ছায়া মানব ২
৪৩.
মাহতিম বাইরে থেকে ডাকল ইমনকে। সে শব্দ করতে পারছে না। মোহনা তার মুখ চেপে ধরে আছে। মূলত সে জোর খাটাচ্ছে না। পর পরই সে এক ঝটকায় মোহনার হাত সরিয়ে দিল,
‘ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনি কি চুরি করার জন্য এ ঘরে এসেছেন?’
মোহনা বিচলিত ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল। জানালার পর্দার দিকে চোখ যেতেই দ্রুত সেদিকে গেল। পর্দার আড়ালে লুকিয়ে চাপা স্বরে বলল,‘দরজা খুলে দিন। ভুল করেও আমার কথা বলবেন না।’
‘বললে সমস্যা কী?’
‘ভ্যাবলা ছেলে, বুঝেন না নাকি কিছুই? ভাইয়া আমাদের একসাথে দেখলে কী মনে করবে?’
‘কী মনে করবে?’
‘আপনার মাথা মনে করবে। দরজা খুলুন আর দয়া করে আমার কথা বলবেন না।’
ইমন লুকিয়ে হাসল। পর পরই দরজা খুলে দিল। মাহতিম চারিদিকে তাকিয়ে বলল,‘তোমার ঘরের লাইট অন কেন? ঘুমাওনি?’
ইমন পর্দার দিকে তাকায়। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মোহনার পোশাকের কিছুটা অংশ। আড়াল করে দাঁড়ায় সে। পর পরই বলল,‘হঠাৎ জ্বর এসেছিল। তাই উঠেছিলাম।’
মাহতিম কিছুটা বিচলিত হয়ে বলল,‘আম্মাকে জাগাতে। ঔষধ নিয়েছ? এখন কেমন আছ?’
‘এখন ঠিক আছি। মোহনা …’
থেমে যায় ইমন। পর্দার আড়াল থেকে কয়েক হাজার কথা শুনিয়ে দিল মোহনা। মাহতিম অবাক চোখে তাকায়,‘মোহনা কী?’
‘মোহনার থেকে ঔষধ নিয়েছিলাম।’
‘ওহ আচ্ছা।’
মাহতিমের কেমন সন্দেহ হলো। সে চারপাশে তাকাল,
‘ঘরে আর কেউ আছে?’
ইমন আঁতকে ওঠে। মোহনাও ভয় পেয়ে যায়। ইমন আমতাআমতা করে বলল,‘কেউ নেই। আমার ঘরে আর কেউ থাকবে কেন?’
‘মনে হচ্ছে কেউ আছে। মেয়েলী স্মেল পাচ্ছি। কেমন চেনা মনে হচ্ছে। মোহনার হয়ত। এর আগে কে এসেছিল এ ঘরে?’
‘কেউ আসেনি। আপনি ভুল ভাবছেন। আমি ছাড়া আর কেউ নেই এ ঘরে। আপনি এতো রাতে জেগে আছেন কেন?’
প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন শুনে মাহতিম বেশ খানিকটা অবাক হলো। তবে দ্বিধা না করে বলল,‘অহনার পরিবারের জন্য মন খারাপ হচ্ছিল তাই ওর মা-বাবার সাথে দেখা করিয়ে আনলাম।’
‘ওহ আচ্ছা। অনেক রাত হয়েছে, আপনার ঘুমানো উচিত।’
মাহতিম এদিক ওদিক তাকিয়ে কেমন সন্দিহান হয়ে বের হয়ে গেল। মোহনা আড়াল থেকে বের হয়ে এলো। কিন্তু সাথে সাথেই আবার দরজায় করাঘাত হলো। মোহনা এবং ইমন আরও বিচলিত হয়ে পড়ল। মোহনা দ্রুত ইমনের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। লেপ মুড়ি দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল। ইমন আবার দরজা খুলে দিল। মাহতিম সাথে সাথেই ভেতরে ঢুকে বলল,‘সরি! তোমার শরীর ঠিক আছে কিনা জানি না। কিছু লাগবে?’
পর পরই ইমনের কপালে হাত রেখে দেখল। সামান্য পরিমাণ জ্বর আছে এখনো। মাহতিম ব্যস্ত হয়ে বলল,‘আর রাত জেগে থেকো না। শুয়ে পড়ো, না হয় শরীর আরো খারাপ করবে। ঠান্ডার কারণে আরো বাড়তে পারে।’
বিছানায় মোহনা থাকায় ইমন বলল,‘আমি একটু বই পড়ব। এখন ঘুমাব না।’
‘না, বই পড়ার দরকার নেই। শুয়ে পড়ো।’
‘আপনি যান, আমি শুয়ে পড়ছি।’
মাহতিমের নজরে পড়ল বিছানায় থাকা একটা বইয়ের দিকে। বলল,‘তুমি কি কিছু লুকাচ্ছ আমার থেকে? চোখ দেখে এমনটাই মনে হচ্ছে।’
ইমন ঘেমে একাকার। ভয়ে মুখ শুকিয়ে এসেছে। বলল,‘তেমন কিছু নয়। আমি কী লুকাতে পারি? কিছুই লুকাচ্ছি না। আপনি যান আমি শুয়ে পড়ব।’
‘আমি গেলেই তুমি বই নিয়ে বসে পড়তে পারো। যাও শুয়ে পড়ো। আমি লাইট অপ করে, দরজা বন্ধ করে যাচ্ছি।’
ইমনের কন্ঠনালী শুকিয়ে এলো। বিছানায় মোহনা শুয়ে আছে। সে কিছুতেই এখন পারবে না। বলল,‘আপনি যান। আমি যাচ্ছি, বই পড়ব না।’
‘তুমি শুয়ে পড়ো। আমি লাইট অফ করে যাব।’
‘আপনি যান।’
মাহতিম বেশ অবাক। ইমনের বিছানায় যেতেই যেন যত সমস্যা। সে ভেবেছে রাত জেগে ছেলেটা বই পড়ার জন্যই শুতে চাইছে না। তাই সে এক প্রকার ঠেলেই তাকে খাটের কাছে নিয়ে গেল,
‘আর একটা কথাও না বলে শুয়ে পড়ো। আমি লেপ টেনে দিচ্ছি।’
মাহতিম লেপের দিকে হাত দিতেই ইমন তার হাত চেপে ধরে,‘ভাইয়া, আপনি চলে যান। আমি সব ঠিক করে নিতে পারব।’
‘তুমি শুতে এত ভয় পাচ্ছ কেন? এভাবে না ঘুমালে কিন্তু শরীর খারাপ করবে। শুয়ে পড়ো বলছি।’
মাহতিম জোর করে ইমনকে খাটে শুইয়ে দিল। তারপর পাশাপাশি লেপটা টেনে দিয়ে বলল,‘আমি তাহলে যাচ্ছি।’
ইমন কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। যেন মাহতিম গেলেই সে প্রাণে বাঁচে। মাহতিম তার এমন আচরণ দেখে বলল,‘বুঝেছি, তোমার ঘুম আসবে না। তবে আর জোর করে লাভ নেই।’
কথাটা বলার সাথে সাথেই ইমন উঠে গেল। মাহতিমও বেশ অবাক হয়ে গেল তার কাণ্ড দেখে। পাশে থাকা ফিলোসফি সম্পর্কিত বইটা হাতে নিল মাহতিম। বলল,‘এটা পড়েছ?’
ইমন বলল,‘হ্যাঁ! সময় পেলেই পড়ি।’
‘আমি নিতে পারি?’
‘অবশ্যই! এটা নিয়েই আপনি চলে যান।’
মাহতিম হকচকিয়ে ওঠল,‘তুমি কি আমাকে বের করে দিতে চাও নাকি?’
কিছুটা হেসেই বলল। ইমন ইতস্তত করে বলল,‘একদম নয়। আপনি অনেক জার্নি করে এসেছেন। তাই ভাবলাম, শুয়ে পড়া উচিত।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
মাহতিম চলে যায়। দীর্ঘ পনেরো মিনিট নষ্ট করেই গেল সে। চলে যেতেই ইমন দীর্ঘশ্বাস নিয়ে দরজা বন্ধ করল। পর পরই মোহনাকে মৃদু স্বরে ডাকল। কোনো সাড়া পেল না। আস্তে আস্তে লেপটা হালকা সরালো। মোহনার শান্ত মুখশ্রী দেখে এক মুহুর্তের জন্য ইমনের হৃদয় উতলা হয়ে ওঠল। ভেতরে শিহরণ দিয়ে ওঠল। সে কয়েকবার ডাকল। মোহনা কোনো সাড়া দিল না। এই অল্প সময়েই মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। ইমন স্বযত্নে তার চশমাটা খুলে একপাশে রাখল। পাশে বসেই মোহনার দিকে তাকিয়ে রইল। দেখতেও যেন ভালো লাগছে। থেকে থেকে ঠোঁট নড়ছে মোহনার। আচমকা ইমনের মুখে হাসি ফুটে ওঠল। নির্মল আনন্দে সে মোহনাকে দেখছে। কপালে এলোমেলো কিছু চুল। ইমন হাত বাড়ালো সেগুলো সরিয়ে দিতে। কিন্তু হাত গুটিয়ে নিল। ছোঁয়ার অদম্য ইচ্ছা থাকলেও পারল না। শিয়রে বসে গালে দুহাত রেখে তাকিয়ে রইল। নজরে পড়ছে কিছু সুক্ষ্ম মলিনতা। ঠোঁটের নিচে কালো তিলটা যতটা মোহনীয় লাগছে, চশমা দেওয়ার ফলে চোখের নিচে দাগটাও ভালো লাগছে। এই সামান্য খুঁতের কারণেই যেন নিখুঁত সে।
_
সকাল হতেই মোহনা পিটপিট করে তাকায়। ঝাপসা দেখতে পেল সে অন্য কোনো জায়গায়। আশপাশ হাতড়ে দেখল তার পাশেই একটা পুরুষ মানুষ। আধশোয়া অবস্থায় সে। আরও খেয়াল করে বুঝতে পারল পুরুষটা ইমন এবং সে আয়েশ করে তাঁর উরুতে মাথা রেখেছে। মোহনা হকচকিয়ে ওঠে যায়। চশমাটা খুঁজে নিয়ে দ্রুত চোখে লাগিয়ে চারপাশ দেখল। রাতের কথা মনে হতেই খুব বিরক্ত হলো। বুকে হাত দিয়ে নিঃশ্বাস নিল। যাক অন্তত তাকে এ অবস্থায় ইমন দেখতে পায়নি। তাহলে ছেলেটা কী ভাবত? পর পরই ইমনকে ডাকল। ইমন চশমাটা ঠিক করে তাকাল মোহনার দিকে,
‘গুড মর্নিং!’
মোহনা কিছুটা রাগী কন্ঠে বলল,‘রাতে আমাকে ডাকেননি কেন?’
‘ডেকেছি, তুমি নিজেই ওঠোনি। তারপর…’
‘তারপর কী?’
‘কিছু না।’
মোহনা কিছু বলল না। কিছুটা লজ্জাও পেল। কেউ দেখার আগেই সে প্রস্থান করল।
সকাল সকাল বাড়ি সাজানোর কাজে লেগে পড়ল ইমন। তাকে সাহায্য করছে মাহতিম। পাশাপাশি বর্ষণও কাজ করছে। অর্থাৎ সবাই ব্যস্ত। অহনা আর মোহনা বসে আছে। দুজনেরই মন খারাপ। তাদের জন্য যে ড্রেস নেওয়া হয়েছে তা ফিট হচ্ছে না। কী গায়ে দেবে তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়। মাহতিম কিছু সময়ের জন্য অহনার সাথে দেখা করতে আসে। মাহতিমকে দেখেই মোহনা এক প্রকার ভান ধরা নাক টেনে বলল,‘ভাইয়া, তোমার বোন আজ পর্যন্ত তোমার কাছে কিছুই চায়নি, আজ একটা জিনিস চাইবে। দেবে তুমি?’
মাহতিম মোহনার মাথায় পর পর দুটো গাট্টা মেরে বলল,‘এমন কোন দিন আছে যেদিন কিছু চাসনি?’
‘সিরিয়াসলি বলছি ভাই। অহনার সামনে এভাবে অপমান করতে পারো না তুমি। আগে বলো যা চাই দেবে কি-না?’
‘দেব না।’
‘ঠিক আছে, আমার লাগবে না।’
মোহনা দাঁত কটমট করে চলে গেল। মাহতিমও বাধা দিল না। অহনাকে বলল,‘ও কী চাইবে আর। নিশ্চয় মোবাইল বা দামি কোনো গ্যাজেট। ওর আবদার পূরণ করা সম্ভব নয় এখন। সময় করে শুনব।’
অহনা কিছুটা অবাক চোখে তাকায় মাহতিমের দিকে। পরপরই খাটে ছড়ানো ড্রেসগুলো সরিয়ে বলল,‘বসো। কোনো দরকার ছিল কি?’
‘মনে হচ্ছে মোহনার সাথে সাথে তোমারও কিছু হয়েছে। কারণ কী? কিছু হয়েছে?’
‘ওর জন্য যে ড্রেসটা নিয়েছে সেটা ওর পছন্দ হয়নি তার পাশাপাশি সেটা ফিট হচ্ছে না। তাই ওর মন খারাপ। তোমার কাছে বলতে চেয়েছিল নতুন ড্রেস লাগবে। তুমিতো রাগিয়ে দিলে।’
মাহতিমের অনুশোচনা হলো,
‘সবসময়ই অবুঝ আবদার করে। তাই কাজের সময় গ্রাহ্য করিনি। ঠিক আছে, আমি তবে সারপ্রাইজ দেব ওকে।’
অহনা খুশি হয়ে যায়,
‘তুমি সত্যিই অনেক ভালো।’
‘ভালো মানুষদের কিস করতে হয়। তোমার ঠোঁটটাও মলিন হয়ে আছে। কিস করলেই দেখবে ভালো লাগছে। আজকে তোমাকে সবচেয়ে সুন্দর লাগবে যদি আমাকে চুমু খাও।’
অহনা মাহতিমের গলা জড়িয়ে ধরল। পর পরই বলল,’এত সখ? বিয়ের পর চুমু খেয়ে সুন্দর হওয়ার সখ আমার। আগে ইচ্ছে করেনা।’
মাহতিম ওর কথার বিপরীতে সময় দিল না। দুঠোঁট নিজের সাথে মিলিয়ে নেয়। অহনা কিল বসালো তার পিঠে তাও আর্তনাদ করল না। মাহতিম কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে বলল,‘বরকে কীভাবে সেবা করতে হয় তা এখন থেকেই শেখানোর চেষ্টা করছি। তুমি না চাইলে এভাবেই জোর করব।’
বলেই চলে গেল মাহতিম। অহনা তব্ধা মেরে রইল। কী ঘটে গেল হঠাৎ বুঝে উঠতে পারেনি।
মোহনা নিচে গিয়েই ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছে ইমনের সাথে। তার কোনো কাজই তার পছন্দ হচ্ছে না। এক পর্যায়ে বলেই বসল,‘যে কাজ পারেন না সে কাজ করতে আসেন কেন? আপনার উচিত কাজ ছেড়ে দেওয়া।’
ইমন বেশ অবাক। মেয়েটাকে সকালেও বেশ শান্ত দেখেছে আর এখন? আগের মতোই খিটখিটে হয়ে গেছে। আনিফা তাকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে গেল,
‘ছেলেটার সাথেই কি তোর সব রাগ নাকি?’
মোহনা শান্ত হয়ে গেল। সত্যিইতো! যত রাগ সব কেন তার ওপরেই দেখাচ্ছে। বলল,‘ওনার ওপরে রাগ দেখাতে ভালো লাগে।’
আনিফা বেশ অবাক হলো। মেয়েটার কখন যে কী ভীমরতি হয় বোঝা দায়। কারণ জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলে না। হঠাৎ করেই মোহনার ফোনটা বেজে ওঠে। নতুন সিম নিয়েছে। হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধুকেই নাম্বার দিয়েছে। অচেনা নাম্বার দেখেও তাই কলটা রিসিভ করল। ফোন কানে দিতেই পরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে ওঠে। বিরক্তিতে দাঁত-মুখ খিঁচে আসে। এক মুহুর্তও দেরি না করে ফোনটাকেই আ’ছাড় দেয় সজোরে।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম