#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২০
#আদওয়া_ইবশার
[আজকের পর্বে গল্পের প্রয়োজনে কিছু স্থানে অশালীন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি সেজন্য]
রাত তখন বারোটা। মেহেদীকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে রক্তিম। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই থমকে যায় দুজনে। দুজনেরই নজর বিদ্ধ হয় বিছানায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা দৃষ্টির দিকে। সাথে সাথে সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে নেয় মেহেদী। ঘরের আনাচে কানাচে তাকিয়ে দেখতে পায় একদম পরিপাটি। আলনায় স্তুপ হয়ে থাকা কাপড় গুলো সুন্দরভাবে ভাজ করা। বিছানাটা টানটান করে গোছানো। মেঝেতে এক বিন্দু ধুলো পযর্ন্ত মনে হচ্ছে নেই। মুচকি হাসে মেহেদী। চারিদিকে নজর বুলিয়ে ভাবে, অগোছালো রক্তিমের ঘর গোছানোর দায়িত্বটা প্রথম দিনই নিয়ে নিয়েছে তার ঘরণী। এবার নিজ থেকে দায়িত্ব নিয়ে অগোছালো রক্তিম শিকদারকে গোছাতে পারলেই হলো। রক্তিমের দিকে তাকিয়ে মেহেদী দেখতে পায় সে এখনো শান্ত দৃষ্টিতে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে। রক্তিমের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য খুক খুক করে কাশে মেহেদী। মুখ ভরে হেসে বলে,
“আজ থেকে আপনার সাথে আমার থাকার মেয়াদ শেষ। এখন থেকে বন্ধু রেখে বউয়ের সাথেই বিছানা শেয়ার করুন। বেস্ট অফ লাক।”
কথাটা বলে আর দাঁড়ায়না মেহেদী। দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে একেবারে বাড়ির আঙ্গিনা থেকেই বিদায় নেয়। রক্তিম সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে আবারও দৃষ্টির দিকে তাকায়। এক পা দু-পা করে এগিয়ে একেবারে দৃষ্টির মুখের কাছাকাছি গিয়ে থামে। টেবিলের কাছে থাকা কাঠের চেয়ার টেনে বসে। ফের তীক্ষ্ম নজর স্থির করে দৃষ্টির দিকে। সেকেন্ড গড়িয়ে মিনিট পার হয়। রক্তিমের পলক পরেনা। কিছুক্ষণ পর নড়ে ওঠে দৃষ্টি। ঘুমটা এখনো তার জোরালো হয়নি। গতরাত নির্ঘুম কাটানোর ফলে খুব বেশিক্ষণ জেগে থাকতে না পেরে বিছানায় হেলান দিয়ে রক্তিমের জন্য অপেক্ষামান অবস্থাতেই ঘুমের জগতে তলিয়ে যায়। ঘুমের মাঝেই অনুভব হয় কেউ তার দিকে শাণিত নজরে তাকিয়ে আছে। সহজা পাতলা ঘুমটা ছুটে যায়। চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পায় রক্তিমের তিক্ষ্ম নজর। হুট করে ফাঁকা মস্তিষ্ক বিষয়টা ধরতে পারেনা। ফ্যালফ্যাল নয়নে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে পুরো বিষয়টা মস্তিষ্ক ধারণ করতেই লাফিয়ে ওঠে দৃষ্টি। গায়ের ওড়না ঠিক করে জড়োসড়ো হয়ে বসে। আমতা আমতা করে বলে,
“ইয়ে, কখন এসেছেন?”
জবাব দেয়না রক্তিম। সেই আগের মতোই তিক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে থাকে দৃষ্টির মুখের দিকে। ঐ নজরের তোপে পরে হাঁসফাঁস করে দৃষ্টি। অস্বস্তিতে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। নিজেকে আরও একটু গুটিয়ে নেওয়ার প্রয়াস চালায়। অজানা এক ভয়ে বুকের ভিতর উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই গর্জে ওঠে কিছু একটা। শুকনো ঢোক গিলে গলা ভেজায়। নিজেকে প্রস্তুত করে রক্তিমের ক্রোধের অনলে ভস্ম করতে। দৃষ্টিকে ভয় পেতে দেখেও দমেনা রক্তিম। বরং আরও একটু ঝুকে আসে দৃষ্টির মুখের দিকে। সাথে সাথে চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নেয় দৃষ্টি। কানে ভাসে রক্তিমের হিমশীতল কন্ঠ,
“খুব শখ ছিল রক্তিমের বউ হবার! ওফস! বউ না তো। বেড পার্টনার হবার। ঠিক বললাম তো!”
কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে দৃষ্টির। কেঁপে ওঠে বন্ধ চোখের পাপড়ি। দুহাতে আকড়ে ধরে বিছানার চাদর। কাঁপা কন্ঠে বলে,
“একদম উল্টাপাল্টা কথা বলে আমার ভালোবাসার অপমান করবেন না।”
‘ভালোবাসা’ শব্দটা উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো নিজের কান দুটো চেপে ধরে রক্তিম। ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলে,
“এই মেয়ে চুপ! একদম চুপ। ঐ মুখ দিয়ে দ্বিতীয়বার ভালোবাসার কথা উচ্চারণ করলে একেবারে জ্বিভ টেনে ছিড়ে ফেলব।”
অশান্ত ভঙ্গিতে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায় রক্তিম। স্বজোরে চেয়ারে লাথি বসায়। কেঁপে ওঠে দৃষ্টি। বন্ধ চোখ দুটো আরও খিঁচিয়ে নেয়। দরজার সামনে গিয়ে ঘন ঘন শ্বাস নেয় রক্তিম। দুই হাতে টেনে ধরে মাথার চুল। পাগলের মতো কতক্ষণ ঘরময় পায়চারি করে আবারও এগিয়ে যায় দৃষ্টির দিকে। ঝুঁকে গিয়ে শক্ত হাতে চেপে ধরে দৃষ্টির নরম গাল দুটো। আৎকে ওঠে দৃষ্টি। বন্ধ চোখের পাপড়ি খুলে অসহায় চোখে তাকায় রক্তিমের দিকে। তার ঐ অসহায় নয়নের আকুতি একটুও টলাতে পারেনা পাষাণহৃদয়ের ক্রোধ। বরং হাতের চাপ আরও একটু জোরালো হয় দৃষ্টির কোমল গালে। দাঁতে দাঁত পিষে শক্ত চোয়ালে রক্তিম বলে ওঠে,
“কিভাবে পারিস? কিভাবে পারিস তোরা শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদার জন্য ভালোবাসার মতো পবিত্র নামটা ব্যবহার করে সেটা অপবিত্র করতে? কি বুঝিস তোরা ভালোবাসার? তোদের মতো ছলনাময়ীর ভালোবাসা মানেই তো শুধু শরীরের ক্ষিদা। এটা ছাড়া তোদের কাছে ভালোবাসার ভিন্ন কোনো সজ্ঞা আছে? কেন, কেন তোদের মতো পতিতার জন্ম কোনো পতিতালয়ে না হয়ে এই শুদ্ধ সমাজের শুদ্ধ পরিবারে হয়? শুধুমাত্র আমাদের মতো কিছু ছেলেদের বুকের বা-পাশে ছুরি বসানোর জন্য! একটা বাগানের মতো সুন্দর পরিবারকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেবার জন্য! বিনিময়ে কি পাস তোরা? ঐ শরীরের ক্ষিদে মিটানোর পৈশাচিক আনন্দ! এটা তো পতিতাবৃত্তি করেই মিটাতে পারিস। তবে কেন একটা পুরুষকে ভালোবাসা নামক বিষাক্ত অনুভূতি দিয়ে জীবন্ত লাশে পরিণত করিস তোরা?”
সহ্য হয়না দৃষ্টির। একের পর এক বিষাক্ত কথার বাণ শ্বাস আটকে দেয় দৃষ্টির। কান চেপে ধরে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,
“চুপ করুন। চুপ করুন প্লিজ। আমার আর সহ্য হচ্ছেনা এসব। একটুও নিতে পারছিনা আপনার কথা গুলো। বুকের ভিতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।”
কিশোরী হৃদয়ের অনুভূতি গুলো যেন এক মুহুর্তের জন্য ফিকে হয়ে যায় রক্তিমের অপবাদ গুলোর কাছে। ডুকরে কেঁদে ওঠে দৃষ্টি। পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে গাল থেকে রক্তিমের হাত সড়ানোর চেষ্টা করে। এই মুহূর্তে রক্তিমের আঘাতের উদ্দেশ্যে করা স্পর্শটুকুও মনে হচ্ছে দৃষ্টির পুরো শরীরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। উন্মাদের মতো গাল থেকে হাত সড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তবুও থামেনা। আচড়ে খাঁমচে নিজের গাল নিজেই রক্তাক্ত করে। এক পর্যায় দৃষ্টির পাগলামি দেখে রক্তিম নিজেই দূরে সরে যায়। দু-পা পিছিয়ে চুপচাপ ভঙ্গিতে দেখে যায় বিধ্বংসী দৃষ্টিকে। হ্যাঁ বিধ্বংসী। এই মুহুর্তে যে কেউ দেখলে দৃষ্টিকে বিধ্বংসীই বলবে। উদ্ভ্রান্তের মতো রক্তিম দূরে সরে যাবার পরও এখনো কেমন নিজেই নিজের গাল নখের আঘাতে ক্ষতবীক্ষত করে যাচ্ছে! এক সময় বুঝতে পারে রক্তিম তার থেকে দূরে সরে গেছে। ক্ষণকাল একটু থামে দৃষ্টি। পূণরায় হাতের উল্টোপিঠ কামড়ে ধরে গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠে। রাতের নিস্তব্ধতায় কি বীভৎস শোনায় দৃষ্টির সেই চিৎকার! কান্নারত অবস্থায় অস্পষ্ট স্বরে বলে,
“আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল আপনাকে ভালোবাসা। সবথেকে বড় পাপ আমি করেছি আপনাকে ভালোবেসে। আগে যদি জানতাম এই ভালোবাসায় এতো বেদনা তবে নিজেই নিজের জীবন শেষ করে দিতাম। তবুও ভালোবাসা নামক নরকে ঝাপ দিতাম না।”
একটু থামে দৃষ্টি। প্রাণপণ চেষ্টা করে কান্না আটকানোর। ঠোঁট কামড়ে ধরে চিৎকার করা কান্নাটা বন্ধ করতে পারলেও চোখের অশ্রু বন্ধ হয়না। বন্ধ হয়না বুকের ভিতরের জ্বলন। সৃষ্টিকর্তার এ কেমন বিচার? নিষ্পাপ হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দেওয়ার পরও কেন এমন অপবাদ পেতে হয়! তার অবুঝ হৃদয়ের ভালোবাসায় তো কোনো স্বার্থ ছিলনা। সেই শুরু থেকে একদম নিঃস্বার্থভাবে সবটুকু ভালোবাসা নিংড়ে দিয়েছে পাষাণ মানুষটাকে। বিনিময়ে কি অবহেলাটুকু যথেষ্ট ছিলনা? সাথে কেন আবার যোগ হলো কথার আঘাত। কিভাবে পারল মানুষটা তার পবিত্র ভালোবাসায় অপবিত্রতার কালিমা লেপ্টে দিতে?
মুখ হা করে বড় বড় দম ফেলে দৃষ্টি। সময় নিয়ে নিজেকে একটু শান্ত করে তাকায় রক্তিমের দিকে। ফের নিবরি অশ্রু গড়িয়ে পরে দৃষ্টির গাল বেয়ে। দুহাতে গালে লেপ্টে থাকা অশ্রুটুকু মুছে ঠোঁট কামড়ে বেদনামিশ্রিত হেসে বলে,
“আমি বেহায়া। বড্ড বেহায়া আমি। অবশ্য আপনার সাথে দেখা হবার আগে এতোটা বেহায়া ছিলাম না। যেই আপনার সাথে দেখা হলো,সেই আমি দৃষ্টি পুরোটাই বদলে গেলাম। আমার অস্তিত্ব আমার ব্যক্তিত্ব পুরোটাই ভালোবাসা নামক এক অদৃশ্য বলয় গ্রাস করে নিয়েছে। বানিয়ে দিয়েছে আমাকে আস্তো এক বেহায়া। যদি বেহায়া না হতাম, তবে কখনো আজ এখানে আপনার স্ত্রী হয়ে বসে থাকতাম না। আর না আপনার এতো গুলো অপবাদ সহ্য করতাম। আগে জানতাম ভালোবাসা মানুষকে ব্যক্তিত্ববান বানায়। কিন্তু যখন নিজে ভালোবাসলাম! তখন দেখলাম একটা মানুষের ব্যক্তিত্ব কেড়ে নিয়ে তাকে পুরোপুরি বেহায়াতে পরিণত করার নামই হলো ভালোবাসা। একবার যখন বেহায়া হয়েই গেলাম। তবে আর কি! না হয় নিলাম সহ্য করে আপনার সমস্ত অপবাদ। যদি আরও কোনো অপবাদ দেবার থাকে দিতে পারেন। বিশ্বাস করুন!কোনো অভিযোগ তুলবনা আপনার প্রতি। শুধু আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে ধৈর্য্য চাইব। আর অপেক্ষায় থাকব সেই দিনের, যেদিন আপনি নিজে আমাকে আকড়ে ধরবেন। মুখ ফোটে বলতে না পারলেও অনুশোচনায় ভুগবেন আমাকে দেওয়া আজকের অপবাদ গুলোর জন্য। সেদিন আমি ঠিক ভালোবাসার জোরে বুঝে নিব আপনার বুকের ভিতরে জ্বলতে থাকা অনুশোচনার আগুন। তবে একটুও উপহাস করবনা। আর না দিব আপনাকে বেশিক্ষন সেই আগুনে পুড়তে। স্ব-যত্নে আমার ভালোবাসার শীতল পরশে নিভিয়ে দিব সেই আগুন। উত্তপ্ত হৃদয়ের প্রতিটা কোণায় কোণায় বিছিয়ে দিব ভালোবাসা নামক শীতল পাটি।
চলবে….