দৃষ্টির_আলাপন #পর্বঃ২১ #আদওয়া_ইবশার

0
448

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২১
#আদওয়া_ইবশার

দৃষ্টির কথার বিপরীতে কোনো কথা বলেনা রক্তিম। স্থির চিত্তে কতক্ষণ শুধু তাকিয়ে থাকে অষ্টাদশীর কান্নারত মায়াবী মুখপানে। অন্তঃকরণে জ্বলন ধরে রক্তিমের। তবে সেটা দৃষ্টির দুঃখে না। বিভীষিকাময় দুই বছর আগের ফেলে আসা সেই অতীত দুয়ারে এসে কড়া নাড়ায় অন্তরে জ্বলন অনুভূত হয়। মস্তিষ্ক হয় অসাঢ়। একটু একটু করে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারায় আবার। ইচ্ছে হয় চোখের সামনে থাকা সমস্ত কিছু ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে। বিধ্বংসী তান্ডব লীলা চালিয়ে ভালোবাসা নামক যন্ত্রণা পোকাটাকে এই পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে মুছে দিতে। নিজেকে বহুকষ্টে সামলায় রক্তিম। পুরোপুরি ভারসাম্য হারানোর আগেই টলতে টলতে বেরিয়ে পরে ঘর থেকে। অসহায় নয়নে তাকিয়ে দেখে দৃষ্টি রক্তিমের প্রস্থান। আবারও অশ্রুস্বজল হয় আঁখি যুগল। বুক চিরে বেরিয়ে আসে হাহাকার মিশ্রিত নিঃশ্বাস। এক দিনেই হাপিয়ে গেছে দৃষ্টি। কথার আঘাতে জর্জরিত ভালোবাসায় টইটম্বুর হৃদয়। ইচ্ছে করছে ভালোবাসা নামক যুদ্ধে পরাজয় মেনে নিয়ে এই নশ্বর পৃথিবীর বুক থেকে পালিয়ে যেতে। তবে সেই ইচ্ছেটুকু পূর্ণতা পাবার নয়। সবার সব ইচ্ছে এক জীবনে পূর্ণতা পায়’ও না। এ যুদ্ধের আহ্বায়ক যে সে নিজেই। এখন যুদ্ধের ময়দানে নেমে সে নিজেই যদি পরাজয় মেনে পালিয়ে যায় তবে তো নিজের বিবেকই নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। হেরে যাবে নিজ স্বত্তার কাজেই ভালোবাসা। এমনটা হতে দেওয়া যাবেনা। কিছুতেই না। দাঁতে দাঁত পিষে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। হাজারটা তীরবিদ্ধ হয়ে হৃদয় ক্ষতবীক্ষত হলেও নিঃশ্বাস চলা অব্দি থামা যাবেনা। সেও দেখতে চায় শেষ পরিণতি কি হয়। ঐ নিষ্ঠুর মানবের পাষাণ হৃদয়ে তার জন্য কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভালোবাসার সৃষ্টি না হলেও মায়ার সৃষ্টি হয় কি না। কোনোদিন ঐ মানুষটার মনে শিশির বিন্দু পরিমাণ মায়ার খোঁজ’ও যদি পায় দৃষ্টি তবে সেটুকুই চলবে। তার একার ভালোবাসাটুকু উজাড় করে মানুষটার সাথে গুছিয়ে নিবে এক মায়ার সংসার। এই পৃথিবীতে কয়জন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভালোবাসা দিয়ে সৃষ্টি হয়? হাজারে একশটা সম্পর্কে ভালোবাসা থাকলেও বাকী নয়শ সম্পর্কই খোঁজ নিলে দেখা যাবে ভালোবাসাহীন। তারা স্রেফ মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে দিব্যি কাটিয়ে দেয় পুরো একটা জীবন। তাদের মতো দৃষ্টিও পারবে ভালোবাসাহীন মায়ার সংসার গড়তে।

কেটে যায় আরও একটা নির্ঘুম রাত। বুকে চাপা যন্ত্রণা নিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগ পযর্ন্ত দৃষ্টি অপেক্ষায় থাকে রক্তিমের বাড়ি ফেরার। তিমিরাচ্ছন্ন রাত কেটে ভোরের নির্মল আভা ছড়ায় প্রকৃতির বুকে। তবুও রক্তিম ফিরেনা। হতাশ হয় দৃষ্টি। ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেয় বিছানায়। অল্পক্ষণের মাঝে ঘুম নেমে আসে ফোলা চোখ দুটোতে। দুই-তিন ঘন্টার ব্যবধানে পেটের ক্ষিদে মাথা চারা দিয়ে উঠতেই ঘুম ভেঙ্গে যায় আপনাতেই। বন্ধ চোখ জোড়া খুলে আবারও একবার খোঁজ করে পাষাণ পুরুষটা এলো কি না। কিন্তু না। আসেনি। মলিন মুখে বিছানা ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় দৃষ্টি। ছোট্ট উঠোনের একপাশে একটা চাপকল। ঠান্ডা পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে দুই হাতের আজলায় একটু পানি পান করতেই খালি পেটে পাক দিয়ে ওঠে। এবার যেন ক্ষিদেটাকে দমিয়ে দায়। উপায় না পেয়ে ঘরে এসে ফোন হাতে নেয়। খোঁজে খোঁজে বের করে প্রথম দিন রক্তিমের দেওয়া রাকিবের নাম্বার। ডায়াল করে কানে ধরতেই দুইবার রিং হবার পরই ঐপাশ থেকে ভেসে আসে রাকিবের উৎফুল্ল কন্ঠস্বর,

“ওও পরদেশী সুন্দরী! এতোদিন পর এই অচেনা পুরুষের কথা মনে পরল তোমার? তা সাত সকালে কি মনে করে ফোন দিলে? ঠিকানা দিতে না কি? তুমি তো দেখি ভারী অলস সুন্দরী। সেই কবে ঠিকানা চেয়ে ম্যাসেজ করেছিলাম! এতোদিন পর আজ মনে হলো?”

একেতো পেটের ক্ষিদে, কান্নার ফলে মাথা ব্যথা। হৃদয়ে অশান্তি। এই এতো এতো যন্ত্রণার মাঝে এখন আবার ঐ ছাগলটার এমন কথা। মেজাজ খিঁচে ওঠে দৃষ্টির। দাঁতে দাঁত পিষে ধমকে ওঠে দৃষ্টি,

“ঐ চামচার বাচ্চা চামচা! চুপ, একদম চুপ! আর একটা উল্টাপাল্টা কথা বললে মাথা ফাটিয়ে দিব।”

এতো সুন্দর সুন্দর কথার বিপরীতে এমন ধমকে ভড়কে যায় রাকিব। চোখ দুটো বড় বড় করে তৎক্ষণাৎ কান থেকে ফোন সরিয়ে নাম্বারে চোখ বুলায়। হ্যাঁ, এটাই তো নাম্বার। এই নাম্বার থেকেই তো ম্যাসেজ করে বলেছিল কেউ তার প্রেমে পরেছে। তবে আজকে কেন এমন ঝাড়ি! এটা প্রেমের কয় নাম্বার ধাপ? এই ধাপের কথা তো রাকিবের জানা নেই। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আবারও কানের কাছে ফোন নেয় রাকিব। ফের কিছু বলতে যাবে তার আগেই দৃষ্টি বলে ওঠে,

“রক্তিম শিকদার কোথায়? তাকে ফোন দিন।”

সাহস কত মেয়ের! তার ফোনে কল দিয়ে তাকেই উপেক্ষা করে রক্তিমকে চায়! এই মেয়েকে তো উচিৎ শিক্ষা দিতেই হয়। বড়সড় একটা ধমক দিয়ে চোখের পানি নাকের পানি এক করে বুঝিয়ে দিতে হবে রক্তিম আর রাকিবের মাঝে কোনো তফাৎ নেই। রক্তিম যদি হয় বারুদ তবে সে হলো আগুন।

“এই মেয়ে এই!”

“বললাম না উল্টাপাল্টা কিছু বললেই মাথা ফাটাবো। চামচা চামচার মতো থাকুন। রক্তিম শিকদারকে বলে দিন তার বউ গত দুপুর থেকে অভুক্ত। পাঁচ মিনিটের ভিতর যেন ঘরে খাবার আসে। নইলে কিন্তু আপনার মাথা চিবিয়ে খাব আমি।”

রাকিবের কথা কেড়ে নিয়ে বলে ওঠে দৃষ্টি। নিজের প্রয়োজনটুকু বলে সাথে সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ঐদিকে রক্তিম শিকদারের বউ শুনে রাকিবের মাথা ঘুরে ওঠে। ফোন কানে ঠেকিয়েই আশ্চর্যের চরম পর্যায় গিয়ে চোখ দুটো বড় বড় করে তাকায় একটু দূরে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানা রক্তিমের দিকে। আকস্মিক এমন একটা কথা হজম করতে না পেরে মাথা ঘুরিয়ে ওঠে রাকিবের। নিশ্চল ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় রক্তিমের দিকে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন ফোনটাই এখনো কানে ঠেকানো। সেভাবেই অসহায় সুরে ডেকে ওঠে,

“ভাই!” ঠোঁটের ভাজে সিগারেট নিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে রক্তলাল চোখে রাকিবের দিকে তাকায় রক্তিম। একের পর এক দুশ্চিন্তায় বিগত দুই-তিনটা রাত পুরোপুরি নির্ঘুম কেটেছে রক্তিমের। যার প্রমাণ রক্তলাল চোখ দুটো। হিমশীতল ঐ লাল আঁখি জোড়া কি ভয়ংকর ঠেকাচ্ছে! মনে হচ্ছে কোনো এক হিংস্র পশু শিকারের আশায় ওত পেতে আছে জলন্ত চোখে। ঐ চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় হয় রাকিবের। পেটের ভিতর মুচড় দিয়ে ওঠে।কিছুদিন যাবৎ এমনিতেই তার ঘাড়ের উপর শনি নাচন করছে। প্রাণ প্রিয় ভাই হুট করেই মেজাজ হারিয়ে ক্ষণেক্ষণে তাকেই প্রহার করে যাচ্ছে। দুদিনে দুটো থাপ্পড় দিয়েই তার নাদুসনুদুস গাল দুটো কেমন চেপ্টা করে দিয়েছে। আজ না জানি আবার বউয়ের কথা শুনে তাকে এই দুনিয়া থেকেই এক থাপ্পড়ে বিদায় করে দেয়। কিন্তু কৌতূহলও তো দমার নয়। কেমন পেটের ভিতর সুরসুরি দিয়ে যাচ্ছে। কথাটা না বলেও শান্তি নেই। বা-হাতে এখনো ফোন কানে ঠেকিয়ে ডান হাতে গাল ঘষে বলে,

“ভাই আপনি ঘরে বউ এনেছেন?”

সাথে সাথেই হাসির রুল পরে যায় সেখানে। উপস্থিত প্রত্যেকে স্ব-শব্দে হেসে ওঠে রাকিবের এমন কথায়। ঘরে বউ এনেছে মানে কি? বউ কি মেলাই কিনতে পাওয়া যায় কাঠের ফার্নিচারের মতো! যে ইচ্ছে হলো ঘরের শোভাবর্ধনের জন্য একটা বউ কিনে এনে সাজিয়ে রাখল।এই রাকিবটাও যে কি বোকা বোকা কথা বলে! এতোদিন পযর্ন্ত রক্তিম শিকদারের আশেপাশে থেকেও একটু চালাক-চতুর হতে পারলনা। রাকিবের কথাটা ছেলেরা মজার ছলে নিলেও মেহেদী ঠিকই বুঝে যায় আসল মর্মার্থ। রক্তিমের কপালেও শুক্ষ ভাঁজ পরে। জোরালো ধমকে সবাইকে চুপ করিয়ে মেহেদী জানতে চায়,

“ফাও প্যাঁচাল রেখে আসল কথা বল।”

নিজের গাল দুটো শক্ত হাতের প্রহার থেকে বাঁচাতে মেহেদীর পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায় রাকিব। ফটাফট বলে দেয়,

“একটা মেয়ে ফোন করে বলল ভাইকে যেন বলি তার বউ গত দুপুর থেকে অভুক্ত। ভাই যেন পাঁচ মিনিটের মধ্যে খাবার পাঠায়। নইলে আমার মাথা চিবিয়ে খাবে।”

কথাটা শুনে হা হয়ে যায় উপস্থিত প্রত্যেকে। অত্যধিক বিস্ময়ে ছানাবড়া সকলের চোখ। ব্যতিক্রম শুধু রক্তিম, মেহেদী। হতবাক দৃষ্টিতে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে দলের সব গুলো ছেলে এক সুরে বলে,

“ভাই! আপনি বিয়ে করেছেন?”

বিরক্ত হয় রক্তিম। তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। মনে মনে রাগে ফুঁসে ওঠে দৃষ্টির প্রতি। কত বড় বেয়াদব মেয়ে। নিজে থেকে ছলনা করে তার বউ হয়ে ঘাড়ে চেপেছে। এখন আবার হুকুম জারি করে! বিয়ের আগে মনে ছিলনা এই গুন্ডার ঘরে এসে খাবে কি? গুন্ডাটার আদও তাকে খাওয়ানোর সামর্থ্য আছে কি না! কোনো খাবার ঘরে নিবেনা রক্তিম। পেটে খাবার না থাকলে দুদিন পর ভালোবাসা এমনিতেই পালাবে। ঐ আপদও তখন নিজে থেকেই ঘর ছাড়বে। এতো বড় সুযোগ একদম হাতছাড়া করবেনা রক্তিম। রক্তিমের হাবভাব দেখে ঠিক বুঝে যায় মেহেদী এই ছেলে জিন্দিগীতেও মেয়েটার জন্য খাবার পাঠাবেনা। ভালোবাসার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত মেহেদীর বড্ড মায়া হয় মেয়েটার জন্য। একটু হলেও অনুভব করতে পারে দৃষ্টির মনের ব্যথা। কারণ সে নিজেও তো একই নাইয়ের মাঝি। দৃষ্টির কষ্টে ব্যথিত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মেহেদী। কাওকে কিছু না বলে নিজেই চলে যায় সেখান থেকে। উদ্দেশ্য হোটেল থেকে খাবার কিনে দৃষ্টিকে দিয়ে আসা।

***
আজও অপেক্ষা করতে করতে রাত গভীর হয়। কিন্তু রক্তিমের ফেরার কোনো নাম নেই। তবে আজ আর ঘুমায়না দৃষ্টি। কোনো কাজ না থাকাই বলতে গেলে পুরো দিনটাই সে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। এখন আর চোখে ঘুম নেই। গত রাত একটা ঘোরের মাঝে থাকার কারণে একা থাকতেও কোনো ভয় করেনি। কিন্তু আজ ভয়টা যেন দৃষ্টির পিছুই ছাড়ছেনা। বারবার মনে হচ্ছে সে হাঁটলেও তার পিছন পিছন কেউ হাঁটছে। বসে থাকলেও মনে হয় কেউ তার পিছনে বসে আছে। কানের কাছে অদ্ভূত আওয়াজ হয়। অজানা ভয়ে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। সকালে খাবার দিয়ে যাবার সময় মেহেদী নিজের নাম্বার দিয়ে গিয়েছিল দৃষ্টিকে। বলেছিল যেকোন প্রয়োজনে নির্দ্ধিধায় ফোন দিয়ে বলতে। মেহেদীর ব্যবহার দৃষ্টির কাছে যথেষ্ট আন্তরিক মনে হয়। তবে এই মুহুর্তে মেহেদীকেও তার বন্ধুর মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন মনে হচ্ছে। দৃষ্টি সেই কখন থেকে বারবার ফোন করে বলছে রক্তিমকে যেন একটু তাড়াতাড়ি চলে আসতে বলে।
একলা এমন এক ভূতুড়ে বাড়িতে থাকতে তার ভয় হচ্ছে। দৃষ্টি যতবার ফোন দিয়েছে ততবার মেহেদী বলেছে রক্তিমকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সেই পাঠিয়ে দেওয়া অব্দিই সীমাবদ্ধ। পাষাণ পুরুষের এখনো আসার কোনো নাম গন্ধ নেই। মনের ভয়টা এখন কান্নায় পরিণত হচ্ছে দৃষ্টির। চোখ গড়িয়ে পরেও যায় অশ্রুজল। বিছানায় বসে দৃষ্টি যখন অশ্রু বিসর্জন দিতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই দরজায় কড়াঘাত পরে। তৎক্ষণাৎ ভয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায় দৃষ্টি। কাঁপা স্বরে জানতে চায়,

“ককে!” কয়েক সেকেন্ড নিরবতায় কেটে যায়। ক্ষণকাল পর ভরাট কন্ঠে রক্তিম নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়,

“আমি।” ছোট্ট একটা শব্দে রক্তিমকে প্রথমে চিনতে অসুবিধা হলেও কিছুক্ষণ পর বুঝে নেই এটা রক্তিমই। সিংহের গুহায় সিংহ ছাড়া আর কে আসবে! ঝটপট দুইহাতে চোখের অশ্রু মুছে দৌড়ে গিয়ে কপাট খুলে দেয় দৃষ্টি। গম্ভীর চিত্তে দৃষ্টিকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে রক্তিম। তাকে দেখার সাথে সাথেই অভিমানে ফুলে ওঠে দৃষ্টি। নাক ফুলিয়ে অভিযোগের স্বরে বলে,

“এই আপনার আসার সময় হলো! ঘরে একটা মেয়ে মানুষ রেখে কেউ এতোক্ষন বাইরে থাকে? নির্দয় পুরুষ একটা!”

ঘামে ভেজা শার্ট গা থেকে ছাড়াতে টপ বোতামে সবেই হাত রেখেছিল রক্তিম। এর মাঝেই দৃষ্টির কথায় বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে যায়। থেমে যায় হাতটাও। ইচ্ছে করে ঐসব ন্যাকা কথার বিপরীতে এক থাপ্পড়ে মেয়েটার মাথা ঘুরিয়ে দিতে। কিন্তু তা করেনা। একটা মানুষের গায়ে কতদিন হাত তোলা যায়! তবুও সে যদি কোনো ছেলে হতো তবে একটা কথা ছিল। মারতে মারতে মেরে ফেলতেও কোনো দ্বিধা ছিলনা রক্তিমের। কিন্তু যেখানে এই মেয়ে জাতির গায়ে হাত দেবার কথা ভাবতেও এখন ঘেন্না হয় রক্তিমের। সেখানে এই মেয়ের গায়ে আর কত হাত তুলবে! চোখে-মুখে বিরক্তি ভাব ফুটিয়েই দৃষ্টির দিকে দু-পা এগিয়ে যায় রক্তিম। ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে,

“আমি আসতে বলেছিলাম, না কি নিয়ে এসেছিলাম! দুটোর একটাও না। যেভাবে একা এসেছিস, সেভাবেই একা নিজের ভাবনা নিজ ভাব। দুনিয়া উল্টে গেলেও এই রক্তিম শিকদার কোনো মেয়েকে নিয়ে ভাববেনা।”

‘তুই’ শব্দটায় ক্ষেপে যায় দৃষ্টি। চোখ রাঙিয়ে বলে,

“একদম তুই-তুকারি করবেন না বলে দিচ্ছি। কাল রাগের মাথায় ডেকেছেন কিছু বলিনি। তাই বলে সবসময় ডাকবেন আর আমি হজম করে নিব এটা ভাববেন না।”

দৃষ্টির সাহসে রক্তিম হতবাক। অবাক চিত্তে কতক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে জোরালো ধমকে ওঠে। নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলে,

“চুপ! গলা নামিয়ে আর চোখ নিচে রেখে কথা বলবি। তুই কেন? বাংলা অভিধানে যদি তুই শব্দের থেকেও নিম্ন কোনো শব্দ থাকত তবে সেটাই উচ্চারণ করতাম তোর বেলায়। দ্বিতীয়বার আমার সাথে গলা উচিয়ে কথা বলতে আসলে গলা কে টে বস্তা ভরে নদীতে ভাসিয়ে দিব।”

এমন শুকনো হুমকিতে অল্প ভিতু হয় দৃষ্টি। তবে সেটা চেহারায় প্রকাশ করতে চায়না। মনের ভয় মনে রেখেই রক্তিমের মতোই গম্ভীর হবার ভাব ধরে বলে,

“মিস্টার রক্তিম শিকদার! আপনি নিজেও গলা নামিয়ে কথা বলবেন আমার সাথে। পুরো সাভারবাসীর কাছে আপনি সবার বড় ভাই হলেও ঘরের ভিতর আমি আপনার হোম মিনিস্টার। সো রেসপেক্ট মি। আমার সাথে বাহাদুরী করতে আসলে একেবারে নারী নির্যাতনের মামলা ঠুকে দিব। তখন দেখব চৌদ্দ সিকের ভিতর থেকে কিভাবে আমার উপর দাও ঘুরান।”

কথাটা বলে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায়না দৃষ্টি। দুরুদুরু মনে গালে থাপ্পড় পরার আগেই দৌড়ে বিছানায় গিয়ে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরে। মনে মনে আল্লাহকে জপে। বারবার আর্জি জানায় তাকে এবারের মতো বাঁচিয়ে দেবার আশায়। আজ যদি তার সুন্দর গাল দুটো ঐ রাক্ষসের হাত থেকে বাঁচে তো সকাল হতেই প্রথম চোখ খুলে যাকে দেখবে দৃষ্টি তাকেই একশো টাকা দান করবে। অন্যদিকে রক্তিম দৃষ্টির সাহসীকতায় বিস্ময়ে জড়িভূত হয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে এক জায়গায়। দিন দিন মেয়েটার কার্যকলাপ যত দেখছে, ততই অবাক হচ্ছে। এতো মার খাওয়ার পরও তার মুখের ওপর কথা বলার সাহস পায় কোথায় এই মেয়ে!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here