#সে_আমার_সন্ধ্যাপ্রদীপ!
#নুসরাত_সুলতানা_সেঁজুতি
#পর্ব (১৬)
সালমা বেগম কদিন যাবত অসুস্থ! আগের চেয়েও শরীরটা কাহিল হয়েছে। শুকনো কাশি, গভীর রাতে গা কাঁপানো জ্বর, কোমড়ের ব্য*থাতে নাজেহাল দশা। মাঝেমধ্যে বিছানা রেখে ওঠাও দুষ্কর হয়ে যায়৷ রাহাতের খেয়াল রাখা হয়না। ছেলেটা প্রায়ই রাতে না খেয়ে ঘুমোয়।
এক সময়ে তার চকচক করে রাখা ঘরটা,আজ এলোমেলো পড়ে থাকে। শরীরে কূলোলে রান্নাটা করতে পারেন,আর না কূলোলে তাও না।
তখন রান্না বসাতে হয় খোরশেদুলকে। বাড়িতে তারা তিনজন। রাহাত বাচ্চা মানুষ, ওতো আর পারবেনা।
গোছালো সংসার আচমকা এরূপ অবিন্যস্ত হওয়ায় খোরশেদুল ভালো বিপাকে পড়েছেন। সারাদিন অফিসে খাটুনির পর বাসায় ফিরে কুটো নেড়ে দুটো করার ইচ্ছে হয় কার? মন-মেজাজ- শরীর কিচ্ছু স্বায় দেয় না তখন।
খোরশেদুল তাওয়ায় মাছ ভাজছিলেন। অফিস থেকে ফিরে, এখনও হাত-মুখ ধুতে পারেননি। কোনও রকম জামাকাপড় ছেড়েই কাজে লেগেছেন। ছোট ছেলেটা খিদেয় মুখ শুকনো করে বসে আছে। ঘর থেকে ভেসে আসছে সালমার রুগ্ন গলায়,কাশির ভাঙা শব্দ।
এই প্রথম,জীবনে এই প্রথম খোরশেদুলের মনে পড়ল পুষ্পিতাকে। প্রখর ভাবে উপলব্ধি করলেন, এখন হয়ত মেয়েটা থাকলে সবকিছু সহজ হোতো আরও। অন্তত বাসায় ফিরে এমন কষ্ট করতে হোতো না।
কিছুক্ষণ থমকে থাকার মতন ভাবলেন তিনি। মাছ গুলো নামিয়ে রেখে, চূলা বন্ধ করে চলে এলেন ঘরে।
সালমা বিছানায় শুয়ে। দেহ ঘোরানো দেয়ালের দিকে। খোরশেদুল গলা খাকাড়ি দিলে, ফিরে চাইলেন। চোখ-মুখে কিছু বলতে চাওয়ার প্রবণতা। শুধোলেন,
“ কিছু বলবে?”
“ হ্যাঁ মানে ওই….”
সালমা আস্তে-ধীরে উঠে বসতে নেন। এর মধ্যে মাথা চক্কর কে*টে ওঠে। সহসা শক্ত করে খাটের পায়া আকড়ে ধরলেন হাতে। খোরশেদুল এগোতে গেলে হাত উঁচু করে মানা করলেন।
ভদ্রলোক থামলেন সেথায়। তবে ইতস্ততা নিয়ে পাশে বসলেন। আজকাল সালমার সঙ্গে কথা বলতে এলে কেমন গুলিয়ে আসে সব! শব্দ-বাক্যের হদিস পাওয়া যায় না। পুষ্পিতা যাওয়ার পর থেকে দুজনের সম্পর্কের মধ্যে কেমন ঠান্ডা নিষ্প্রভতা ভিড়েছে। সালমার নির্জীব আচরণ গুলো মস্তকে বিভ্রম ধরিয়ে দেয়। রাগারাগি করা,রেগে কথা বন্ধ করে দেওয়া, গাল ফোলানো পূর্বের সালমা, এই চুপচাপ সালমা থেকে অধিক সহজ যেন।
“ কী বলবে?”
প্রশ্নটায় ধ্যান ভা*ঙল খোরশেদুলের। জ্বিভে ঠোঁট ভেজালেন প্রথমে।
রয়ে সয়ে বললেন
“ ভাবছিলাম, পুষ্পিতার একটা খোঁজ-খবর নেওয়া উচিত। কোথায় আছে না আছে! অন্তত থানায় একটা জিডি করলে কেমন হয়?”
সালমার বিরস নেত্রযূগল চকিতে তাকাল।
কণ্ঠে অবিশ্বাস,
“ তুমি বলছো এ কথা?”
খোরশেদুল চাওনি দেখে অস্বস্তিতে পড়লেন। অপ্রতিভ স্বর, সাবলীল রাখার প্রয়াস করে বললেন,
“ হ্যাঁ। আসলে হঠাৎ মনে হলো, ও এতদিন এ বাড়িতে ছিল, আমাদের কাছেই ছোট থেকে বড় হয়েছে। তাছাড়া তুমিও ওকে ছাড়া থাকতে পারছো না। তাই ভেবে দেখলাম যে একটা বিবেকবোধ থেকে হলেও আমার উচিত ওর ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া আর কী!”
সালমা কিছুক্ষণ একভাবে তাকিয়ে রইলেন। অচিরে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“ আজকে দুটো মাস মেয়েটা নেই। আমি কাঁদছি, রাহাত কাঁদছে, তখন একবারও এসব ভাবলেনা। সব সময়, সেই ছোট্টটি থেকে ওকে যা নয় তাই বলে অপমান করেছ। সেদিন তো সবার সাথে গলা মিলিয়ে চরিত্র নিয়ে বললে। সেই মানুষের আজ হঠাৎ এত দরদ কেন?”
“ বারবার পুরোনো কথা টেনো না। আমি তো তোমাদের জন্যই বললাম।”
সালমা মুচকি হেসে বললেন,
“ খোরশেদ,আর যাই হোক,পুষ্পিতার ব্যাপার নিয়ে আমাদের জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না । মেয়েটা যেখানেই থাকুক, অন্তত এখান থেকে ভালো আছে হয়ত। হয়ত যেখানে থাকছে সেখানে কেউ ওর সাথে কুকুরের মতোন ব্যবহার করছে না। এমন হলে,আমি চাইবও না ও এখানে আসুক। যেখানে দুবেলা খাবারের খোঁটা খেয়ে বাঁচতে হয়, সেখানে একটা পশুও থাকে না। পুষ্পিতাতো র*ক্তে-মাংসে গড়া মানুষ ছিল।”
খোরশেদুল রেগে দাঁড়িয়ে গেলেন,
“ তুমি অহেতুক কথা বলো সালমা। আমি নিতান্ত দায়িত্ববোধ থেকে বলেছি যা বলার। তুমি রাজী থাকলে করব,না হলে না। এর মাঝে এত বাড়তি কথার তো প্রয়োজন নেই।”
“ সেইত। বউ অসুস্থ, পেটের দ্বায়ে অফিস থেকে ফিরে রান্না করতে হচ্ছে। খুব পরিশ্রমের কাজ! এজন্যই হঠাৎ দায়িত্ববোধটা জেগে উঠল তাই না?”
মুখের উপর জবাবটায় খোরশেদুলের বাক্য স্তব্ধ। তালা ঝুলে গেল ঠোঁটে। আর একটা উত্তর ও দিলেন না তিনি।
ওদিকে বাইরে থেকে বাবা- মায়ের সমস্ত কথা-বার্তা শুনে ফেলেছে রাহাত। ভেতরে ঢুকতে নিয়েও ঢুকল না, চলে গেল বসার ঘরে৷
সেই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল,যেখান থেকে তীব্র হাত নেড়ে ডেকেছিল ওকে। বলেছিল,কয়েক দিনের মধ্যেই ছোটপুকে খুঁজে এনে দেবে। জানাবে সে কোথায়!
অথচ আজ কতগুলো দিন, তীব্রর দেখা নেই। স্কুল যাতায়াতের সময় , রাহাতের হন্যে চোখে খুঁজে বেড়ায় ওকে। করিম সাহের দোকানের ওই বেঞ্চী গুলোতে আর্ত নজর ঘুরে ফিরে যায়। কিন্তু তীব্রকে দেখা যায় না।
ওর বন্ধুরা থাকে শুধু। রাহাতের আকাশ ভে*ঙে কান্না পেলো। ক্ষুদে মনের আশপাশে ভর্তি হলো বিষণ্ণতায়। শুধু রাস্তার দিক চেয়ে বিড়বিড় করল,
“ কোথায় গেলে ছোটপু? আর আপনিই বা কথা দিয়ে কোথায় গেলেন ভাইয়া?”
****
মিথিলা তাজ্জব বনে পলাশের দিক চেয়ে। মেয়েটা তখনও ওর বুকে। ছাড়া-ছাড়ির নাম নেই। স্ত্রীর কাছে তা নিশ্চয়ই বড় কটু দৃশ্য!
“ পলাশ, এই মেয়ে কে? আর তোমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরেছে কেন?”
এতক্ষণে সরে এলো দুজন। জেনি ভ্রু কুঁচকে শুধাল,
“ ফালাশ,হু ইজ দিস লেডি?”
“ মিথিলা।
আর মিথিলাকে বলল,
“ ও আমার বন্ধু জেনি। এই অ্যাপার্টমেন্টেই থাকে। ”
জেনি হাসল। চোখের নিকট,সাদা চামড়ায় ভাঁজ পড়ল।
“ নাইস ঠু মিঠিং ইউ মেটিলা!’
মিথিলা তব্দা খেয়ে গেল। নিজের নামের উচ্চারণ শুনে মেজাজ তিরিক্ষ আকারে বেঁকে গেছে। চোখ দুটো ঘুরছে, বারবার পলাশের হাতের ওপর। যেটা প্রতাপ নিয়ে বসে আছে জেনির কাঁধে।
সৌজন্যবোধেও উত্তর দিলো না মিথিলা। ত্রস্ত পলাশের হাতটা ছিটকে ফেলার মত সরিয়ে নিলো জেনির কাঁধ থেকে। তারপর খপ করে কব্জি চেপে হাঁটা ধরল সামনে।
ঘটনায় ভড়কে গেল ওরা।
পলাশ বলল,
“ আরে কী হোলো?”
মিথিলা ডানে-বামে তাকাল না। উত্তরও দিলো না। একেবারে ওকে সমেত লিফটে উঠে যায়৷ দোর আটকানো মাত্রই গজগজ করে বলে,
“ একটা মেয়ে তোমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরল, তাও আমার সামনে, আর তুমি কিছু বললেনা?”
“ কী বলব?”
নিরুৎসাহিত পলাশ।
“ কী বলবে মানে? অন্য কেউ তোমায় জড়িয়ে ধরবে কেন?”
“ অন্য মেয়ে কোথায়?তোমাকে তো বললাম ও আমার বন্ধু।”
“ বন্ধু হলেই এমন গায়ে পড়তে হবে?”
পলাশ মৃদু তেঁতে বলে,
“ গাইয়াদের মতন কথা বলবেন মিথিলা। এটা তোমার বাংলাদেশ নয়,কানাডা। এখানে আলাপ করতে গেলেও একজন অন্যজন কে জড়িয়ে ধরে। ইট’’স ঠু মাচ কমন হিয়ার। ”
মিথিলা পালটা তেঁতে বলল,
“ ওদের জন্য যত ইচ্ছে কমন হোক। কিন্তু তুমি আমার স্বামী। তোমাকে আমি ছাড়া কেউ ধরবেনা। না মানে না।”
পলাশ ভ্রু গুটিয়ে চেয়ে থাকে। তারপর নিঃশ্বাস ঝেড়ে বলে,
“ আচ্ছা বেশ,এসব বাদ দাও এখন। আমার প্রচুর খিদে পেয়েছে। বাসায় গিয়ে কিছু একটা বানিয়ে দিও।”
মিথিলা আঁতকে উঠল যেন।
“ বানিয়ে দেব মানে? রান্না করতে হবে?”
“ হ্যাঁ। কেন?”
ও চূড়ান্ত ভাবসাব নিয়ে বলল,
“ রান্না আর আমি? আমি রান্না করতে পারিনা।”
কাঁধ উঁচাল পলাশ,
“ ওকে, সমস্যা নেই। সবাই সব কিছু পারেনা তো। তুমি পারোনা যখন শিখে নেবে। ইউটিউব দেখে দেখে রাঁধবে। আর শুধু রান্না কেন? সংসারের সব কাজই তো এখন তোমার করতে হবে।”
মিথিলা হতবাক হয়ে বলল,
“ মানে? আমি কেন করব? তোমার মেইড নেই?”
ততক্ষণে লিফট দশতলায় পৌঁছায়। দরজা খুললে, পলাশ বলল,
“ বের হও।”
মিথিলা বাইরে আসে। তবে চোটপাট দেখিয়ে বলে,
“ আমি কিন্তু রান্নাবান্না পারব না পলাশ। তুমি মেইড কে দিয়ে করাও ওসব। আমার এত সুন্দর নখ আমি…”
পলাশ দরজার লক খুলতে খুলতে জানাল,
“ মেইড নেই।”
কথা থামল ওর। পরপরই উদ্বীগ্ন হয়ে বলল,
“ নেই মানে? এত বড় বাড়ি, আর মেইড রাখোনি?”
পলাশ দরজা খুলে ঘরের ভেতর ঢুকল।
“ তোমাকে আমি বলেছি এটা আমার বাড়ি?”
মিথিলা পেছনে ঢোকে। ঘরের দিকে তাকানোর সময় নেই তার। দুরুদুরু বুকে,উঁচু গলায় শুধাল,
“ নয়?”
পলাশের মৃদূ জবাব,
“ না। আমি এখানে ভাড়া থাকি। যেভাবে ঢাকায় তোমারা ভাড়া থাকো ঠিক অমন।”
মিথিলা দাঁড়িয়ে গেল।
অস্ফুটে শুধাল, “ মানে?”
পলাশ ফিরে তাকায় ওর দিকে। নিসঙ্কোচে জানায়,
“ মানে, আমার এখানে বাড়ি-গাড়ি কিছুই নেই মিথিলা। মেইড তো আরো পরের কথা। আমি এখানে একটা ছোটখাটো সফটওয়্যার কোম্পানিতে জব করছি। তাই যে শৌখিন লাইফ লিড করার কথা ভেবে মাতাল হয়ে তুমি কানাডায় এলে,ওসব এখনই ভুলে যাও।”
গোটা আকাশটা ভে*ঙে মাথায় পড়ল মিথিলার। আর্ত*নাদ করে বলল,
“ কী?”
তার বৃত্তাকার চোখদুটো দেখে হাসি পায় পলাশের। সারাটা পথ মিথিলার এই প্রতিক্রিয়া ভেবেই মনে মনে হেসেছে।
“ এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। কানাডায় বাড়ি-গাড়ি করা মুখের কথা ভাবছো?”
মিথিলা ধপ করে কাউচে বসে পড়ল৷ হা-হুতাশ করে বলল,
“ এর মানে তোমার কিছু নেই? বাংলাদেশে তুমি যা,এখানেও তাই?”
পরপরই জ্ব*লন্ত চোখে চেয়ে বলল,
“ তুমি আমাকে এসব কিছু বলোনি কেন? কেন ঠকালে আমাকে?”
পলাশ আশ্চর্য হয়ে বলল,
“ ঠকালাম কোথায়? আমি শুধু বলেছি আমি কানাডায় সেটেল। আমি এখানকার নাগরিক। একবারও বলিনি সেখানে আমার রাজপ্রাসাদ আছে। চড়ার জন্য ঘোড়ার গাড়ি আছে। বলেছি?
তুমি নিজে থেকে এসব ভেবে নিলে তো আমার কিছু করার নেই। আর শোনো,এতটা পথ জার্ণি করে এসে এসব ফ্যাচফ্যাচ করার সময় নেই। যাও,হাত-মুখ ধুয়ে রান্না বসাও।”
মিথিলা মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“পারব না।”
“ পারবেনা? তো তোমাকে এখানে এনেছি কেন?”
ও বিহ্বল হয়ে বলল,
“ তুমি আমাকে এখানে কাজ করাতে এনেছ?”
পলাশ বলল,
“ তবে? বউ হয়েছ। এত গুলো পয়সা খরচ করে তোমাকে এখানে এনে তো, আমি বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারব না মিথিলা। তারওপর এসেছোও জোর করে। থানা-পুলিশ, মামলা আরও কত কত থ্রেট দিলেনা আমাকে? এবার নাও, তোমাকে কানাডায় আনা হয়েছে। কিন্তু এখানে থাকতে হলে যে আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে। যা বলব সব শুনতে বাধ্য তুমি। আমি বাইরে থেকে রোজগার করে আনব, আর তুমি ঘরের সব কাজ করে রাখবে। মেইড-টেইড রেখে পয়সা নষ্ট করার মানে আছে? তাছাড়া বিদেশে সবাই নিজেদের কাজ নিজেরা করে। এতে লজ্জার কিছু নেই।
যাক গে,কেবিনেটে চাল আছে, ধুয়ে বসিয়ে দাও। ফ্রেশ হতে যাচ্ছি৷ এসে যেন দেখি খাবার অর্ধেক রেডি। এই কথার একটুও অন্যথা হলে, বুঝবে পলাশ কী জিনিস!”
শান্ত গলায় তর্জন দিয়ে চলে গেল সে। মিথিলা হা করে চেয়ে রইল তার যাওয়ার দিক। বাপের ঘরে একটা প্লেট ধুয়ে ভাত খায়নি আর এখন রান্না করবে? হায় কপাল! এ কেমন লীলা দেখাচ্ছে! এ জীবন তো ও চায়নি। এবার কী হবে?
***
তখন রাত। ঘুমন্ত গাজীপুরের সবথেকে উঁচু বৃক্ষের মগডাল থেকে ভেসে আসছে হুতুম প্যাঁচার ভুতুড়ে ডাক। অল্প অল্প উত্তাপ গরমের।
পুষ্পিতা বিছানা ঝাড়ছে। মশারির এক মাথা টানানোর মধ্যেই রুমে এলো নূহা। এসেই বলল,
“ একটা কথা জিজ্ঞেস করব রে পুষ্পিতা?”
ও ভ্রু কুঁচকে চাইল।
“ তোর আবার অনুমতি নিয়ে হয়? বল না,কী বলবি?”
নূহার মধ্যে ইতস্ততা। সময় নিয়ে বলল,
“ মিথিলা আপুর কি বিয়ের আগে কারো সাথে সম্পর্ক ছিল?”
কাজে ব্যস্ত হাতটা থেমে গেল পুষ্পিতার। পালটায় তার স্বাভাবিক মুখবিবর। মনে পড়ে, সেই রাতের ঘটনা। মিথিলার বদলে ওকে তুলে নিয়ে যাওয়া। একটা ছেলের বুক চাপড়ে কাঁদার শব্দ৷ এসব কথা পুষ্পিতা কাউকে বলেনি। নূহাকেও নয়। মিথিলার মিছিমিছি বদনাম হবে ভেবে সবটা চাপা দিয়েছে ভেতরে।
তবে আংশিক সত্যি বলেছিল নূহাকে। অন্য কারো বদলে ওকে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই অন্য কেউটা যে মিথিলা, সেসব নয়।
সে যেভাবে নাহিদকে ঠকিয়েছে,ওসব শুনলে কে কী ভাববে! শত হলেও তার বোন। একসাথে বড় হয়েছে। ওদের নিয়ে কেউ কিছু বললে, পুষ্পিতা মেনে নিতে পারে না।
ওকে থম মেরে যেতে দেখে গা ধরে ঝাঁকাল নূহা।
“ কী রে, চুপ হয়ে গেলি কেন? ছিল, জানিস কিছু? “
পুষ্পিতা নড়ে ওঠে। সত্যিটুকুন সন্তর্পণে গিলে নেয়৷ আমতা-আমতা করে বলে ,
“ ককই,ননা তো।”
“ ছিল না?ওহ।”
“ ঘুমাই? ঘুম পেয়েছে অনেক!”
নূহা বলল,
“ হ্যাঁ ঘুমা।”
পুষ্পিতা মশারি কোনও রকম টাঙিয়েই,শুয়ে পড়ল চটপট। বেশিক্ষণ নূহার সামনে থাকলে, ধরা পড়ার আতঙ্কে পালাল এক রকম। মেয়েটার কাছে কোনও অলৌকিক শক্তি আছে বোধ হয়। কীভাবে যেন পড়ে ফেলে ওকে!
পুষ্পিতা চোখ খিচে মনে মনে বলল,
“ সরি রে নূহা! এই নিয়ে দুবার মিথ্যে বললাম তোকে। মাফ করে দিস।”
ওদিকে নূহা নিম্নোষ্ঠ কাম*ড়ায়। মশগুল হয় চিন্তায়। পুষ্পিতার কথায় সে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছে না।
কারণ, আজ ঐ ছেলেটার ওয়ালেটে ও মিথিলার ছবি দেখেছে। এক ঝলক দেখলেও চিনতে ভুল হয়নি৷
কিন্তু ধরা দেয়নি তাও। প্রথমত বিষয়টা জানতে চেয়েছিল। কারণ মিথিলাকে ও ছোট থেকে দেখেছে। কলেজ পড়াকালীন থেকেই সে সারাক্ষণ ফোনে ফুসুরফাসুর করত। প্রেম করত নির্ঘাত!
কিন্তু সেটা কী এই ছেলের সঙ্গে? এজন্যেই ইচ্ছে করে জিজ্ঞেস করা,গার্লফ্রেন্ড ভেগে গেছে কী না! কিন্তু ছেলে তো তেমন কিছুই বলল না। আবার ছেলেটিকে প্রথম দিন থেকেই ওর চেনা চেনা লাগছে। কোথাও একটা দেখেছে যেন৷ রাস্তায় এত লোক দেখে,এভাবে কী মনে রাখা যায়? আবার পুষ্পিতার কথানুযায়ী যদি কারো সাথে সম্পর্কই না থাকে….
নাহ,আর ভাবা গেল না। নূহার বিচক্ষণতা,কোনও ভাবেই সাড়া দেয় না আজ।
কিন্তু ভাবতে হবে তাও। হাল ছাড়লে তো চলবে না। আরো প্রখর ভাবে চিন্তা করতে হবে এ নিয়ে। আচ্ছা,এমনও তো হতে পারে, শুধুমাত্র ছেলেটা পছন্দ করত মিথিলাকে, ও করত না। আদৌ এরকম কিছু, না কি ঘটনা উলটো?
কার থেকে জানবে এবার? কীভাবে সব হিসেব মেলাবে?
****
আজ শুক্রবার। আয়েশা খাতুনের অফিস বন্ধ। বন্ধ সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান।
নূহাদের এই নতুন বাসাটায় একটাই বারান্দা। তাও উত্তর দিক বরাবর। ওখানে সূর্যের আলো সোজাসুজি পড়ে।
পুষ্পিতা দুপুরের গোসল সেড়েছে কেবল। মাথায় প্যাচানো গামছা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। পিঠে বসা ভেজা চুল ঝেড়ে, গামছা মেলে দিলো গ্রিলে বাঁধা রশিতে। তাকে লাগছে মায়াময়,স্নিগ্ধ-স্নাত বেলীফুলের মতোন।
ওদের পাশেই,উচ্চতায় খাটো একটি লাগোয়া দালান আছে। একেকটি ঘরের জানলা এদিকেই মুখ করে তৈরী। সব সময় থাই গ্লাস টানা থাকে। ভেতরের সব কিছু অস্পষ্ট।
আচমকা কোনও এক জায়গা থেকে পুরুষালি কণ্ঠ এলো। টেনে টেনে গান ধরেছে,
‘ রূপসী তোমার ভেজা চুল, এই মন কইরাছে আকুল।’’
চমকে উঠল পুষ্পিতা ।গায়ের ওড়না ঠিকঠাক করে চকিতে খুঁজল চারদিক। তৎক্ষনাৎ জবাব এলো,
“ এদিক ওদিক কী দেখছো? এই যে আমি।”
তারপর কতগুলো পুরুষের হাসির শব্দ। পুষ্পিতা ঘাবড়ে গেল। এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে, ছোটার মতন করে ঢুকে গেল ঘরের ভেতর।
তক্ষুণি সামনে পড়লেন আয়েশা। ওর অপ্রস্তুত, ভীত মুখটা দেখে বললেন,
“ কী হয়েছে?”
পুষ্পিতার আদল সংকীর্ণ। কিছু বলতে নিলো,সে সময় সেই একই কণ্ঠ গান ছোড়ে,
“ পড়েনা চোখের পলক, কী তোমার রূপের ঝলক!
আহা কই গেলেন, এই যে ম্যাডাম? ভয় পেলেন না কী! আরে আমাদের ভ*য় পাওয়ার কী আছে? আরেকবার এদিকে আসুন না! একটিবার চাঁদ মুখখানার দর্শন দিন দেখি।”
ফের একাধিক হাসির আওয়াজ। দলবেঁধে মজা নিচ্ছে ওরা। যা বোঝার বুঝে গেলেন আয়েশা। হনহন করে বারান্দায় গিয়ে বললেন,
“ এই কে রে? কোন হতচ্ছাড়া বিরক্ত করছিস?”
ওপাশে কাউকে দেখা গেল না। তবে একজন চিল্লিয়ে বলল,
“ ও চাচী,আপনার মেয়েকে বিবাহ করিতে চাই৷ রাজী থাকিলে বলুন কবুল।”
পাশের গুলো সশ্বব্দে হাসে। আনন্দ ধ্বনিতে চিল্লিয়ে ওঠে। নূহা রুমে ছিল। দুরন্ত পায়ে ছুটে এসেই বলল,
“ তোর দাদীকে গিয়ে কবুল বলতে বল হারাম-জাদা। একেবারে মে*রে তক্তা বানিয়ে দেব।”
থাই গ্লাসটা সরল এবার। কতগুলো মাথা উঁকি দিতেই আয়েশা, নূহাকে টেনেছে নিয়ে এলেন।
নূহা চেতে-টেতে একাকার হয়ে বলল,য়
“ কোথাকার কোন অজাত-কুজাত গুলোকে ভাড়া দিয়েছে। পাশের ফ্ল্যাটে ব্যাচেলর,পাশের বিল্ডিংয়ে ব্যাচেলর। অসহ্য!”
আয়েশা বললেন,
“ আহা এত চেঁচিও না। আমি ওই বাড়ির মালিকের সাথে কথা বলে দেখছি। এগুলো যে এত অসভ্য জানাতে হবে তো!”
তারপর মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে থাকা পুষ্পিতাকে বললেন,
“ তুমি আর এ বারান্দায় কিছু শুকোতে যেও না । বারান্দার দরজাটা দিয়ে রেখো সবসময়। দুজনেই কাপড়চোপড় যা শোকাতে হয় ছাদে গিয়ে দিও। ছাদ থেকে তো এদের ঘর দেখা যায় না।”
পুষ্পিতা এবারেও ঘাড় হেলায় একপাশে।
***
ইদানিং তীব্রর মেজাজ খারাপ। অবশ্য মহারাজের মেজাজ ভালো থাকে-ই বা কখন! শীত হোক বা বর্ষা,হোক সকাল বা বিকেল, তার মাথার আবহাওয়া একটাই। তালু বরাবর সর্বদা মধ্যাহ্নের দগদগে সূর্য ঘুরে বেড়ায়।
তবে আজকের ব্যাপার ভিন্ন। গত তিন দিন যাবত তার হাবভাবের অবস্থা একটু বেশিই পরূষ। এর কারণ পুষ্পিতা!
এই মেয়ে সারাদিন ঘরে খিল দিয়ে বসে থাকে। দোর খোলা তো দূরে থাক,একবার বাইরে উঁকিও দেয় না। একমাত্র ভার্সিটিতে ছাড়া, তার মুখ দর্শন করার উপায় নেই।
কলেজে যাওয়ার জন্য বের হয় কখন, সেটাও বুঝতে পারেনা তীব্র। ন’টা বাজেই তো বের হয়েছিল সেদিন, কিন্তু রাস্তায় পুষ্পিতাকে দেখেনি।
এরকম হলে, প্লান সাকসেসফুল হতে হতে যে যুগ পেরিয়ে যাবে।
তীব্রর তপ্ত মেজাজখানা কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না। উলটে, গলার কাছটায় খুশখুশ করে জানান দিল প্রত্যন্ত সুখে টান বসানোর সময় এসেছে। সিগারেট প্যাকেট পকেটে ভরে ছাদের পথ ধরল। নাহিদ গরুটা একটা ছেলে হয়েও, সিগারেটের ধোঁয়ায় খুক খুক করে কাশে। এমন কাশি যেন গলার হাড় ভে*ঙে বেরিয়ে আসবে বাইরে।
তীব্র মহাবিরক্ত অভিব্যক্তি সমেত, শূন্য ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়।
তখন সন্ধ্যে নামার ভাব। চারদিক ঝাপ্সা অন্ধকারে ছেঁয়ে। ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাসে,তীব্রর জমাট মন ফুরফুরে হয়ে আসে। নিমিষেই দুটো সিগারেট সাবাড় করে ফেলল। বাতাসে ছাদের দরজা একবার খুলছে,আরেক বার বন্ধ হচ্ছে।
তীব্র সময় কাটানো শেষে ফিরতে নেয়। চেপে যাওয়া দরজা যখনই খুলতে যাবে, পূর্বেই ওপাশ থেকে ঠেলে দিল কেউ একজন। ওমনি টিনের দোর, দুম করে ওর কপালে ঠুকে গেল। চূড়ান্ত পর্যায়ের একটা বারি খেয়ে,তীব্র কপাল ধরে পিছিয়ে যায়। হকচকায় ভীষণ!
পরপরই, আ*গুন জ্বল*ল মাথায়। মস্তিষ্কের ঘিলু শুদ্ধ টগবগিয়ে ওঠে। স্বভাব সুলভ বিট্টু মাস্তান সত্তা খুঁ*ড়ে বেরিয়ে এলো।
প্রচন্ড ক্ষে*পে বলল,
“ শালা, গলা টিপে মে…..
সামনে দেখতেই, বাকি কথা রুদ্ধ,স্থগিত। পুষ্পিতা ভয়ে এইটুকুন হয়ে তাকিয়ে।
তীব্র থামলো। কপাল থেকে হাত নামিয়ে আরো ভালো করে তাকাল। সত্যিই কী কাঙ্ক্ষিত মুখখানা চোখের সামনে ওর?
পুষ্পিতা তক্ষুণি বড় মায়া করে শুধাল,
“ লেগেছে স্যার? ব্যথা পেয়েছেন?”
তীব্র এতক্ষনে বুঝল, এটা সত্যিই সে,যার জন্য তার তবিয়ৎ চারশ আশি ডিগ্রীতে ঘুরছিল। কিন্তু এ মেয়ে গুহা রেখে বের হলো কী করে? ঘরে যেভাবে ঘাপটি মেরে থাকে,ওটাতো গুহাই।
সে ঠিকঠাক হয়ে দাঁড়াল এবার। স্যারসুলভ গাম্ভীর্য আনল গলায়,
“ ইচ্ছে করে ব্য*থা দিলে, ব্য*থা পাবনা?”
পুষ্পিতা উদ্বেগ নিয়ে বলল,
“ এ বাবা, না না। আমি একদমই দেখিনি, বিশ্বাস করুন।’
এমন কাতর,ব্যকুল কণ্ঠটা তীব্রর ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলেনি। কড়া কণ্ঠে বলল,
“ আমি সহজে কাউকে বিশ্বাস করি না। এরকম মেয়েদের তো একদমই না।”
পুষ্পিতা বুঝতে না পেরে বলল,
“ জি? কীরকম মেয়ে?”
তীব্র ধমকের সুরে বলল,
“ সেটা তোমাকে বলতে হবে?”
পুষ্পিতা চুপসে যায়। বক্ষ চিড়ে হতাশা আসে সুপ্ত আকারে। ছোট্ট জীবনটা ওর গত হলো মানুষের ধমক খেয়ে খেয়ে। সে অপরাধীর ন্যায় মাথা নোয়াল। চুপচাপ,সরে এলো তীব্রর সামনে থেকে। ছাদে মেলে দেওয়া ওদের জামাকাপড় গুলো হাতে তুলে পিলপিলে কদমে নীচে নামতে গেল যেই,
ওমনি হাওয়ার বেগে এসে পথ আগলায় তীব্র।
হুটহাট বিষয়ে,কিছু চমকাল মেয়েটা। চাইল গোলাকার চোখে।
তীব্র মোটা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ আমি ব্যথা পেয়েছি দেখেছ?”
পুষ্পিতা ছোট কণ্ঠে বলল,
“ জজী।”
“ সরি বলেছ তুমি?”
“ জী? বলেছি তো মাত্র।”
“আমি এক্সেপ্ট করেছি?”
পুষ্পিতা চোখ নামিয়ে বলল,
“জি না।”
তীব্র বলল,
“ তাহলে চলে যাচ্ছিলে কেন? যতক্ষণ না আমি সরি এক্সেপ্ট করছি, তোমার উচিত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকা।’
পুষ্পিতা তাজ্জব চোখে চায়। এগুলো কেমন কথা? কিছু বলতে মন চাইলেও,গরম বাক্য নরম ঠোঁটের ডগায় এলো না।
কোমল কণ্ঠে বলল,
“ আমি আপনাকে দেখিনি। দেখলে এভাবে দরজা খুলতাম না।”
তীব্র অলীক আশায় চেয়েছিল এতক্ষণ। এতকিছুর পরেও,পুষ্পিতার একইরকম নম্র আওয়াজ নিরাশ করল ওকে। ব্যর্থ,মুগ্ধ চোখ গেঁথে রইল মসৃন ওই আদলখানির ওপর। মনে মনে বলল,
“ একটু রেগেও কথা বলতে পারো না ভীতু মেয়ে? রাগলে তোমায় কেমন লাগে? আমার মত বাজে,নাকী বুকে ছু*রি বসানোর মত সুন্দর!’’
চলবে।