ছায়া মানব ২
৪.
‘আমি মাহতিম। ভয় পেও না। আমি তোমার ক্ষতি করব না।’
হুড়মুড় করে ওঠে বসে অহনা। চারিদিকে তাকিয়ে কাউকে না দেখে ঢোক গিলল,
‘আমি কোথায়?’
‘ কিছু দেখে হয়ত অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে। চিৎকার শুনে দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি মাটিতে পড়ে আছ। তাই ক্যাম্পে নিয়ে এলাম। এখানে তুমি সুরক্ষিত।’
‘ওহ!’
পরপরই অহনা নিজের দিকে তাকাল। অন্য পোশাক দেখে আঁতকে ওঠে। ভয়ে কিছুটা পেছনে সরে যায়,
‘আমার পোশাক! কে পরিবর্তন করল?’
‘ ভয় নেই। আমি করিনি।’
এমন সময় তাঁবুতে ঢুকল একটা মেয়ে। মাহতিম তাকে দেখিয়ে বলল,’ও তোমাকে সাহায্য করেছে।’
অহনা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। মেয়েটাকে ধন্যবাদ দিল। মেয়েটাও হাত বাড়িয়ে দিল,’আমি এলিনা। তোমার সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লাগল।’
অহনা মৃদু হাসল,’আমারো।’
‘ এখন কেমন আছ?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ!’
মাহতিম গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,’আরেকজনকে কিন্তু ধন্যবাদ দাওনি।’
অহনা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,’যাকে তাকে বলিনা।’
ক্যাপ্টেন নিমো এলিনাকে ডাকতেই সে চলে গেল। মাহতিম অহনার দিকে ঝুঁকে বলে,’আমি তোমাকে বাঁচিয়েছি। তার জন্য আমাকে তোমার ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। না হয়…’
‘ না হয় কী?’
‘ আমি নিজেই নিয়ে নেব।’
‘ মানে..’
‘ মানে বলব নাকি বুঝিয়ে দেব? আমি কিন্তু সবকিছু প্রাকটিক্যালি দেখাতে পছন্দ করি।’
অহনা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ওঠে যায় দ্রুত। মাহতিম ওর হাত চেপে ধরে,
‘কৃতজ্ঞতাবোধ নেই একদম তোমার। কেউ উপকার করলে প্রতিদান দিতে হয়। তা বোধ হয় জানো না তুমি।’
অহনা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,’কী চাই বলুন। টাকা চাইবেন নাকি? বলুন কত চাই?’
মাহতিম মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,’তেমন কিছু না। যা চাই তা দেবে তো?’
‘ বলেই দেখুন।’
‘ কথা দিতে হবে। আমি যা চাইব তাই দেবে।’
‘ ওকে, কথা দিলাম।’
‘ ভেবে চিন্তে কথা দাও। আমি যা চাই তাই কিন্তু দিতে হবে। তখন আমি বাহানা শুনব না। সো, ভেবেই বলো।’
‘ একদম ভেবেই বলছি। কত চাই বলুন। আমি দিয়ে দেব। আমি কারো ঋণ রাখি না।’
‘এখন চাইব না। আবার দেখা হলে নিশ্চয়ই চেয়ে নেব। আপাতত বাকি থাক। আমিও ভেবে নিই একটু।’
‘ বাকির নাম ফাঁকি। এখনই বলুন।’
মাহতিম ধীরে ধীরে অহনার মুখোমুখি দাঁড়ায়। গাঢ় নিঃশ্বাস অহনার চোখে-মুখে ভীড় করে। অহনার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। বুকের ভেতর যেন হাতু’ড়ি পে’টা শুরু হয়েছে। নিজেকে উদ্ভ্রান্ত লাগছে ভীষণ। এলোমেলো শব্দ যুগল উচ্চারণ করল,’কী করছেন?’
মাহতিম আরো কিছুটা কাছে গিয়ে তার কানে কানে বলল,’এত তাড়াতাড়ি সব পেতে চাও কেন? চরিত্রহীন মনে হবে আমাকে। যখন তোমার আপত্তি থাকবে না তখনই প্রতিদান চাইব। এখন বলো কোথায় যাবে? আমি পৌঁছে দেব।’
মাহতিম অহনাকে ছেড়ে দেয়। অহনার পুরো শরীর কাঁপছে। পুরুষালী গন্ধ পেয়ে তার হৃদয় ব্যাকুল। আর কখনোতো এমন হয়নি। আজ কেন হলো? প্রশ্নগুলো ঘোরপাক খাচ্ছে মস্তিষ্কে।
অহনা ব্যাকুল চিত্তে বলল,’ফ্লার্ট করছেন! তবে সুযোগ পাবেন না, সেটা আগেই বলে দিচ্ছি।’
‘ তুমি কি আমাকে চ্যালেঞ্জ করছ নাকি?’
‘ মেয়েদের গায়ে পড়া ছেলেকে আমি চ্যালেঞ্জ করব? স্বপ্ন দেখছেন।’
‘ আমি কখনো কোনো মেয়ের গায়ে পড়িনি। এটা অপমান।’
‘ ভুলে গেলেন নাকি? কালকেইতো আমার গায়ে পড়লেন। আপনারতো দেখছি ভুলে যাওয়ার অভ্যাসও আছে।’
‘ কিছু্ই ভুলিনি আমি। ওটা একটা এক্সি’ডেন্ট ছিল।’
মাহতিম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আধো আধো কন্ঠে বলল,’তোমাকে ছাড়া আর কোনো নারীকে কখনো স্পর্শ করিনি।’
বলেই মাহতিম বেরিয়ে গেল। অহনা তব্ধা মেরে দাঁড়িয়ে আছে। মাহতিমের শেষ বাক্যটা তার হৃদয়ে স্থান পেল। হয়ত সেটা টের পায়নি। কিন্তু বেহায়া মনে জানান দিবে খুব শিঘ্রই।
অহনার ধ্যানের মাঝেই আশিশ নামক একটা ছেলে আসে। অহনা অপ্রস্তুত হতেই সে বলল,’মাহতিম বলেছে আপনার পরিচয় জেনে বাড়ি পৌঁছে দিতে।’
‘ লাগবে না। আসলে আমার মোবাইলটা বন্ধুদের কাছেই আছে, যেখানে সবাই রেষ্ট নিয়েছিল। যদি একটা মোবাইলের ব্যবস্থা করে দেন তাহলে আমি আমার বন্ধুদের কল করে এখানে আসতে বলতে পারি।’
‘ সিউর। আপনি আমার মোবাইলটাই ব্যবহার করতে পারেন।’
‘ অগ্রিম ধন্যবাদ।’
অহনা তমার কাছে কল করল। ইতমধ্যে তারা অহনাকে খুঁজে হয়রান। আর্মি ক্যাম্পের কাছেই আসছিল। যদি কোনো খবর পায়। কলটা পেয়ে তারা আরো নিশ্চিন্ত মনে চলে আসে। এসেই দেখা হয় মাহতিমের সাথে। সে ক্যাপ্টেন নিমোর সাথে কথা বলছিল। পাশেই আছে সেনা প্রধান কে এম ফাত্তাহ। রাবি খুশিতে আত্মহারা। অবশেষে দেখা পেল ফাত্তাহের সাথে। ওদের সবাইকে দেখেই নিমো বলল,’তোমরা কারা?’
ওসমান সাবধানী স্বরে বলল,’আমাদের বন্ধু এখানেই আছে। একটু আগে এখান থেকেই কল করা হয়েছিল। ওকে নিতেই এসেছি।’
মাহতিম অনুমতি নিয়ে বলল,’আমি সাহায্য করছি ওনাদের। আপনি নিমো স্যারের সাথে তাঁবুতে যান।’
মাহতিম সবাইকে নিয়ে অহনার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। কিন্তু রাবি নড়ল না। সে ফাত্তাহের মুখোদর্শন করে আনন্দিত। কিছুটা সন্দিহান চোখে ফাত্তাহ তার দিকে তাকায়,
‘ কিছু বলবে তুমি?’
রাবি এক গাল হেসে বলল,’আমি আপনার অনেক বড় ফ্যান। আপনার প্রতিটা দুর্ধর্ষ কাজ দেখে আমি খুবই উৎসাহিত। আপনার আদর্শই অনুসরণ করি সবসময়। আমি আপনার মতোই অনেক বড়ো বীর হতে চাই।’
ফাত্তাহ মৃদু হাসল। তৎক্ষণাৎ গম্ভীর হয়ে বলল,’আমার মতো নয়, আমার থেকেও আরো বড়ো হও যেন এই দেশ তোমাকে মনে রাখে আমৃ’ত্যু।’
‘ অবশ্যই স্যার। আপনার থেকেই অনুপ্রেরণা পাই।’
মাহতিম ভেতরে গেল না। ওসমানকে বলল,’তোমরা ওকে নিয়ে যাও। আমার যতটা করার ছিল সেটা শেষ। বাকিটা তোমাদের দায়িত্ব। আর শোনো, কখনো কোনো বন্ধুকে একা ছাড়বে না।’
তমা বলল,’আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি। খুব চেনা মনে হচ্ছে।’
মাহতিম হাসল,’সম্ভব না। আমি কয়েকদিন আগেই দেশে ফিরলাম। এতোদিন কাতার ছিলাম। এর মধ্যে বাইরে বের হইনি।’
‘হয়ত ভুল হয়েছে আমার। তবে আপনি অনেক ভালো। আপনার উপকার কখনোই ভুলব না।’
‘ দেশ এবং জাতি রক্ষার শপথ নিয়েছি, এটা আমার দায়িত্ব।’
অহনা সবাইকে পেয়ে খুব খুশি। অনেক বকাও খেল অবশ্য। অবশেষে তারা বাড়ি যাবে বলেই ঠিক করে। তাদের বনভোজন আর হলো না। অহনা তৈরি হয়ে নেয়। এলিনার থেকে বিদায় নিয়ে নিল। বাঁকা চোখে কয়েকবার মাহতিমকে দেখল। তবে মাহতিম একবারও তার দিকে তাকাল না। আশিশের সাথে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলছিল। অহনা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল মাহতিমের তাকানোর জন্য। সে তাকাল না। তমাকে বললো,’ওনি আমাকে সাহায্য করেছেন। গিয়ে বল কালকে দেখা করতে। ওনাকে ট্রিট দেব।’
তমা গিয়ে বলল তাকে। মাহতিম সোজা বাক্যে না করে দিল। অহনাও মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল।
অহনা চলে যেতেই ভীষণ উদাস হয়ে পড়ল মাহতিম। কিছুতেই তার মন বসছে না। আইলে বসে ছিল। এমন সময় আশিশ তাকে মন খারাপের কারণ জিজ্ঞেস করলে বলল,’জানি না। কখনো এমন হয়নি, আজ হচ্ছে। নিজেকে কেমন অন্যের কাছে সমর্পিত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে হারিয়ে গেছি কোথাও।’
‘তুই অসুস্থ। ডাক্তার দেখানো দরকার।’
‘ কি বলছিস এসব? আমার আবার কিসের অসুস্থতা?’
‘ এখনো বুঝলি না? আমি তোর কথা শুনেই বুঝে গেলাম।’
‘ কি অসুখ আমার?’
‘ প্রেম চিনিস, প্রেম?’
‘হ্যাঁ, তো?’
‘প্রেম অসুখ বলে এটাকে। আচ্ছা তুই বল, তোর কি কাউকে দেখে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়? তার কথা ভাবতে ভালো লাগে? বা কাছে পেতে চাস?’
‘ ভেবে দেখিনি। তবে খুব উদাসীন লাগছে।’
‘ ঠিক বুঝেছি। তোকে শিঘ্রই ডাক্তার দেখাতে হবে। এই প্রেম অসুখ ভয়ঙ্কর। যাকে একবার ধরেছে সেই মরেছে। কেউ বাঁচেনি। আমারতো তোর জন্য কষ্ট হচ্ছে। তুই আর বেশিদিন নেই আমাদের মাঝে। অন্যকারো হয়ে যাবি।’
মাহতিম এতক্ষণে আশিশের ফাজলামো বুঝেছে। গাট্টা মেরে বলল,’কাল যাচ্ছি। যাকে দেখে মন-প্রাণ থেমে গিয়েছে। যাকে অনুভব করছি তার সাথে দেখা করব। পুনরায় দেখতে পেয়ে আমার যে কী অবস্থা হবে সেটাই ভাবছি। ভীষণ ভালো লেগে গেছে তাকে। মনে হয় না এজীবনে ঐ মায়াবিণীকে ভুলতে পারব।’
‘ শুভকামনা।’
আশিশের মুখটা কেমন উদাস হয়ে গেল। যেন মাহতিমের খুশিতে সে খুশি নয়। মনে মনে বলল,’সেটা আমি কী করে হতে দিই? অবশ্যই আমাকেও তার প্রেমে কিছু একটা করা দরকার।’
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম