দৃষ্টির_আলাপন #পর্বঃ১২ #আদওয়া_ইবশার

0
449

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১২
#আদওয়া_ইবশার

হঠাৎ করেই রক্তিমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাকিবের নজর যায় দৃষ্টির দিকে। দেখতে পায় বাচাল মেয়েটা একটা পিচ্চি ছেলের সাথে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে। কথা বললে ভুল হবে। এক প্রকার আঙুল উচিয়ে তর্ক করে যাচ্ছে। দাঁত দিয়ে নিম্নোষ্ঠ কামড়ে ভাবে রাকিব, আধ পাগল মেয়েটা এই ফুটফুটে বাচ্চা ছেলেটাকেও রেহাই দিলনা। নিশ্চয়ই এখানে এসেছিল আবার রক্তিম শিকদারকে জ্বালাতে। কিন্তু এতো গুলো মানুষের মাঝে রক্তিমের নাগাল না পেয়ে এই বাচ্চা ছেলেটার মাথা নষ্ট করছে। এই মেয়ের এলেম আছে বলতে হয়। বারবার রক্তিম শিকদারের কাছে অপদস্থ হয়েও ঘুরেফিরে তার পিছেই আসবে।

দৃষ্টির থেকে নজর ঘুরিয়ে এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দলের অন্যান্য ছেলেদের অবস্থান দেখে নেয় রাকিব। মেহেদী সহ সকলেই রক্তিমের আশেপাশেই আছে। তাছাড়া পুলিশ ও আছে এখানে। রক্তিম শিকদার বা আজীজ শিকদারের উপর ভরা মঞ্চে আচমকা হামলা করার কোনো পরিস্থিতি নেই। নিশ্চিত হয়ে শান্তর দিকে তাকিয়ে ইশারায় কিছু একটা ইঙ্গিত দিয়ে নেমে পরে মঞ্চ থেকে। লাফিয়ে কয়েক কদমে ঠিক দৃষ্টির পিছনে এসে দাঁড়ায়। স্ব-হাস্য স্বরে বলে,

“কি ব্যাপার ললনা! রক্তিম শিকদার মনে হয় ডোজ কম দিচ্ছে তোমাকে! গলা টি’পা এন্টিডোজ তোমার মতো পুঁচকে ভালোবাসা নামক ভাইরাসরে ঘায়েল করতে পারলনা। বড়োই ভাবনার বিষয়।”

আচমকা পেছন থেকে কারো গলার আওয়াজ পেয়ে কপাল কুঁচকে পিছন মুখে তাকায় দৃষ্টি। দেখতে পায় রাকিব দাঁত কপাটি বের করে হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। বিরক্ত হয় দৃষ্টি। চোখ পাকিয়ে বলে,

“এই আপনার সাহস তো দেখি কম না! জনসভার এতো এতো কাজ রেখে শরীরে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছেন। ফাঁকিবাজ চামচা একটা।”

চামচা সম্বোধনে আজকে আর রাগেনা রাকিব। বিগলিত হেসে বলে,

“একটু সাইডে আসো। কথা আছে।”

“কি কথা?”

সন্দিহান কন্ঠে জানতে চায় দৃষ্টি। উত্তরে রাকিব তাড়া দিয়ে বলে,

“আরে আসোই না! না আসলে শুনবা কেমনে?”

“কি কথা এখানেই বলুন।”

দৃষ্টির কন্ঠে স্পষ্ঠ রাকিবের কথায় সাথে যাবার অনিহা প্রকাশ পাচ্ছে। রাকিব বলে,

“এতো গুলো মানুষের সামনে বলা যাবেনা। সিক্রেট কথা।”

খ্যাঁটখ্যাঁটে চামচার হঠাৎ এমন ভালো মানুষী আচরণ! হজম হয়না দৃষ্টির। নিশ্চয়ই বদটা মনে মনে কোনো শয়তানি ফন্দি এটেছে তাকে নাস্তানাবুদ করার। তবে সেও জানেনা দৃষ্টি কেমন চিজ। উল্টাপাল্টা কিছু করলে সাথে সাথেই চেঁচিয়ে সভায় উপস্থিত প্রতিটা মানুষকে দিয়ে গণধুলাই খাইয়ে ছাড়বে দৃষ্টি। নাক-মুখের নকশা পাল্টে গেলে ঠিক বুঝবে দৃষ্টির সাথে ইতরামি করার সাজা কেমন ভয়ানক। কথাগুলো ভেবে নিজেকে একটু আশ্বস্ত করে দিহানের হাত টেনে এগোই দৃষ্টি। তৎক্ষণাৎ রাকিব বলে,

“সাথে আবার এই মসিবত টেনে আনছো কেন? ঝগড়া শেষ হয়নি এটার সাথে?”

চোখ পাকায় দৃষ্টি। রাগি স্বরে বলে,

“কোন সাহসে আমার ভাইকে মসিবত বলছেন আপনি? আর একবার আমার ভাইকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু বললে একেবারে মাথা ফাটিয়ে দিব।”

একটু ভড়কায় রাকিব। থমথম খেয়ে বলে,

“এটা তোমার ভাই! আমি আরও ভাবছিলাম ঝগড়া করার জন্য কোনো বাড়ি থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছো। তা ভাইকে সাথে নিয়ে এখানে এসেছো কেন?”

সত্যি কথাটা বলতে গিয়েই টুপ করে জ্বিভের ডগা পযর্ন্ত বেরিয়ে আসা কথাটা গিলে নেয় দৃষ্টি। কপট রাগি ভাবে বলে,

“তা জেনে আপনার কি? কিজন্য ডেকেছেন আগে সেটা বলুন। আপনার মতো এতো আজাইরা প্যাচাল পারার সময় নেই আমার।”

বাব্বাহ্! বলে কি মেয়ে। এতো দেখি ভূতের মুখে রাম নাম। যে মেয়ে পারলে দিন-রাতের চব্বিশ ঘন্টায় রক্তিম শিকদারের পিছনে ঘুরে নিজের আজাইরা সময় কাজে লাগায়। সে না কি আবার বলে তার সময় নেই। কথাটা মনের মাঝেই চেপে রাখে রাকিব। এই হাফ পাগল মেয়ের সাথে বেশিক্ষণ থাকা যাবেনা। যা বলতে এসেছে সেটা সম্পূর্ণ করে দ্রুত কেটে পরাই মঙ্গল। সচেতন চোখে এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দেখে নেয় কেউ তাদের দেখছে কি না। নাহ্! আপাতত কারো ধ্যান এদিকে নেই। সকলেই রক্তিম শিকদারের কথা গিলতে ব্যস্ত। আবারও দু-পাটি দাঁত বের করে হাসে রাকিব। দৃষ্টির দিকে কিছুটা ঝুকে ফিসফিসিয়ে বলে,

“শুনো সুন্দরী! তোমারে একটা ভালো বুদ্ধি দেই। ঐ জড় বস্তুর ন্যায় ইস্তাপ কঠিক হৃদয়ের অধিকারী রক্তিম শিকদারের পিছনে অযথা সময় নষ্ট না করে একটু আমার দিকে দেখো। তুমি রাজি থাকলে আমাদের প্রেম জমে ক্ষীর হইতে বেশিক্ষণ লাগবেনা। ঐসব প্রেমের ব্যাপারে ভালো ধারণা আছে আমার। কথা দিচ্ছি একদম ঠকবানা।”

কথাটা শেষ করে আবারও ঠোঁট কামড়ে হাসে রাকিব। রাগে গা-পিত্বি জ্বলে ওঠে দৃষ্টির। ঝাড়ি মেরে বলে,

“যেই না চেহারা তার নাম রাখছে আবার পেয়ারা। সাহস কত বড়! রক্তিম শিকদারের ভাবি স্ত্রীকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়! আবার দাঁত বের করে হাসে! কি বিচ্ছিরি হলুদ দাঁত! আমার তো দেখেই বমি চলে আসছে। মুখ বন্ধ করুন।”

গরম গরম এমন একটা অপমানে থমথম খেয়ে যায় রাকিব। তৎক্ষণাৎ মুখের হাসি হাওয়ার সাথে মিলিয়ে যায়। কিছুটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বিরবির করে বলে,

“তার চেহারা থেকে মনে হচ্ছে ডালিমের রস বেয়ে বেয়ে পরছে। নেহাত আমি ভদ্র একটা ছেলে দেখে একটা মেয়ের ভালোবাসা না পাবার কষ্টে একটু বুক জ্বলেছে আমার। সহমর্মিত দেখিয়ে তাই প্রেমের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আর এই মেয়ে বিনিময়ে আমার কচি চেহারা আর সুন্দর হাসিটা নিয়ে অপমান করল! অভদ্র, অসভ্য মেয়ে জাতি কোথাকার।”

নিজেকে একটু ধাতস্থ করে গলা উচিয়ে চোখ রাঙিয়ে আবারও বলে রাকিব,

“এই মেয়ে! তুমি জানো রোজ রোজ কতশত মেয়েরা আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়? সেই শত শত মেয়ের ক্রাশকে তুমি এইভাবে অপমান করলা! আমার প্রেমিকারা যদি এই কথা জানতে পারে তোমার চুল একটাও আস্তো থাকবেনা বলে দিলাম।”

মুখ বাকায় দৃষ্টি। ব্যঙ্গ করে বলে,

“খালি কলসি সবসময় বাজে বেশি। ধন্যবাদ বিষয়টা আবারও প্রমাণ করার জন্য।”

পূণরায় অপমান! এসব কি মেনে নেওয়া যায়? যে ছেলেটাকে এক প্রকার রক্তিম শিকদারের বাঁ-হাত বলা চলে সেই সুদর্শন ছেলেটাকে এভাবে অপমান করছে মেয়েটা। এর প্রতিশোধ তো নিতেই হয়। কিন্তু কিভাবে নিবে? ভাবতে ভাবতেই চক করে মাথায় আসে কয়েকমাস আগেই না তার নাম্বারে এক অচেনা মেয়ে প্রেমের প্রস্তাব দিল! সেটা দেখিয়েই তো এই মেয়ের মুখের উপর অপমানের জবাব ছুড়ে দেওয়া যায়। ভেবেই পকেট হাতের ফোন বের করে বলে,

“আমি ফাঁকা কলসি না! খারাও। দেখাইতেছে কে ফাঁকা কলসি আর কে ভরা কলসি। এই যে দেখো। দেখো এইটা কি। মেয়েরা ফোনে পযর্ন্ত প্রেমের প্রস্তাব দিয়া আমারে পাগল করে ফেলে। আর তুমি রক্তিম শিকদারের পিছনে বেহায়ার মতো ঘুরেও পাত্তা পাওনা। সেই তুমি কি না আমারে ফাঁকা কলসি বলো! এবার দেখো কে ফাঁকা কলসি আর কে ভরা কলসি।”

চোখের সামনে ফোনের স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করা ম্যাসেজটা দেখার পর রাকিবের কোনো কথায় আর দৃষ্টির মস্তিষ্কে পৌঁছায় না। অবাক নেত্রে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ফোনের দিকে। এ তো সেই ম্যাসেজ। যেটা রক্তিম শিকদারকে দিয়েছিল দৃষ্টি। বিনিময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ফিরতি ম্যাসেজ ও পেয়েছিল। আর ভেবেছিল রক্তিম শিকদার কিভাবে তাকে এমন ম্যাসেজ ছিল। কিন্তু ঘটনা যে একেবারে উল্টো এটা কে জানতো? রক্তিম শিকদার সেদিন তার সাথে তো বড় একটা বেঈমানি করল! নিজের নাম্বার বলে তাকে এই চামচা রাকিবের নাম্বার দিল?

দৃষ্টি-রাকিব দুজনের কারোর কোনো কথার আগা-মাথা বুঝতে পারছেনা দিহান। অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে তাদের কান্ড। এর মাঝে বোনকে আবার এমন ফিজড হয়ে থাকতে দেখে একটু চিন্তিত হয়। ভাবে এই লোকটা আবার খারাপ কিছু দেখাল কি না তার বোনকে। কিছুটা ভয় পেয়ে যায় ছেলেটা। দৃষ্টির হাত ঝাকিয়ে বলে,

“আপু! আমার আর হিরো দেখার ইচ্ছে নেই। চলো আমরা ফিরে যায়।”

চোখ-মুখ থমথমে দৃষ্টির। অপলকে এখনো তাকিয়ে আছে ফোনের দিকে। তা দেখে বিজয়ের হাসি হাসে রাকিব। স্বগর্বে বুক ফুলিয়ে বলে,

“কি? প্রমাণ দেখে এখন মুখের কথা হাওয়া হয়ে গেছে?”

অস্বভাবিক থমথমে দৃষ্টিতে রাকিবের দিকে তাকায় দৃষ্টি। শক্ত কন্ঠে বলে,

“আপনাদের পাতি নেতা রক্তিম শিকদার যে কতটা লয়্যাল তার লয়্যালিটির প্রমাণ আজকে আমি দিব। কঠিন বোঝাপড়া আছে রক্তিম শিকদারের সাথে আমার।”

নির্বাচনের আর মাত্র দুদিন বাকী।জনসভা শেষে বাবার সাথে নিরবে কিছু আলোচনা সাড়তে সোজা পার্টি অফিসে চলে যায় রক্তিম। এতো এতো মানুষের মাঝে দৃষ্টি আর সাহস করে ওঠতে পারেনি রক্তিমের মুখোমুখি দাঁড়ানোর। তবে পিছু নিয়েছে ঠিকই। স্কুল মাঠ থেকে পায়ে হেঁটে মাত্র দুই মিনিটের পথ অতিক্রম করলেই পার্টি অফিস। মেইন রোড সংলগ্ন অফিসটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে মনে মনে অন্য এক বুদ্ধি আঁটে দৃষ্টি। মত পরিবর্তন করে। রক্তিমের সাথে আর দেখা করবেনা। যা করার কালকেই করবে। কথাটা ভেবে কুটিল হেসে ভাইকে নিয়ে প্রস্থান করে দৃষ্টি। বাসায় পৌঁছনোর আগ পযর্ন্ত পুরোটা পথ দিহান বোনকে হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখে ফেলেছে। রক্তিম শিকদার কে? ঐ বুড়ো লোকটাকে কেন তার বোনের চোখে হিরো মনে হয়? আর ঐ ছেলেটাই বা কে যে তার বোনের সাথে এতোক্ষন ঝগড়া করল! এতো এতো প্রশ্নের জবাবে দৃষ্টি শুধু একটা কথায় বলেছে,

“সময় হলে সব জানতে পারবি।”
বোনের জবাবটা ঠিক পছন্দ হয়নি দিহানের। অসন্তুষ্ট মুখে হাঁটতে হাঁটতে কিছু একটা ভেবে নিজ থেকেই অল্প চমকায়। হাঁটার গতি থামিয়ে বোনের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে জানতে চায়,

“আপু! তুমি কি ঐ বুড়ো লোকটার প্রেমে পরেছো?”

ভাইয়ের এমন প্রশ্নে থমথম খেয়ে যায় দৃষ্টি। আমতা আমতা করে বলে,

“আরে ধুর! এমন কিছুই না। প্রেম-ভালোবাসার বুঝিস কিছু তুই? অযথা না বুঝে পাকনামি করবিনা একদম।”

দিহানের ঠিক বিশ্বাস হয়না কথাটা। সে ছেলেটা ছোট হতে পারে। কিন্তু আজ কালকার ছেলে-মেয়েরা কি এতো অবুঝ হয় না কি? তারা ক খ শিখার আগেই প্রেম-ভালোবাসা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলে। আর দিহান কি না তার বোনের হাবভাব দেখেও বুঝবেনা বোন ঐ বুড়ো লোকটার প্রেমে পরেছে কি না!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here