দৃষ্টির_আলাপন #পর্বঃ১৮(শেষ অংশ) #আদওয়া_ইবশার

0
409

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১৮(শেষ অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

নিজের মেয়েকে ঘিরে এমন একটা কথা শুনে বুকের ভিতর মুচড়ে ওঠে দিলশান আরা’র। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আজীজ শিকদারের দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থাকে। পরক্ষনে নিজেকে সামলে জোর গলায় প্রতিবাদ জানিয়ে বলে,

“একদম ফালতু কথা বলবেন না আমার মেয়েকে ঘিরে।সেই তখন থেকে কিসব অযৌক্তিক কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন! আমি আগেই বুঝতে পারছিলাম আপনারা আমার বাড়িতে এসেছেন কিছু একটা অশান্তি করার জন্যই। আমার বাড়িতে বসে আমার মেয়ে সম্পর্কে এমন একটা কথা বলার পরও আমি যথেষ্ট আন্তরিক ব্যবহার করছি আপনাদের সাথে। সম্মানের সহিত বলছি, দয়া করে বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে। অন্যথায় আপনাদের সাথে ঠিক কতক্ষণ আন্তরিকতা বজায় রাখতে পারব তা সঠিক বলতে পারছিনা।”

আজীজ শিকদার এখনো শান্ত। কথাগুলো একদম গায়ে লাগেনি, এমন একটা ভান করে বোঝানোর স্বরে বলে,

“আহা! এতো রেগে যাচ্ছেন কেন আপা? আমি তো খারাপ কিছু বলিনি। ভালোবাসা পবিত্র একটা শব্দ। এটাতে খারাপ কি পেলেন? তাছাড়া আমি যতটুকু জানি আপনাদেরও ভালোবাসার বিয়ে। ভালোবাসা খারাপ হলে তো নিশ্চয়ই আপনাদের মতো দুজন শিক্ষিত মানুষ ভালোবেসে সংসার গড়তেন না! তবে এখন কেন মেয়ের ভালোবাসার কথা শুনে এমন রিয়েক্ট করছেন?”

চমকের পালা যেন শেষই হচ্ছেনা সাদেক সাহেব, দিলশান আরা’র। লোক গুলো কেমন আসার পর থেকেই একের পর এক বুক কাঁপানো আওয়াজ দিয়ে যাচ্ছে! সবথেকে আশ্চর্যের বিষয়, ওনারা এটা জানল কিভাবে যে তারা ভালোবেসে বিয়ে করেছে? সাদেক সাহেব, দিলশান আরা তো কখনো এই কথাটা নিজের ছেলে-মেয়ের কান পযর্ন্ত পৌঁছাতে দেয়নি। ওনাদের পৈত্রিক ভূমি ময়মনসিংহের তারাকান্দা গ্রামের হাতে গুণা কয়েকজন মানুষ ছাড়া তো এই কাহিনী শহরের কেউ জানেনা। বহু বছর আগেই সেই অতীত গ্রামে ফেলে জীবিকার তাগিদে আর অল্প আয়েশী জীবনের আশায় ছুটে এসেছিল এই শহরে। তাহলে এই গোপন তথ্য কিভাবে জানল লোকগুলো! তবে কি ওনারা এখানে আসার আগেই সব খবরাখবর জেনেই এসেছে! রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত মানুষ গুলো এমনিতেই ধূর্ত হয়। এরা সর্বদা নিজেদের পাওয়ার খাটিয়ে অসম্ভবপ্রায় কাজকেও সম্ভব করে নেয় এক চুটকিতেই। তবে কি এবার এই মানুষ গুলোর ক্ষমতার কাছে নত হতে হবে তাদের? মেয়ের জন্য যে প্রস্তাব এনেছে মেনে নিতে হবে তা! কথা গুলো যত ভাবছে ততই অস্থির হয়ে ওঠছে দিলশান আরা। একটা মাত্র মেয়ে তাদের। সেই মেয়েটাকে কিছুতেই তারা রাজনীতি নামক নোংরা শব্দের সাথে জড়িত মানুষ গুলোর হাতে দিবেনা। তাছাড়া কোথায় তাদের বসবাস ময়মনসিংহ আর ছেলের বসবাস ঢাকার সাভারে! তারা না জানে ছেলে সম্পর্কে, আর না জানে ছেলের পরিবার সম্পর্কে। হুট করে মস্তিষ্কে ছেলের কথা স্বরণ হতেই তড়িৎ শিরদাঁড়া টানটান করে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তিমের দিকে তাকায় দিলশান আরা। মুখে দাড়ি-গোঁফ আর অপরিপাটি চুলের বেহাল অবস্থায় আপাত দৃষ্টিতে যে কেউ দেখলে প্রথমেই বলে দিবে,এলাকার বড় ভাই টাইপ ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ানো গুন্ডা ধাচের ছেলে। বয়সটাও তো কম মনে হচ্ছেনা। কিন্তু মুখ ভর্তি দাড়ি আর মাথা ভর্তি এলোমেলো চুলের ভীরে লুকিয়ে থাকা শ্যাম পুরুষের সুডৌল চেহারাটা নজরে পরলে যে কোনো মেয়ে মুগ্ধ হতে বাধ্য, এই কথাটা মানতে হবে। তবে যায় হোক, কিছুতেই এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য না। তাছাড়া এটাও বিশ্বাসযোগ্য না, দৃষ্টি নিজের থেকে এতো বড় একটা ছেলেকে ভালোবাসতে পারে।

দিলশান আরা’র ভাবনা গুলোকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে কিছুটা রাগত স্বরে সাদেক সাহেব বলে ওঠেন,

“ফাজলামি করতে এসেছেন আমার বাড়িতে? আমরা কি করব না করব, আমাদের সন্তানেরা কি করবে না করবে সেটা একান্তই আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনারা যতই ক্ষমতাশীল মানুষ হয়ে থাকুন না কেন, কারো ব্যক্তিজীবনে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কেউ দেয়নি আপনাদের। দেখুন, আপনাদের মতো মানুষের সাথে আমার ঝামেলা করার কোনো শখ নেই। আমি অতি সাধারণ মানুষ সাধারণ ভাবেই জীবন যাপন করতে পছন্দ করি। দয়া করে আমার পরিবারে জটিলতা সৃষ্টি করবেন না।”

“জটিলতা আমরা না আপনারা সৃষ্টি করছেন। একটা সহজ বিষয়কে সহজ ভাবে মেনে নিলেই তো সব মিটে যায়। কেন শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে বিষয়টাকে জটিল করছেন? তাছাড়া যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ে দুজন দুজনকে ভালোবাসে সেখানে আপনারা কিন্তু কোনোভাবেই বাঁধা দিতে পারবেন না। কোনো ঝামেলা ছাড়া বিষয়টা মেনে না নিয়ে আইনি পদক্ষেপের দিকেও যদি যান তবে সেখানেও কিন্তু কোনো বাঁধা দিতে পারবেনা তারা। কারণ আপনাদের মেয়ে রাজি এই প্রস্তাবে। আর তার বয়স’ও বর্তমানে আঠারো ছাড়িয়েছে। এখন আর তার উপর নিজেরা কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারবেননা। কোট-কাচারি করেও যখন লাভের লাভ কিছুই হবেনা তাই বলছি, আত্মীয়তার আগেই দুই পরিবারে তিক্ততার সৃষ্টি না করে বিষয়টা মেনে নিন। এতে সম্মান, সম্পর্ক দুটোই ঠিক থাকবে।”

এমপি মাজহারুল ইসলামের কথার ধরনে দৃষ্টির বাবা-মা এবার স্পষ্ট বুঝে যায় এরা সহজে দমার পাত্র না। আঁটঘাঁট সব বেঁধেই এসেছে। এক একটা কথার পিঠেই সু-স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে আইন’ও তাদের আশ্রয় দিবেনা। এবার যেন দিশেহারা দুজনেই। সর্বদা নিজের কঠোর ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে মাথা উচিয়ে চলা দিলশান আরা’র চোখে-মুখে অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে। সেই অসহায়, উস্থির চিত্তে তাকায় স্বামীর দিকে। সাদেক সাহেব নিজেও ভেবে পায়নি কি বলে দমাবে এদের। স্ত্রীর অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে আদেশ ছুড়ে,

“দৃষ্টিকে ডেকে নিয়ে আসো। যা শোনার ওর মুখ থেকেই শুনতে চাই। বাইরের কোনো মানুষের থেকে নিজের মেয়ে সম্পর্কে কিছু শুনে বিশ্বাস করে নিব,এতোটাও অপদার্থ বাবা আমি না।”

সাহেক সাহেবের কথায় মনে মনে হাসে আজীজ শিকদার। নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে শরীর নাড়িয়ে আরেকটু আয়েশ করে বসে। আমুদে কন্ঠে সম্মতি জানিয়ে বলে,

“হ্যাঁ তাই করুন। মেয়ের মুখ থেকে সবটা শোনার পর আশা করি আপনারা কোনো আপত্তি করবেন না।”

সন্দেহের পালাটা যেন ধীরে ধীরে সত্যি হবার সংকেত দিচ্ছে। দিলশনা আরা সাদেক সাহেব এই পর্যায়ে নিজের মেয়েকে নিয়েই সন্দিহান হয়। লোকটা যেভাবে আত্মবিশ্বাসের সাথে দৃষ্টির থেকে জানার কথা বলছে এতেই প্রমাণ হয়ে যায় ওনারা যা বলছে তা পুরোটাই সত্য। এই কথা শোনার পর রক্তিম নিজেও ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়। ঐ বেশরম মেয়ে যেভাবে রাস্তা-ঘাটে তাকে ভালোবাসার কথা জানান দেয় সেভাবে যদি এখানেও সবার সামনে বলে দেয়! তবে সব শেষ। আজীজ শিকদারকে কেউ আটকে রাখতে পারবেনা আর। ফের ঐ আগুনে ঝাপ দিতে হবে তাকে।

নিজের রুমের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে প্রথম থেকে শেষ পযর্ন্ত সবটাই শুনছিল দৃষ্টি। দিলশান আরা মেয়েকে ডাকতে এসে তাকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় মেয়ের দিকে। তবে ভিন্ন কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে শান্ত ভাবে আহবান জানায় ড্রয়িং রুমে যাওয়ার জন্য। দুরুদুরু মনে চুপচাপ মায়ের পিছন পিছন ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয় দৃষ্টি। আগে থেকেই জানত সে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। তবে তখন এটা জানতনা সেই পরিস্থিতি যে তাকে এতোটা ভিতু করে দিবে। বুকটা কেমন ধরফর করছে। পুরো শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে। দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। মাথা পুরো ফাঁকা মনে হচ্ছে। দৃষ্টি উপস্থিত হতেই আজীজ শিকদার অভয় দিয়ে বলে,

“মা! কোনো ভয় পেয়োনা। তুমি সরাসরি নির্ভয়ে তোমার মনের কথা বলো। তুমি কি আমার ছেলেকে ভালোবাসো? বিয়ে করতে চাও ওকে! যদি চাও তবে তোমার মা-বাবার কাছে বলে দাও। বাকীটা আমি সামলে নিব।”

দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইস্পাত কঠিন মুখের মানুষটার দিকে এক পলক তাকায় দৃষ্টি। যে মানুষটাকে প্রথম দেখায় মন-প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছে অষ্টাদশী দৃষ্টি। এতো করে ভালোবেসেও পাষাণ মানুষটার মনে নিজের জন্য একটু মায়ার সৃষ্টি করতে পারেনি। তবুও তাকে পাওয়ার জন্যই কিশোরী প্রাণ ব্যাকুল আজও। সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে মা-বাবার দিকে তাকায় দৃষ্টি। দেখতে পায় তারাও উৎসাহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। উপস্থিত প্রতিটা মানুষ ব্যকুল হয়ে আছে দৃষ্টির মুখের একটা কথা শোনার জন্য। যে কথাটা এক পক্ষকে জিতিয়ে দিতে পারলেও হারিয়ে দিবে অপরপক্ষকে। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নেয় দৃষ্টি। বুকে অদম্য সাহস যুগিয়ে বলে দেয় মনের কথা। নিজেকে প্রমাণিত করে আরও একবার বেহায়া হিসেবে। একটু ভালোবাসার লোভে ভেঙ্গে চুড়মাড় করে দেয় মা-বাবার আশা ভরসা।

“হ্যাঁ। আমি রক্তিম শিকদারকে ভালোবাসি। দুই পরিবারের সম্মতিতে আমার ভালোবাসার সুন্দর একটা পরিণয় চাই আমি।”

নিজের কথাটুকু শেষ করার আগেই স্বপাটে চড় বসিয়ে দেয় দিলশান আরা। আকস্মিক এতো গুলো মানুষের সামনে মায়ের থেকে থাপ্পড় খেয়ে স্তব্দ হয়ে যায় দৃষ্টি। গালে হাত দিয়ে ছলছল নয়নে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। দিলশান আরার হঠাৎ এমন আক্রমণে রক্তিম সহ উপস্থিত প্রতিটা মানুষ বিস্মিত। বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায় আজীজ শিকদার। গলা উচিয়ে বলে,

“এতো গুলো মানুষের সামনে কিভাবে আপনি এতো বড় একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলেন? এই আপনি একজন কলেজের সম্মানিত প্রভাষক? আপনার থেকে এমন কিছু আশা করা যায়না আপা।”

অত্যধিক রাগে-ক্রোধে অন্ধ দিলশান আরা। এতো দিনের তিলতিল করে গড়ে তোলা সম্মান অহংকার সবটাই মনে হয় মেয়ে নিজের ভালোবাসার কথা জাহির করে শেষ করে দিয়েছে। অধিক রাগে কাঁপছে দিলশান আরা। হাত উচিয়ে আজীজ শিকদারকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“একদম চুপ থাকবেন আপনি। আমার মেয়েকে আমি মা র ব না কে টে টু ক রো টু ক রো করে নদীতে ভাসিয়ে দিব সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার বাসা থেকে এক্ষুণি বেড়োবেন আপনারা। নইলে আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব।”

“ডাকুন পুলিশ। দেখি কোন আইন আপনার সাপোর্ট করে। ভুলে যাবেন না এখন আপনার মেয়ে সাবালিকা। তাকে শাসন করতে গিয়ে ভালোবাসা জাহির করার অপরাধে অপশাসন করতে পারেন না। ।জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের ভাষায় আঠারোই হলো অধিকার দাবি করে মাথা তোলার সময়। আপনার মেয়ে এখন নিজের যেকোন বিষয়ে নিজেই মতামত নিতে পারবে। হোক সেটা ভালোবাসা-বিয়ে কিংবা অন্য যেকোন ক্ষেত্রে। আইন অনুযায়ী তা বৈধ। বাবা-মা হিসেবে এখন আপনাদের সন্তানের মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে। যদি না দিন তবে সেটাই হবে আইনবিরূদ্ধ। একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে আশা করি এই ধারণা টুকু আপনাদের আছে।”

এক কথা দুই কথা হতে হতে কিছুক্ষণের মাঝেই দৃষ্টি হয়ে যায় বিড়াট এক ঝামেলা। যে ঝামেলার নিরব দর্শক দৃষ্টি, রক্তিম, মেহেদী। বহু কথা কাটাকাটির পর আজীজ শিকদার নিজ তাগিদে থানা-পুলিশ করতেও পিছুপা হয়না। অবশেষে আইন, নীতি আর মেয়ের মুখের একটা বয়ান হার মানতে বাধ্য করে সাদেক-সাহেব দিলশান আরা’কে। বাবা-মায়ের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে এক সময় দৃষ্টি বদলে ফেলতে চায় নিজের সিদ্ধান্ত। কিন্তু আজীজ শিকদার সেটা হতে দেয়না। দৃষ্টির হাবভাব দেখেই ধূর্ত মস্তিষ্ক বুঝে যায় তার মনোভাব। ঘটনা সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে প্যাচিঁয়ে সিদ্ধান্ত নেয় সেই মুহূর্তেই কাজী ডেকে ইসলামি শরীয়ত মোতাবেক বিয়ের কার্যক্রম সমাপন করবে। ময়মনসিংহ থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার সহ রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে দৃষ্টির মা-বাবা সকলের উপস্থিততে অল্প সময়ের ব্যবধানেই ইসলামের দৃষ্টিতে এক হয়ে যায় দৃষ্টি -রক্তিম। মাঝখানে যদিও রক্তিম নিজেও ভেজাল করতে চেয়েছিল কিন্তু আজীজ শিকদার নিজের সুপ্ত মস্তিষ্কের ধূর্ত চালে সামলে নেয় সবটা। নিজের ছেলের নিশ্চিত একটা ভবিষ্যতের আশায় জীবনে প্রথম জয় ছিনিয়ে আনে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে। এতো গুলো মানুষের উপস্থিতি, তর্কবিতর্কে পুরোটা সময় একটা ঘোরের মাঝে ডুবে ছিল দৃষ্টি। কবুল বলার সময় টুকুতেও শুধু কাজির কথায় কলের পুতুলের মতোই মুখ ফুলে পরপর তিনবার শব্দটা উচ্চারণ করে আপন করে নেয় ভালোবাসার মানুষটাকে। পুরো ঝামেলা শেষ হতে হতে দিন পেরিয়ে রাত গভীর হয়। সে রাতেই পুত্রবধূ সমেত বিদায় নিতে প্রস্তুত হয় আজীজ শিকদার। বিদায় শব্দটাও কর্ণগোচর হবার পরও সচল হয়না দৃষ্টির মস্তিষ্ক। তবে শেষ সময়ে এসে মায়ের কথায় ঘোর কাটে দৃষ্টির। শক্ত চোয়ালে বুকে পাথর চেপে দিলশান আরা মেয়েকে বলেন,

“ভালোবাসার মানুষকে চেয়েছো। বাবা-মায়ের সম্মানের বলি দিয়ে সেটা ছিনিয়ে নিয়েছো। বাবা-মায়ের সম্মান, ভালোবাসার থেকেও যখন নিজের ভালোবাসা তোমার কাছে বেশি প্রিয় মনে হয়েছে, তবে জেনে রেখো। ঠিক যে মুহূর্তে মুখে কবুল শব্দ উচ্চারণ করে ঐ ছেলেকে স্বামী হিসেবে মেনেছো। সেই মুহুর্তেই আমি তোমাকে আমার মেয়ে হিসেবে মন থেকে বাদ দিয়েছি। ভুলে গিয়েছি আমার কোনো মেয়ে ছিল। আমরা যে তোমার বাবা-মা আশা করি তুমিও সেটা ভুলে যাবে। আজকের পর থেকে এই বাড়ির কারো সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক থাকবেনা।”

মায়ের কথা গুলো শেষ হতে না হতেই কান্নায় ভেঙে পরে দৃষ্টি। মেঝেতে লুটিয়ে মায়ের পা জড়িয়ে চিৎকার করে বলে,

“আমি না হয় তোমাদের চোখে একটা ভুল করেই ফেলেছি। তাই বলে তোমরা আমাকে এতো বড় শাস্তি দিবে? তুমি তো আমার মা! তুমি কিভাবে আমাকে এই কথা বলতে পারো? আমি তো শুধু আমার ভালোবাসাটুকুই চেয়েছি তোমাদের কাছে। এটা অন্যায়! আর কোনোদিন আমি তোমাদের কাছে কিছুই চাইবনা। তোমরা যেভাবে বলবে সেভাবেই চলব। তবুও আমাকে এতো বড় শাস্তি দিয়োনা প্লিজ।”

মেয়ের কান্নায় দিলশনার আরা না গললেও সাদেক সাহেব একটু নরম হয়। চোখে ভেসে ওঠে আজ থেকে তেইশ বছর আগে দিলশান আরাকে বিয়ে করে তিনি নিজেও ঠিক এভাবেই মায়ের পায়ের কাছে লুটিয়ে পরেছিল। বারবার আর্জি জানিয়েছিল ভালোবাসার মানুষটাকে মেনে নেওয়ার। কিন্তু সেদিন কেউ তাদের মেনে নেয়নি। নববধূকে নিয়ে খালি হাতে পারি দিতে হয়েছিল এই অচেনা শহরে। সেদিন সাদেক সাহেবের মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবথেকে পাষাণ মা-বাবা বুঝি তার নিজের মা-বাবা।প্রকৃতির কি অদ্ভূত নিয়ম! আজ সেই তেইশ বছর আগের একই ঘটনা মনে হচ্ছে নিজের চোখের সামনে ঘটছে। নিজের জায়গায় দেখতে পাচ্ছেন মেয়েকে আর বাবা-মায়েয জায়গায় নিজেকে। আচ্ছা! সেদিন যে সাদেক সাহেব ওনার বাবা-মাকে পৃথিবীর শ্রেষ্টা পাষাণ বাবা-মা বলে মেনে নিয়েছিল। আজ কি তবে তার মেয়েটাও তাকে সেই কাতারে ফেলল তাদের! ফেলে আসা সেই দিনটার কথা স্বরণ হয়েই যেন সাদেক সাহেব একটু নরম হয়। ভরসার একটা হাত বাড়িয়ে দেয় মেঝেতে বসে ডুকরে কাঁদতে থাকা মেয়ের মাথায়। তড়িৎ কান্নার বেগ কমে দৃষ্টির। মেঝে থেকে নজর সরিয়ে উপরে তাকায়। দেখতে পায় বাবা নামক বট বৃক্ষটা আজ এতো কিছুর পরও কি সহজে তার মাথার উপর ছায়া দিচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে আবারও ডুকরে ওঠে দৃষ্টি। অস্ফুট স্বরে ডাকে, “আব্বু!” বেদনা মিশ্রিত অল্প হাসেন সাদেক সাহেব। মেয়েকে টেনে মেঝে থেকে তুলে আগলে নেয় দুই-হাতে। বলে,

“যা চেয়েছো পেয়েছো। এবার বাবা হিসেবে আমার একটাই চাওয়া। সুখে থাকো। মায়ের কথায় কষ্ট পেয়োনা। একটু বেশি রাগ হয়েছে তো তাই এমন বলেছে। রাগ পরলে ঠিকই সবটা মেনে নিবে।”

বিভিন্ন কথায় মেয়েকে শান্ত করে এগিয়ে যায় আজীজ শিকদারের দিকে। বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই রক্তিম বন্ধুকে নিয়ে বেড়িয়ে গেছে। তাকে না পেয়ে আজীজ শিকদারের হাতেই তুলে দেয় আদরের একমাত্র মেয়েকে।

“ভাই সাহেব! যা হবার তা তো হয়েই গেছে। মানুষের জীবনে এরকম ছোট বড় কত ঘটনাই ঘটনা। ঐসব মনে রাখবেন না দয়া করে। সম্পর্ক যেহেতু একটা হয়েই গেছে তখন না হয় সব ভুলে নতুন করে সম্মানের সাথে মেনে নিলাম সবটা। আসলে আমারই ভুল হয়েছে। আগেই যদি মেয়ের কথা মেনে তার সুখেই সুখী হয়ে সবটা মেনে নিতাম তবে এতোটা ঝামেলা হতনা। সেইজন্য আমি লজ্জিত। ক্ষমা করবেন আমাকে। সেই সাথে একটাই অনুরোধ। আমি আপনার ছেলের ভরসায় না। আপনার ভরসায় আমার মেয়েকে আপনাদের সাথে দিচ্ছি। জানিনা আমার মেয়ের ভালোবাসা কতটা ঠিক বা ভুল। তবে বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধন যে কখনো ভুল হয়না সেটা জানি। আমি আশা রাখব সেই পবিত্র সম্পর্কের জোরেই আমার মেয়ে আপনার ঘরে সুখে থাকবে। আপনি আমার মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মতো করেই আগলে রাখবেন। কখনো কোনো ভুল করলে বাবা হিসেবে শাসন করবেন। আর যদি কখনো বোঝা মনে হয় তবে কষ্ট করে আমাকে একটা খবর দিবেন। আমি আমার মেয়েকে অতি আদরে আপনার বাড়ি থেকে নিয়ে আসব।”

আজীজ শিকদারের মুখে জয়ের হাসি। তবে বিয়ে শেষ হতেই ছেলেটা এভাবে চলে যাওয়ায় একটু বিব্রতও হচ্ছেন। এতো ঝামেলার পর ছেলেটার এমন ব্যবহারে না জানি দৃষ্টির মা-বাবার মনে কেমন ধারণা তৈরী হয়েছে! কিন্তু যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন আর এসব ভেবে কিছু হবেনা। সেদিক থেকে ভাবনা সরিয়ে নিজেও সাদেক সাহেবের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয় পুরো ঘটনার জন্য। এরপর আশ্বস্ত করেন দৃষ্টিকে তিনি সবসময় নিজের মেয়ের মতোই রাখবেন। কখনো কোনো কষ্ট পেতে দিবেননা। অবশেষে বাবার থেকেই অল্প শান্তনা আর অফুরন্ত দোয়া নিয়ে পা বাড়ায় দৃষ্টি নতুন জীবনে। সে জীবনে দৃষ্টির জন্য ঠিক কি অপেক্ষা করে আছে জানা নেই তার। রক্তিম আদও তাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবে কি না তাও জানা নেই। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে শুধুমাত্র ভালোবাসা পুঁজি করেই অগ্রসর হয় দৃষ্টি।

চলবে….

( গত দুদিনের ঝামেলায় আমার মাথা এখনো পুরো ফাঁকা। ঠিক আজকের পর্বের দৃষ্টির মতোই। কি লিখেছি নিজেও জানিনা। অথচ এই পর্বটাই সবথেকে সুন্দর ভাবে লেখার ইচ্ছে ছিল। পর্বটা হয়তো অনেকটাই খাপছাড়া লাগবে। দয়া করে একটু মানিয়ে নিবেন সকলে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here