ছায়া মানব ২
৬.
কোনো মেয়ের আর্তনাদ শুনতেই মাহতিম আচমকা গাড়ি থামিয়ে দেয়। দ্রুত নেমে শব্দের উপস্থিতি শনাক্ত করার চেষ্টা করে। ঘন জঙ্গল থেকেই আসছে বলে মনে হচ্ছে। তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে আর্তনাদ। মাহতিম আর এক মুহূর্তও দেরী না করে জঙ্গলের দিকে পা বাড়ালো। শব্দ অনুযায়ী দেখতে পেল কারো পায়ের ছাপ। আরো কিছুটা সামনে এগিয়ে গেল। দেখল একটা মেয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়াচ্ছে। মাহতিম তাকে থামতে বলে। মেয়েটা থেমে যায়। মাহতিমকে দেখে কেঁদে ওঠে। মাহতিম কাছে যেতেই মেয়েটা তার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে,’বাঁচান আমাকে, ওরা মেরে ফেলবে আমায়।’
মাহতিম অভয় দেয়,’কেউ কিচ্ছু করবে না। কে আপনি? এখানে কী করে এলেন?’
‘ আমি শিমলা। কতগুলো ছেলে আমার পেছনে পড়েছে। আমাকে বাঁচান আপনি, দয়া করে বাঁচান।’
মেয়েটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাহতিমকে। মাহতিম তাকে শান্ত করে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু মেয়েটা সরতে নারাজ। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,’আমাকে ছাড়বেন না। আমাকে আপনার সাথে নিয়ে যান।’
‘ আপনি চিন্তা করবেন না। কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমি আপনাকে আপনার বাড়ি পৌঁছে দেব।’
কথাটা শেষ হতেই মাহতিমের সামনে হাজির হয় ইন্সপেক্টর ফাইয়াজ। তাকে হাতকড়া পরিয়েই বলল,’আপনার থেকে কখনোই এটা আশা করিনি।’
মাহতিম অবাক হয়ে যায়,
‘আমি কিছু করিনি। ভুল করছেন। আমি মেয়েটাকে বাঁচালাম।’
শিমলা মেয়েটাও ওল্টো বলা শুরু করল,’বিশ্বাস করবেন না ওনাকে। ওনি আমাকে একা পেয়ে অসভ্যতামো করেছেন। আমায়…’
কেঁদে ওঠে শিমলা। মাহতিম বুঝতে পারল, কেউ তাকে ইচ্ছে করে ফাঁসিয়েছে। সে বোঝানোর চেষ্টা করল,’মেয়েটা মিথ্যে বলছে। আমি কিছুই করিনি।’
ফাইয়াজ কোনো কথা শুনল না,
‘আমাদের কোনো একটা মেয়ে কল করে বলেছে আপনি তার ক্ষতি করছেন। লোকেশন এই জায়গাটাই বলল। আমরা বিশ্বাস করিনি। কিন্তু হাতেনাতে প্রমাণ পেলাম। কিছু করার নেই আমাদের। সব প্রমাণ আপনার বিরুদ্ধে। আমরা দেখেছি আপনি মেয়েটাকে কিভাবে আঁটকে রেখেছিলেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, কোনো মেয়ে নিজের সম্মান নিয়ে মিথ্যে বলবে না।’
শিমলা এখনো কেঁদেই যাচ্ছে। তাকে ভালোয় ভালোয় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। মাহতিমকে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। মাহতিম বারবার বলছে,’আমি এখন জেলে যেতে পারিনা। অনেক কাজ বাকি। এই মুহুর্তে আমি না থাকলে খুব সমস্যা হয়ে যাবে। কেউ আমাকে ফাঁসাচ্ছে। আমি কোনো দোষ করিনি।’
কেউ শুনল না তার কথা। জয়ন্তের কানেও কথাটা গেল। দেখা করতে এলো মাহতিমের সাথে। মাহতিম কিছু বলার আগেই জয়ন্ত বলল,’আমি জানি। আমাকে কিছু বলতে হবে না বুঝিয়ে। আমি জানি, কেউ ফাঁসিয়েছে।’
‘ কে আমার সাথে এমনটা করবে? মেয়েটা কোথায়? তার থেকেই সত্যিটা বের করা যাবে।’
‘আমি দেখছি বিষয়টা। তুমি শান্ত থাকো।’
জয়ন্ত শিমলার খবর নেওয়ার চেষ্টা করছে। ফাইয়াজ এসে বলল,’শিমলা নামের কারো কথা বলা হয়নি। যে কল করেছিল সে নিজের নাম বলেছিল তাহিয়া।’
‘ এসব কি হচ্ছে? কোনো কিছু না জেনেই তোমরা একজন আর্মি অফিসারকে গ্রেফতার করেছ? খোঁজ লাগাও। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই মেয়েকে খুঁজে আনো। কে তাকে এসব করতে বলেছে জানা প্রয়োজন।’
সাথে সাথেই পুলিশ পাঠানো হলো। মেয়েটা হয়ত বেশিদূর যায়নি। তাই হলো। রাস্তার মাঝেই দেখা গেল তাকে, কালো কোর্ট পরা কারো সাথে কথা বলছে। পুলিশ দেখতেই সেই লোক পালিয়ে গেল। শিমলা ধরা দিল। তাকে আনা হলো জয়ন্তের সামনে। তাকে জিজ্ঞেস করল,’কে বলেছে এসব করতে?’
শিমলা নিশ্চুপ। সে কিছুই বলছে না। জয়ন্ত পুনরায় জিজ্ঞেস করল,’ সত্যি বলো, না হয় জেলই হবে তোমার আজীবনের ঠিকানা না হয় মেরে ফেলব। বলো সবটা।’
‘ আমি বলে দিলে আমাকেই মেরে ফেলবে সে। আমি বলতে পারব না।’
‘ কে না করেছে বলতে? কে সে?’
‘ বলতে পারবনা।’
জয়ন্ত মেয়েটাকে মারার আদেশ দিল। যেন সে সত্যি কথা বলে। কিন্তু মেয়েটা হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। খেয়াল করল, তার আঙুল এখনো মুখে। তড়িঘড়ি তাকে হাসপাতাল নেওয়া হলো। তার আগেই মারা গিয়েছে। ডাক্তার টেস্ট করে বলল,’কেউ তাকে পয়জন দিয়েছে? প্রাণঘাতী সেটা! এখানে আসার আগেই মারা গিয়েছে।’
জয়ন্ত চিন্তায় পড়ে যায়। জেলের ভেতরে কে তাকে বি’ষ দেবে? পোস্ট মর্টেম করার আদেশ দেয়। জানতে হবে, ঠিক কিভাবে মেয়েটার মৃ’ত্যু হলো।
অহনা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। মুখটা আপেলের মতো ফুলিয়ে রেখেছে। অর্পি এসে কয়েকবার গরম কথা শুনিয়ে গেল, কিছুই কানে নিল না। সন্ধ্যা পর্যন্ত সে মাহতিমের জন্য অপেক্ষা করেছে। সে আসেনি। রাগে অহনার ইচ্ছে করছে দু’তিনটা খু’ন করে ফেলতে। এক পর্যায়ে ওঠে গেল। রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলল,’কতো বড়ো সাহস! আমাকে ইগনোর করে। আসলো না সে। চিবিয়ে খাব। লবণ ছাড়া খাব।’
ছোঁয়া ওকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,’জ্বর আসলো নাকি? কে আসেনি?’
‘ ঐ লোকটা। ভীষণ বাজে, ফাজিল ছেলে। আমাকে আসতে বলে বসিয়ে রাখল সন্ধ্যা পর্যন্ত। কিন্তু আসেইনি। জানি না কী এমন রাজকার্য করছে যে দেখা করতে পারেনি। একটা খবরও দিল না। আশায় আশায় বসিয়ে রাখল।’
‘ আরে নাম বলবেতো নাকি?’
‘ মাহতিম।’
‘ কল করো তাকে!’
‘ নাম্বার নেই।’
ছোঁয়া কিছু ভাবল। পরক্ষণেই বলল,’জাস্ট ওয়ান মিনিট।’
তারপর সে নিজের মোবাইল হাতে নিল। মাহতিম নামটা ফেসবুকে সার্চ করল। অহনার হাতে মোবাইলটা দিয়ে বলল,’এবার দেখো, এখানে তাকে পাওয়া যায় কিনা!’
‘ খুঁজে কী করব?’
‘ ধ্যাঁত! অযথা আমার সময় নষ্ট করলে। তাহলে এভাবেই বসে থাকো। আমার কী!’
ছোঁয়া চলে যেতেই অহনা নিজের ফেসবুকেই মাহতিম নামটা সার্চ করল। প্রায় পাঁচ মিনিট খোঁজার পর একটা আইডি পেল,’মাহতমি চৌধুরী’। প্রোফাইলে তার নিজের ছবি ছিল বিধায় চিনতে অসুবিধে হয়নি। অহনা সাথে সাথেই মেসেজ করল। কোনো উত্তর পেল না। পাবে কী করে? মাহতিম এখন জেলে আছে। অহনা বারবার মোবাইল চ্যাক করতে থাকে। কিন্তু রিপ্লাই আর আসেনা। মোবাইলের দিকে তাকিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল।
মামুন এসে জামিনের ব্যবস্থা করল। মাহতিমকে বাড়ি নিয়ে গেল। যদিও শিমলার রহস্য এখনো অজানা। আনিফা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠল। মাহতিম মায়ের ব্যাকুলতাকে প্রশ্রয় দিল না। অতি গম্ভীর কন্ঠে বলল,’আম্মা, তুমি সাধারণ ছেলের মা নও। সামান্য বিষয়ে কান্না করা মানায় না তোমার। আমি একজন আর্মি অফিসার। জীবনকে হাতে নিয়ে ঘুরি। জীবনের মায়া নেই। হাজার শত্রু বাঁধিয়েছি পেছনে। কখন কী হয় বলা যায় না। তোমাকে শক্ত হতে হবে। কারণ তুমি আমার আম্মা। আমার আম্মা এতো দুর্বল হলে আমি যুদ্ধক্ষেত্রে যাব কী করে? মায়ের কান্নাময় মুখ দেখে ছেলে কি যুদ্ধে জয়ী হতে পারবে? অথচ তোমার সাহসী মুখশ্রী আমাকে আরো অদম্য করে তুলবে। কখনো যদি মৃ’ত্যু নিয়ে ফিরে আসি তখনও যেন হাসিমাখা মুখ নিয়ে গর্ব করতে পারো। কারণ তোমার ছেলে জয়ী হয়েছে।’
মাহতিম আনিফার চোখের পানি মুছে দেয়,’কেঁদো না একদম। তোমাকে সাহস সঞ্চয় করতে হবে। তোমাকে শক্ত হতে হবে। এমন সামান্য বিষয়ে যদি ভেঙে পড়ো তবে তোমার ছেলে হেরে যাবে শত্রুদের কাছে।’
আনিফা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। কান্না করবে না বলে শপথ নেয়।
মামুনের ফোনে কল আসে মাহতিমের সহচর অনুজের। বলল দ্রুত অফিসে যেতে। আনিফার কোনো কথা শুনল না। বাবা-ছেলে চলে গেল।
শিমলার রিপোর্ট এসেছে। সবাই অবাক হয়ে যায় রিপোর্ট দেখে। শিমলার মৃ’ত্যুর কারণ এক প্রকারের বিষ এবং সেটা তার আঙুল থেকে ছড়িয়েছে। সায়ানাইড নামক বিষাক্ত পদার্থ কেউ তার হাতে লাগিয়ে দিয়েছিল। যখনই সে মুখে হাত দেয়, সেটা তার পেটে যায়। সায়ানাইড এতটাই ভয়ঙ্কর যে, এটা সেবন করার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু কারোই বুঝে আসছে না, মেয়েটা কেন নিজে নিজে মরতে যাবে! কেউ ইচ্ছে করে এমনটা করেছে বলেই মনে করল। কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই।
একপাশে দাঁড়িয়ে আছে আশিশ। অনুজের চোখ তার দিকে। অনুজ ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনা আশিশকে। সবসময় সবকিছুর মূলে তাকেই ধরে নেয়। আশিশের পাশ ঘেঁষে এসে বলল,’এটা তোমার কাজ হতে পারে।’
আশিশ হেসে বলল,’প্রমাণ করো।’
‘ আফসোস, সেটাই পারব না। তুমি সব প্রমাণ লোপাট করেছ। ভীষণ শেয়ানা। আচ্ছা, বলো ওকে ফাঁসিয়ে তোমার লাভ কী?’
‘ আমার কোনো লাভ নেই। নিজের সীমার মধ্যে থাকো। আমার সাথে লাগতে এসো না।’
আশিশ পায়ে গটগট আওয়াজ তুলে সেখান থেকে চলে গেল।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম