”ঘেমে গিয়েছো তো।এখন একটু কুল হও।”
মুখের উপর চুলগুলো থাকায় লিয়ার খুব গরম লাগছিলো।সেইজন্য ঘামতে থাকে।লিয়া এক হাত দিয়ে আলতো করে চুলগুলো মুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে, মাস্ক টা খুলে,তারপর টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে নেয়।মুখ মুছার সময় টিস্যু ভিজে দু এক জায়গায় খুঁত খুঁত সাদা টিস্যুর টুকরো রয়ে যায়।জারিফ এটা দেখে লিয়াকে ইশারায় মুখ থেকে টুকরো গুলো ফেলতে বলে।লিয়া বিষয় টা বুঝতে না পেরে বলে,,”আমি তো দেখতে পাচ্ছি কোন জায়গায় আছে?ভালো করে বলুন।”
জারিফ কোনো বাক্য ব্যয় না করে সরাসরি হাত দিয়ে লিয়ার কপাল থেকে লেপ্টে থাকা সাদা টুকরো গুলো ফেলে দেয়।
চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে নাস্তা করে সন্ধ্যার আগেই লিয়া বাসায় চলে আসে।
রাতে হালকা কিছু খেয়ে লিয়া রুমে চলে আসে।রুমে এসে জারিফের কাছে ফোন করবে বলে,ফোন খুঁজতে থাকে। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক খুজাখুজি করে পরক্ষনেই লিয়ার মনে পড়ে বাসায় আসার পর তো ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করাই হয়নি।লিয়া এক হাত দিয়ে ব্যাগের চেইন খুলে দেখে অবাক হয়। শুধু অবাক বললে ভুল হবে অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে যায়।লিয়া দেখতে পায়,ওর ব্যাগের ভেতর ছোট একটা গিফট বক্স।চোখে মুখে উৎসুকতা নিয়ে লিয়া বক্সটা বের করে কিয়ৎক্ষন ভাবে,ব্যাগের ভেতর এটা রাখলো কে? অদ্ভুত বাইরে যাওয়ার সময় তো আমি ব্যাগ দেখেই নিয়ে গিয়েছিলাম।আর বাইরে তো সব সময় ব্যাগ আমার কাছেই ছিলো।তাহলে এটা এখানে আসলো কি করে,স্ট্রেইন্জ।এই ব্যাপারে আম্মু কে কিছু বলবো কি?
আবার কিছু একটা ভেবে লিয়া মনে মনে আওড়ায় থাক আম্মু কে জানানোর দরকার নেই। আচ্ছা স্যার তো রাখেনি আবার? কিন্তু কখন রাখবে?সব সময় তো আমি স্যারের সাথেই ছিলাম।
অনেকক্ষন ভাবাভাবি করে কোনো মতেই লিয়া ক্যালকুলেশন করে উত্তর মিলাতে পারছিলো না।তারপর কৌতুহল বশত লিয়া বক্স টা খুলে দেখে আশ্চর্য হয়। সুন্দর একটা রুপার পায়েল চকচক করছিলো।লিয়া এক হাতে পায়েল টা তুলে সামনে ধরে দেখে অস্ফুট স্বরে বলে,এতো সেই দিন যে পায়েল টা আমার পছন্দ হয়েছিলো সেইম সেই ডিজাইনের বাট এটা তো রুপার।লিয়া এক সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝে ফেলে এটা জারিফ দিয়েছে।লিয়া পায়েল টা হাতের মুঠোয় নিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে নিঃশব্দে হাসে।স্যার আমাকে গিফট করেছে। পায়েলটা পায়ে দিয়ে দেখতে থাকে।
লিয়া বিছানায় বসে পায়েল টার দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে আর জারিফের কাছে কল করে।সালাম দিয়ে মৃদু আওয়াজে লিয়া শুধায়,,”স্যার ডিনার করেছেন?কি করছেন?”
জারিফ পড়ার টেবিলে বসে পড়ছিলো।সেই সময় ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠে ।জারিফ রিসিভ করে সালামের উত্তর দিয়ে শান্ত গলায় বলে,,”হুম,ডিনার করেছি।সামনের মাসেই তো বিসিএস প্রিলিমিনারি তাই প্রিপারেশন নিচ্ছি।”
লিয়া ভরাট গলায় বলে,,”ওহ্।এই সময়ে আমি ফোন করে ডিস্টার্ব করে ফেললাম।সরি।”
জারিফ নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,,”একদম নয়।যে অবস্থাতেই থাকি বা সিচুয়েশন যেমনই হোক না কেনো,তোমার বিষয়ে কখনোই আমি বিরক্ত হইনা আর না কখনো হবো। তোমার সব কিছুতেই আমি মুগ্ধতা খুঁজে পাই।ইউ আর মিক্সড ইন মাই ট্রায়ার্ড ব্রেইন লটস অফ লাভ।(তুমি আমার ক্লান্ত মস্তিষ্কে মিশে থাকা এক গুচ্ছ ভালোবাসা) তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বিশেষ ও অপূর্ব প্রিয়জন।তুমি আমার সেই নে’শা।যার সাথে কথা না বললে,আমার মন ভালো হয়না।তোমার সাথে কথা না হলে আমার মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়।তাই বিরক্ত হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।”
জারিফের প্রতিটা কথা শুনে লিয়া নিজেও মুগ্ধ হয়।আসলে প্রত্যেক টা মানুষেরই নেচার এটা প্রিয়জনের সব কিছুর মধ্যেই ভালো লাগা খুঁজে পাওয়া। প্রিয়জনের মুখ নিঃসৃত ছোট একটা শব্দ অনায়সে মন ভালো করতে সক্ষম।লিয়া কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ থেকে মৃদু আওয়াজে বলতে থাকে,,”স্যার আপনি পায়েল টা কেনো দিতে
লিয়ার কথাটা শেষ করতে না দিয়ে,ফোনের ওপাশ থেকে জারিফ নির্বিকার গলায় বলতে থাকে,,”তুমি আগে বলো,তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা?কেনো দিতে গেলাম,এটা তোমার না জানলেও চলবে”
লিয়া এক হাত দিয়ে আলতোভাবে পায়েলটা ছুঁয়ে, কোমল গলায় বলে,,”আপনি দিয়েছেন এখানে পছন্দ না হওয়ার কোনো কারনই নেই।কারন ইউ আর মাই ফাস্ট প্রায়োরিটি।আমার লাইফে সব কিছুর ঊর্ধ্বে আপনি।সেই আপনি নিজে আমাকে গিফট করেছেন সেটা আমার কাছে সব থেকে বেস্ট।আর রিয়েলি অনেক সুন্দর হয়েছে। স্যার এটা তো দেখছি,সেদিন দোকানে আমি যেটা চুজ করেছিলাম সেইম ডিজাইনের।আর স্যার কিউরিওসিটি নিয়ে বলছি,আপনি কোন সময় ব্যাগে রেখেছিলেন?”
লিয়ারা চলে যাওয়ার পর সেদিন জারিফ দোকান থেকে ঐ পায়েল টার পিক তুলে নিয়েছিলো।সেই পিকটা দেখিয়ে অর্ডার দিয়েছিলো সেইম পায়েল বানানোর।
জারিফ গলা ঝেড়ে বলতে থাকে,,”আসলে আমি তো তোমাকে চিনি।আমি তোমাকে দিতে গেলে তুমি নিতে চাইতে না।আর বাইরে লোকজনের সামনে বারবার তোমাকে নিতে বলা,বিষয়টা কিরকম দেখায় না।তুমি সেই সময় লোকজনের মধ্যে বিব্রত বোধ করতে।আর আমি তোমাকে বিব্রতকর পরিস্থিতে ফেলতে চাইনা।তাই তুমি যখন খাওয়া দাওয়া শেষে ওয়াশের জন্য বেসিনে গিয়েছিলে সেই সময়।”
লিয়া নিঃশব্দে হেসে ছোট করে বলে,,”ওহ্।”
জারিফ কিয়ৎক্ষন ভেবে গম্ভীরভাবে বলে,,”আচ্ছা তুমি এব্যাপারে আন্টিকে ম্যানেজ করবে কিভাবে?না মানে আন্টি দেখলে তো তোমাকে প্রশ্ন করবে নিশ্চয়।”
লিয়া দুই সেকেন্ড ভেবে নিয়ে ভরাট গলায় বলে,,”আসলে আমি এখনই আম্মুকে এই বিষয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না।পরশু তো চলে যাবো,ওখানে গিয়ে পায়েলটা পড়তে পারবো।আর আপনার দেওয়া আমাকে ফাস্ট গিফট এটা আমি সযত্নে আমার কাছে রেখে দেবো।”
“আচ্ছা লিয়া ভালো থেকো।এবার ঘুমিয়ে পড়ো কেমন।”
“ওকে।বাই।”
কয়েক মাস পর,,
লিয়া ক্যাডেটে আছে।এদিকে জারিফ প্রিলিতে ঠিকেছে আবার রিটেনেও ঠিকেছে।এখন সামনে ভাইবা ওয়েট করছে।জারিফের ফাস্ট চয়েজ বিসিএস প্রশাসন।আর এদিকে মাস্টার্স ও করছে।
বেলা দশটার দিকে জেরিন ড্রয়িংরুমে বসে প্রাকটিক্যাল খাতা প্রস্তুত করছিলো। জারা স্কুলে গিয়েছে।জাহানারা বেগম রুমে ছিলেন।এমন সময় কলিং বেল বাজতে থাকে। জেরিন বিরক্তিতে মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে চ জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করে বিড়বিড় করে বলে,এখন আবার কে আসলো। আব্বু তো স্কুলে,ভাইয়াও এইমাত্র বাইরে গেলো। কেবলই ব্যাঙের পোস্টিকতন্ত্র আঁকতে বসেছি,ধ্যাত ভালো লাগে না।এখন আমাকে উঠে দরজা খুলতে হবে,জারাটা থাকলে আমার আর যেতে হতো না।এসব কিছু বিড়বিড় করে বলে জেরিন বিরক্তিকর ফেস নিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখে, লম্বা চওড়া শ্যাম বর্ণের একটা ছেলে স্ট্রেইট দাঁড়িয়ে আছে।জেরিনের কাছে মনে হচ্ছে এই ফেসের সাথে শ্যামবর্ণটা যেনো বেশি পারফেক্ট হয়েছে। সেইজন্য ছেলেটিকে বেশি আকর্ষণীয় লাগছে।জেরিন এক পলক দেখে নিয়ে দৃষ্টি নিচু করে কাকে চাই জিগ্গেস করতে যাবে,তার আগেই দরজার ওপাশের মানবটা স্থির দৃষ্টিতে সামনে থাকা মেয়েটির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শান্ত গলায় শুধায়,,
“জারিফ আছে?আমি জারিফের ফ্রেন্ড রোহান।”
জেরিন মৃদু আওয়াজে জবাব দেয়,,”ভাইয়া বাসায় নেই।একটু আগেই বাইরে গিয়েছে।”
রোহান ছোট করে বলে,,”ওহ্।”
জাহানারা বেগম এদিকে এগিয়ে আসতে আসতে হাঁক ছেড়ে জেরিন কে ডেকে শুধালেন,,”কে আসছে জেরিন?”
জেরিন ঠোঁট প্রসারিত বলতে যাবে,তখন জাহানারা বেগম এসে রোহান কে দেখেই চিনতে পারেন।কারন এর আগে একদিন রোহান জারিফের সাথে আসছিলো। জাহানারা বেগম মিষ্টি হেসে নরম কন্ঠে শুধালেন,,”কেমন আছো বাবা?”
রোহান সালাম দিয়ে অমায়িক হেসে বলে,,”আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আন্টি।আপনি কেমন আছেন?”
“এই তো আল্লাহ রেখেছেন যে হালে। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।তোমার বাবা মা কেমন আছেন?আর ভেতরে আসো বাবা।”
জেরিন দরজার সামনের থেকে সরে দাঁড়ায়।রোহান জেরিনের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ভেতরে ঢুকে মনে মনে বলে,জারিফের বোন তো দেখছি বেশ সুন্দরী।জারিফকে তো সত্যিই শা’লা বানানো যায়।রোহান সোফায় বসে বলে,,”আসলে এই দিকে একটা কাজে আসছিলাম তো।তাই ভাবলাম জারিফের সাথে দেখা করে যাই।”
জাহানারা বেগম শান্ত গলায় বলে,,”জারিফ একটু আগেই বাইরে গিয়েছে।তুমি বসো ও চলে আসবে হয়তো।”
জাহানারা বেগম জেরিন কে সাথে নিয়ে কিচেনে যান। নাস্তা রেডি করতে।সামনে থাকা ট্রি টেবিলের উপর প্রাকটিক্যাল এর খাতা পেন্সিল দেখে রোহান বুঝতে পারে,জেরিন বোধহয় খাতা প্রস্তুত করছিলো। অর্ধেক আঁকানো চিত্র টা দেখতে থাকে রোহান।এর আগে একদিন জারিফের বাসায় আসলেও শুধু জাহানারা বেগম এর সাথেই দেখা হয়ছিলো।জারা বা জেরিন কারো সাথে দেখা হয়নি।
জেরিন নাস্তা এনে টেবিলের উপর রেখে হালকা কেশে বলে,,”ভাইয়া আপনার নাস্তা।”
রোহান খাবার খেতে খেতে বলে,,এইবার এইচএসসি দিবে। প্রিপারেশন কিরকম?”
রোহানের প্রশ্নে জেরিন ভাবে উনি কিকরে জানলো? পরক্ষনেই টেবিলের উপর বায়োলজি বইটা দেখে জেরিন ওর প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায়। জেরিন ঘাড় নাড়িয়ে হ্যা সূচক উত্তর দিয়ে বলে,,”ভালো।”
রোহান প্রাকটিক্যাল খাতার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে,,”বাহ্।বেশ সুন্দর করে তো আঁকিয়েছো। ফ্রি হ্যান্ডে না ট্রেসিং করে আঁকছো?”
জেরিন কোমল স্বরে বলে,,”আসলে ভাইয়া ফ্রি হ্যান্ডেই তো আঁকানোর নিয়ম।বাট অত দক্ষ নইতো সেইজন্য ট্রেসিং করেই।”
জেরিনের কথাটা শুনে রোহান মুগ্ধ হয়। রোহান মনে মনে আওড়ায়, বাহ্ বেশ অনেস্ট চিন্তা।তারপর রোহান গলা ঝেড়ে বলতে থাকে,,”নাহ্, ঠিক আছে।আসলে প্রায় সবাইই ট্রেসিং করে।তা পরীক্ষা শেষে চিন্তা কি তোমার?কোথায় ভর্তি হতে চাও?”
“এখনও শিয়র হয়ে ভেবে দেখিনি।কারন একবার মেডিকেলের কথা ভাবি।আবার কিছু কিছু ফ্রেন্ডদের কথা শুনে ইন্জিনিয়ারিং এর দিকে যেতে ইচ্ছে করে।আবার আপনাদের ভার্সিটিতেও এডমিশন দেওয়ার ইচ্ছে আছে।”
রোহান দৃষ্টি সরু করে বেশ শান্ত গলায় বলে,,”এ ব্যাপারে জারিফের থেকে ডিসিশন নিতে পারো।”
“হুম।”
রোহান নাস্তা শেষ করে জাহানারা বেগম কে উদ্দেশ্য করে বলে,,”আন্টি আমি এখন আসছি।জারিফের সাথে ফোনে কথা বলে নিবো।”
জাহানারা বেগম শান্ত গলায় বলে,,”আচ্ছা ঠিক আছে বাবা।আবার এসো কেমন।”
রোহান অমায়িক হেসে বলে,,”নিশ্চয় আসবো আন্টি।”
যাওয়ার সময় জেরিনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসে।
সময়টা মধ্য দুপুর বেলা বারোটা।জারিফ আর ওর ফ্রেন্ডরা ক্লাস শেষ করে ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো।যদিও একে একচুয়েলি আড্ডা বলে না।কারন ওরা আন্তর্জাতিক বিষয় তারপর ওদের সামনের ভাইবা নিয়েই আলোচনা করছিলো।সেই সময় জারিফের ফোনে কল আসে।জারিফ ফোনটা ওপেন করে দেখে হটস আ্যপে লিয়ার ভিডিও কল।এই সময় লিয়ার কল তাও আবার ভিডিও এতে করে জারিফ অনেকটা অবাক হয়।জারিফ বন্ধুদের দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে,,”দোস্ত তোরা থাক,আমি একটু আসছি।”
জারিফ ফোন নিয়ে বাইরে চলে যায়।তবে রেখে যায় প্রশ্ন বিদ্ধ চার জোড়া চোখ।ওরা চারজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে সবার মনেই একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে,,কার ফোন আসলো যে জারিফ এখানে বসে রিসিভ করলো না।তবে মুখে কেউ বললো না।
ক্যাডেটে আজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। অনুষ্ঠান চলছে।লিয়া অরিন ইচ্ছা করে পিছনের সারিতে বসছে।এটা অবশ্য অরিনের প্লান।অরিনের ভাষ্যমতে, পিছনে বসলে জমিয়ে গল্প করা যাবে,স্যার ম্যামের দৃষ্টি পড়বে না। অরিনের বুদ্ধিতে পিছনের সারিতে বসে লিয়া নিজেও আজ এর ফায়দা হাসিল করতে ব্যস্ত।লিয়া ভাবে এখন স্যারের সাথে কথা বলে নিই।
জারিফ Accept এর উপর এক আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করতেই ফোনের স্ক্রিনে ভেসে আসে,ক্যাডেটের পোশাক পড়া, চুলগুলো দুইপাশে দুইটা বেনুনি করা। বেনুনি দুইটা দুই কাঁধের উপর দিয়ে সামনে দেওয়া,গলায় চিকন একটা স্বর্ণের চেইন।মাথায় সাদা ক্যাপ।ক্যাপের উপর বড়বড় করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সেই নিয়ে লেখা।লিয়ার হাস্যোজ্জ্বল ফেস।এই লুকে লিয়াকে দেখে জারিফ কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলে নেয়।লিয়াকে খুব সুন্দর লাগছে।লিয়ার কপালে আর থুতনিতে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। এটা যেনো লিয়ার সৌন্দর্যতা আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি করেছে।
জারিফ শান্ত গলায় বলে,,”তা আজ হঠাৎ এই সময় ফোন দিলে যে।”
লিয়া নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,,”আপনার কথা মনে পড়ছিলো তাই।অবশ্য সব সময়ই আপনার কথা মনে হয়। কিন্তু পরিবেশ, পরিস্থিতির জন্য ইচ্ছে থাকলেও কল দেওয়ার সুযোগ হয় না।এখন যেহেতু সুযোগ পেলাম,তাই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে ফেললাম।”
জারিফ স্মিত হেসে বলে,,”ভালো করেছো।লিয়া তোমাকে তো এই লুকে একদম বাচ্চা বাচ্চা লাগছে।তো আমার ফিউচার বউ হিসেবে তোমাকে আজকে একটু বেশিই ইম-ম্যাচিউর লাগছে।”
জারিফের কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই পাশ থেকে অরিন গমগমে স্বরে বলে,,”তা আপনারা বিসিএস ক্যাডারদের তো নজর পড়ে শুধু বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের উপর।আপনাদের দৃষ্টি আটকে যায় ইম-ম্যাচিউর দের উপর।আর এই বাচ্চা মেয়েদের কে বিয়ে করে নিয়ে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাচ্চার মা বানিয়ে ফেলে।এখন আমার বান্ধবী কে বাচ্চা বাচ্চা দেখতে লাগছে বললেও ঠিকই আর দুইদিন পর আপনার বাচ্চার মা বানিয়ে ছাড়বেন।”
অরিনের কথা শুনে জারিফ অস্বস্তিতে পড়ে যায়। লজ্জায় লিয়ার ফর্সা মুখটা লালাভ বর্ণ ধারণ করে।লিয়ার কান গরম হয়ে আসে।তাই বলে স্যারের সামনে অরিন গড়গড় করে কিসব বলে ফেললো।লিয়া অরিনের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে ইশারায় চুপ থাকতে বলে।লিয়া ব্যাগ থেকে ইয়ার ফোনটা বের করে সেট করে নেয়।লিয়া পরিস্থিতি টা স্বাভাবিক করার জন্য প্রসঙ্গ বদলিয়ে বলে,,”স্যার আপনি তো দেখছি ভার্সিটিতেই আছেন।বাসায় যাবেন কখন?”
জারিফ চুলের মধ্যে এক হাত চালিয়ে বলে,,”এই তো একটু পরেই।””
লিয়া ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,,”ওহ্।আমাদের এখানে আজ প্রোগ্রাম হচ্ছে।”
জারিফ শীতল কন্ঠে বলে,,
“তোমাকে দেখে তা বোঝাই যাচ্ছে।বিশেষ করে ক্যাপ টা।তা তুমি কিসে পার্টিসিপেট করেছো?”
লিয়া মৃদু আওয়াজে বলে,,
“আই ডেলিভার দ্যা স্পিস অন দ্যা কারেন্ট ইন্টারন্যাশনাল এ্যপেয়ার্স।
“গুড।আই ফিল প্রাউড ফর ইউর ডেলিভার স্পিস।”
“থেংকিউ।”
কিছু সময় থেমে লিয়া মুখটা মলিন করে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,,”স্যার আপনাকে অনেকদিন দেখি না। আপনার সাথে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে খুব। আপনার মায়ায় এমন ভাবে আটকিয়েছি যে,এখন আপনি ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না।”
লিয়ার কথা শুনে জারিফ স্মিত হেসে নরম কন্ঠে বলে,,
“আমার কাছেও সব চেয়ে ভালো মূহূর্ত হলো,তোমার সাথে কাটানো মূহূর্তগুলো।তবে চোখের দেখায় নয়, মনের দেখায় ভালোবাসি । কাছে থাকো বা দূরে তোমাকেই ভেবে হাসি।সবাই তো খুশি চায়।আর আমি আমার প্রতিটি খুশিতে শুধু তোমাকেই চাই।পাগল হাওয়ার মত, আমার এই দুচোখ তোমার দিকে তাকিয়েই আজীবন নির্বাক হতে চায়।জীবনে কি পেয়েছি তা জানিনা,তবে ভাগ্য করে একটা পা’গলি পেয়েছি।যে আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না।লাভ ইউ আমার পিচ্চি,পাগলি প্রেয়সী।”
জারিফের প্রতিটি কথা শুনে লিয়ার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফোটে লিয়া কোমল গলায় বলে,,”লাভ ইউ টু।”
“অল দ্যা বেস্ট। ভালোভাবে নিজেকে প্রেজেন্ট করো কেমন আর ইনজয় করো।বাই।”
সময় চলে যায় পানির স্রোতের মতো।তবে সময়ের সাথে সাথে সব কিছুই পরিবর্তন হতে থাকে।পরিবেশের সাথে সাথে মানুষের জীবনেও আসে পরিবর্তন।এই পরিবর্তন কারো কারো জীবনে ভালোর বার্তা বাহক হয় আবার কারো কারো জীবনে খারাপের।তবে আপাতত জারিফ আর ওর ফ্রেন্ডদের সময়টা খুব ভালো।ওদের সবারই চিত্ত প্রশান্তিতে আছে।জারিফ ভাইবাতেও ঠিকেছে।এখন পুলিশ ভেরিফিকেশন করে জারিফকে জয়েনিং এর ডেট দিবে।জারিফ বিসিএস প্রশাসন এ,রোহান লাইভ স্টোক, তাসনিম বিসিএস প্লানিং ।
ওদিকে পড়াশোনা নিয়ে লিয়া খুবই ব্যস্ত ছিলো।এখন একটু চিলমুডে আছে লিয়া। লিয়ার এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। প্রাকটিক্যাল চলছে।জারিফের বিসিএস প্রশাসন এ হওয়াতে লিয়া খুব খুশি।
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দূর আকাশে মিটিমিট করে জ্বলা তাঁরার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে,আর হয়তো বেশিদিন বাকি নেই।আমার সব স্বপ্ন পূরণ হতে।আমার পরীক্ষাও এদিকে শেষ হলো।স্যারের চাকরিও হলো।এখন স্যার যদি প্রস্তাব পাঠায় আব্বু নিশ্চয় রাজি হবে।না করতে পারবে না।
লিয়ার এসব ভাবনার মাঝেই অরিন এসে গমগমে সুরে বলতে থাকে,,”আচ্ছা লিয়া সত্যি করে একটা কথা বলতো, মাস্টার মশাই কি তোকে ভালোবাসে?”
অরিনের কথা শুনে লিয়া কপালটা কুঞ্চিত করে ইশারায় বোঝায়, হঠাৎ এরকম বলছিস যে?
অরিন হালকা কেশে মৃদু কন্ঠে বলে,,”নাহ্।আসলে।এখনকার লাভ বার্ড দের যেরকম ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন আলাপ,তারপর ঘুরতে যাওয়া এসব দেখা যায়।তোদের দুজনের মধ্যে আমি এরকম কিছু তেমন দেখি না,তাই প্রশ্ন টা করছি। তুইই তো বেশি সময় ফোন করিস।আর হাতে গোনা কয়েকবার মিট হয়েছে তোদের। মাস্টার মশাই তো মাঝে মাঝে এখানে এসেও দেখা করতে পারে।”
লিয়া অরিনের দিকে শান্ত চাহনিতে চেয়ে মৃদু আওয়াজে বলে,,”স্যার হয়তো নিজে থেকে খুব কমই আমাকে ফোন করে।তারমানে এই নয়যে উনি আমাকে ভালোবাসেন না বা কম ভালোবাসেন।স্যারের প্রতিটা খুশি স্যার আমার সাথে শেয়ার করে।স্যার প্রতিটা মুহূর্তে আমাকে ফিল করে,সেটা আমি বুঝতে পারি।আমি আমার মাস্টার মশাইয়ের ওপপসস সরি এখন তো মাস্টার মশাই ট্যাগের সাথে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ট্যাগটা দিতে হবে।হালকা হেসে লিয়া বলতে থাকে,আমি স্যারের ভাবনার জগৎ টাকে খুব ভালো করেই জানি,সেই ভাবনার জগৎটা আমাকে দিয়েই শুরু আর আমাকে দিয়েই শেষ।”
এই এক বছরে এনামুল খাঁন এর সাথে অভ্র এর সম্পর্কটা খুব গাঢ় হয়েছে। শুধু অভ্র নয় অভ্র এর বাবার সাথেও এনামুল খানের দেখা সাক্ষাৎ হয়।মাঝে মাঝেই ফোন আলাপ হয়। অভ্র নিজেও এনামুল খাঁন এর সাথে দেখা করতে আসেন,উনার অফিসে।এক কথায় অভ্র ওর আচরন দিয়ে এনামুল খাঁন এর মনে নিজের জন্য শক্ত পোক্ত করে একটা জায়গা করে নিয়েছে। ফেইসবুক আইডিতে দেওয়া বায়ো থেকে এনামুল খাঁন এর বার্থ ডেট জেনেছিলো অভ্র।তাই তো আজকে অভ্র এনামুল খাঁন এর জন্য বার্থডে তে একটা আইফোন গিফট করেছে।একবার অভ্র ভেবেছিলো একটা ক্যারোলা গাড়ি গিফট করবে।আবার ভাবে যদি আঙ্কেল মাইন্ড করে বসে,তাই গাড়ি গিফটের চিন্তা বাদ দিয়ে আইফোন গিফট করে। এনামুল খাঁন শুধু ভদ্রতার খাতিরেই নয়, অভ্র কে ভালো লাগার দিক হতেই গিফটা নেন। অভ্র এর বাবা কথার মাঝে মাঝেই অভ্র আর লিয়ার বিয়ের তাগাদা দেন।বলেন,লিয়ার তো এইচএসসি শেষ ই হয়ে আসলো।এবার তো আগানো যায়। আর পড়াশোনা বিয়ের পরেও করা যাবে।এনামুল খাঁন অবশ্য ভদ্রভাবে বলেন,আসলে আমাদের বড় মেয়েকে রেখে লিয়াকে বিয়ে দেই কিকরে।বিষয়টা কিরকম দেখায় না।তবে কথা দিচ্ছি তাসনিম এর বিয়ে হলেই আমরা আগাবো।লিয়া অবশ্য এসব কিছু জানে না। অভ্র এর সাথে আর দেখা হয়নি আর কথাও হয়নি। অভ্র আশায় আছে,লিয়ার এক্সাম শেষ হলে, লিয়ার সাথে দেখা করবে।
তাসনিম পড়ার টেবিলে বসে কলম কামড়ে ধরে ভাবে,,আমরা ফ্রেন্ডরা তো আর কয়দিন পরেই দূরে চলে যাবো।যে যার মত আলাদা জায়গাতে থাকতে হবে, কর্মক্ষেত্রের জন্য।চাইলেই আর বিকেল হলে বোটানিক্যাল গার্ডেনে বসে আড্ডা দেওয়া হবে না। ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে বসে কফির মগ হাতে নিয়ে গল্পের আসর বসবে না। শুধু থিসিস করার সময় মাঝে মাঝে দেখা হবে এছাড়া নয়।এটা ভাবতেই তাসনিম এর মনটা খা’রাপ হয়ে যায়। জারিফের সাথে দেখা হবে না,লুকিয়ে লুকিয়ে,আড়চোখে জারিফকে দেখা হবে না।এটা ভাবতেই।আষাঢ়ের আকাশ ভেঙ্গে যেমন করে বৃষ্টি নামে। তাসনিম এর দুচোখ ফেটে অশ্রু নামতে চাইলো।তবুও তাসনিম নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবে,আমি তো এতদিন এই দিনেরই অপেক্ষায় ছিলাম।কবে জারিফের চাকরি হবে।জারিফ নিজেকে সেটেল করবে।তবে আরো চেয়েছিলাম জারিফ নিজে থেকে যেনো আমাকে ভালোবাসি কথাটা বলে।তবে এখনো পর্যন্ত যখন জারিফের মুখ থেকে কাংখিত কথাটা শুনতে পেলাম না।আমি নিজেই আমার মনের কথাটা জারিফকে জানাবো।আমি আর জারিফের আশায় বসে থাকবো না।আবার ওদিকে বাড়ি থেকে যে কোনো সময় আমার বিয়ের জন্য চাপ দিতে পারে।তাই আমাকে জারিফকে বলতে হবে,জারিফকে আমার ভালো লাগে,আমি ওকে ভালবাসি।
তাসনিম মনে মনে ফাইনাল ডিসিশন নিয়ে নেয়।সরাসরি জারিফ কে জানাবে। তাসনিম এর বিশ্বাস জারিফ ওকে ফিরিয়ে দিবে না।
পরের দিন,,
বিকেলের দিকে তাসনিম জারিফের কাছে কল করে।জারিফ রিসিভ করে বলে,,”হ্যা তাসনিম বল।”
কোনো প্রকারের ভনিতা ছাড়াই তাসনিম স্পষ্ট গলায় সোজাসুজি বলে,,”জারিফ তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
জারিফ গম্ভীর গলায় বলে,,”হ্যা বল।”
তাসনিম ভরাট গলায় বলে,,”ফোনে নয়।আমি তোর সামনে বলতে চাই।তুই গাঙ্গিনাপাড়ের কফিশপে আয়।আমি তোর জন্য ওয়েট করছি।”
জারিফ কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে,কোনো প্রশ্ন না করে স্পষ্ট স্বরে বলে,,”আচ্ছা, ঠিক আছে।আমি আসছি।”
তাসনিম নীল রঙের একটা শাড়ি পড়ে নেয়।হাতে কাঁচের চুড়ি।চোখে হালকা করে কাজল দেয়। ঠোঁটে পিংক কালারের লিপবাম দেয়। তাসনিম কখনো সাজে না।আজকে শখের মানুষ টার জন্য এই সাজসজ্জা।এর আগে কবে চোখে কাজল দিয়েছে তাসনিম তা মনে করতে পারে না। তাসনিম একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে কফিশপের নিরিবিলি একটা কর্ণারে টেবিলের,চেয়ারে বসে ফোন স্ক্রল করতে থাকে। পাঁচটার দিকে জারিফের আসার কথা,সেখানে তাসনিম খুব এক্সাইটেড থাকায় পাঁচটা বাজার আগেই চলে এসেছে।ঘড়ির কাঁটা চারটা পঞ্চাশ বাজে।হয়তো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জারিফ চলে আসবে।এটা ভেবে তাসনিমের মুখে থাকে এক চিলতে হাসি। তাসনিম লাজুক হাসি নিয়ে,প্রিয় মানুষটার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
[চলবে…ইন শা আল্লাহ]