ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি 💞💞 #লেখিকা-Mehruma Nurr #পর্ব-৫০

0
924

#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি 💞💞
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-৫০

★ ফাংশন শেষে নূর মাত্রই রুমে এসেছে। তানি ওকে নিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ আগে আদিত্য নিজের হাতে নূরকে খাবার খাইয়ে দিয়েছে। তানি নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
….তুই ফ্রেশ হয়ে নে। তোর মেহেদীও শুকিয়ে গেছে, এখন তুলে ফেল।

নূর মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….ঠিক আছে।

তানি নূরের কাপড়চোপড় সহ নূরকে ওয়াশরুমে দিয়ে এলো,ফ্রেশ হওয়ার জন্য। তানি ততক্ষণে সানার রুমে গেল ফ্রেশ হতে।

বিশ মিনিট পর নূর ফ্রেশ হয়ে বের হলো। বেডের ওপর বসে নিজের হাতের মেহেদী দেখতে লাগলো। কতো সুন্দর গাঢ় লাল রং হয়েছে। নূর হাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।

হঠাৎ ওর ফোনে টুন করে একটা মেসেজের শব্দ এলো। নূর সামনে তাকিয়ে দেখলো বেডের পাশে ছোট টেবিলের উপর ওর ফোন রাখা। মনে হয় তানি ওর ফোন এখানে রেখে গেছে। কথাটা ভেবে নূর মুচকি হেসে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো কে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। ম্যাসেজ টা পরে নূর নিচের ঠোঁট কামড়ে লাজুক হাসলো।

ত্রিশ মিনিট পরে তানি আবার নূরের রুমে এলো। রুমে এসে দেখলো নূর রুমে নেই। তানি ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলো, ওয়াশরুমের দরজা খোলা। আর ভেতরে কেউ নেই। তানি ভ্রু কুঁচকে ভাবলো। এতো রাতে নূর আবার কোথায় গেল। তানি বেলকনিতে যেয়ে দেখলো ওখানেও নেই।

তানি রুমের বাইরে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলো। তারপর সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে ড্রয়িং রুমেও দেখলো। নূর ওখানেও নেই। রাত অনেক হওয়ায় বেশির ভাগ মানুষই যার যার রুমে গিয়ে শুয়ে পরেছে। তাই এখানে তেমন কেউ নেই। তানি মনে মনে বললো। নূর আবার আদিত্য ভাইয়ার সাথে দেখা করতে যায়নি তো? এদের নিয়ে আর পারা যায় না। রাত পোহালেই বিয়ে হবে, তাও যেন এদের তরই সইছে নাহ। এতরাতেও আবার প্রেমালাপ করতে গেছে। এসব ভেবে তানি আদিত্যের রুমের দিকে এগিয়ে গেল নূরকে ডেকে আনার জন্য।

সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে আদিত্যের রুমের দিকে যেতে নিলেই, হঠাৎ কেউ তানির হাত টেনে ধরে একটা রুমের ভেতর নিয়ে যায়। তানি সামনে তাকিয়ে দেখলো,আবির ওর দিকে দুষ্টু হেসে তাকিয়ে আছে। তানি ভ্রু কুঁচকে বললো।
….এসব কি?এভাবে কেউ টান দেয়? জানো আমি কতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম?

আবির দুষ্টু হেসে আহ্লাদি কন্ঠে বলে উঠলো।
….আলে আলে, আমার কিউটি টা ভয় পেয়েছে? আসো আমি তোমার সব ভয় দূর করে দিচ্ছি।
কথাটা বলেই আবির নিজের ঠোট দুটো চোখা করে তানির ঠোঁটের দিকে এগুতে লাগলো।

তানি আবিরের ঠোটের ওপর নিজের তর্জনী আঙুল ঠেকিয়ে বললো।
….হইছে,আর ভয় দূর করতে হবে না। আমি এতটাও ভয়ে মরছি না। সুযোগের সৎ ব্যবহার করা কেউ তোমার কাছ থেকে শিখুক। এখন সরোতো যেতে দাও আমাকে।
কথাটা বলেই তানি আবিরের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চলে যেতে নিলেই, আবির পেছন থেকে তানির হাত ধরে টেনে ধরে গানের সুরে বলে উঠলো।

♬ যেওনা সাথী ও ও ও ও
♬ চলেছ একেলা কোথায়
♬ একটা চুমু দিয়েতো যাও
♬ শুধু একটা ও ও ও

তানি আবিরের দিকে ঘুরে বললো।
….নেও হয়ে গেলো ড্রামা চালু
এখন ছেলো বসে আলু।

আবির তানিকে টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে দুষ্টু হেসে বললো।
….বাহ্ তুমিতো দেখছি আমার মতোই জোক মারা শিখে গেছো।নট ব্যাড।

….হুম, কি করবো সঙ্গদোষের প্রভাব। এখন ছাড়তো, আমাকে নূরকে খুঁজতে যেতে হবে।

আবির ভ্রু কুঁচকে বললো।
….কেন ভাবি আবার কোথায় গেছে?

…কিজানি রুমে আর ড্রয়িং রুমে তো দেখলাম না। নিশ্চয় আদিত্য ভাইয়ার সাথে দেখা করতে গেছে। আর কোথায় যাবে।

….দেখেছ ভাবি কতো রোমান্টিক? আজ বাদে কাল বিয়ে, তবুও ভাইয়া ডাকার সাথে সাথে চলে গেছে। আর এক তুমি। একটা আনরোমান্টিকের বস্তা। একটুও ভালুপাসনা আমাকে।

….হইছে, অফ যান এখন। আর ছাড় আমাকে। নূরকে ডেকে নিয়ে আসি।

আবিরের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এলো। আবির দুষ্টু হেসে বললো।
….চলো,আজ দুটেকে একদম হাতে নাতে ধরবো। সেই মজা হবে।

…মানে?

….আরে চলতো, দেখাচ্ছি।
কথাটা বলেই আবির তানির হাত ধরে আদিত্যের রুমের দিকে যেতে লাগলো।

আদিত্যের রুমের দরজার সামনে এসে আবির তানির দিকে তাকিয়ে নিজের ঠোঁটের উপর তর্জনী আঙুল রেখে চুপ থাকার ইশারা করলো। তারপর আস্তে করে দরজাটা খুলে রুমে ঢুকেই জোরে বলে উঠলো।
….পাকাড় লিয়া,,,,,

কথাটা বলেই দুজন সামনে তাকাতেই থতমত খেয়ে গেল। কারণ সামনে শুধু আদিত্য একা বেডে শুয়ে আছে। সারা রুমে কোথাও নূর নেই।

আবিরের চিল্লানিতে আদিত্য চমকে উঠলো। এইসময় রুমে আচমকা ওদের দেখে আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
….কিরে তোরা এখানে কি করছিস? আর এতো রাতে ষাঁড়ের মতো চিল্লাছিস কেন?

আবির বলে উঠলো।
…..বাহ্ ভাই, কি এ্যাকটিং না করছিস। একদম অসকার উইনিং পারফরম্যান্স। তবে এখন আর ড্রামা করে লাভ নেই। আমরা সব জেনে গেছি।

….মানে? কি বলছিস তুই? নেশা টেশা করে এসেছিস নাকি?

তানি এবার বলে উঠলো।
….ভাইয়া নূরকে ডেকে দিন। এতো রাতে কেউ দেখে ফেললে খারাপ ভাববে।

আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
….মানে? নূরকে আমি কিভাবে ডেকে দিব? ওতো ওর রুমে হবে।

আবির বলে উঠলো।
…এবার কিন্তু ওভারেক্টিং হয়ে যাচ্ছে। দেখ আমরা ভালো করেই জানি ভাবি এখানেই আছে। তাই নাটক না করে ভাবিকে ডেকে দে। ভাই এতোটা ডেস্পারেট হওয়াও ঠিক না। রাত পোহালেই তো বিয়েটা হয়ে যাবে। তবুও তোরা এতরাতেও দেখা করছিস?

আদিত্য এবার রেগে উঠে বললো।
….জাস্ট শাট আপ ইডিয়ট। তুই ভাবলি কি করে নূর এতোরাতে আমার রুমে থাকবে? আরে আমরা যখন এখানে একা ছিলাম তখনও আমি কখনও নূরকে রাতে আমার রুমে ডাকিনি। আর আজ এতো মানুষের ভেতর আমি ওকে আমার রুমে ডাকবো? আমাকে কি তোদের এতো ইম্যাচিওর মনে হয়?

তানি আমতা আমতা করে বললো।
……সরি ভাইয়া, আসলে নূর ওর রুমে নেই। আর ড্রয়িং রুমেও ওকে দেখলাম না। তাই ভাবলাম হয়তো আপনার কাছে এসেছে কিনা?

তানির কথা শুনে আদিত্যর কপালে ভাজ পরে গেলো। আদিত্য এবার এক ঝটকায় বেড থেকে নেমে দাঁড়িয়ে তানির দিকে তাকিয়ে বললো।
….এক মিনিট, রুমে নেই মানে? এইসময় কোথায় গেছে নূর?

…..জানি না ভাইয়া। রুমে আর ড্রয়িং রুমে তো কোথাও দেখলাম না। ফোনাটাও রুমে রেখে গেছে। তাই ফোন দিয়েও শুনতে পারছি না।

আদিত্যের এবার একটু চিন্তা হতে লাগলো।
আবির সেটা বুঝতে পেরে বলে উঠলো।
….ভাই আমার মনে হয় ভাবি তার ভাই আর চাচার সাথে হয়তো দেখা করতে গেছে। এতোদিন পরে দেখা হয়েছে, তাই হয়তো ওদের সাথে একটু কথাবার্তা বলতে গেছে ।

আবিরের কথাটা আদিত্যের কাছে ঠিক মনে হলো। আদিত্য মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….হ্যাঁ সেটা হতে পারে। আমি যেয়ে দেখছি।
কথাটা বলেই আদিত্য তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো । আবির আর তানিও আদিত্যের পেছন পেছন গেল।

নূরের চাচা আর ভাই যে রুমে আছে, সেই রুমের সামনে এসে দরজায় নক করলো আদিত্য।
একটু পরেই নূরের চাচা এসে দরজা খুলে দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে বললো।
…..আরে আদিত্য, তুমি এখানে? কিছু বলবে?

আদিত্য বলে উঠলো।
….সরি আপনাকে এতো রাতে ডিস্টার্ব করলাম। আসলে নূর কি আপনাদের রুমে এসেছে?

নূরের চাচা বলে উঠলো।
….নাতো নূর তো এখানে আসেনি। আমরা তো ঘুমিয়ে ছিলাম।

আদিত্যের এবার ভয় হতে লাগলো। কোথায় গেল নূর? আদিত্য একটা শুকনো ঢোক গিললো। তারপর ওখান থেকে সরে এসে সারা বাড়ি নূরকে খুঁজতে লাগল,আর জোরে জোরে নূরের নাম ধরে ডাকতে লাগলো। আবির আর তানিও নূরকে খুঁজতে লাগলো। ওদের এখন সত্যি সত্যিই চিন্তা হচ্ছে নূরের জন্য। ওদের ডাকাডাকিতে বাসার সবাই জেগে গেল। সবাই রুম থেকে বেড়িয়ে এসে আবিরকে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে? আবির সবাইকে সবটা খুলে বললো। আবিরের কথায় সবাই চিন্তায় পড়ে গেল। তাসির, সায়েম, সানা,নিশি ওরা সবাইও নূরকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু নূর কোথাও নেই।

বাসার ভেতর না পেয়ে আদিত্য এবার ছাদে উঠে এলো নূরকে খুঁজতে। ছাঁদে এসে চারিদিকে খুঁজে দেখলো, কোথাও নূরকে পেল না। নূরকে না পেয়ে আদিত্য দুই হাত দিয়ে নিজের চুল টেনে ধরে, পাগলের মতো এদিক ওদিক হাটতে লাগলো। ভয়ে ওর অন্তর শুকিয়ে আসছে। কোথায় গেল ওর প্রাণপাখি টা? একটু আগেও তো ওর সাথেই ছিল। এখুনি আবার কোথায় হারিয়ে গেলো? আবারও কোনো বিপদে পরলো নাতো নূর? এসব ভেবে আদিত্যের বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেলো।

আদিত্য আবার দৌড়ে নিচে নেমে, দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে এলো। পেছন থেকে সবাই আদিত্যকে ডাকছে, কিন্তু সেদিকে আদিত্যের কোনো খেয়াল নেই। ও বাইরে এসে পুল সাইডে, বাগানে সব জায়গায় পাগলের মতো নূরকে খুঁজতে লাগলো। কোথাও নূরকে না পেয়ে আদিত্যের এবার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মাথা ভনভন করে ঘুরছে ওর। আদিত্য দুই হাতে নিজের চুল শক্ত করে টেনে ধরে হাঁটু গেড়ে ধপ করে নিচে বসে পড়লো। আহত কন্ঠে বিড়বিড় করে বললো।
….আমাকে রেখে কোথায় গেলে তুমি প্রাণপাখী? একটু আগেও তো সবকিছু কতো সুন্দর ছিল। তুমি আমার পাশে কতো হাসিখুশি ছিলে। তাহলে একমুহূর্তেই কি হয়ে গেলো? কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি? কোথায় খুঁজব এখন তোমায় আমি?

আদিত্যর এমন অবস্থা দেখে আদিত্যের বাবার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আদিত্যের বাবা আদিত্যের কাছে এসে ওর কাঁধে হাত দিয়ে শান্তনা দিয়ে বললো।
….আদি বাবা, এভাবে ভেঙে পড়লে কিভাবে চলবে বলো? তোমাকে শক্ত হতে হবে। আমাদের নূরকে খুঁজে বের করতে হবে তাইনা? তুমি চিন্তা করোনা নূর মাকে আমরা অবশ্যই খুঁজে বের করবো।

আদিত্য নিজেকে একটু ঠিক করে উঠে দাঁড়িয়ে ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো।
….হ্যাঁ বাবা তুমি ঠিক বলেছ। নূরকে আমি খুঁজে বের করবোই। যদ পুরো দূনিয়াও উল্টে ফেলতে হয়। তবুও আমি আমার নূরকে খুঁজে বের করবই। যেভাবেই হোক।

আদিত্যের বাবা বললো।
…..আমি পুলিশ কমিশনারকে ফোন করছি। উনি এখুনি পুরো ঢাকা শহরে পুলিশ লাগিয়ে নূরকে খোজার জন্য।

আদিত্য মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….ঠিক আছে বাবা আমিও গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছি নূরকে খুঁজতে।

তাসির এগিয়ে এসে বললো।
…..আমরাও সবাই আলাদা আলাদা ডিরেকশনে গিয়ে নূরকে খুঁজব।

আদিত্য মাথা ঝাকিয়ে বললো।
…..ঠিক আছে।

আবির বলে উঠলো।
….ভাই তোর কি কারোর উপর সন্দেহ হয়? আই মিন আগেও তো একবার ওই এ্যানি ভাবিকে কিডন্যাপ করিয়েছিল। তাছাড়া ওই জনি ছেলেটা আবার ভাবির সাথে কিছু করে নিতো?

আদিত্য বলে উঠলো।
….হ্যাঁ হতে পারে। আমাদের কোনোটাই বাদ দেওয়া যাবে না। তবে আমি যতদূর জানি এ্যানিকে ওর বাবা আমেরিকা পাঠিয়ে দিয়েছে। তাহলে ও এসব করতে পারবে না। বাকি থাকলো ওই স্ক্রাউন্ডেল টা। ওর ওপরে তো আমারও সন্দেহ আছে। আমি পুলিশ কে ওর নাম্বার টা দিয়ে দিচ্ছি ট্রেস করার জন্য।
কথাটা বলেই আদিত্য ফোনের জন্য নিজের পকেটে হাত দিয়ে দেখলো, ওর ফোনটা নেই। আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
….আমার ফোনটা কই গেল?

আদিত্য সানাকে বললো ওর রুম থেকে ফোনটা আনতে। আদিত্যের কথামতো সানা ভেতরে চলে গেলো। একটু পরে আবার বেড়িয়ে এসে বললো।
….রুমেতো তোমার ফোন পেলাম না। আপাতত তুমি আমার ফোনটা রাখ। তোমার টা পরে খুঁজে নিও।

আদিত্য মাথা ঝাকিয়ে সানার হাত থেকে ফোনটা নিল।

তারপর সবাই যার যার মতো বেড়িয়ে পরলো নূরকে খোঁজার জন্য। আদিত্য যেতে নিলেই পাশে তাকিয়ে দেখলো রবি দাঁড়িয়ে কান্না করছে। আদিত্য ওর কাছে যেয়ে কাঁধে হাত দিয়ে বললো।
….আম সরি বাডি। আমি তোমার আপুর খেয়াল রাখতে পারিনি। তবে চিন্তা করোনা আমি যেভাবেই হোক তোমার আপুকে খুঁজে বের করে নিয়ে আসবো।

রবি কাঁদো কাঁদো সুরে বললো।
….আপনার ওপর আমার ভরসা আছে। জলদি আপুকে নিয়ে এসেন জিজু।

আদিত্য চলে যেতে নিয়ে কিছু একটা মনে করে আবার রবির দিকে তাকিয়ে বললো।
….আচ্ছা শোন, তুমি তোমার মায়ের নাম্বার টা দিতে পারবে?

রবি ভ্রু কুঁচকে বললো।
….কেন?

….এমনই, একটু দরকার ছিল আরকি।

রবি মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….ঠিক আছে দিচ্ছি।
তারপর রবি আদিত্যকে ওর মায়ের নাম্বার টা দিল।

আদিত্য নাম্বার নিয়ে দ্রুত বেড়িয়ে পরলো নূরকে খোঁজার জন্য। গাড়িতে উঠে পুলিশের কাছে জনি আর রবির মায়ের নাম্বার দিল ট্রেস করার জন্য। রবির মায়ের ওপর আদিত্যের সন্দেহ আছে। তাই তার নাম্বারও ট্রেস করতে দিল। তারপর গাড়ি চালিয়ে পাগলের সবজায়গায় নূরকে খুঁজতে লাগলো।

—————————
রাত ২টা
একটা অন্ধকার রুমে হাত পা বাঁধা অজ্ঞান অবস্থায় ফ্লোরে পরে
আছে নূর। একটু পরে ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে আসলে, পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো নূর। চোখ খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো ও কোথায়। নিজেকে এই অবস্থায় দেখে নূরের ভয়ে আত্মা কেঁপে উঠলো। নূর মনে মনে ভাবলো, আমি এখানে কিভাবে এলাম? আমিতো আদিত্যের সাথে দেখা যাচ্ছিলাম। নূরের মনে পরলো, আদিত্য তখন ওকে ম্যাসেজ দিয়ে বলেছিল মেইন গেটের কাছে এসে দেখা করতে। কেও যেন দেখতে না পায়। ওর জন্য নাকি কি সারপ্রাইজ আছে? তাই নূর ওর সাথে দেখা করার জন্য বাইরে গেটের কাছে গিয়েছিল। তখনই হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ওর মুখের ওপর রুমাল চেপে ধরে। তারপর আর কিছু মনে নেই ওর।

তারমানে কেউ আমাকে আবারও কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছে। কথাটা মনে আসতেই নূরের ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে আসছে। আত্মা শুকিয়ে আসছে। দু চোখ বেয়ে পানি পরতে লাগলো। আমি এখানে কতক্ষণ ধরে আছি? আর কারাই বা আমাকে নিয়ে এসেছে? আদিত্য? আদিত্যর নাজানি কি অবস্থা হচ্ছে, আমাকে না পেয়ে?

নূরের ভাবনার মাঝেই রুমের বাইরে কারোর কথা বলার আওয়াজ শুনতে পেল। নূর চুপ করে থেকে ভালোকরে শোনার চেষ্টা করলো ওরা কি বলছে।

…..ওই অপয়াকে আজ একদম শেষ করে দিব। যেভাবে আমি ওর মাকে শেষ করে ছিলাম।

কথাটা শুনতেই নূর স্তব্ধ হয়ে গেল। এটাতো ওর ছোট মার কন্ঠ। তারমানে মায়ের মৃত্যু হয় নি, বরং ছোট মা সেদিন আমার মাকে মেরে ফেলেছে? আর আমাকেও আজ মেরে ফেলতে চাচ্ছে? নূর যেন রক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছে এসব ভেবে। নূরের ভাবনার মাঝেই নূর আবারও শুনতে পেল।

…..ফুপি তুমি ওকে মারো কাটো আর যায় করো। কিন্তু তার আগে আমাকে আমার কাজটা করে নিতে দেও। ওর ওপরে অনেক আগে থেকেই নজর ছিল। কিন্তু কখনো ওকে বাগে আনতে পারিনি। আজ ফাইনালি সেই সুযোগ এসেছে। আজ আমি আমার মনের স্বাদ মেটাবো। এইজন্যই তো আজ আমি তোমার এতো হেল্প করলাম ওকে কিডন্যাপ করে আনতে। কতো কৌশলে ছদ্মবেশে অনুষ্ঠানের ভেতর যেয়ে ওই আদিত্যের ফোনটা চুরি করে আনলাম। তারপর সময় বুঝে নূরকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিলাম। তারপরে ওকে বেহুঁশ করে এখানে নিয়ে এলাম। এতো কিছু করেছি শুধু আমার কার্য হাসিলের জন্য।

নূরের বুঝতে বাকি রইল না যে, এটা আর কেউ না, ওই বদমাইশ জনি। ওদের কথা শুনে নূরের ঘৃণায় সারা শরীর রি রি করছে। মানুষ এতো খারাপ কি করে হতে পারে?

নূরের ছোট মা বলে উঠলো।
….ঠিক আছে। তোর যা করার করে নে। তারপর ওকে মেরে ফেলবো।

….ঠিক আছে চলো দেখি ওর জ্ঞান ফিরেছে কিনা?

তারপর দুজন রুমে ঢুকে লাইট জ্বালিয়ে দিল। সামনে তাকিয়ে দেখলো নূর ওদের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জনি সয়তানি হেসে বলে উঠলো।
…..বাহ্ ম্যাডামের তাহলে জ্ঞান ফিরেছে। যাক ভালোই হলো। এখন তাহলে খেলা জমবে।

নূর জনির দিকে একবার অগ্নি চোখে তাকালো, তারপর ওর সৎ মায়ের দিকে তাকিয়ে ব্যাথিত কন্ঠে বললো।
….তুমি আমার মাকে কেন মেরেছ? কি দোষ করেছিল আমার মা? সে তো তোমার বান্ধবি ছিল তাইনা? তাহলে নিজের বান্ধবীকে খুন করতে একবারও তোমার বুক কাঁপল না? তুমি কি মানুষ? আজ নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে যে, তোমার মতো জঘন্য মহিলাকে আমি আমার মায়ের স্থান দিয়েছিলাম।ছিঃ

রুবিনা বেগম সয়তানি হেসে বললো।
….তাহলে তুই জেনে গেছিস।যাক ভালোই হয়েছে। মরার আগে অন্তত সত্যিটা জেনেই মর। হ্যাঁ আমিই তোর মাকে খুন করেছি। আরে কিসের বান্ধবী হ্যাঁ? ও বান্ধবী না বরং চরম শত্রু ছিল। ছোট বেলা থেকেই তোর মা সবকিছুতে আমার থেকে এগিয়ে থাকতো। পড়ালেখা, কাজে কর্মে সবকিছুতে আমার আগে থাকতো। সবসময় ওর জন্য আমাকে কথা শুনতে হতো। মা বলতো, তোর বান্ধবী এতো কিছু পারে তুই পারিস না কেন? তখন থেকেই ওর প্রতি আমার হিংসা হতে শুরু করলো। উপরে উপরে বান্ধবী হয়ে থাকলেও ভেতরে ভেতরে ওর প্রতি আমার রাগ থাকতো। তোর বাবাকে আমিও পছন্দ করতাম। কিন্তু সেখানেও তোর মা আবারও আমাকে হারিয়ে দিল। তোর বাবাকে পটিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেললো। সেদিন থেকে ওর প্রতি আমার রাগ ঘৃণায় পরিনত হলো। এদিকে আমার মা বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দিল এক নেশাখোরের সাথে। তোর মা বিয়ে করে সুখে জীবন গড়ছিল। আর আমি ওখানে কষ্টে মরছিলাম। যখন মাকে তোর বাবার সাথে হাসিখুশি দেখতাম, তখন আমার সারা শরীরে আগুন ধরে যেতো। তাই আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম যে করেই হোক তোর মায়ের জায়গা আমি নিয়েই ছাড়বো। তাই প্রথমে কৌশলে আমার আগের স্বামীর কাছ থেকে ডিভোর্স নেই। তারপর তোর মায়ের কাছে এসে সাহায্য চাই। তোর মাও আমার ওপর দয়া করে আমাকে আর আমার মেয়েকে তোদের বাড়িতে থাকতে দেয়। এভাবে থাকতে থাকতে যেদিন তোর মায়ের ডেলিভারি হয়,সেদিন সুযোগ বুঝে তোর মাকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলি। তোকেও সেদিন মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। তারপরে তোর দাদিকে ছলেবলে পটিয়ে তোর বাবার সাথে বিয়ে করে নিলাম। বিয়ের পরেও তোকে অনেকবার মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম কিন্তু যখন দেখলাম সবাই তোকে তোর মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী করছে। তোকে অপয়া বলছে। তখন আমি তোকে মেরে না ফেলে অন্য প্ল্যান করলাম। তোকে সবার কাছে আরো বেশি করে অপয়া বানানোর জন্য আমি তোর দাদীকেও মেরে ফেললাম।

দাদিকেও মারার কথা শুনে নূর আরো বেশি থমকে গেল। কেমন যেন অনূভুতি শূন্য হয়ে গেলো। তিব্র ঘৃণার চোখে তাকালো রুবিনা বেগমের দিকে।

রুবিনা বেগম আবার বলে উঠলো।
….হ্যাঁ ঠিকই শুনেছিস । তোর দাদিকেও আমি মেরে ফেলেছি। কারণ ওই বুড়ি বেঁচে থাকতে আমি কিছুই করতে পারতাম না। তাই ওকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছি। আর তোকে সবার নজরে বানিয়ে দিয়েছি। এমনকি তোর বাবার কাছেও। তোকে বানিয়ে নিলাম বাসার কাজের লোক। আমি চাইলে তোকে মেরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু তোকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখে আমার অনেক ভালো লাগতো। আমার মনে হতো আমি তোর মাকেই শাস্তি দিচ্ছি। কিন্তু তুই তো তোর মায়েরই মেয়ে। ঠিকই নিজের রুপের জালে আশিক যুগিয়ে ফেললি। তুই কি ভেবেছিস? তুই বিয়ে করে রাজরানীর মতোন সুখে থাকবি, আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো?কখনোই না। যে কাজ আগে করিনি সেটা এখন করবো। তোকেও তোর মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিব।

এতক্ষণ রুবিনা বেগমের কথাগুলো শুনে নূর যেন অনূভুতি শূন্য হয়ে গেলো। ওর এতো বছরের জীবন একটা মিথ্যের মধ্যে ছিল? আর ও কিনা নিজেকেই এতদিন সবকিছুর জন্য দোষী মেনে এসেছে? এসব ভেবে নূরের শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। গলায় সব দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। কোনো কথায় বলতে পারছে না।

রুবিনা বেগম এবার জনির দিকে তাকিয়ে বললো।
…তোর যা করার করে নে। তারপর ওকে শেষ করে ফেলবো। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। কাজ হয়ে গেলে আমাকে ডাক দিস।

জনি মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো।

রুবিনা বেগম বেড়িয়ে যেতেই, জনি নূরের সামনে এক হাঁটু গেড়ে বসে সয়তানি হাসি দিয়ে বললো।
….তো নূর সোনা এখন কোথায় পালিয়ে যাবে? ওই আদিত্যকে দিয়ে আমাকে মার খাইয়েছিলি না? এখন কে বাঁচাবে তোকে আমার হাত থেকে? ভেবেছিলাম তোকে বিয়ে করেই আমার চাহিদা পূরণ করবো। কিন্তু তুই তা হতে দিলি না। তাই এখন বিয়ে ছাড়াই আমার মনের বাসনা পূরণ করবো।

রুবিনা বেগমের কথা শুনে নূর এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকলেও, জনির এই নোংরা কথাগুলো শুনে অগ্নি চোখে তাকালো জনির দিকে। তারপর হঠাৎ উচ্চস্বরে হাসা শুরু করলো নূর।

নূরকে এভাবে হাসতে দেখে জনি একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে বললো।
….এতো শক খেয়ে পাগল হয়ে গেলে নাকি?

নূর হসি থামিয়ে জনির দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বললো।
…পাগল আমি না তোরা হয়ে গেছিস। তোরা কি ভেবেছিস, তোরা আমার সাথে যা খুশি তাই করতে পারবি? আর তুই, গতবারের মারের কথা এত তাড়াতাড়িই ভুলে গেছিস? তবে চিন্তা করিস না। আমার আদিত্য এসে আবার তোকে মনে করিয়ে দিবে। এবারের মার তুই জীবনেও ভুলতে পারবি না। যদি তোর জীবনটা বেঁচে থাকে আরকি। কারণ আমারতো মনে হয় না এবার আদিত্যের হাত থেকে তোকে কেও বাঁচাতে পারবে।

নূরের কথায় জনির প্রচুর রাগ উঠে যায়। জনি চোয়াল শক্ত নূরের গালে সজোরে একটা থাপ্পড় মেরে দেয়। চড় দেওয়াতে নূরের মাথা আরেক দিকে বাকা হয়ে ঝুকে পড়ে। ঠোঁট ফেটে রক্তও বের হয়ে যায়।

তবুও নূর ভয় না পেয়ে চোখ মুখ কঠিন করে জনির দিকে তাকিয়ে ওর মুখের ওপর থুতু ফেলে বললো।
…..থুহ্, তোর মতো কাপুরুষেরা শুধু এটাই পারিস। একটা মেয়েকে ধরে বেঁধে এনে নিজের পুরুষত্ব দেখাতে। আরে আসল পুরুষ দেখতে হলে, আমার আদিত্যকে দেখ। কতো পারিস তার সাথে মোকাবিলা করে দেখ। হুহ্, এক সেকেন্ডেও টিকতে পারবি না। তুই জোর করে আমার শরীর ভোগ করতে চাস। আর আদিত্য চাইলে আমি নিজেই নিজেকে ওর কাছে বিলিয়ে দেব। তবুও ও আমার নারীত্ব হরণ করবে না। সেই হলো আসল পুরুষ। আরে তোর মতো নর্দমার কিটের সাথে আমার আদিত্যর তুলনা দেওয়াও চলে না। তুই ভুলেও ভাবিস না যে আমি তোকে দেখে ভয় করবো। একদম না। তুই জানিস আদিত্য আমাকে বলেছে, ভীতু চেহারায় আমাকে নাকি অনেক সুন্দর লাগে। আমি যেন অন্য কোনো পুরুষের সামনে ভয় পেয়ে আমার ভীতু চেহারাটা না দেখাই। আমি আবার আমার আদিত্যের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। কারণ আমি ওকে অনেএএএএএএক ভালোবাসি। তুই আমার কোনো ক্ষতি পারবি না। কারণ আমি জানি আমার আদিত্য, আমার রাজকুমার অবশ্যই আসবে। আর তোদের উচিৎ শিক্ষা দিবে।

নূরের কথাগুলো শুনে জনি প্রচুর অবাক হলো। সাথে রাগও হলো। জনি চোয়াল শক্ত করে বললো।
…..অনেক ভরসা না তোর ওই আদিত্যের ওপর? ঠিক আছে তাহলে দেখা যাক তোর আদিত্য কিভাবে তোকে আজ আমার হাত থেকে বাঁচায়।
কথাটা বলেই জনি উঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর নূরের দিকে তাকিয়ে সয়তানি হেসে ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।

নূর উপরে উপরে সাহস দেখালেও ভেতরে ভয়ে আত্মা শুকিয়ে আসছে। মনে মনে শুধু আল্লাহর নাম নিচ্ছে, আর বলছে আদিত্য কোথায় তুমি? তাড়াতাড়ি চলে এসো। নাহলে যে আজ সব শেষ হয়ে যাবে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here