ছায়া মানব ২
৪১.
গভীর রাতে দরজায় করা’ঘাত পেয়ে খানিকটা অবাক হলো সুমা। পাশে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে রোস্তম। মৃদু গলায় ডাকল,‘শুনছেন?’
কোনো শব্দ না পেয়ে পুনরায় আলতো করে ঠেলে ডাকল,‘শুনছেন? বাইরে কেউ দরজা ধাক্কাচ্ছে। ওঠুন!’
রোস্তম না চাইতেও ওঠল। সারাদিন কাজ করে খুব ক্লান্ত ছিল। তাই এত রাতে জাগানোর ফলে কিছুটা রাগ ওঠল। তবে নিজেকে শান্ত করে নিল। বউকে সে প্রচণ্ড ভালোবাসে। সংসারের এতোটা সময় পার হয়ে যেতেও তাদের ভালোবাসা কমেনি। রোস্তম উঠে গিয়ে দরজা খুলল। সাথে সাথেই অহনা ঝাঁপিয়ে পড়ল বাবার বুকে। রোস্তম অবাক না হয়ে পারল না। এত রাতে মেয়েকে আশা করেনি সে। আবেগে কেঁদে ফেলল। সুমা এসেও আনন্দে আত্মহারা। মেয়েকে হাজার চুমু দিল। অহনা রসিকতা করে বলল,‘আমি এখন আর ছোট নই মা।’
সুমা মেয়েকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,‘বাবা-মায়ের কাছে সন্তান কখনো বড়ো হয়না। তুই যখন ছোট ছিলি….
‘না, না, ছোট বেলার গল্প বলো না। আমি শুনতে চাই না।’ মনে মনে বলল,‘এখন শুরুই করবে ডায়াপার্স পরার সময়ের কথা।’
মাহতিমকে খেয়াল করেনি রোস্তম আর সুমা। চোখাচোখি হতেই মাহতিম সালাম দিল। অহনা পরিচয় করানোর জন্য বলল,‘ও হচ্ছে মাহতিম। আমি….
রোস্তম বাধা দিয়ে বলল,‘আমি সবটাই জানি।’
‘কে বলল তোমায়?’
‘মাহতিমের মায়ের সাথে কথা হয়েছিল। ওনিই সব বললেন।’
‘কী কী বলল?’
সুমা হেসে বলল,‘পরে জানবি।’
সুমা মাহতিম কে বসতে দিল। কিছু খেতে বলায় মাহতিম না করল। রাতে তারা খেয়েই এসেছে। সুমা জিজ্ঞেস করল,‘এতরাতে হঠাৎ করে এলে যে?’
অহনা রেগে গেল,
‘আমি কি নিজের বাড়িতে আসতে পারিনা? তোমরা কি আমাকে পর ভাবো?’
‘সেটা বলিনি। কিন্তু রাতটা তো কম নয়। কত বিপদ-আপদে চারিপাশ। নিশ্চয় ছেলেটাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, বোকা বানিয়ে নিয়ে এলি?’
অহনার রাগ মাথা চেপে বসে। কান দিয়ে ধোঁয়া বের হবে মনে হলো,
‘ওকে জিজ্ঞেস করো। আমি আসতে চাইনি, ও জোর করে নিয়ে এসেছে।’
মাহতিম বলল,‘আসলে আন্টি, ওর মন খারাপ ছিল। জিজ্ঞেস করায় বলল আপনাদের কথা মনে পড়ছে। তাই ভাবলাম নিয়ে আসি। রাত ছিল বলে ও মানা করেছিল। কিন্তু গাড়ি আছে যেহেতু আসতে সমস্যা ছিল না। তাই আমিও একটু জোর করলাম। আমার মনে হয়েছিল, মন খারাপে আপনাদের দেখলে ভালো লাগবে।’
রোস্তম বলল,‘এসেই যখন পড়েছ, আজ রাতটা থেকে যাও।’
‘সম্ভব নয়। অন্য একদিন আসব আবার। আজ যেতে হবে।’
অহনা অস্বীকার করল,
‘তুমি যেতে পারো। আমি যাচ্ছি না।’
‘না, তোমাকে যেতেই হবে। তাছাড়া কালতো আঙ্কেল, আন্টিও যাচ্ছেন। তাহলে তোমার সমস্যা কী?’
‘আমি না গেলে তোমার সমস্যা কী? আমার ইচ্ছে করছে না যেতে। তুমি চলে যাও। আমি না হয় কাল মা-বাবার সাথে যাব।’
সুমা ঝগড়ার মাঝে থাকল না। সে রান্নাঘরে গেল। এদিকে রোস্তম বসে বসে তাদের দুজনের ঝগড়া দেখছে। কোনোমতেই থামাতে পারল না। এক পর্যায়ে মাহতিম বলল,‘তোমাকে ছাড়া আমার ভালো লাগবে না।’
কথাটা বলেই সে জিভে কামড় দিল। অর্থাৎ শ্বশুরের সামনে লজ্জাজনক কথাটা বলে ফেলল। রোস্তম না শোনার ভান ধরে উঠে গেল। নিজেকে সে ঝগড়ার মাঝে অপ্রয়োজনীয় মনে করল। তবে কিছুটা খুশিও হলো, মেয়েটা তার ও বাড়িতে খুশিতেই আছে। আর কী চাই? মেয়েটার খুশির জন্যইতো এত আয়োজন।
অহনা রেগে গেল,
‘আমি যাব না মানে যাব না। এটাই ফাইনাল। তুমি চুপ করে বসে থাকো।’
মাহতিম পুনরায় কিছু বলার আগেই সে মাহতিমের মুখ চেপে ধরল,‘একদম চুপ! আর একটা কথাও বলবে না। এভাবেই থাকো। ছেলেদের বেশি কথা মানায় না।’
মাহতিম অহনার হাত ছাড়িয়েই বলল,‘এটা তোমার বাড়ি বলে যা ইচ্ছা তাই করবে? মনে রেখো, এটা আমারও শ্বশুর বাড়ি।’
‘তোমাকে বিয়ে করব না। এর থেকেও হ্যান্ডসাম এবং বাধ্য ছেলেকে বিয়ে করব, দেখে নিও।’
‘আমার মতো কেউ ভালোবাসতে পারবে না তোমায়!’
‘ভালোবাসার ট্রেইনিং দিয়ে নেব।’
‘ঠিক আছে। আমি তাহলে চললাম। আমি কিন্তু আর আসব না। তুমি হ্যান্ডসাম কাউকেই বিয়ে করো যাও।’
মাহতিম উঠে দাঁড়ায়। অহনার বুক কেঁপে ওঠল। সত্যি সত্যিই কি চলে যাবে? সে তো ভেবেছিল মাহতিমকেও নিজের সাথে রাখবে। তা কি হবে না? এরই মাঝে সুমা চা নিয়ে আসে। মাহতিমকে উঠতে দেখে বলল,‘কোথায় যাচ্ছ তুমি? বসো! চা খাও একটু।’
মাহতিম অহনার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল,‘ও বলেছে চলে যেতে। আমি যেতে চাইনি।’
অহনার কপাল কুঁচকে এলো। সুমাও বলে উঠল,‘এ কেমন আচরণ অহনা? কেউ এভাবে বলে? ছেলেটা এ প্রথম এলো, তাও আবার এতো রাতে। আর তুই ওকে চলে যেতে বলছিস?’
মাহতিমকে বলল,‘ওকে আমি সামলাচ্ছি, তুমি বসো শান্ত হয়ে।’
সাথে সাথেই রোস্তমকে ডাকল। অহনাকে বকা খাওয়াতে পেরে অনেকটাই মজা পেল মাহতিম। ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে রসিকতা করে চায়ে চুমুক দিল।
ইমনের আচমকা খুব জ্বর এসেছে। গায়ে কাঁপুনি দিচ্ছে বারবার। প্রায় দেড় ঘন্টা আগে মোহনার ঘর থেকে এসেই একটা বই নিয়ে বসেছিল। তারপর থেকেই মাথা ব্যথাটা শুরু হলো। বইটা রেখেই সে শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘণ্টা যেতেই বেশ শীত অনুভব করল। আস্তে আস্তে জ্বরে পড়ল। হাঁসফাঁস করছে ভীষণ। তার কাছে কোনো ঔষধও নেই। ভাবল আনিফার থেকে নিয়ে আসবে। গায়ে একখানা তোয়ালে জড়িয়ে নিয়েই দরজা খুলল। মোহনার কানে গেল দরজা খোলার শব্দ। এতরাতে কেউ জাগার কথা নয়। সে পড়া শেষ করে মাত্রই ঘুমানোর পজিশন নিচ্ছিল। এমতাবস্থায় নিজের ঘর থেকে বের হয়ে এলো। গায়ে তোয়ালে পেঁচানো দেখে ভাবল কোনো চোর হবে। তাই পেছন থেকে ডাকল,‘কে ওখানে?’
ইমন ঘুরে দাঁড়ায়। মাথায় লম্বা করে ঘোমটা টেনে রেখেছে সে। মোহনা কিছুটা আন্দাজ করেই বলল,‘আমি একদম ঠিক ভেবেছি। এই চোর আপনি ছাড়া আর কেউ হতে পারে না।’
মোহনা তেড়ে এলো ইমনের দিকে। তোয়ালেটা টেনে খুলে ফেলল। ইমন কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করল। মনে মনে বলল,‘যা বুঝাতে চাই তা বুঝো না অথচ উল্টা পাল্টা তিন চামচ বেশি বুঝো।’
ইমনের শীত করছে প্রচুর। সে দেরি করল না। মোহনাকে এড়িয়ে যেতে চাইল। হুট করে সে নিজের ঘরে চলে গেল। এই মুহুর্তে সে মোহনার থেকে পালাতে চাইছে। অথচ মোহনা তাকে ছাড়ল না। দরজা বন্ধ করার আগেই তার ঘরে ঢুকল,
‘আপনি আমার থেকে পালাতে চান? আচ্ছা এসব বাদ। আপনার মতলব কী বলুন? এতরাতে কী খুঁজতে বের হয়েছিলেন?’
‘আপনার কি আমাকে চোর মনে হয়? রাতের বেলা কি বের হওয়াও দোষের?’
মোহনা তার দিকে এগিয়ে আসে। চোখ লাল দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ করেই মোহনা বলল,‘ভ্যাম্পায়ার মুভিতে নায়কের চোখ লাল ছিল! আপনি কি ভ্যাম্পায়ার?’
‘অদ্ভুত মেয়ে আপনি।’
ইমনের অবস্থা কিছুটা খারাপ হয়ে পড়ল। জ্বরের পরিমাণ বাড়ছে এবং শীতের পরিমাণও। সরে যেতে চাইলেই মোহনা তার হাত চেপে ধরে। কিছুটা উষ্ণ লাগতেই তার খটকা লাগল। সে অবাক হয়েই তার দুহাত স্পর্শ করল। ইমন অবাকের চরম পর্যায়ে। মোহনার ছোঁয়া যেন তার অসুস্থতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। মোহনা কোনোকিছু না ভেবে ইমনের গলদেশে এবং কপালে হাত দিয়ে দেখল। প্রচন্ড জ্বর দেখে আঁতকে ওঠে,
‘আল্লাহ! আপনার তো গা পুড়ে যাচ্ছে। ঔষধ নিয়েছেন?’
ইমন কোনোরকমে বলল,‘ঔষধের জন্যই যাচ্ছিলাম কিন্তু আপনি বাধা হয়ে দাঁড়ালেন।’
‘সরি! আমি বুঝতে পারিনি। আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি ঔষধ নিয়ে আসছি।’
বলেই সে পা বাড়ালো। কিন্তু না গিয়ে ফিরে এলো। নিজের হাতে থাকা তোয়ালেটা জড়িয়ে দিল ইমনের গায়ে। পরপরই টেনে নিয়ে খাটে বসিয়ে দিয়ে বলল,‘এভাবেই থাকুন, আমি আসছি।’
দৌড়ে সে নিজের ঘরে গেল। ঔষধপত্র নিয়ে ফিরে এলো। কপালে চিন্তার গাঢ় ভাঁজ। যেন আপনজনের কষ্ট হচ্ছে। ইমন খুব অবাক হলো মোহনার কাণ্ড দেখে। মোহনা দ্রুত ঔষধ এবং এক গ্লাস পানি নিয়ে তার পাশে এসে বসল। ঔষধটা হাতে দিয়েই বলল,‘এবার খেয়ে নিন। আশা করি কিছুক্ষণের মাঝেই জ্বর পালাবে।’
ইমন কয়েক মুহুর্ত মোহনাকে দেখল। পরপরই ঔষধ খেয়ে আধশোয়া হয়ে বসল। মোহনা কাঁথা টেনে দিয়ে বলল,‘বের হওয়ার দরকার নেই। কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবেন। এখন বলুন, আপনার কিছু লাগবে?’
হঠাৎ করেই ইমনের ফোনে মেসেজ আসলো। লেখাটা স্ক্রিনে ভেসে ওঠল,‘কী ভাই, টিপস্ কাজে লাগিয়ে কি মধুচন্দ্রিমায় আছ নাকি?’
রিয়াজের এমন বিচ্ছিরি মেসেজ দেখে খুব রাগ হলো। মোহনা সেটা লক্ষ্য করেই বলল,‘এতরাতে কেউ মেসেজ দেয়? গার্লফ্রেন্ড বুঝি?’
ইমনের কাশি উঠে গেল। সে মোবাইলের দিকে তাকাতেই ভেসে ওঠল তৃতীয় টিপসের বিষয়টা। লেখা ছিল, আমরা সাধারণত অন্যের দুঃখ-কষ্ট অনুভব করতে পারিনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় মেয়েরা কষ্টের বিষয়টা চেপে যায়। এবং নিজেকে সাবলীল প্রমাণ করতে গিয়ে আরও কঠোর, রাগী, উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ে। তাই মেয়েদের আকর্ষণ পেতে হলে প্রথমে তার কোনো কষ্ট আছে কিনা বের করে নাও। এবং তার কষ্টের সাথে নিজের কোনো কষ্ট আছে কিনা মিলিয়ে দেখো। যদি নাও থাকে তবুও মিথ্যে কিছু বানিয়ে বললেও সমস্যা নেই। তাকে বুঝিয়ে দাও, তার কষ্টে তোমারও কষ্ট হচ্ছে, তুমিও তার মতোই অনুভব করো। সান্ত্বনার জন্য মাথায় হাত রাখো এবং কাঁধে। কারণ ভরসার জায়গা এ দুটিও। এতে অপরজন মানসিক প্রশান্তি পায়। তখন তার তোমাকে ভালো লাগবেই। যখন দুজন মানুষের ধারণা একই হয়ে যায় তখন তাদের মাঝে আকর্ষণ ঘটে। পুরো কথার সারমর্ম হলো, তার কষ্টে তুমিও ব্যথিত হও।’
লেখাটা পুরোটা পড়তেই ইমনের মনের ব্যথাগুলো যেন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। চোখ দুটো জলে টইটুম্বর করতেই মোহনার নজরে আসে। এতক্ষণ সে ইমনের দিকে তাকিয়ে ছিল উত্তরের আশায়। কিন্তু তার কান্নামাখা মুখ দেখে মুহুর্তেই বলল,‘গার্লফ্রেন্ড ছ্যাকা দিয়ে গেল নাকি?’
ইমন সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,‘আমার পাশে এসে বসবেন একটু?’
মোহনা কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে এলো। ইমন জোরেসোরে শ্বাস নিল। বলল,‘হুম। একমাত্র গার্লফ্রেন্ডকেই হারালাম আমি। যে আমার জীবনকে পৃথিবীর বুকে উপস্থাপন করতে সব থেকে বেশি কষ্ট করেছে, সে মানুষটাকে হারিয়েছি।’
মোহনা হাঁফ নিঃশ্বাস ছাড়ল। বলল,‘আমি আপনাকে সবচেয়ে সুখী ভেবেছি, অথচ আপনিও কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছেন। এ জগতে কি কোনো সুখী মানুষ নেই?’
‘দুঃখ না থাকলে মানুষ সুখ অনুভব করতে পারেনা। অর্থাৎ সুখে থাকলে সুখী মানুষটা কখনোই বুঝবে না সুখ কী? মানুষের জীবন সুখ-দুঃখ মিলিয়েই। একটা অন্যটার পরিপূরক। এখন এটা প্রমাণিত আপনিও দুঃখী!’
মোহনা কিছুটা বিচলিত হয়ে বলল,‘আমি সুখী।’
‘তাহলে আজকের দিনের সুখের তালিকাটা বলুন।’
মোহনা বলতে গিয়ে থেমে যায়। কিছুই বলতে পারল না। এমন কেন হলো? সে তো নিজেকে সুখী, হাস্যোজ্জ্বল রাখার অনেক চেষ্টা করেছে। তবে কি সে অসফল?
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership