দৃষ্টির_আলাপন #পর্বঃ১০

0
464

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১০

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ মনোনীত স্বতন্ত্র প্রার্থী আজীজ শিকদার এলাকায় বেরিয়েছেন নির্বাচনী প্রচারণায়। বরাবরই আজীজ শিকদার শান্তি প্রিয় মানুষ। সর্বদা সর্বস্থরের জনগণের সাথে সহজেই মিশে যাওয়া আজীজ শিকদার চান না এই নির্বাচনী কোনো কর্মকান্ডে জনসাধারণের কোনো প্রকার অসুবিধা হোক। যার জন্য নাম মাত্র দলের কিছু লোকজন নিয়ে ভোট চাইতে বেরিয়েছে মানুষের দুয়ারে। রক্তিম আসেনি বাবার সাথে। তার বদলে মেহেদী এসেছে। সকাল থেকে একটানা বিকেলের আগ পযর্ন্ত যে কয়টা এলাকা পেরেছে মানুষের সুবিধা অসুবিধার কথা শুনে আশ্বাস দিয়েছেন ক্ষমতা হাতে আসলে সমাধান তিনি করবেন। নির্বিঘ্নে প্রচারণা শেষে ফেরার পথে মুখোমুখি হয় ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী লিয়াকত বিল্লার সাথে। নিজের দলবল নিয়ে লিয়াকত বিল্লা ভোট চাইতে এদিকেই আসছেন বুঝতে পেরে রাস্তার এক পাশে থেমে যায় আজীজ শিকদার। মেহেদীর দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে হুশিয়ারী দেন,

“ওরা আসছে। চুপচাপ পাশ কাটিয়ে যাবে সবাই। কারো মুখ দিয়ে যেন কোনো শব্দ না বের হয়। আমি কোনো ঝামেলা চাইনা।”

রুশপূর্ণ দৃষ্টিতে মেহেদী এতোক্ষন লিয়াকত বিল্লার পাশে থাকা মাসুম বিল্লার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়েছিল। মনে মনে ভাবছিল, “শা’লা রক্তিম শিকদারের হাতে উত্তম ধোলাই খেয়েও সোজা হয়নি। নির্লজ্জের মতো চ্যাপ্টা হওয়া মুখ নিয়েই বেরিয়ে পরেছে বাপের সাথে ভোট চাইতে।” নিশপিশ করছে মেহেদীর হাত-পা। রক্তিমের সেদিনকার রক্তাক্ত দেহটা ভেসে উঠছে চোখের তারাই। ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে বাপ-ছেলে দুটোর কলিজা বের করে মেপে দেখতে কত বড় হয়েছে। যার দাপটে রক্তিম শিকদারকে মা’রা’র সাহস করেছিল। ঠিক তখনই কানে আসে আজীজ শিকদারের হুশিয়ারি সংকেত। চোখ দুটো বন্ধ করে বড় বড় দুটো শ্বাস টেনে সামলে নেয় নিজেকে। ভদ্র ছেলের মতো মাথা কাত করে সাই জানায় আজীজ শিকদারের কথায়। আবারও শান্ত ভঙ্গিতে হেটে যায় সামনের দিকে সকলেই। সামনে আজীজ শিকদার। পিছনে মেহেদী, জাবির, রাকিব সহ আজীজ শিকদারের দলের কয়েকজন সিনিয়র রাজনীতিবিদ।

লিয়াকত বিল্লা আজীজ শিকদারকে এগিয়ে আসতে দেখে কূটিল হেসে ছেলের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করে। বাবার ইশারা পেয়ে সাথে সাথে মাসুম বিল্লা দলের ছেলেদের নিয়ে স্লোগান শুরু করে লিয়াকত বিল্লার নামে। সাথে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে ফুসলানো শুরু করে মেহেদীদের।

মুখোমুখি দুটো দল। একদল শান্ত ভঙ্গিতে এড়িয়ে যেতে চাইছে বিরোধী দলটাকে। আর অপর দল পথ আগলে আকাশ-পাতাল ভারী করে তুলছে লিয়াকত বিল্লার জয়ের ধ্বণীতে। আজীজ শিকদার এক পলক লিয়াক বিল্লার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সরে আসতে চাইলে হাত ধরে আটকে দেয় লিয়াকত বিল্লা। আমুদে কন্ঠে বলে,

“আরেহ মেয়র সাহেব যে! যাচ্ছেন কোথায়? আসেন একটু সুখ-দুঃখের আলাপচারিতা করি। অনেক দিন পর দেখা হলো আপনার সাথে। সেই যে লাস্ট নিজের ছেলের জান ভিক্ষা চাইতে আমার বাড়ি গিয়ে পায়ের কাছে হামলে পরেছিলেন এরপর কতদিন হয়ে গেল আপনাকে দেখিনা। বর্তমানে আপনি যতই নিজের ছেলের কথায় উস্কানি পেয়ে আমার বিরোধীতা করতে আসেন। তবুও তো আমার এলাকার মেয়র। আর আমি হলাম একই এলাকার এমপি। একজন সচেতন এমপি হিসেবে আপনার খোঁজ-খবর নেওয়া আমার কর্তব্য। কি বলিস তোরা?”

শেষের প্রশ্নটা নিজের দলের ছেলেদের দিকে তাকিয়ে জানতে চায় লিয়াকত বিল্লা। সাথে সাথে সমস্বরে হৈচৈ করে প্রত্যেকে বলে ওঠে,

“ঠিক ঠিক।”

মেহেদী ফুঁসছে। লিয়াকত বিল্লার প্রতিটা কথা তার ধৈর্যের পারদ গলিয়ে দিচ্ছে। দাঁতে দাঁত পিষে বাপ-ছেলের দিকে তাকায়। কি বিচ্ছিরি হাসি দুটোর!সহ্য হয়না মেহেদীর। খ্যাঁপা ষাড়ের মতো তেড়ে আসতে নিলেই হাত টেনে ধরে আজীজ শিকদার। গরম চোখে তাকিয়ে ইশারায় পিছিয়ে আসতে বলে মেহেদীকে। নিরুপায় মেহেদী ফুঁস ফুঁস করে শ্বাস নেয় শুধু। বাঁধাগ্রস্থ হয়ে করতে পারেনা কিছু।

মেহেদীকে টেনে নিজের পিছনে সরিয়ে মুখে মুচকি হাসি টেনে লিয়াকত বিল্লার দিকে তাকায় আজীজ শিকদার। শান্ত কন্ঠে বলে,

“দলবল নিয়ে নিশ্চয়ই ভোট চাইতে এসেছেন বুঝতে পেরেছি। হাতে সময় কম। এর মাঝে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে চাচ্ছিনা। দাওয়াত রইল ভাই। নির্বাচনের পর না হয় একদিন জমিয়ে আলাপচারিতা করা যাবে!”

“জনগণের কাছে হাত পেতে ভোট চাওয়া আপনার মতো দু-টাকার মেয়রের কাজ। আমার বাবার মতো একজন সফল এমপির কাজ না। গিয়েছিলেন তো বর্তমান দলের হয়ে মনোনয়ন চাইতে। লাভটা কি হলো! সেখানেই আমার বাপের কাছে হেরে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঘুরছেন-ফিরছেন। কি মনে হয়?বাঘের সাথে লড়ে জিততে পারবেন তো! না কি গো-হারা হেরে হাতে চুড়ি পরে ঘরে বসে থাকবেন?”

মাসুম বিল্লার কথায় রোল পরে যায় হাসির। শরীর দুলিয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে হেসে আজীজ শিকদারকে অপদস্থ করতে মত্ত হয় প্রত্যেকে। ধৈর্যের বাধ ভাঙে মেহেদীর। চোখ রাঙিয়ে এগিয়ে এসে কলার চেপে ধরে মাসুম বিল্লার। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

“আর একটা শব্দ মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলে তোর জ্বিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব শো’য়’রে’র। তোর বাপ একটা শো’য়’র আর সেই বাপের সন্তান তুই জন্ম নিছিস কু’ত্তা হয়ে। কবে যানি রক্তিম শিকদারের হাতে ম’রে বেওয়ারিশ লা’শের মতো পরে থাকিস রাস্তা-ঘাটে।”

মুহূর্তেই শুরু হয়ে যায় দুই দলের সংঘর্য। হাতাহাতির এক পর্যায়ে দূর থেকে ইটের টুকরো ছুড়ে কেউ আজীজ শিকদারকে টার্গেট করে। দক্ষ হাতের নিশানা হেরফের হয়না। ঠিক আজীজ শিকদারের কপাল ছুঁয়ে মাটিতে পরে ইটের টুকরোটা। সাথে সাথে ঝরঝরিয়ে কপাল বেয়ে গড়িয়ে পরে তাজা রক্ত। ঘটনার আকস্মিকতায় থমকে যায় মেহেদী সহ, রাকিব, জাবির দলের অন্য সব সিনিয়র রাজনীতিবিদরাও। ছোটখাট কথা কাটাকাটি এক পর্যায়ে রূপ নেই বড়সড় দাঙ্গায়। ঝড়ের গতিতে খবর পৌঁছে যায় রক্তিম শিকদারের কানে। যে আজীজ শিকদার অশান্তি হবে বলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল বিরোধী দলকে সেই আজীজ শিকদার রুশের তোপে পরে কপাল ফাটিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে। কপাল বেয়ে যে গলগলিয়ে তাজা রক্ত গড়িয়ে পরছে সেদিকে কারো ধ্যান নেই। ব্যস্ত সকলেই বিরোধী দলের আক্রমণ ঠেকাতে। ঠিক সেই মুহূর্তে কোথা থেকে যেন রক্তিম এসে আগলে ধরে আজীজ শিকদারকে। বসিয়ে দেয় নিজের বাইকের পিছনে। রক্তিম, শান্ত দুজনের মাঝে বসিয়ে এক টানে বাইক ছুটিয়ে পৌঁছে যায় নিকটবর্তী হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ছোট্ট একটা বেন্ডেজ করে দেয় আজীজ শিকদারের কপালে। যতটা রক্ত ঝরেছে সেই তুলনায় ক্ষত খুব একটা গভীর নই ডাক্তার জানিয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাবাকে শান্তর সাথে বাড়ি পাঠিয়ে নিজে ক্ষতটাস্থলে যেতে উদ্যত হতেই মেহেদী ফোন করে জানায় পুলিশ এসে সামলে নিয়েছে সবটা। কতক্ষণ ফাঁপা হুমকি দিয়ে দুই দলকে শান্ত করে আবারও চলে গেছে পুলিশ। দলের অন্য কারো কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না খোঁজ-খবর নিয়ে নিশ্চিত হয়ে রক্তিম নিজেই বাবাকে পৌঁছে দিতে যায় শিকদার মঞ্জিলে। আজীজ শিকদারের বেন্ডেজ করা কপালের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে রক্তিম। চোখ বন্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে নিজ মনে প্রতিজ্ঞা করে,

“তোমার শরীর থেকে ঝরা প্রতি ফোটা রক্তের শোধ আমি তলব বাবা। যে বা যারা তোমার গায়ে হাত তোলার সাহস করেছে তাদের একটাকেও ছাড়বনা আমি।”

****

বিরোধী দলের আক্রমনে জখম হয়েছে আজীজ শিকদার।কথাটা শিকদার মঞ্জিলে পৌছাতে সময় লাগেনি খুব একটা। বিশাল বড় বাড়িটাই থাকা তিনজন সদস্যই খবরটা শোনার পর থেকে কেঁদে-কেটে অস্থির। বিলাপ জুড়েছে রেহানা বেগম। বুকের ভিতর ভয় জমেছে ছেলের মতো আবার স্বামীকে না হারাতে হয়।বাড়ির সহকর্মী কাকলির মা, ইতি দুজন মিলেও শান্ত করতে পারছেনা রেহানা বেগমকে। এমন পরিস্থিতির মাঝেই রক্তিম আজীজ শিকদারকে নিয়ে উপস্থিত হয় শিকদার মঞ্জিলে। স্বামীর মাথায় বেন্ডেজ দেখে আরও ভেঙ্গে পরে রেহানা বেগম। পাশে দাঁড়ানো রক্তিমকে দেখে শোকটা যেন পরিণত হয় ক্রোধে। স্বামীকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি রক্তিমের সামনে গিয়ে দুই হাতে একের পর এক এলোমেলো চড় বসিয়ে বলতে থাকে,

“তুই খু’নি। শুধু খু’নি না একটা রা’ক্ষ’স তুই। দশ মাস পেটে ধরে এক রা’ক্ষ’স জন্ম দিয়েছি আমি। প্রথমে আমার ছেলেকে খেয়েছিস। এখন আমার স্বামীর দিকে নজর দিয়েছিস!আগে যদি জানতাম বড় হয়ে এমন রাক্ষসে পরিণত হবি তুই সেই আতুর ঘরেই গলা টিপে মে’রে ফেলতাম তোকে। কেন করছিস? কেন করছিস আমার সাথে এমন? কি ক্ষতি করেছি আমি তোর? কেন আমার সব সুখ কেড়ে নিচ্ছিস তুই? তোকে জ’ন্ম দেওয়াই আমার পাপ হয়েছে। সবথেকে বড় পাপ করেছি তোর মতো কু’লা’ঙ্গার জন্ম দিয়ে।”

স্ত্রীর এমন পাগলামিতে ধমকে ওঠে আজীজ শিকদার। কাজ হয় না কোনো। ধমকে যেন রেহানা বেগম আগের থেকেও আরও ক্ষিপ্র হয়ে ওঠেন। অবলীলায় একের পর এক আঘাত করে যাচ্ছেন রক্তিমের গায়ে। মায়ের সকল আঘাত, অভিযোগ চোখ বুজে সহ্য করে নেই রক্তিম। একটা টু শব্দ পযর্ন্ত করেনা। ইতি, আজীজ শিকদার দুজন মানুষ টেনেও ছাড়াতে পারেনা রেহানা বেগমকে। দুর্বল শরীরটাতেই যেন কোনো এক অদৃশ্য অ’শু’র বস করেছে।

আজীজ শিকদারের খোঁজ নিতে ঘটনা স্থল থেকে ছুটে এসেছিল মেহেদী। শিকদার মঞ্জিলে পা দিয়েই চোখের সামনে এমন একটা দৃশ্য দেখে থমকে যায় মেহেদী। রুদ্ধশ্বাসে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ছুটে আসে রক্তিমের কাছে। তিনজন মানুষের শক্তির কাছে অবশেষে হার মানতে হয় রেহানা বেগমকে। মায়ের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায়না রক্তিম। মাথা নিচু করেই বেরিয়ে যায় বাড়ি ছেড়ে। পিছন থেকে আজীজ শিকদার অসহায় কন্ঠে ডাকে ছেলেকে। ফিরে তাকায়না রক্তিম।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here