#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ১১
#আদওয়া_ইবশার
সারাদিনের দৌড়-ঝাপের পর ঘরে ফিরে ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দেয় রক্তিম। উপুড় হয়ে শুয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে গভীর একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। মেহেদী হাতে থাকা খাবারের প্যাকেটটা টেবিলের এক কোণে রেখে নিজের গা থেকে ঘার্মাক্ত শার্ট ছাড়াতে ছাড়াতে জিজ্ঞেস করে রক্তিমকে,
“শুয়ে পরলি যে! খাবি না?”
“খিদে নেই। তুই খেয়ে নিস।”
চোখ বন্ধ রেখে ওভাবেই শুয়ে থেকে ক্ষীণ স্বরে জানিয়ে দেয় রক্তিম। ভ্রু কুঁচকায় মেহেদী। জানতে চায়,
“তা কি খেয়ে পেট ভরেছিস? সিগারেটের ধোয়া!”
জবাব দেয়না রক্তিম। চুপচাপ সেভাবেই পরে থাকে বিছানায়। শরীর ক্লান্ত থাকায় এটুকু সময়েই তার চোখে ঘুম ঘুম ভাব চলে এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে এবার একটু বিরক্ত হয় মেহেদী। বলে,
“খাবি না ঠিক আছে। তাই বলে কি শার্টটাও পাল্টাবিনা? বাইরে থেকে এসেই ল্যাদার মতো শুয়ে পরছিস! তোর গা থেকে ঘামের গন্ধ বের হচ্ছে। ওঠ, দ্রুত শার্ট পাল্টে ফ্রেশ হয়ে ঘুমা। নইলে তোর ঘামের দুর্গন্ধে আমার ঘুম হারাম হবে আজ।”
তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবে থেকেই ঠোঁট টেনে হাসে রক্তিম। নিজের প্রতি নিজেই তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে বলে,
“যার ভিতরে পুরোটাই গন্ধযুক্ত নর্দমা হয়ে আছে। তার আর শরীর পরিষ্কার করে কি হবে? সেই তো ভিতরের দুর্গন্ধযুক্ত আবরণ থেকেই যাবে।”
নিস্পল চোখে রক্তিমের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ে মেহেদী। ক্রস্থ পায়ে বাইরে থেকে কোনোমতে হাত-মুখ ধুয়ে এসে শুয়ে পরে রক্তিমের পাশে। খাবারের প্যাকেটটা টেবিলে ওভাবেই পরে থাকে অবহেলায়। রক্তিমের কথায় মেহেদীর’ও খাবার ইচ্ছে মিটে গেছে। বিকেলের ঘটনা গুলো স্বরণ হয় মেহেদীর। একজন মা কতটা উন্মাদ হলে এভাবে নিজের সন্তানকে আঘাত করতে পারে!
****
রক্তিম শিকদারের কাছে এতো বাজে ভাবে অপদস্থ হবার পরও দমে যায়নি দৃষ্টি। মনের কোণে অল্প অভিমান জমা হলেও তা ঝেড়ে ফেলে পরোক্ষনেই এটা ভেবে, ঐ পাষাণ পুরুষটার মনে তার জন্য এখনো ভালোবাসার জন্ম হয়নি। যার হৃদয়ে ভালোবাসা নেই তার আচরণে কষ্ট পেয়ে পিছু হটা নেহাত বোকামি ছাড়া কিছুই না। দৃষ্টি হাল ছাড়েনি। ভয় পেয়ে পিছিয়েও যায়নি। সময়ে অসময়ে দাঁড়িয়ে গেছে রক্তিম শিকদারের সামনে ভালোবাসা জাহির করতে। নিষ্ঠুর মানুষটার মন জয় করতে না পারলেও সেই দিনের মতো এমন ঐদ্ব্যত্য আচরণ আর পায়নি। কোনো এক অজানা কারণে রক্তিম দ্বিতীয়বার মেয়েটার সাথে বাজে আচরণ করতে পারেনি। হয়তো মনের কোণে কোথাও একটু অনুতপ্ততার লেশ উকি দিয়েছিল। অনুভব করতে পেরেছিল তার থেকে বয়সে এতো ছোট একটা মেয়ের কথায় উত্তেজিত হয়ে এতোটা খ্যাঁপাটে আচরণ করাটা ঠিক হয়নি। মেয়েটার বয়স কতই বা হবে! সতেরো কি আঠারো। এর থেকেও বেশি হলে ঊনিশ। এই বয়সী মেয়েরা বড্ড আবেপ্রবল হয়। এরা ঠিক ভুল বিচার করতে জানেনা। চোখের সামনে যা ভালো লাগে তাই নিজের করতে মরিয়া হয়ে যায়। দৃষ্টি মেয়েটাও ঠিক তেমন ধরনের মেয়েই। আবেগে গা ভাসিয়ে এসেছে রক্তিম শিকদারকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে। ঘটে যদি বুদ্ধি-সুদ্ধি কিছু থাকত তবে নিশ্চয়ই দেশে হাজার হাজার সুদর্শন ছেলে থাকতে রক্তিমের মতো এমন চালচুলোহীন একটা গুন্ডা, মাস্তানকে প্রেমের প্রস্তাব দিতনা।
ফুরফুরে এক বিকেল। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ডুবি ডুবি ভাব করছে। আকাশ জুড়ে রক্তিম আভা। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে দূর আকাশের দিকে আনমনে তাকায় দৃষ্টি। দিনের শেষ প্রহরে আকাশের এমন আগুন রাঙা সাজ দেখে ভাবে, একেই বুঝি বলে গোধূলি লগ্নের কনে দেখা আলো। ঊর্ধ্বগগণ থেকে মুখ সরিয়ে পাশে তাকায় দৃষ্টি। দেখতে পায় দিহানের একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যস্ত তুসী। ছেলেটা যা দেখছে সেটা সম্পর্কেই জানতে চাচ্ছে। এটা কার বাসা, ওটা কার গাছ একের পর এক প্রশ্ন করতে করতে পাগল বানিয়ে ফেলছে তুসীকে। মুচকি হাসে দৃষ্টি। ভাইটা তার বরাবরই প্রশ্ন করতে পারদর্শী। সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে রাস্তার এপাশ-ওপাশ তাকায় দৃষ্টি। বেহায়া মনটা না চাইতেও হয়তো খোঁজে বেড়ায় অতি প্রিয় একটা মুখ। যদি একবার দেখা পেত নির্লজ্জ চোখ দুটোর তৃষ্ণা মিটতো হয়তো।
হাঁটতে হাঁটতে প্রায় অনেকটা দূর চলে এসেছে তারা। বাসার গলি পেরিয়ে একেবারে মেইন রোডের কাছাকাছি। চারিদিকে পোস্টার, মাইকিং এর উচ্চ শব্দ জানান দিচ্ছে কাছেই হয়তো কোথাও একটা জনসমাবেশ হচ্ছে।
দৃষ্টি শুনেছে রক্তিম শিকদারের বাবা এমপি পদে নির্বাচনে লড়ছেন। সেটাও না কি ছেলের জেদে। কথাটা মনে পরতেই আনমনে প্রশ্ন করে তুসীকে,
“তুসু! রক্তিম শিকদারের বাবার নাম যেন কি?”
আবার সেই রক্তিম শিকদার! এই মেয়ে কি রক্তিম শিকদার ছাড়া আজ-কাল কোনো কথা খোঁজে পায়না? বিরক্ত হয় তুসী। অনিহা নিয়ে আঙুল তুলে দেয়ালে লাগানো একটা পোস্টার দেখিয়ে বলে,
“নিজেই দেখে নে।”
তুসীর হাত অনুসরণ করে তাকায় দৃষ্টি। দেখতে পায় সাদা-কালো পোস্টারে হাস্যজ্জল এক মুখ। গাল জোরে শুভ্র দাড়ি। ঠোঁটে লেগে আছে নির্মল হাসি। কপাল কুঁচকায় দৃষ্টি। ভাবে, লোকটা কি সুন্দর হাসে!অথচ এই লোকের ছেলে ওমন গুমরা মুখো কেন? বোনের দেখাদেখি দিহানও একটু এগিয়ে এসে পোস্টারে নজর দেয়। গুটি গুটি বাংলা অক্ষরে লেখা গুলো শব্দ করে পড়ে। পরোক্ষনে ভাবুক হয়ে প্রশ্ন করে,
“আচ্ছা আপু! ঐ রক্তিম শিকদার কে?”
মাথা কাত করে ঠোঁট চেপে হাসে দৃষ্টি। বলে,
“সিনেমায় হিরো দেখিস না! রক্তিম শিকদার হলো সেই হিরো। তবে সিনেমার না রিয়েল হিরো।”
দৃষ্টির এমন কথায় মুখ বাকায় তুসী। বিরবির করে বলে,
“হিরো! হাহ্! রাক্ষসের হিংস্র থাবা থেকে কোনোমতে জান নিয়ে ফিরে এসেও এখনো শিক্ষা হয়নি। নির্লজ্জ মেয়ে কোথাকার!”
বোনের জবাবে অবাক হয় দিহান। বাচ্চা ছেলেটার মনে কৌতূহল জাগে বোনের ভাষায় সেই রিয়েল হিরো রক্তিম শিকদারকে নিয়ে। আবার অল্প একটু সন্দেহও হয়। বোন না আবার তাকে ছোট ভেবে মিথ্যা বলে বোকা বানাতে চাইছে। চোখ পিটপিট করে জানতে চায়,
“ওনি কি সত্যিই হিরো? তুমি দেখেছো ওনাকে? আচ্ছা বলো তো শুনি রিয়েল হিরো দেখতে কেমন?”
ঠোঁট চেপে আবারও হাসে দৃষ্টি। শরীর দুলিয়ে বলে,
“মুখে শুনে কি আর বুঝা যায় কেমন হিরো? বাস্তবে দেখা আর মুখে শোনার মাঝে বিস্তর তফাৎ।”
“তাহলে আমি দেখব সেই হিরোকে।”
“সত্যি দেখবি?”
সন্দিহান হয়ে প্রশ্ন করে দৃষ্টি। ঘনঘন উপর-নিচ মাথা দুলিয়ে সাই জানায় দিহান। প্রফুল্ল হাসে দৃষ্টি। কাধ ঝাকিয়ে বলে,
“ঠিক আছে। চল তাহলে রিয়েল হিরো দেখিয়ে নিয়ে আসি তোকে।”
ভাই-বোনের কথোপকথন শুনে কপাল চাপড়ায় তুসী। কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“জাহান্নামে যা তোরা দুইটা। আমি কিছুই বলবনা। কিন্তু খবরদার! তোদের সাথে আমাকে টানবিনা।”
কথা শেষ করে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায়না তুসী। দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরে উল্টো পথে। সেদিকে তাকিয়ে মুখ বাকায় দৃষ্টি। হাক ছেড়ে বলে,
“যা যা। যেখানে খুশি সেখানে যা। কি ভেবেছিস?তোর মতো মেয়ে আমার সাথে না থাকলে রক্তিম শিকদারের খোঁজ পাবনা! আমার ভাইকে তার হবু দুলাভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে তবেই বাসায় যাব আমি।”
স্কুল মাঠে বিশাল জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে আজীজ শিকদারের পক্ষ থেকে। উত্তাল জনগণের সামনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বুক টানটান করে চিরায়িত গম্ভীর স্বরে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে রক্তিম শিকদার। উৎসুক জনগণের নজর সেদিকেই। বাবার হয়ে রক্তিম শিকদার নিজে জনগণের কাছে প্রতিজ্ঞা রাখছে এলাকার উন্নয়নের লক্ষ্যে। গিজগিজ করা মানুষের ভীড় ঠেলে একপাশে ভাইয়ের হাত ধরে দাঁড়ায় দৃষ্টি। জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকে রক্তিমের দিকে। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে তার স্মিত হাসি। বক্তৃতার মাঝে মাঝে একটু বিরতি নিয়ে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিচ্ছে রক্তিম। শ্যামবর্ণ বলিষ্ঠ দেহে কালো শার্টটা ঘামে চিটচিটে হয়ে আছে। দূর থেকেই তা দৃষ্টির চোখে ভাসে। সেদিকে নজর রেখেই ভাইয়ের হাতে মৃদু চাপ প্রয়োগ করে দৃষ্টি। এক হাত উচিয়ে ইশারায় দেখায়,
“রিয়েল হিরো দেখতে চেয়েছিলি না! ঐ দেখ রিয়েল হিরো।”
মঞ্চে বক্তব্যরত শ্যামাঙ্গ পুরুষটার দিকে তাকায় দিহান। অপলক চোখে কতক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রক্তিমকে পরখ করে বলে,
“এই লোক তো আধ বুড়ো। গায়ের রংটাও কালো। একে তোমার কাছে হিরো মনে হয়?”
বিস্ময়ে চোখ দুটো বৃহদাকৃতির হয় দৃষ্টির। যে পুরুষটার প্রেমে দিন-রাত মজে থাকে দৃষ্টি। সেই পুরুষটার সম্পর্কে নিজের ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে যারপরনাই অবাক হয়। অসহায় চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ওনাকে তোর সত্যি সত্যি বুড়ো মনে হয়? আর কালো বলছিস কাকে? মোটেও ওনি কালো না। শ্যাম বর্ণের শ্যামাঙ্গ পুরুষ ওনি। ওনার গায়ে এই রংটাই কত সুন্দর মানিয়েছে! শ্যাম বর্ণ না হয়ে গায়ের চামড়া সাদা হলে বরং আরও কুৎসিত দেখাত।”
বোনের যুক্তি গুলো মানতে নারাজ দিহান। চোখে-মুখে বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে বলে,
“আরে ধুর! তুমি তো দেখি হিরোই চিনোনা। আবার আমাকে নিয়ে আসছো হিরো দেখাতে! শুনো, হিরোদের চোখ হবে সুন্দর ভাসা ভাসা। হিরোরা না হাসলেও তাদের চোখ হাসবে। আর চুল হবে স্টাইল করে কাটা। জেল দিয়ে চুল গুলো সেট করা থাকবে। আর না হয় সিল্কি চুল গুলো কপালে ঢেউ খেলবে। দাড়ি থাকবে ট্রিম করে কাটা। আর ওনাকে দেখো! চুল গুলো কেমন পাগলের মতো আউলাঝাউলা হয়ে কাকের বাসার মতো দেখাচ্ছে। মনে হয় কতদিন ধরে শ্যাম্পু করেনা। মুখ ভর্তি দাড়ি- গুফ। দাড়ি গুলো যদি আর কয়েক ইঞ্চি বড় আর সাদা হতো তবে একদম রবীন্দ্রনাথের মতো লাগত। ওনাকে কোনোভাবেই হিরো বলা যায়না। তবে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বিরহী কবিতা লেখা কবি বলা যায়।”
এতটুকু একটা ছেলের মুখে এমন বিশদ বর্ণনা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টি। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে যেন। ফ্যালফ্যাল নয়নে শুধু তাকিয়ে থাকে ভাইয়ের মুখের দিকে। শেষ পযর্ন্ত কি না নিজের মায়ের পেটের ভাইটা তার পছন্দকে এভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করল! এই দুঃখ কিভাবে মেনে নিবে দৃষ্টি?
চলবে…..