#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১৮(প্রথম অংশ)
#আদওয়া_ইবশার
ড্রয়িং রুম জুড়ে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। স্ত্রীর ফোন পেয়ে সাদেক সাহেব তৎক্ষণাৎ ছুটে আসে বাসায়। তবে ঘটনার বিস্তারিত বুঝতে পারেনা কিছুই। এখন পযর্ন্ত সৌজন্যমূলক আলাপচারিতা ছাড়া সঠিক উদ্দেশ্যের কথা কেউ জানায়নি। পরিচয় পর্বের মাঝেই সাদেক সাহেব জানতে পারে নিজের এলাকার মেয়র, এমপির সাথের অপরিচিত লোক গুলোর একজন সাভারের এমপি এবং এমপি পুত্র সাথে তার বন্ধু। হুট করে কোনো আগামবার্তা ছাড়া নিজের এলাকার রাজনৈতিক সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে অন্য এলাকার এমপিও উপস্থিত বিষয়টা ক্রমশই গভীর চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে দৃষ্টির মা-বাবা দুজনকেই। কিছুতেই কিছু ভেবে পাচ্ছেন না ঠিক কি কারণে ওনারা সরাসরি বাসায় এসে উপস্থিত হতে পারে। কোনো কূলকিনারা না পেয়ে ভাবনা-চিন্তা একপাশে রেখে সাদেক সাহেব সৌজন্য হেসে বলেন,
“আপনাদের মতো এতো সম্মানীয় ব্যক্তি আমার বাসায় এসেছে বিষয়টা সত্যিই আমার খুব ভালো লাগছে। কিন্তু ঠিক কি কারণে হঠাৎ আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের বাসায় আসলেন বিষয়টা ক্লিয়ার করলে হয়তো আমাদের সবার ভালো হতো।”
সাদেক সাহেবের কথায় উপস্থিত সকলেই একটু নড়েচড়ে বসে। আজীজ শিকদার নিজের পাশে বসা ময়মনসিংহ আসনের এমপি মাজহারুল ইসলামকে ইশারায় কথা শুরু করতে বলেন। কৃত্রিম কাশির শব্দ তুলে মাজহারুল ইসলাম সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে শুরু করেন,
“দেখুন ভাই সাহেব হতে পারি আমরা বর্তমানে নিজেদের এলাকার এমপি পদে আছি। তবে আমি-আপনি আমরা সবাই তো সাধারণ মানুষেই তাই না! আপনারা যদি আমাদের ভোট না দিয়ে এলাকার ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব না দিতেন তবে তো আর আমরা এই দায়িত্ব পেতাম না। তাই বলছিলাম আমাদের স্বাভাবিক মেহমান হিসেবে গ্রহণ করলেই আমরা খুশি হবো। তাছাড়া আমাদের আজকে এখানে আসার উদ্দেশ্যটাই আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি করার জন্য।”
আত্মীয়তার জন্য ওনারা এই বাসায় বাসায় এসেছে! কিন্তু কিরকম আত্মীয়তা? সঠিক বুঝতে পারছেনা সাদেক সাহেব। দিলশান আরা, সাদেক সাহেব সন্দিহান চোখে একে অপরের দিকে তাকায়। মাজহারুল ইসলাম আবারও বলে ওঠেন,
” যাইহোক। বাকী কথা টুকু না হয় আজীজ ভাই আপনি নিজেই বলুন।”
মুচকি হেসে সম্মতি জানায় আজীজ শিকদার। সরাসরি সাদেক সাহেবের তাকিয়ে বলেন,
“আপনার মেয়ে দৃষ্টি মেহজাবিন কিছুদিন আগে সাভারে বেড়াতে গিয়েছিল আপনার বড় শ্যালিকার বাড়ি। সেখানেই ওর সাথে আমার দেখা হয়। প্রথম বার দেখেই আপনার মেয়েকে আমার ছেলের জন্য মনে ধরে। আমি সবসময় সব কথা সরাসরি বলতে পছন্দ করি ভাইজান। তাই ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে না বলে সরাসরিই বলে দিচ্ছি। আপনার বাসায় আমি আমার ছেলে রক্তিম শিকদারের জন্য আপনার মেয়ের হাত চাইতে এসেছি।”
দৃষ্টি নামটা শোনা মাত্রই লাফিয়ে ওঠে মেহেদী। হতবাক দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে থাকে রক্তিমের দিকে। এটা যে তার বন্ধুর প্রেমে দিওয়ানি হওয়া সেই মেয়েটার বাড়ি তা এতোক্ষনে মাত্র জানতে পারল মেহেদী। কিন্তু কিভাবে কি হলো? ঐ মেয়ের খোঁজ আজীজ শিকদার অব্দি কিভাবে পৌঁছালো? আর রক্তিমেই বা সব জেনেও কিভাবে রাজি হলো এখানে আসতে? তবে কি ভিতরে ভিতরে বন্ধু তার আবারও প্রেমে মজলো? কিন্তু কখন? দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা একসাথে থেকেও সে একটুও টের পেলনা কেন? আচ্ছা সে না হয় মেনে নিল রক্তিম মেয়েটার প্রেমে পরেনি। আজীজ শিকদার নিজ উদ্যোগে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। তারপরও তো এখানে একটা কিন্তু থেকে যায়। আজীজ শিকদার যদি নিজ উদ্যোগেই এই পর্যন্ত আসে তবে রক্তিম কিভাবে আসল? সে তো এতো সহজে বাবার কথায় রাজি হয়ে চলে আসার পাত্র না। তাছাড়া এই মুহুর্তে রক্তিমের চোখ-মুখ দেখেও মনে হচ্ছেনা সে আগে থেকে কিছু জানতনা বা তাকে জোর করে নিয়ে আসা হয়েছে। তবে কি! আর কিছুই ভাবতে পারেনা মেহেদী। মাথা এখনই পুরো ফাঁকা মনে হচ্ছে তার। এতো বড় একটা ঘটনা বদ হজম হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বহু কষ্টে মেহেদী তা চেপে রাখছে। ঘটনা পুরোটা না জেনে মুখ খোলা ঠিক হবেনা।
এমন কিছু আবদার নিয়ে যে মানুষ গুলো ওনার বাসায় এসেছে সেটা ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি তারা সাদেক সাহেব। দিলশান আরা কথাটা শোনা মাত্রই বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে উদ্যত হতেই ইশারায় থামিয়ে দেয় সাদেক সাহেব। স্ত্রীকে শান্ত হয়ে বসতে ইশারা করে ওনি নিজেই স্মিত হেসে বলেন,
“মেয়ের বাবা হয়েছি,বিবাহ যোগ্য মেয়ে ঘরে আছে এমতাবস্থায় প্রস্তাব আসাটাই স্বাভাবিক। তবে ভাইসাহেব, আমাদের মেয়েকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে আমরা প্রস্তুত নই। মেয়ে পড়ছে পড়োক। একটা মাত্র মেয়ে আমাদের। তাকে প্রতিষ্ঠিত করার আগেই বিয়ে নিয়ে ভাববনা আমরা।”
“প্রতিষ্ঠিত হতে চাইলে মেয়েরা তো বিয়ের পরেও হতে পারে। তাছাড়া আজকালের যুগে আমার মনে হয় মেয়েদের আঠারো হলেই যোগ্য পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই বাবা-মায়ের জন্য ভালো। কারণ ছেলে-মেয়েরা বড় হলে কলেজ-ভার্সিটিতে গিয়ে বাবা-মায়ের আড়ালে ভুল কোনো সম্পর্ক বা অন্য কিছুতে জড়িয়ে পরে কি না এই সম্পর্কে কিন্তু আমরা সবসময় অবগত থাকিনা। সেকারণেই…”
“মাজহারুল ইসলাম নিজের কথা শেষ করার আগেই দিলশান আরা বলে,
“বিয়ে দিয়ে দিলেই যে মেয়ে কোনো খারাপ কাজে বা সম্পর্কে জড়াবেনা এটার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? যে মেয়ের এমন সম্পর্কে জড়ানোর ইচ্ছে থাকে তাকে শুধু বিয়ে কেন সে যদি দুই-তিন বাচ্চার মা’ও হয়ে যায় তবুও সে অবৈধভাবেই সম্পর্ক রাখবে। ভুল পথে পা দিবে। আর যে মেয়ের এমন কোনো ইচ্ছে না থাকে সে মেয়ে বিয়ের আগেও কোনো সম্পর্কে জড়াবেনা বিয়ের পর তো কথায় নেই। তাছাড়া আমার মেয়েকে এখন বিয়ে দিলে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে যাব এর মানে কি? আমার মেয়ে নিয়ে যদি আমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ থাকে তবে সেটা বিয়ে না দিলেও থাকবে বিয়ে দিলেও থাকবে। আর সবথেকে বড় কথা আমাদের মেয়ের কি করলে ভালো হবে কি করলে খারাপ হবে এটা বোঝার জন্য আমরা এখনো বেঁচে আছি। আপনাদের কষ্ট করে এসব নিয়ে ভাবতে হবেনা। অনেক দূর থেকে এসেছেন আপনারা, নিজেদের অনেকটা মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন সেজন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত সাথে অসংখ্য ধন্যবাদ। এবার আপনারা আসতে পারেন।”
মুখের উপর সরাসরি এমন একটা জবাব ছুড়ে দেওয়াই উপস্থিত সকলের মুখে অসন্তুষ্টির রেশ থাকলেও রক্তিম নির্বিকার। দিলশান আরা’র কথা গুলো অন্য সবার মতো তার কাছে কটূক্তি মনে না হয়ে অত্যন্ত শ্রুতিমধুর বাণী মনে হচ্ছে। সে আগে থেকেই এমন একটা ধারণা করেছিল। মেয়ের বাবা-মা এখনো ছেলে সম্পর্কে জানলোই না। তার আগেই এমন প্রতিক্রিয়া! আর ছেলে সম্পর্কে যখন সবটা জানবে তখন কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে? সেই প্রতিক্রিয়া দেখার পর আজীজ শিকদারের মুখটাই বা কেমন দেখাবে? আজীজ শিকদার কি খুব বেশি অপমানিত বোধ করবে না ঐসব কটূক্তি গায়ে মাখবেনা! ঠোঁটের কোণে ধূর্ত হাসির রেখা ঝুলিয়ে মাথা নত করে সেসব ভাবনায় মশগুল রক্তিম। ঠিক তখনই কর্ণগোচর হয় আজীজ শিকদারের কথা। দিলশান আরা’র কথায় একটুও অপমানিত হবার না হয়ে স্বহাস্যে আজীজ শিকদার বলেন,
“সে নাহয় বুঝলাম আপা। কিন্তু আপনার মেয়ে আর আমার ছেলে যে একে অপরকে ভালোবাসে! এখন আপনি কি বলবেন? এই মুহুর্তে কি আমাদের উচিৎ না তাদের নামহীন সম্পর্কটা মেনে নিয়ে বৈধতার সাথে নতুন একটা নাম দেওয়া! এখন যদি আমরা এটা না করি তবে হয়তো একদিন আগে হোক বা পরে, মানুষ ওদের মেলামেশা দেখে নানান কথা রটাবে। বাবা-মা তুলেও মন্তব্য করবে। বলবে কেমন বাবা-মা? ছেলে-মেয়েদের এভাবে ছেড়ে দিয়েছে। তখন কি সেসব শুনতে বা দেখতে ভালো লাগবে আপনাদের?”
কথাটা শোনা মাত্র সাদেক সাহেব, দিলশান আরা যতটা না অবাক হয়েছে তার থেকেও অধিক বিস্মিত রক্তিম। আজীজ শিকদার কি বলল এসব? তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসে মানে? রক্তিম কখন ঐ মেয়েকে ভালোবাসতে গেল? সে পারেনা একেবারে মেয়েটার গলা চেপে ধরে শ্বাস রোধ করে মে রে ফেলেতে। সেখানে কি না বলল রক্তিম ঐ মেয়েকে ভালোবাসে! মুহূর্তেই শান্ত মেজাজ উত্তপ্ত হয় রক্তিমের। ছলাৎ করেই যেন পায়ের রক্ত সব মাথায় ওঠে যায়। মেজাজ খিঁচিয়ে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই বাঁধা পরে যায় আজীজ শিকদারের কঠিন দৃষ্টির কাছে। না চাইতেও শান্ত হয়ে যায় শরীরের উত্তপ্ত রক্ত কণিকা। সে যতই খারাপ হোক। আর যতই বাবার অবাধ্যতা করুক। সবটাই তো নিজের এলাকায় করেছে। এখন এরকম অন্য এক এলাকায় এমন সম্মানীয় মানুষ গুলোর সামনে বাবার কথার অবাধ্য হতে মন সাই দেয়না রক্তিমের। সবার অলক্ষ্যে আগোচরে চোয়াল শক্ত করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সামলে নেয় নিজেকে। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত কি হয় সেটা দেখার।
চলবে…..
( ভিষণ চাপে আছি। চেষ্টা ছিল আজকে বড় একটা পর্ব দেওয়ার। কিন্তু সম্ভব হয়নি। আজকের দিনটা একটু মানিয়ে নিন। কালকে থেকে বড় বড় পর্বই পাবেন ইন শা আল্লাহ। রি-চেইক দেওয়া হয়নি। ভুল গুলো ক্ষমা করবেন।)