#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_২৭
#ইশরাত_জাহান
🦋
দুপুর হয়ে এসেছে।এখন কেয়াকে গোসল করানো হবে।কেয়া ও রিকের গায়ে হলুদ থেকে বৌভাত সকল অনুষ্ঠান কমিউনিটি সেন্টারে হবে।রিকের বাবা এসেছেন আজ দুইদিন হয়েছে।ছেলের বিয়ে দিয়ে কয়েকদিন থেকে আবার চলে যাবেন। রিককে বাংলাদেশের ব্যাবসা সম্পর্কে বুঝিয়ে দিবেন তিনি।
নীরা বসে আছে দ্বীপের জন্য।দীপান্বিতা মাত্র লাইভ শেষ করলো।নিজের শাড়িগুলো থেকে নীরাকে একটি শাড়ি দিয়ে নিজের জন্য একটি শাড়ি রাখলো।কলাপাতা পারের হলুদ শাড়ি দীপান্বিতার কাছে এভেইলেবল।তাই আর আলাদা করে কেনা লাগেনি।
দ্বীপ চলে এসেছে।আজকে হাফ টাইম ক্লাস করিয়েছে।দ্বীপের হাতে একটি ছোট প্যাকেট।নীরা প্যাকেটটি দেখে হেসে বলে,”আমার জন্য গাজরা এনেছেন,ক্যাডার সাহেব?”
“হ্যা।চোখ বন্ধ কর।”
“আচ্ছা।”
বলেই চোখ বন্ধ করে নীরা।তারপর অনুভব করে দ্বীপ তার মাথায় হাত রেখেছে।সমস্ত চুলগুলো একসাথে করে বেধে দিচ্ছে দ্বীপ।অতঃপর নীরা অনুভব করে তার মাথার উপর পাতলা কোনো কিছু দেওয়া। গাজরার জায়গায় অন্য কিছু অনুভব করে চোখ মেলে তাকালো নীরা।দেখতে পেলো হলুদ ও সোনালী রঙের মিশ্রণে একটি সুন্দর হিজাব।হিজাব দেখে কপাল কুঁচকে নীরা বলে,”আমার গাজরা কোথায়?”
“গাজরার থেকেও দামী উপহার দিয়েছি।আমার বউয়ের সৌন্দর্য্য আমি ছাড়া অন্য কেউ দেখবে না।তাই এই হিজাব পরেই অনুষ্ঠানে যাবে।”
“আমি খেলবো না।”
“এখন খেলার মুড আছে বুঝি?”
“আরে!খালি বাজে কথা।দুষ্টু প্রফেসর আমার।আমি চেয়েছি গাজরা আপনি এনে দিলেন হিজাব।আজকে কি সুন্দর সবাই নিজেকে ফুল দিয়ে সাজাবে। আর আমি কি না,ধুর।”
বলেই শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় নীরা।এদিকে নীরব এত চেষ্টা করেও পারছে না দীপান্বিতার অভিমান ভাঙাতে।তাই অসহায় হয়ে বসে আছে ব্যালকনিতে।অভ্র তাদের ব্যালকনি দিয়ে তাকিয়ে আছে নীরবের দিকে।নীরবকে বলে,”কি করছো মামু?”
“তোমার মায়ের অভিমান ভাঙাতে চাইছি পুচকু।”
অভ্র বড়দের মত ভাব করে বলে,”আমার আম্মু অভিমান করেছে কেন?”
“আমি ভালোবাসিনি তাই।”
“তাহলে তো তুমি পঁচা।”
“আমি তো এখন ভালোবাসতে চাই তোমার আম্মুকে।”
“ওহ,তাহলে তুমি ভালো।”
“কি করা যায় বলোতো?”
কিছুক্ষণ ভাবুক ছেলেদের মত ভঙ্গি করে অভ্র বলে,”কাল রাতের মত গান শোনাও আমাকে।আপাতত মাথায় বুদ্ধি আসছে না।”
নীরব কিছু বলতে যাবে তার আগে দীপান্বিতা এসে দাঁড়ায় অভ্রর পাশে।অভ্রকে উদ্দেশ্য করে দীপান্বিতা বলে,”এখানে কি কর বাবাই?ভিতরে আসো।”
বলেই ঘরে ঢোকে দীপান্বিতা।নীরব গলা উছিয়ে গান গায়,
“বাড়ির পাশে আমার উনি,
কথা কয় না আমার সাথে।
বন্ধু আমার রাগ করিছে,
ভাব লয় হারা দিন ভরে।
অভ্র পিছনে ফিরে বলে,”ওয়াও মামু অনেক সুন্দর গান গাও তুমি।”
বলেই হাত তালি দেয় অভ্র।নীরব বারবার মামু ডাক শুনে আর আহত হয়।তারপরও চুপ করে আছে।বিড়বিড় করে বলে,”আগে তোর মাকে বসে আনি তারপর এই মামা ডাক বাদ দিয়ে ডাকবি বাবা।”
নীরা শাড়ি পরে বের হতেই নীরবের এই গান শুনতে পেলো।দ্বীপ খাটে বসে ছিলো।এমন উল্টা পাল্টা কথা দিয়ে গান শুনে নীরার দিকে ফিরে বলে,”তোমরা ভাই বোন দুটো কি মেন্টাল এসাইলাম থেকে ডেলিভারি হয়েছিলে?”
“আলতু ফালতু কথা বলবেন না আমাদের নিয়ে।আমরা এরকম বলেই তো আজ আপনাদের ভাই বোনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি।”
“হ্যা।সে তো দেখতেই পাচ্ছি।এক বোন নিজের গায়ে হলুদের দিন মঞ্চ কাপিয়ে দেয়। আর ভাই প্রতিবেশীর গায়ে হলুদের দিন এলাকা কপিয়ে দেয়।”
“আমার ভাই আপনার বোনের প্রেমে পরে দেবদাস হয়েছে।আপনি কি করছেন ভাই হয়ে?একবারও বোনকে বুঝিয়েছেন!”
হামি তুলতে তুলতে দ্বীপ বলে,”ওসব কুটনি বুদ্ধি তোমার মাথায় চলে।আমি এতে নেই।”
ভেংচি কেটে নীরা নিজেকে সাজাতে থাকে।কেয়াকে কমিউনিটি সেন্টারে নেওয়ার আগে তাদেরকে যেতে হবে।কমিউনিটি সেন্টারে যেয়েই গোসলের পর্ব চলবে।নীরা হিজাব বাঁধছে আর দ্বীপ কলাপাতা রঙের পাঞ্জাবী পরে এসে আয়নায় নিজের চুল সেট করছে।নীরা আড় চোখে তাকিয়ে দেখতে থাকে।হিজাব বেধে বলে,”এটা কি হলো?”
“কোনটা কি হলো?”
“আপনি কেনো চুল সেট করছেন?”
“তাহলে কি করবো?”
“না,আপনি হ্যান্ডসাম দেখতে হলে তো আমার জীবন তেজপাতা।”
বলেই দ্বীপের চুলগুলো এলোমেলো করে দেয় নীরা।স্মিত হেসে দ্বীপ নীরাকে বলে,”চোখ বন্ধ কর।”
“কেনো?”
“কর।”
“আচ্ছা।”
বলেই চোখ বন্ধ করে নীরা।দ্বীপ নীরার হিজাব দেওয়া মাথায় সুন্দর করে ক্লিপ দিয়ে বেলি ফুলের গাজরা সেট করে দেয়।কপালের উপর থেকে রাউন্ড করে মাথার পিছনে গাজরার দুই প্রান্ত একসাথে করে বেলি ফুলের চিকন গাজরা। গাজরা সেট করে দ্বীপ বলে,”চোখ খোলো।”
নীরা চোখ খুলে নিজেকে আয়নায় দেখে।হিজাবের উপর দিয়ে দ্বীপের দেওয়া এই গাজরা খুব সুন্দর মানিয়েছে।নীরা খুশি হয়ে দ্বীপকে জড়িয়ে ধরে।বলে,”আমার ক্যাডার সাহেব আমাকে এত সুন্দর করে সাজিয়ে দিবে ভাবতেই পারিনি।”
“খুশি হয়েছো তুমি?”
“খুব খুব খুব।”
“আচ্ছা এবার চলো।”
“মুখে কিছু লাগাবো না?”
“একদম না।তুমি এমনিতেই সুন্দর আছো।ওসব কিছু লাগাতে হবে না।বিশেষ করে লিপস্টিক তো নাই। কার না কার নজর লাগবে আমার বউয়ের উপর।তখন হবে আরেক ঝামেলা।”
মেকি হেসে নীরা বলে,”জেলাস ক্যাডার সাহেব।”
নীরার হাত ধরে নিজের কাছে এনে বলে,”বউ তো আমার শখের নারী।তার জন্যই তো জেলাস হব আমি।”
বলেই দুজনে একসাথে হেসে দেয়।তারপর ড্রয়িং রুমে এসে দেখে দীপান্বিতা ও অভ্র রেডি হয়ে এসেছে।মিসেস সাবিনা মিসেস শিউলি ও মিসেস নাজনীন কমিউনিটি সেন্টারে আছেন রিকের মা বাবার সাথে। বড়রা মিলে কিছু নিয়ম কানুনের কাজ করছে।এছাড়া সমস্ত কাজ কেটারিংয়ের লোক করছে।নীরা ও দ্বীপকে একসাথে দেখে নতুন সাজের সাথে দীপান্বিতা ওদের কিছু ছবি তুলে নিলো।এর ভিতর কলাপাতা রঙের পাঞ্জাবী পরে এসেছে নীরব।আজকের গায়ে হলুদে ছেলেদের পাঞ্জাবী কলাপাতা রঙের হবে।মেয়েরা কলাপাতা পারের হলুদ শাড়ি।সবাই মিলে একসাথে রওনা দেয় কমিউনিটি সেন্টারে।
কেয়াকে নিয়ে এসেছে কেয়ার বাবা মা।চশমা চোখে সুতির হলুদ শাড়ি পরে আছে কেয়া। গোসলের জন্য তাকে আপাতত নরমাল শাড়ি পরানো হয়েছে।সাথে করে গায়ে একটি গামছা জড়িয়ে দেওয়া আর কানের গোড়ায় দুইটি লাল গোলাপ দেওয়া আছে।বিয়ের কনের ভাব চলে এসেছে কেয়ার মুখশ্রীতে।
রিককে নিয়ে এসেছে নীরব ও দ্বীপ।রিক ও কেয়াকে কমিউনিটি সেন্টারের সামনে ফাঁকা জায়গায় রোদে পাশাপাশি দাড় করিয়ে মাঝখান থেকে বড় এক মোটা কাপড়ের পর্দা দেওয়া হয়েছে।কেয়ার গোসলের দিকে ছেলেরা আসবে না। আর রিকের গোসলে মেয়েরা যাবে না।
গোসলের আগে সবাই মিলে হালকা হলুদ ছোঁয়ালো একে অপরকে।ছেলেরা ছেলেদের মতো করে আর মেয়েরা মেয়েদের মতো করে আনন্দ করছে।অবশেষে রিক ও কেয়ার হলুদের গোসল সম্পূর্ণ করা হলো।শীতে কাপতে থাকে রিক ও কেয়া।
নীরা কেয়াকে বলে,”আরে দোস্ত এত কাপছিস কেনো?বিয়েতে গোসল করলে তো আর জ্বর আসে না।”
সবাই মিলে হাসতে থাকে।নীরার বিয়ের সময় কেয়া কথায় কথায় বলতো দোস্ত এটা করলে বিয়ে হয় না ওটা করলে বিয়ে হয় না।এগুলো মনে পরে গেলো নীরা ও কেয়ার।
কেয়া বলে,”রিভেঞ্জ নিচ্ছিস?সেই তো বরের সাথে খুশি খুশি সংসার করছিস। আর আমার বিয়েতে শীতে কাপাকাপি করাচ্ছিস।”
পর্দার ওপাশ থেকে রিক বলে,”ডোন্ট ওয়ারী চশমিশ।তোমার সাদা বিলাইও এই শীতে তোমার মতো ভিজে একাকার।আমরা একসাথে একই দুঃখ ভাগাভাগি করে নিচ্ছি।”
কেয়া রিকের কথা শুনে খুশি হয়।নীরা ও দীপান্বিতা মিলে কেয়াকে নিয়ে যায় কাপড় পাল্টাতে।এখন কেয়াকে হলুদের সাজে সাজানো হবে।কেয়াকে একটি রুমে বসিয়ে রাখার পর পরই অভ্র এসে নীরাকে ডাক দেয়।বলে,মামু ডাকছে তোমাকে।”
নীরা চলে যায় সেখানে।দ্বীপ উল্টো দিকে ফিরে আছে।নীরা এসে বলে,”আমাকে ডেকেছিলেন ক্যাডার সাহেব?”
দ্বীপ নীরার দিকে ঘুরে তাকিয়ে নীরার কাছে আসে।তারপর নীরার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় নির্জন পরিবেশে।কোনো কিছু না বলেই নীরার গালে আলতো করে হলুদ মেখে দেয়।তারপর নীরার গাল থেকে নিজের গালেও মেখে নেয় হলুদ।নীরা তাকিয়ে থাকে দ্বীপের চশমা দেওয়া চোখের দিকে।নীরার নাকের সাথে দ্বীপ আলতোভাবে নিজের নাক ছুঁয়ে বলে,”আমাদের বিয়ের সময় ইচ্ছা ছিলো তোমাকে এভাবে হলুদ ছোয়ানোর।কিন্তু তখন তুমি ছিলে আমার জন্য নিষিদ্ধ।কবুল বলার আগে তো ভালোবাসার মুহূর্ত গড়ে তুলতে চাইনি।আমার পুরুষ মনকে আমি কবর দিয়ে রেখেছিলাম অনেক কষ্টে।আজ তার পুনর্জন্ম নিচ্ছে,চন্দ্রপাখি।”
নীরা দ্বীপকে জড়িয়ে ধরে বলে,”ভালোবাসি আপনার সমস্ত চিন্তাভাবনাকে।ভালোবাসি আপনার এই ছোট ছোট মুহূর্তকে।ভালোবাসি আপনার সুপ্ত অনুভূতিকে।আমি ভালোবাসি আমার এই আস্ত ক্যাডার সাহেবকে।”
চলবে…?